মেদিনীপুর, মন্বন্তর, ডেবরা, লঙ্গরখানা, 1943, famine, Medinipur, Soup-Kitchen, Debra.

মেদিনীপুরে পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমি এবং ডেবরা এলাকার একটি লঙ্গরখানা ।

The background of 1943’s famine in Medinipur and a Soup-Kitchen in Debra area.

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা।


১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ করে জার্মানি। দু-দিন পর ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করল। শুরু হয়ে গেল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক মারণযজ্ঞ― দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর অধিকাংশ শক্তিধর দেশগুলো কারণে-অকারণে সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই যুদ্ধ চলাকালে সেনাবাহিনীর জন্য ইংল্যান্ড এই মহাযুদ্ধে প্রয়োজনীয় অধিকাংশ রসদ সংগ্রহ করত তার উপনিবেশভুক্ত দেশগুলো থেকে, বিশেষত ভারত থেকে। যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হল, ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের উপর ইংরেজদের নির্ভরতা ও দমননীতি স্বাভাবিকভাবেই তত বাড়তে থাকল। শুরু হল নিত্যনতুন আদেশ জারি। তা রূপায়ণে কঠোর হল প্রশাসন। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল দেশের যুব সম্প্রদায়ের ক্ষোভ। তার ফল স্বরূপ স্বদেশি আন্দোলনে কাতারে কাতারে যুবক ঝাঁপিয়ে পড়ল এসময়।

মেদিনীপুর, মন্বন্তর, ডেবরা, লঙ্গরখানা, 1950, famine, Medinipur, Soup-Kitchen, Debra.
মেদিনীপুরে পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমি এবং ডেবরা এলাকার একটি লঙ্গরখানা | The background of 1950’s famine in Medinipur and a Soup-Kitchen in Debra area.

ইতিমধ্যে দেশের যুব সম্প্রদায়ের আইডল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি তাঁর এলগিন রোডের বাড়ি থেকে হঠাৎ অন্তর্ধান হয়ে গেলেন। নিরুদ্দেশ কালে কাবুল-ইউরোপ হয়ে তিনি পৌঁছে গেলেন জাপানে। সেখানে রাসবিহারী বসু'র সাহায্যে গড়ে তুললেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। তোজো'র জাপানি সেনার সহায়তায় যে কোনও দিন ভারত আক্রমণ করতে প্রস্তুত তাঁর বিখ্যাত ফৌজ। ১৯৪২-এর মাঝামাঝি সময়ে মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যায়― জাপানের সহায়তায় বিদ্রোহী সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ ফৌজ ব্রিটিশ ভারত আক্রমণ করবে। এসময় সিঁদুরে মেঘ দেখল ইংরেজ সরকার। সরকারের আশঙ্কা― জাপবাহিনী বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে প্রথমে উপকূল অঞ্চলে আক্রমণ শানাবে। আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সমগ্র মেদিনীপুর জেলায়, বিশেষ করে মেদিনীপুরের দীঘা, কাঁথি, নন্দীগ্রাম, তমলুক উপকূল অঞ্চলে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে। সরকারি নির্দেশক্রমে তমলুক ও কাঁথি উপকূল অঞ্চলকে জরুরি অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং ওই সব জরুরি অঞ্চলের নৌকা চলাচল ব্যবস্থা একরকম বন্ধ হয়ে যায়। জাপান যাতে যানবাহনের সুবিধা না-পায়, তা আটকাতে কোনও ব্যবস্থাতেই এতটুকু খামতি রাখেনি সরকার পক্ষ।

নৌকার পাশাপাশি বাস, লরি, ট্রাক, লঞ্চ, এমনকি সাইকেলও অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার আদেশ জারি করা হয়। ১৯৪২-এর ৮ এপ্রিল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এমন আদেশ জারি করেন যে কাঁথির উপকূল অঞ্চল, তমলুক মহকুমার নন্দীগ্রাম ও ময়না থানা এবং ডেবরা থানার নৌকা ও লঞ্চ-সহ সবরকম জলযানকে তিন ঘন্টার মধ্যে ঘাটাল মহকুমার রানিচকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় এই নির্দেশ মানা না-গেলে, হয় ওই সব জলযান পুড়িয়ে ফেলতে হবে নতুবা জলে ডুবিয়ে রাখতে হবে। সরকারি এই নির্দেশের কারণে বিশেষ করে গরীব মাঝি-মল্লা ও নৌকা মালিকদের জীবন-যাপন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। যাত্রী সাধারণের সহজ ও সুলভ জলপথ ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। জলপথের পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী অগ্নিমূল্য হয়ে ওঠে। ফলে সাধারণ জনগণের দুর্গতি বাড়ে।

মেদিনীপুর, মন্বন্তর, ডেবরা, লঙ্গরখানা, 1950, famine, Medinipur, Soup-Kitchen, Debra.
মেদিনীপুরে পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমি এবং ডেবরা এলাকার একটি লঙ্গরখানা | The background of 1950’s famine in Medinipur and a Soup-Kitchen in Debra area.

ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব এশিয় রণাঙ্গন ক্রমশ ভারতের দিকে অগ্রসর হওয়ায় ব্রিটিশ সরকার সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং মেদিনীপুর থেকে খাদ্যশস্য সরিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে জেলাটিকে উদ্বৃত্ত জেলা হিসাবে ঘোষণা করে দেয়। উল্লেখ্য, জেলা থেকে সংগৃহীত খাদ্যশস্যের সিংহভাগ দানা বিহারে চালান হতে থাকে, ইংরেজ সৈন্যের প্রয়োজনে। অথচ ১৯৪১-এ অজন্মার কারণে মেদিনীপুরে এমনিতেই খাদ্যশস্যের সংকট চলছিল। যেটুকু উদ্বৃত্ত ছিল, তাও সরকার বাহাদুর অন্যত্র সরিয়ে ফেলায় মেদিনীপুরবাসী দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। তার উপর ব্রম্ভদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য অবিভক্ত বাংলাদেশে আমদানি হত, যুদ্ধের কারণে তা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এসময় খাদ্যশস্যের তীব্র সংকট তৈরি হয়। এবার ১৯৪২-এর মার্চ মাসে জেলা কংগ্রেস নড়েচড়ে বসে। মাঠে নেমে আন্দোলন পরিচালনা করে জেলা নেতৃত্ব। খাদ্য সামগ্রী সংকটের ব্যাপারে তাদের হাজার অনুরোধ সত্ত্বেও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাতে কর্ণপাত করেনি। উপরন্তু, জোরপূর্বক খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান চালিয়ে যায়। জুলুমের এখানেই শেষ নয়! প্রশাসন আরও ঘোষণা করে― কোনও ব্যক্তি তার উদ্বৃত্ত শস্য জমা না-দিলে বিনা ক্ষতিপূরণে সেই শস্য সরকার বাজেয়াপ্ত করবে। বাজেয়াপ্ত হওয়ার ভয়ে অনেকে উদ্বৃত্ত সমস্ত খাদ্যশস্য বাজারে বিক্রি করে দেয়। খোলা বাজারে যেটুকু চাল অবশিষ্ট ছিল, তা মহাজন-আড়তদার-ব্যবসায়ী'র গুদামজাত হয়ে যায়। এরপর খুব সামান্য যে পরিমাণ চাল বাজারে এল, তার মূল্য তখন সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। একটা সামান্য তথ্য তুলে ধরলে মূল্যবৃদ্ধির চিত্রটি আরও পরিষ্কার হবে। সেসময় কলকাতায় মোটা চালের দাম ১৯৪৩ সালের ৩ মার্চ তারিখে প্রতি মণ ১৫ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭মে তারিখে তা প্রায় মণ প্রতি ৩১ টাকায় দাঁড়ায়। পরে সময় যত এগোয়, চালের মূল্য আরও বাড়ে। কিন্তু ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতায় প্রতি মণ চাল ৬ টাকার কমে বিক্রি হচ্ছিল। সঙ্কট বিস্তার লাভ করায় কোনও কোনও জেলায় প্রতি মণ চাল ১০০ টাকার উপরে বিক্রি হয়। এই চিত্র শুধু কলকাতার নয়, সমগ্র বাংলার। মেদিনীপুর এর ব্যতিক্রম ছিল না। আর এতেই দারুণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মেদিনীপুরের সাধারণ মানুষ।

১৯৪২-এর শরৎকাল। মেদিনীপুরের আকাশে তখন ছেঁড়া-পেঁজা মেঘের আনাগোনা। কাশফুল জানান দিচ্ছে হিমের পরশ মেখে শরৎ এসেছে দ্বারে। দেবী দূর্গা বোধহয় এবার মুখ তুলে তাকাবেন। মেদিনীপুরবাসীর সমস্ত দুঃখ-কষ্টের হবে অবসান। পঞ্চমী থেকে শুরু হল দেবীর আরাধনা। কিন্তু না, ষষ্ঠী পেরিয়ে সপ্তমী থেকে আরও ভয়াবহ বিপর্যয় যেন অপেক্ষা করে ছিল দক্ষিণবঙ্গে। ব্রিটিশ অত্যাচার ও শোষণের সঙ্গে এবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো হাজির হল প্রাকৃতিক বিপর্যয়― প্রচণ্ড গতির ঘূর্ণিঝড়। বালিচকের স্বাধীনতা সংগ্রামী বলাইচন্দ্র হাজরা মহাশয়ের কথায়, '১৬ই অক্টোবর, মহাসপ্তমীর দিন সকাল হইতে ঝড় শুরু হয়। সন্ধ্যা হইতে আরও প্রলয়ঙ্করী রূপ নেয় রাত্রি সাড়ে নয় ঘটিকা পর্যন্ত। ঘরবাড়ী গাছপালা সবই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়। আধঘণ্টা বিরতির পর আবার প্রবল বর্ষণ প্রায় সারা রাত্রি চলিতে থাকে। ৭০ শতাংশ ঘরবাড়ী ধ্বংস, বাকী আংশিক নষ্ট। গবাদি মৃত্যুর হিসাব নাই। সব রকমের ফলের গাছ নির্মুল। শস্য সম্পূর্ণ বিনষ্ট। প্রকৃতির খেয়ালের কবলে পড়িয়া জীবিত মানুষগুলিও বাস্তুহারা এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সরকার পক্ষও নিশ্চেষ্ট। এই দারুণ সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার মত শক্তি সেদিন কাহারও ছিল না। তবু ক্ষীণ, নিষ্প্রভ কংগ্রেসের যে অংশটি তখনও টিম টিম করিতেছিল তাহার সর্বশক্তি লইয়া যথাসাধ্য সাহায্য করার উদ্দেশ্যে ছোট-খাট দু'একটি লঙ্গরখানা খুলিয়া যৎসামান্য খিচুড়ি সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হয়।'

মেদিনীপুর, মন্বন্তর, ডেবরা, লঙ্গরখানা, 1950, famine, Medinipur, Soup-Kitchen, Debra.
মেদিনীপুরে পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমি এবং ডেবরা এলাকার একটি লঙ্গরখানা | The background of 1950’s famine in Medinipur and a Soup-Kitchen in Debra area.

এর ফলে খুব শীঘ্রই অবস্থার অবনতি ঘটে। উপকূলীয় জেলাসমূহে ৩২০০ বর্গমাইল অঞ্চল জুড়ে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ক্ষেতের আমন ধানের বিপুল ক্ষতি হয়। যেখানে যতটুকু শষ্য অক্ষত ছিল, ঘূর্ণিঝড়ের পরে তাও ধূলিসাৎ হবার জোগাড়। কারণ ফসলে ফাংগাস জাতীয় রোগের আক্রমণ শুরু হয়ে গেল। যার পরিণতিস্বরূপ ১৯৪২-এর শেষের দিকে আমন ধান সংগ্রহে ঘাটতি দেখা যায়। এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হল কলেরা, বসন্ত-রোগ ও ম্যালেরিয়া মহামারির প্রাদুর্ভাব।

এ হেন দুঃসময়ে জেলা কংগ্রেস কমিটি গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে। কারণ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধান রহস্যের পর মেদিনীপুরের দ্বিধাবিভক্ত আঞ্চলিক কংগ্রেস কমিটিগুলো সাময়িক শক্তিহীন হয়ে পড়ে ছিল। মাঝের সময় টুকু নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজ না-কি মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন― কাকে সমর্থন করবেন, কোন পক্ষ নেবেন তা নিয়ে এতদিন সামান্য দ্বিধাবোধ করছিলেন তারা। এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষের এই দুঃসময়ে নিজেদের মধ্যে সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে আগে মানুষের পাশে দাঁড়ানো একান্ত জরুরি। এবার কঠিন সময়ে তাই সমস্ত বিরোধ ভুলে পুনরায় একজোট হয়ে মাঠে নেমে পড়ল তারা। ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য সরাসরি সংঘাতের পথে গিয়ে বাজার থেকে ধান-চাল তুলে নেওয়ার বিরুদ্ধে জেলা ব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলে। শুধু তাই নয়, নিরন্ন মেদিনীপুরবাসীর মুখে অন্ন যোগানোর বিষয়ে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চলতে থাকে। এরই ফলস্বরূপ ডেবরা থানার আষাড়ী বাঁধে 'মুক্তি কেন্দ্রে' একটি লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব বর্তায় স্বদেশি সেবকগণের উপর। লঙ্গরখানা পরিচালনার দায়িত্ব ভার অর্পণ করা হয় জেল-ফেরৎ ননীবালা মাইতি মহোদয়ার উপর। সবার প্রিয় 'ননীদি' ১৯৩০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত সকল দ্বিধা সংশয় জয় করে 'ডেবরার গান্ধী' ঋষিতুল্য পুরুষ নগেন্দ্রনাথ সেন মহাশয়ের আলোককেন্দ্রে আসেন দুঃস্থ ও আর্তজনের মানবিক সেবার মহান ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে। শ্রদ্ধেয় নগেন বাবুর দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন 'ভগিনী ননীবালা'। 'মুক্তি কেন্দ্রে' সেদিন ননীবালা দেবীকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন আনন্দময়ী হাজরা মহাশয়া, বাড়গোপীর জমিদার স্বাধীনতা সংগ্রামী পুলিনবিহারী মাইতি'র কন্যা। ৪২-এর আগস্ট বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে তাঁর স্বদেশি আন্দোলনে অংশগ্রহণের হাতেখড়ি হয়। সেদিন ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন জোগাতে জোতদার, জমিদার, মহাজন, ব্যবসায়ী প্রভুত জনের কাছে ধর্ণা দিতেন স্বদেশি সেবকরা। স্বেচ্ছায় না-দিলে পরিমাণের ফর্দজমা দিয়ে জোরপূর্বক চাল-ডাল আনতে হত। তবে বিনা খরচে নয়। সুদিন ফিরলে অবশ্যই ফেরৎ দেওয়ার শর্তে। স্বদেশিদের এরকম পন্থা অনেকেই মান্য করে নিয়েছিলেন। মানতে পারেনি শুধু আষাড়ী বাঁধের একজন মজুমদার ধান্য-ব্যবসায়ী। অন্যান্য প্রতিবাদীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি পুলিশের সাহায্যে মুক্তিকেন্দ্রে গোলমাল চালাতে লাগলেন। সে-সময় মুক্তিকেন্দ্রের ওপর এমনিতেই সরকারের নেক নজর ছিল। ফলে মুক্তিকেন্দ্রের কাজে বিঘ্ন দেখা দিল। শেষমেশ ক্ষুধার্ত মানুষের আহার্যের ন্যূনতম সংস্থানটুকুও বন্ধ হয়ে গেল। এদিকে, সরকার বাহাদুরও চুপচাপ বসে নেই। শুরু করল ধরপাকড় ও বিনা দোষে হাজতবাস। আষাড়ী বাঁধ, বিষ্ণুপুর, খাসবাজার, দ্বারপাড়া, কালাচাঁদ বাজার, মণ্ডলেশ্বর, শ্রীরামপুর, পাইকপাড়ী, পিপুড়দা, শীতলানন্দপুর, কাঁটাপাল প্রভৃতি গ্রামগুলিতে পুলিশের যথেষ্ট অত্যাচার বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে চলল নির্দোষ পুরুষ মানুষদের নির্বিচারে জেলবন্দি। গ্রামের পর গ্রাম তখন পুরুষ শূন্য হয়ে উঠল। আর পুলিশের অত্যাচারে একসময় গ্রামগুলি প্রায় প্রমীলা রাজত্বে পরিণত হল। এমন ঘটনা ১৯৪৩ সালের মার্চ কিংবা এপ্রিল মাস পর্যন্ত চলে। এর মধ্যে প্রিয় ননীদি আষাড়ী বাঁধের মুক্তিকেন্দ্র ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন।

তবে, এত অসুবিধার মধ্যেও সুখবর হল যে বালিচকের ব্যবসায়ীগণ দ্বারা পরিচালিত অপর একটি লঙ্গরখানা বহাল তবিয়তে চলতে থাকে। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় তার ব্যবস্থা অত্যন্ত নগন্য ছিল। তার উপরে ছিল নেতৃত্বে শূন্যতার পরিস্থিতি তৈরি হওয়া। সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ তখন অবশিষ্ট ছিলেন না। নগেন্দ্রনাথ সেন, বলাইচন্দ্র হাজরা, সন্তোষ কুমার মাইতি, মোহিনীমোহন পতি, অমূল্যচরণ আদক, গৌরহরি ঘোড়াই-সহ প্রমুখ প্রথম সারির স্বদেশিগণ ইতিমধ্যে কারারুদ্ধ হয়েছেন। ১৯৪৩-এর শেষার্ধে এবং ১৯৪৪-এর প্রথমার্ধে থানার সব কর্মী অবশ্য কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। কেবল বলাইচন্দ্র হাজরা ও মোহিনীমোহন পতি বাদে। তাঁরা দুজনে ১৯৪৫ সালের শেষার্ধ পর্যন্ত বিনা বিচারে 'নিরাপত্তা বন্দি' হিসাবে কারাদণ্ড ভোগ করেন। আরও একটি দুঃসংবাদ ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। ডেবরা থানা এলাকার সত্যপুর গ্রামের বাসিন্দা স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রমদারঞ্জন চক্রবর্তী ১৯৪৩ সালে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনিই ডেবরা থানার একমাত্র শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁর মতো একজন প্রথম সারির দেশসেবকের মৃত্যুতে ডেবরা থানার বিপুল ক্ষতি হয়ে গেল।

এত সব করেও ঠেকানো গেল না ১৯৪৩ এবং ১৯৪৪― দুই সাল জুড়ে চলা অনাহার, অর্ধাহার ও রোগ ভোগের পর মৃত্যুর মহামিছিল। গ্রামকে গ্রাম একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। জনমানবহীন ধূ ধূ প্রান্তর যেন। ১৯৪৩-এর ডিসেম্বরে মৃত্যুর হার সর্বাপেক্ষা বেশি হয়। সরকারি হিসাবে, বাংলাদেশে সেসময় ছয় কোটি মানুষের মধ্যে ২১―৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটা আরও বেশি― প্রায় ৩৫ লক্ষ থেকে ৩৮ লক্ষের উপর। ১৩৫০ বঙ্গাব্দে (১৯৪৩ খ্রস্টাব্দ) ঘটে যাওয়া এ হেন দুর্ভিক্ষ-মহামারিই 'পঞ্চাশের মন্বন্তর' নামে অধিক পরিচিত। এ দুর্ভিক্ষ যত না প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত, তার থেকেও বেশি মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম মহামারি। আর এর দায় এড়াতে পারে না ভারতবর্ষ শাসনরত ইংরেজরা। তাদের প্রত্যক্ষ মদতে সেদিন দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল অখণ্ড মেদিনীপুরের বুকে। সরকার চাইলে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা যেত এ হেন বিপর্যয়, যা সরকারি উদাসীনতায় স্বদেশী সেবকগণের ক্ষুদ্র সামর্থে সেদিন সম্ভব হয়নি। মেদিনীপুরবাসী বিস্মৃত নয় সে-ঘটনা।


midnapore.in

(Published on 28.02.2021)

■ তথ্যঋনঃ

● ডেবরা থানার ইতিকথা - বলাইচন্দ্র হাজরা।

● অতীতের স্মৃতির পাতা থেকে - আনন্দময়ী হাজরা।

● স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর ― শঙ্কর কুমার দাস।

● স্মরণিকা: স্বাধীনতা সংগ্রামী দেশবরেণ্য নগেন্দ্রনাথ সেন ― নগেন্দ্রনাথ সেন স্মরণিকা কার্যকরী কমিটি।