খড়্গপুরকে বিষয় করে তপন সিংহের যে সিনেমা বাস্তবায়িত হয়নি
Tapan Singh's movie about Kharagpur did not actually happen
সৌমেন গাঙ্গুলি।
Home » Medinikatha Journal » Soumen Ganguly » খড়্গপুরকে বিষয় করে তপন সিংহের যে সিনেমা বাস্তবায়িত হয়নি
১৯৩৭ সাল। শীতকাল। স্থান খড়গপুর স্টেশন।আলো - আঁধারের কুয়াশা ভেদ করে শহর তখন ভোরের মুখ দেখছে। খড়গপুর স্টেশনের নির্জন প্লাটফর্মের বইয়ের দোকান হইলার স্টলে একটি পত্রিকা নেড়ে -চেড়ে দেখতে চাইছে একটি কিশোর । যার ডাকনাম “সাতু” । স্কুলের বন্ধুদের কাছে রমাপদ চৌধুরি।বইটির প্রচ্ছদে আগুন-রঙা অলংকরণ | মাঝখানে বড় বড় করে লেখা “দেশ”। দোকানদার তার হাত থেকে পত্রিকাটি কেড়ে নেয়। অবাঙালী সেই দোকানদারের যুক্তি, “ও বাচ্চা লোগকা লিয়ে নেহি।” কিশোরটির দু-চোখ জন্ম নেয় ভবিষ্যতে বড় কিছু হয়ে ওঠার স্বপ্ন । ক্যামেরা রেডি।ক্যামেরার সামনে কিশোরটি নিজেকে পরিচয় করাবে “তিমু”বলে । এ যেন নিজের লেখা চিত্রনাট্যে তার নিজেরই অভিনয়। লাইট অন। তিন নং প্ল্যাটফর্মে “বোম্বে মেল” এসে দাঁড়াল। চা ওয়ালা, পানী-পাঁড়ে আর কুলীর চিৎকার। যেহেতু শীতকাল, বেশীর ভাগ কামরার জানলা বন্ধ।
বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক তপন সিংহ।
এদিকে কিশোর “তিমু'র জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা ঘটতে চলেছে। হঠাৎ তার চোখ চলে যায় একটা খোলা জানলার দিকে। ক্যামেরা এবার ক্লোজ -আপে।“তিমু” একেবারেই স্তম্ভিত বিস্মিত, শিহরিত। এ কি দেখছি ! এ তো আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। সারা প্লাটফর্ম চত্বর জুড়ে হাজার হ্যালোজেন বাতির আলো ছড়িয়ে যেন তিনি বসে আছেন। ক্যামেরা রেডি। এবার শুরু হবে একটি স্বপ্নের সাক্ষাৎকার | সদ্য জমে ওঠা সেই কিশোর শহর খড়গপুর কথা বলে উঠবে “তিমু'র মুখ দিয়ে। শ্রোতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তিনি মুগ্ধ হয়ে শুনবেন, শহরের প্রাচীন ইতিহাস। দক্ষিণ দিকে অদুরে থাকা হিজলী বন্দী শিবিরের শহীদ বীরদের গল্প।
রমাপদ চৌধুরী।
না চিত্রনাট্য তৈরী থাকলেও সিনেমাটি আর করা হয়ে ওঠেনি প্রয়াত প্রবাদপ্রতিম পরিচালক তপন সিংহের । উপন্যাসের নাম “প্রথম প্রহর'। যে উপন্যাসকে অবলম্বন করে তিনি খড়গপুরের জীবন-যাত্রাকে সেলুলয়েডের পর্দায় বন্দী করতে চেয়েছিলেন। কেন হয়নি সে অন্য প্রসঙ্গ, কিন্তু প্রখ্যাত সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীর কৈশোর জীবনের ফ্ল্যাশব্যাকই হলো উপরে বলা ঘটনাটি । এখান থেকেই শুরু হতে পারত “প্রথম প্রহর" উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণের প্রথম পর্ব।দুই বন্ধুকে নিয়ে মর্নিং ওয়াক সেরে সাবওয়ে দিয়ে গোলবাজারের রেল কোয়ার্টারে ফেরার মুখে রমাপদবাবু এই ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন। সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীর প্রথম উপন্যাস 'প্রথম প্রহর" নিয়ে সিনেমা হলে পরাধীন ভারতবর্ষের একটি রেলশহর কিভাবে গড়ে উঠছিল তার একটা ডকুমেন্টেশন পৌঁছে যেতে পারতো বিশ্বের দরবারে । যেভাবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পথের পাঁচালী” কে সত্যজিত রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায় । কখনও কি আমরা ভুলতে পারি ট্রেনের আওয়াজ শুনে আকুল “অপু'র সেই কাশবন ভেঙে ছুটে চলা দিদি দুর্গার সঙ্গে।
কিংবা “সোনার কেল্লা'র সেই বিখ্যাত দৃশ্য - ট্রেন আর উটের মধ্যে টক্কর । কিংবা “হাঁসুলি বীকের উপকথা” অবলম্বনে পালকিবহনকারী কাহার সম্প্রদায় নিয়ে অসাধারণ ছবি। যেখানে যুবক কাহার করালি বাপ-ঠাকুরদার পদাঙ্ক অনুসরণ না করে চাকরি নিয়েছিলেন রেল কারখানায় কুলির কাজে। হিন্দীতে “আশীর্বাদ“ছবির সেই বিখ্যাত গান “রেলগাড়ি”যা কিনা প্রথম ভারতীয় র্যাপ গান - এর মতনই অন্তত দুটি লোকগীতি “প্রথম প্রহর" উপন্যাসে আমরা উপস্থিত দেখি। রেল চলার ছন্দে কোনো গ্রাম্য বধুর গলায় আমরা শুনতে পেতাম - “রেল রেল রেল / তোমার পায়ে দিই তেল/রেলের কুঠি কতদূর, ব্যাথার পায়ে তেল সিঁদুর/এসো রেল বোসো রেল/ মুখে জল বাতাসা / চালে ডালে রেখো তুমি/ আমার কাছারে বাছারে ........ রেল রেল রেল / আমার ভাতারে দিও মুড়ি তেল।”
খড়গপুরে রমাপদ চৌধুরীর শৈশবের বাড়ি।
কিন্তু কেন হল না “প্রথম প্রহর” কে নিয়ে সিনেমা। লেখক রমাপদ চৌধুরী জানাচ্ছেন, প্রথম প্রহর” ছবি করার ইচ্ছে ছিল তপন সিংহের, তার প্রযোজক কিছু টাকাও দিয়েছিলেন, শেব পর্যন্ত কি গোলযোগে জানিনা, ছবিটি হয়নি। তার বদলে আমার “বিবি করজ” গল্প নিয়ে তপন সিংহ ছবি করলেন “কালামাটি"। পরে " প্রথম প্রহর” ছবি করার আবার বাসনা হয় তার, কিন্তু কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা মেলেনি .......। তপন সিংহের ঐকান্তিক চেষ্টাকে ভবিষ্যতের কোনো পরিচালক হয়ত কাজে রূপান্তরিত করবেন, খড়গপুরবাসী হিসেবে আমরা এইটুকুই আশা করতে পারি।
M E D I N I K A T H A J O U R N A L
Edited by Arindam Bhowmik
(Published on 14.07.2024)
নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।