রূপময়ীর নাম শিলাবতী
Rupmoyee's name is Shilabati
সুদর্শন নন্দী।
আদর করে আমরা যেমন প্রিয় কন্যাদের পুঁটি, পুচি, গেঁড়ি বলে ডাকি তেমনি আলোচ্য এই আদরের কন্যার আটপৌরে বা ডাক নামটি পুঁটি গেঁড়ির মতো সেকেলে নয়। একটু চৌখস, বাহারি আর মার্জিতও বলা যেতে পারে। সবাই ডাকে তাকে শিলাই বলেই, ভালো নাম শিলাবতী । পুরুলিয়ার কন্যা তিনি, মেদিনীপুরে বেড়ে ওঠা আর দ্বারকেশ্বরের সাথে তাঁর শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ বা মিলন। তারপর তিনি দ্বারকেশ্বরের সাথে নতুনের স্রষ্টার ভূমিকায়। রুপময়ী পরের পথে নামাঙ্কিত রূপনারায়ণ নামে। ইনি কোথাও দেবী, কোথাও কন্যা, কোথাও স্রষ্টা। রূপে গুণে চোখ জুড়ানো এই কন্যা পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-পশ্চিম মেদিনীপুরবাসীর প্রিয় এক নদীর নাম। বড় আদরের নদী শিলাবতী। প্রবাহিত হয়েছে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার উপর দিয়ে । কোথাও তিনি শান্ত, কোথাও গম্ভীর। কোথাও তিনি আপন বেগে পাগল পারা, কোথাও দিশেহারা বালি তুলে তুলে তার গতিপথকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেওয়ায়। বালিচোরের বলিতে তাকে যেভাবে যন্ত্রনা দেওয়া হয়, তিনি কথা কইতে পারলে অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি হত অবধারিত। কিন্তু যতই আমরা তাকে আদর করি, গালভরা নাম দিই, কন্যা বলে ডাকি, ফাঁকি আমাদের ষোলআনা। ঐ অত্যাচারকে মুখ বুজে সহ্যই করি। থাক সে কথা বা ব্যথা।
শিলাবতী নদী (Shilabati River)
পুরুলিয়ার পুঞ্চা থেকে হুড়া শহরের মাঝে উৎপন্ন আমাদের এই প্রিয় নদীকন্যা। শিলাবতী নদীর উৎসস্থলে রয়েছে শিলাবতী দেবীর মন্দির। জাগ্রতা এই দেবী স্থানীয় মানুষজন পূজা করেন নিয়মিত। উৎসস্থল থেকে উৎসারিত হয়ে এই রূপময়ী শিলাবতী গভীর অরণ্যের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাঁকুড়ার সিমলাপাল হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ঢুকেছে। এরমধ্যে তার কোল থেকে বেরিয়েছে তমাল, পারাং, কুবাই এসব উপনদী। আবার তার সাথেও মিশেছে জয়পণ্ডার মতো খরস্রোতা নদীও। শিলাবতীর মোক্ষলাভ স্ফীতাকার দ্বারকেশ্বর নদে মিশে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা ও খড়কুসমা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ঘাটালের কাছে দ্বারকেশ্বর নদে মিশেছে শিলাবতী। একসময় শিলাবতীকে কেন্দ্র করে ঘাটাল শহর হয়ে উঠেছিল এক বাণিজ্যকেন্দ্র। উল্টোদিকে, আজ ঘাটালকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর যে বন্যা হয় তা এই শিলাবতীর জলেই।
স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস এই শিলাবতী নদীরও জন্মদিন রয়েছে। প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির দিন মেলা বসে শিলাবতী নদীর উৎসস্থলে। কয়েকদিন ধরে চলে এই বিশাল মেলা।
শিলাবতী নদী (Shilabati River)
লোকবিশ্বাস, শিলাবতী তাদের পরিবারেরই মেয়ে। প্রবাদ রয়েছে—
এখানে একটি আশ্রমে এক সময়ে এক সাধু থাকতেন। তার নাম জয়পণ্ডা। শিলাবতী তাঁর শিষ্যা। সাধু গঙ্গাসাগরে তীর্থে যাবেন। শিলাবতী জেদ ধরলেন তিনিও যাবেন তাঁর সাথে। গুরুদেব রাজি না হওয়ায় শিলাবতী তাঁর হাতে একটি পুঁটলি তুলে দিলেন। বললেন, গঙ্গায় গিয়ে যেন এই পুটলি বিসর্জন দেওয়া হয়।
জানা যায়, রাস্তায় সেই পুটলির দৈবিক ক্ষমতায় সাধু বাঘের এবং ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা পান। এরপর গঙ্গাসাগর পৌঁছে যখন সেই পুঁটলি ছুঁড়লেন সাধু , দেখলেন জল থেকে উঠে এল দু’টি হাত। পুঁটলি নিয়ে আবার ডুবে গেল সে হাত। বিস্ময়ে ঘরে ফিরে এলেন সাধু জয়পণ্ডা । ফিরে দেখলেন, দূর থেকে শিষ্যা শিলাবতী জল নিয়ে আসছেন। সাধুকে দেখেই সে দৌড়তে শুরু করে দেয়। কলসি পড়ে গিয়ে গড়িয়ে গেল জল। অদৃশ্য হয়ে গেলেন সেই মহিলা। জনশ্রুতি হল, সেই কলসির জল থেকেই জন্ম নেয় শিলাবতী নদী। আর গুরুদেব ছুটতে থাকেন তার পিছু পিছু। পরে সাধু জয়পণ্ডা নদী হয়ে বাঁকুড়া জেলা থেকে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় গড়বেতার অদূরে প্রবাহমান শিলাবতীর সাথে মিলিত হন। মিলন হয় গুরু শিষ্যার ।
শিলাবতী নদী (Shilabati River) Photo: Sudipto Das
শিলাবতী ঘাটালে দ্বারকেশ্বরের সাথে মিলিত হয়ে পরবর্তীতে রূপনারায়ণ নামে পরিচিত হয়। খড়গপুর হাওড়া পথে এই বিশাল নদীর দেখা মেলে। এটি অবশেষে হুগলি নদীতে মেশে এবং পরে মিশে যায় বঙ্গোপসাগরে । হুগলী নদীর সাথে এই মিলন স্থল হল গাদিয়াড়া। এই গাদিয়াড়ার সৌন্দর্যের স্বাদ পেতেও পর্যটকরা ছুটে যান সারা বছর। বাগনান থেকে ঘণ্টা খানেকের পথ। উল্টো দিকে অবিভক্ত মেদিনীপুরের গেওখালিতে তাকে দুচোখ ভরে দেখা যায়।
খাতড়ার কাছাকাছি শিলাবতী নদীর উপর ছোট জলাধার রয়েছে একটি। এটি কদমদেউলি বাঁধ নামে পরিচিত, যেখানে মুকুটমনিপুর কংসাবতী বাঁধ থেকে একটি খাল জুড়েছে।
শিলাবতী নদী (Shilabati River) Photo: Deba Prasad Roy
রূপময়ী শিলাবতী বয়ে যাবার পথে যে সকল তীরকে অকৃপণভাবে অপরূপ সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তালডাংরার হাড়মাসড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার ঘাঘর। শিলাবতী নদীর পাথরের খাঁজে খাঁজে বয়ে যাওয়া এই নদীর সৌন্দর্য পাগল করে দেওয়ার মতো। বাঁকুড়া-লক্ষীসাগর ভায়া হাড়মাসড়া বাস রাস্তা ধরে কদমা মোড় থেকে লাল মোরাম রাস্তা দিয়ে খানিক গেলেই পৌঁছে যাওয়া যায় তালডাংরা-সিমলাপাল ব্লক সীমান্তে আদিবাসী প্রধান গ্রাম তুলসীপুর। আর এই গ্রামের পাশেই শিলাবতী নদী ঘাট ঘাঘর। যারা জানেন তারা ঘুরে যান পাথরে বহমান শিলাবতীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে। তবে যাবার রাস্তাটি একটু ক্লান্তির। স্থানীয়দের অনেকে মনে করেন ঘাঘরে এবং বেশ কিছু স্থানে পাথর তথা শিলার উপর বহমান নদী বলে এর নাম শিলাবতী। নামে কি এসে যায়, রূপে যখন এই নদী মানুষের হৃদয়ে মনে গেঁথে গেছে। শিলাবতী সেই রূপের আরেক সাক্ষাৎ মেলে গড়বেতায়। সহজেই পৌঁছন যায় ট্রেনে এবং একদিনেই ঘুরে আসা যায় সেই গড়বেতার গণগণিতে মোরাম পাহাড় বা টিলার বাঁকে শিলাবতীর সৌন্দর্য দেখতে। শুধু শিলাবতীর সৌন্দর্য দেখতে সারা বছর ভ্রমণপিপাসু মানুষজন সারাদিন কাটিয়ে যান গণগণির শিলাবতীর তীরে বেড়িয়ে। তীরে বাড়তি পাওনা রয়েছে কাজুবাদাম গাছের জঙ্গল। হাওড়া থেকে গড়বেতা ১৮০ কিলোমিটার। সাড়ে তিন ঘণ্টার ট্রেনযাত্রা।যাওয়া যায় কারেও ছ’নম্বর জাতীয় সড়ক ( মুম্বাই রোড) ধরে। সত্যি বলতে কি, জঙ্গলমহলের পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার মুখ্য তিনটি নদীর মধ্যে শিলাবতীর (অন্য দুটি কংসাবতী ও সুবর্ণরেখা) সৌন্দর্য অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলাকে গৌরবের আলাদা মাত্রা বাড়িয়েছে। তার সাথে অরণ্যের প্রাচুর্য পর্যটন শিল্পকে করে তুলেছে অতি সম্ভবনাময় ।
midnapore.in
(Published on 28.03.2021)