রাকেশ সিংহ দেব।
Home » Medinikatha Journal » Rakesh Singha Dev » Termitomyces heimii
জঙ্গলমহলের পর্ণমোচী শাল জঙ্গল ও তার পাশ্ববর্তী এলাকার ঝোপ, জমির আল বা জঙ্গল সংলগ্ন এলাকার মানুষের কাঁচা বাড়িতেও মাটি ফুঁড়ে বর্ষাকালের শেষের দিকে বিশেষ করে জন্মাষ্টমী তিথির পাশাপাশি সময় থেকেই কাড়ান ছাতুর (Termitomyces heimii) আবির্ভাব ঘটে। তবে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে এই ছাতু সর্বাধিক পাওয়া যায়।
কাড়ান ছাতুর মরসুমে শেষ রাতে দিনের আলো ফোটার আগে অন্ধকারে হিমের চাদর জড়িয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে ছাতু সন্ধানীরা। মরসুমে কিছু টাকার আশায়। বছরের একটা বাড়তি রোজগারের উৎস হওয়ায়, এই ছাতুকে জঙ্গলবাসীরা কেউ অবহেলা করতে চায়না। সাধারণভাবে মরশুমে ছাতু তুলতে ভোর চারটে থেকেই মানুষ জঙ্গলে উপস্থিত হয়ে যায়। পুরুষ, মহিলা এমনকি খুদে বাচ্চারাও ছাতু সংগ্রহের ব্যাপারে সক্রিয়। তবে মহিলাদেরই এ ব্যাপারে ভূমিকা বেশী। সাধারণত পাড়াপড়শীর মেয়েরা ছোট ছোট দল করে রাত থাকতেই জঙ্গলে হাজির হয়। হাতে থাকে ঝুড়ি বা ছোট থলে। কখনও আঁচলে বা গামছার খুঁটে বেঁধে নিয়ে আসে জঙ্গলের ধন। আগের রাত্রে বৃষ্টি হলে সংগ্রহকারীদের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি হলে অনেকে বিকেলের দিকেও ছাতু সংগ্রহ করে। শুধু বয়স্করাই নয়, এখানকার ছোট বাচ্চারাও খাবার ছাতু ভালোভাবেই চেনে।
কুঁড়ি ছাতু খেতে অধিক সুস্বাদু এবং সকলের খুব বেশি প্রিয়। কাড়ান ছাতু রান্না করার কয়েকটি প্রচলিত পদ্ধতি রয়েছে। সব ভোজ্য ছাতুর মতো কাড়ান ছাতুকেও সাধারণত মশলা ও সরষের তেল দিয়ে কষে রান্না করা যায়। জঙ্গলমহলের অধিবাসীরা জঙ্গলের এই ছাতু সংগ্রহ করে বিভিন্ন ধরনের রেসিপি বানান। কাড়ান ছাতুর ভাজা থেকে মশলা দিয়ে ঝাল হয়ে চালের গুঁড়ো মিশিয়ে পিঠে পর্যন্ত - কি না হয় এই ছাতু দিয়ে! কাড়ান ছাতু দিয়ে বানানো পিঠে অত্যন্ত সুস্বাদু এবং এগুলি জঙ্গলমহলের আদি ও অকৃত্রিম রেসিপিও বটে। অনেকে আবার কচি ঝিঙ্গা দিয়েও রান্না করে থাকে। জঙ্গলমহলের প্রচলিত সংস্কার অনুসারে ভিটের ছাতু খাওয়া নিষেধ। কাড়ান ছাতু অনেকসময় গৃহস্থ বাড়ির আশেপাশের মাটিতে, ঝোপঝাড়ে জন্মে থাকে। যাদের বাড়ীর এলাকার মধ্যে ছাতু জন্মায় তাদের সেই ছাতু খাওয়া প্রচলিত সংস্কার মতে নিষিদ্ধ। এই ছাতুগুলো অন্যরা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ার কারণে বাজারে আমদানি হওয়া মাত্রই কাড়াকাড়িতে বিক্রি হয়ে যায়। যার থেকে এই ছাতুর নাম হয়েছে কাড়ান ছাতু।
রাধাঅষ্টমী, ঈদ, একাদশী, সীতাষ্টমী, দূর্গা অষ্টমী প্রভৃতি বিশেষ বার, তিথির সময়ক্ষণ অনুযায়ী এসব ছাতুর আধিক্য দেখা যায়; প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ছাতুদের প্রচলিত নাম স্থান ভেদে পরিবর্তন হতে পারে। দুর্গা পুজার আগে যে কাড়ান ছাতু হয়, তাকে বলে আউলি কাড়ান আর দুর্গা পূজার সময় যে কাড়ান ছাতু হয়, তাকে বলে দুর্গা কাড়ান। কাড়ান ছাতু অষ্টমী তিথির আগে-পরে হয় বলে একে অষ্টমী ছাতুও বলা হয়। পরিণত ছাতুটি দেখতে সাদা রঙের ছাতার মতো। সাদা রঙের মাঝখানের উপরিতল কিছুটা কালচে ধূসর রঙের । টুপির নিম্নাংশ অনেক গিলযুক্ত - যা একটা সাদা রঙের দীর্ঘ বৃন্ত বা ডাঁটার (স্টাইপ) সঙ্গে যুক্ত হয়ে মাটির নিচ অবধি বিস্তৃত গ্রাম্য ভাষায় যাকে সিক বলে। এইজন্য অনেকে সিক ছাতু বলে থাকে। তবে বর্তমান সময়ে বিরূপ আবহাওয়া, অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, জঙ্গলের আগুন ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে কাড়ান ছাতুর পরিমাণ অনেকটাই কমে গেছে। ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে কাড়ান ছাতুর আবাস শাল, মহুল জঙ্গলের পরিসর। তাইতো জঙ্গলমহলের লোককবি আক্ষেপের সুরে বলেছেন -
(‘অরণ্যের কাব্য’ স্বর্গীয় লোককবি ভবতোষ শতপথী।)
বিজ্ঞানসম্মত নাম : Termitomyces heimii
টুপি :৮ সেমি থেকে ১২ সেমি ব্যাসের। কেন্দ্রের চারপাশে কিছুটা জুড়ে গোল কালো বা বাদামী রঙ থাকে। টুপির উপরের অংশ মসৃণ ও পিচ্ছিল। কুঁড়ি অবস্থায় টুপিটিকে ডিম্বাকার লাগে। ছাতু সম্পূর্ণ ফুটে গেলে উপরের তল ধূসর ও হালকা।
ডাঁটা : টুপির নীচে মাঝ বরাবর জোড়া। নরম এই ডাঁটা ১৯ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
গিলস : মুক্ত, ঘন, নরম, সাদা।
রেনুর ছাপ : সাদা বা গোলাপী।
মানবদেহের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে এই ছাতুর গুরুত্ব অপরিসীম। এই ছাতুতে প্রয়োজনীয় মাত্রায় কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট এবং খনীজ পদার্থ থাকে।
midnapore.in