দুষ্টনদ কেলেঘাই ছিল চৈতন্যদবের গমনপথ
The River Keleghai was the route of Chaitanya Mahaprabhu
সুশীলকুমার বর্মন।
বৃন্দাবন দাসের ‘শ্রীশ্রীচৈতন্য ভাগবত’অনুসারে, প্রথমবার নীলাচলে যাত্রাকালে আদিগঙ্গার কূলে প্রাচীন বন্দর ছত্রভোগের (বর্তমানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মথুরাপুর১ ব্লকের অন্তর্গত) অম্বুলিঙ্গঘাট থেকে স্থানীয় অধিকারী রামচন্দ্র খান মহাপ্রভুকে নদীপথে ওড্রদেশ বা উৎকলের গঙ্গাঘাটে পৌঁছে দেন। সেসময় গৌড়-উৎকলের মধ্যে যুদ্ধের কারণে সীমান্তের স্থলপথ অবরুদ্ধছিল। রাজার সৈন্যরা পথে ত্রিশূল পুঁতে রাখতেন। তাছাড়া ছিল বাঘ-সহনানা হিংস্র জন্তু ও দস্যুর ভয়।
‘রাজারা ত্রিশুল পুঁতিয়াছে স্থানে স্থানে।
পথিক পাইলে জাসু বলি লয় প্রাণে’ (চৈতন্য ভাগবত)।
পনের শতকের শেষের দিকে গৌড়ের সিংহাসনে বসলেন আলাউদ্দিন হোসেন শাহ। উৎকলাধিপতি প্রতাপাদিত্যের অনুপস্থিতির সুযোগে তিনি ওড়িশা আক্রমণ করে পুরী পর্যন্ত দখল করে নেন। মেদিনীপুর গৌড়ের অধিকারে আসে। প্রতাপাদিত্য ফিরে এসে হোসেন শাহের সৈন্যদের গঙ্গাতীর পর্যন্ত ধাওয়া করেন। বহুদিন ধরে যুদ্ধ চলে। ওড়িশা সীমানায় অবস্থিত মেদিনীপুরে দেখা যায় চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা।
চৈতন্য ভাগবতে ছত্রভোগ থেকে গঙ্গাঘাট পর্যন্ত যে জলপথের বিবরণ মেলে তা থেকে স্পষ্ট,এটি মেদিনীপুরের দক্ষিণাংশের নদীপথ। সম্ভবত মহাপ্রভুর নৌকা ছত্রভোগ থেকে আদিগঙ্গা ধরে রূপনারায়ণে এসে পড়ে। রূপনারায়ণের তীরে গামাখালি (এখনগেঁওখালি) হয়ে রূপনারায়ণ ও ট্যাংরাখালির (এখনহলদি) মধ্যে সংযোগকারী নদীপথে ট্যাংরাখালিতে পৌঁছয়। রেনেলের মানচিত্রে (১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দ) এই সংযোগকারী নদীপথটি চিহ্নিত আছে। প্রত্নগ্রাম নাটশাল, মহিষাদল হয়ে প্রবাহিত এটিই বর্তমানের হিজলি টাইডাল ক্যানেল। পূর্বে এটি গামাখালি, বাঁকানালা, হরিখালি প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। ট্যাংরাখালি দিয়ে মহাপ্রভুর নৌকা প্রয়াগঘাট হয়ে গঙ্গাঘাটে পৌঁছয়। এই স্থানেএকটি শিবমন্দির রয়েছে। জনশ্রুতি্ প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠির এই শিবমন্দিরটি তৈরি কররেছিলেন-
‘সেই স্থানে আছে তার গঙ্গাঘাট নাম।
তথি গৌরচন্দ্র প্রভু করিলেন স্নান।।
যুধিষ্ঠির স্থাপিত মহেশ তথি আছে।
স্নান করি তাঁরে নমস্করিলেন পাছে’।
পাথরঘাটার কঙ্কেশ্বর শিব মন্দির (ছবি: অরিন্দম ভৌমিক)।
গঙ্গাঘাট হল বর্তমানে কেলেঘাইয়ের তীরে অবস্থিত পাথরঘাটা। নদীঘাটে বহু পাথরের স্তম্ভ পড়ে রয়েছে। সেই স্তম্ভে ছবি খোদাই করা। পাথরের জন্য নাম পাথরঘাটা।এটি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পটাশপুর১ ব্লকের বুলাকিপুর গ্রামে অবস্থিত। এখনও পাথরঘাটাতে কঙ্ক অর্থাৎ যুধিষ্ঠির প্রতিষ্ঠিত কঙ্কেশ্বর শিবমন্দির অবস্থিত। চৈতন্যযুগের কঙ্কেশ্বর মন্দিরটি সম্ভবত প্রবল বন্যায় ধ্বংস হয়ে যায়। প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর পরবর্তীকালে গড়ে উঠেছেনতুন কঙ্কেশ্বর মন্দির। মন্দিরের আশপাশের মাটিতে মিশে আছে প্রাচীন মৃৎপাত্রের টুকরো। মন্দির চত্বরে পোঁতাশিকলে ঝোলানো ঘন্টা ও পদ্মকোরক খোদাই করা আট-ন’ ফুট উঁচু, আড়াই-তিন ফুট বেড়ের সাত-আটটি দৃষ্টিনন্দনবেলেপাথরের স্তম্ভ। নদীচরে মাটি চাপা পড়ে আছে পাতলা পোড়াইটের পাঁচিল। আর নিকটবর্তী পায়রাডাঙ্গার ঢিবির ইটের দেওয়াল নিশ্চয় কোন অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ। শ্রীচৈতন্যের আগমন ও অবস্থান উপলক্ষে স্থানীয় মানুষ মন্দির চত্বরে ফলকসহ একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছেন। ফলকে লেখা, শ্রীচৈতন্য ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে নীলাচল গমনকালে কঙ্কেশ্বর মহাদেবের পূজার্চনা করেছিলেন।
পাথরঘাটার প্রস্তর স্তম্ভ (ছবি: অরিন্দম ভৌমিক)।
প্রয়াগঘাট সম্বন্ধে তেমন কিছু বলা না থাকলেও এটি সম্ভবত বর্তমানের নরঘাট। মহাপ্রভুর স্মরণে একসময় নরঘাটের নাম ছিল নরনারায়ণ ঘাট। সেকালে কেলেঘাইয়ের প্রাচীন স্রোত এখনকার মঙ্গলখালি-চৌখালি-কাগড়া-পিছলদা-ঈশ্বরপুর-চণ্ডীপুর হয়ে নরঘাটের কাছে এসে পড়ত। এই মজা নদীপথ এখন নিকাশি খাল। কাঁসাই নদীর একটি শাখা নরঘাটের অদূরে ট্যাংরাখালিতে পড়েছে। অতীতে তাম্রলিপ্ত থেকে একটি স্রোতও নরঘাটের নিকট এসে মিলত। এই ত্রিবেণী সঙ্গম প্রয়াগঘাট।
‘শ্রীশ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’ গ্রন্থে কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছেন, পাঁচ বছর নীলাচলে অবস্থানের পর শ্রীচৈতন্য যখন বৃন্দাবন যাত্রাপর্বে গৌড়ে আসছেন তখনও সীমানা অঞ্চলেচরম নৈরাজ্য। গৌড়ের সীমাধিকারী ছিলেন এক ‘যবন’। পিছলদা পর্যন্ত তাঁর অধিকার। মহাপ্রভুকে গৌড়ে পাঠানোর জন্য ওড়িশার মহাপাত্র অধিকারীর সঙ্গে আলোচনা করেন। অধিকারী‘দিব্যকান্তি জ্যোতির্ময়’ শ্রীচৈতন্যদেবের সাক্ষাৎ পেয়ে‘বিগলিত চিত্তে’নৌযাত্রার দায়িত্ব নেন। সুসজ্জিত কক্ষসহ নতুন নৌকা তৈরি করিয়ে দশনৌকা পাহারাদার-সহ তিনি দুষ্টনদ মন্ত্রেশ্বর (এখনকেলেঘাই) পার করে মহাপ্রভুকে পিছলদা পর্যন্ত পৌঁছে দেন।
‘মন্ত্রেশ্বর দুষ্টনদে পার করাইল।
পিছলদা পর্যন্ত সেই যবন আইল’।
পিছলদা বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার চণ্ডীপুর ব্লকে। চৈতন্যের স্মরণে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে এখানে গৌড়ীয় মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়। মঠের অধিকারী শ্রীঅরবিন্দ লোচনদাস অধিকারী বললেন, “মঠের জমি দান করেছেন যজ্ঞেশ্বর রথ নামে এক ব্রাহ্মণ। এখানে তাঁদের লক্ষ্মীজনার্দনের মন্দির ছিল। পিছলদা বর্ধিষ্ণু গ্রাম। তাই অধিকারী শ্রীচৈতন্যকে পিছলদা পৌঁছে দেন। এখান থেকে শ্রীচৈতন্য ট্যাংরাখালি-রূপনারায়ণ-গঙ্গা পথে পানিহাটি পৌঁছান।”
পিছলদা গৌড়ীয় মঠ (ছবি: লেখক )।
মন্ত্রেশ্বর বা একসময়ের সুনাব্য কেলেঘাই দুষ্টনদই বলা যায়। নদীর দু’পাড়ে ঘাই পড়ে (অর্থাৎ বাঁধ ভেঙে) প্রতি বছর বন্যায় সর্বস্বান্ত হন লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাই কেলেঘাইকে বলা যায়‘মেদিনীপুরের দুঃখ’। কাল অর্থাৎ সর্বনাশা ঘাই থেকে সম্ভবত কেলেঘাই নামের উৎপত্তি। শুধু বন্যা নয়, কেলেঘাই দুষ্টনদ, কারণএর প্রবাহে ছিল সুগভীর তেঁতুলাগড়, বত্রিশাগড়, বুড়াবুড়ির দহ প্রভৃতি বিপজ্জনক ঘুর্ণিস্রোত।ছিল জলদস্যুর আক্রমণ। কেলেঘাইয়ের উৎস ঝাড়গ্রামের সাঁকরাইল ব্লকের বাদিনা-দুধকুণ্ডী সংলগ্ন প্রান্তর। ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম ও পূর্ব মেদিনীপুর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ময়নার ঢেউভাঙার কাছে কাঁসাইয়ের এক শাখার সঙ্গে মিলিত হয়ে হলদি নামে হলদিয়ার কাছে এটি গঙ্গাতে মিশেছে। এটি অবিভক্ত মেদিনীপুরেই প্রবাহিত।
স্মৃতিফলক (ছবি: লেখক )।
কেলেঘাই (ছবি: লেখক )।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য কেলেঘাই পথে যাতায়ত করেছিলেন বলে নদীপাড়ের গ্রামনামে আছে শ্রীকৃষ্ণের প্রভাব। যেমনবিষ্ণুপুর, মাধবচক, নোনামাধবচক, দাসপুর, জগন্নাথচক, মুরারীচক, গোপীনাথপুর, কালীদহচড়া, বৃন্দাবনপুর, রাধাগঞ্জ। কেলেঘাইয়ের উভয়তীরের প্রতিটি গ্রামে আছেবৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বাস। এই নদীকূলে তুলসীচারাতে আছে চৈতন্যশিষ্য গোকুলানন্দ বাবাজীর সুউচ্চ হরিমঞ্চ। তুলসীচারার শতাব্দীপ্রাচীন মকর সংক্রান্তির মেলা মেদিনীপুরের এক প্রধান মেলা।ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে বৌদ্ধরাও নিশ্চয় কেলেঘাই নদীপথ ব্যবহার করতেন। কারণ কেলেঘাই বৌদ্ধক্ষেত্র তাম্রলিপ্ত ও মোগলমারি বৌদ্ধবিহারের মধ্যে যাতায়তকারী একমাত্র নদীপথ।
midnapore.in
(Published on 15.05.2022)