The neglected Lokeshwara Vishnu | Mara Dighi, Keshiary, Paschim Medinipur | উপেক্ষিত লোকেশ্বর বিষ্ণু

উপেক্ষিত লোকেশ্বর বিষ্ণু

The neglected Lokeshwara Vishnu (Mara Dighi, Keshiary, Paschim Medinipur)

শুদ্ধসত্ত্ব মান্না।


পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ির নিকটস্থ এক অতি অখ্যাত গ্রাম মরা দীঘি (মড়াদীঘি, মারা দিঘি)। হাতিগেড়িয়া অথবা খাজরা থেকে খুব সহজেই এখানে পৌছোনো যায়। এই গ্রামের ভেতরের রাস্তার পাশে রয়েছে খানিক ভগ্ন স্লেট পাথরের এক দন্ডায়মান বিষ্ণু মূর্তি । মূর্তিটির মাথার পেছনে সর্পচালি রয়েছে, প্রধান বাহুদ্বয় সুস্পষ্ট হলেও হাতগুলি খানিকটা অস্পষ্ট, পায়ের কাছে দুপাশে দুটি দন্ডায়মান মনুষ্য মূর্তি।


The neglected Lokeshwara Vishnu | Mara Dighi, Keshiary, Paschim Medinipur | উপেক্ষিত লোকেশ্বর বিষ্ণু
উপেক্ষিত লোকেশ্বর বিষ্ণু। ছবিঃ শুদ্ধসত্ত্ব মান্না।

বিষ্ণু বাংলার সকল দেবতাদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলার বহু জায়গায় নানারকম বিষ্ণু মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। এব্যাপারে 'বাঙালীর ইতিহাস- আদি পর্ব' গ্রন্থে শ্রদ্ধেয় নীহাররঞ্জন রায় বলছেন, পাল-চন্দ্র-কম্বোজ পর্বের বাংলাদেশে যত প্রতিমা পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে বৈষ্ণব পরিবারের মূর্তির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। পরিবারের প্রধান হচ্ছেন বিষ্ণু স্বয়ং। তাঁর দুই পত্নী লক্ষ্মী ও সরস্বতী। কোথাও কোথাও দেবী বসুমতী। নিম্নে বাহন গরুড়। এছাড়াও বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠলোকের দুই দ্বারী জয় ও বিজয়।



আসন, শয়ান ও (সমপদ) স্থানক - এই তিন ধরণের বিষ্ণু মূর্তির মধ্যে বাংলাদেশে এই পর্বের অধিকাংশ মূর্তিই স্থানক অর্থাৎ দন্ডায়মান। আসন ও শয়ান মূর্তি বাংলাদেশে কমই পাওয়া যায়।


The neglected Lokeshwara Vishnu | Mara Dighi, Keshiary, Paschim Medinipur | উপেক্ষিত লোকেশ্বর বিষ্ণু
উপেক্ষিত লোকেশ্বর বিষ্ণু। ছবিঃ শুদ্ধসত্ত্ব মান্না।

স্থানক বিষ্ণু মূর্তিগুলি সাধারণত সপরিবার বিষ্ণু। বিষ্ণু মাঝখানে দন্ডায়মান। তার ডানে ও বামে উপরে ও নীচে পরিবারের অন্যান্য দেবদেবী। এগুলি সবই সর্বভারতীয় প্রতিমা শাস্ত্র অনুসরণ করে তৈরী। বাংলার বিষ্ণু মূর্তি সাধারণত দুই প্রকরণের - ত্রিবিক্রম ও বাসুদেব। এই প্রকরণ পার্থক্য নির্ভর করে বিষ্ণুর চার হাতের শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম এই চারটি লক্ষণের ওপরে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিমা শিল্পীরা সবসময়েই যে এই লক্ষণ মেনে চলতেন এমনটা মনে হয় না।



সাধারণত চতুর্ভুজ বিষ্ণু মূর্তি বেশি দেখা যায়, এছাড়াও ষড়ভুজ, অষ্টভুজ, দ্বাদশ ভুজ বিষ্ণু মূর্তি ও দেখা যায়। আর এক শ্রেণীর বিষ্ণু মূর্তি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এখানে তিনি সর্পচালীযুক্ত ও চার হাতে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম ধরে আছেন। এটিই লোকেশ্বর বিষ্ণু। আবার অনেকের মতে, এটি বিষ্ণুর মহাসঙ্কর্ষণ মূর্তি। বাঁকুড়া ও বীরভূমে এ জাতীয় মূর্তি প্রচুর দেখা গেছে। এ জাতীয় মূর্তিগুলিতে কিছু জৈন ও বৌদ্ধ প্রভাবও রয়েছে।


The neglected Lokeshwara Vishnu | Mara Dighi, Keshiary, Paschim Medinipur | উপেক্ষিত লোকেশ্বর বিষ্ণু
বালি বিল গ্রামে জৈন পার্শ্বনাথ ও তার পাশে চতুর্ভুজ বিষ্ণু মূর্তি।

বেশিরভাগ বিষ্ণু মূর্তিগুলির পেছনে পদ্মাসনে উপবিষ্ট ধ্যান মুদ্রা যুক্ত ক্ষুদ্রাকৃতি অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি দেখা যায়। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, এগুলি মহাযান শাখার লোকেশ্বর মূর্তি। আবার, অনেক গবেষকদের মতে, লোকেশ্বর ও বিষ্ণু পৃথক দেবতা।



মরা দীঘি গ্রামে যে মূর্তিটি দেখা যায়, সেটিতে সর্পচালী খুবই সুস্পষ্ট। মূর্তির মাথার মুকুটটিও বোঝা যায়। কিন্তু হাতগুলি খানিকটা ভগ্ন; তবুও ভালো করে দেখলে মনে হয় এটি সম্ভবত অষ্টভুজ। এটি কি বিশ্বরূপ বিষ্ণুর মূর্তি?? মূর্তিটির পদতলে দুপাশে দুটি দন্ডায়মান মানুষের মূর্তি দেখা যায়। ডানদিকেরটি কি লক্ষ্মী ও বামদিকের টি সরস্বতী?? মূর্তিটির হাতে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম আছে কিনা তাও সুস্পষ্ট নয়। দীর্ঘদিন খোলা আকাশের নিচে রোদ জল ঝড় সয়ে সয়ে ক্ষয় ও ভগ্ন হয়ে যাওয়াই অস্পষ্টতার অন্যতম কারণ। অনেকে বলেন, মূর্তিটি দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত। বিতর্ক থাকলেও এর গঠন তত্ত্বে জৈন মূর্তি গঠনের চিহ্ন সুস্পষ্ট। নীহাররঞ্জন বাবুর মতে, নাগ ফণা ছত্রের নীচে দন্ডায়মান বিষ্ণু মূর্তিগুলি সবই মহাযানী এবং পাল পর্বের। তবে, মরা দীঘি গ্রামের মূর্তির পদতলে কোনো গরুড় মূর্তি দেখা যায় না। কিন্তু এই মূর্তির পাশেই একটি দন্ডায়মান জৈন মূর্তি দেখা যায়। তাছাড়া এর পাশের বালি বিল নামক গ্রামে একটি বড় বট গাছের তলায় মাকড়া পাথরের পাশাপাশি দন্ডায়মান জৈন পার্শ্বনাথ ও বিষ্ণু মূর্তি দেখা যায়। এখানের বিষ্ণু মূর্তিটি চতুর্ভুজ।



'মেদিনীপুরের ইতিহাস' গ্রন্থে যোগেশ চন্দ্র বসু জানিয়েছেন, প্রাচীন জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, প্রাচীন ২৪জন তীর্থঙ্করের মধ্যে প্রায় সকল তীর্থঙ্করের সঙ্গে বাঙালীর যোগাযোগ ঘটেছিল। এই জেলার নানা স্থানে এখনও জৈন প্রভাবের অনেক নিদর্শন রয়েছে। কোন স্থানে ওই সকল মূর্তি শিব রূপে, কোথাও বিষ্ণু রূপে, কোথাও বা হিন্দু দেবী মূর্তি রূপে পুজো পেয়ে আসছে।



এই দিকে অনেক হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। তাই বলা যেতে পারে, এই অঞ্চলে আদিবাসী সংস্কৃতির পাশাপাশি ব্রাহ্মণ্য, বৈষ্ণব, শৈব, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সমান্তরাল বিকাশ হয়েছিল। লোকেশ্বর বিষ্ণু তারই একটি অনন্য নিদর্শন।


midnapore.in

(Published on 24.07.2022)

তথ্য সহায়তা :
● কিয়ারচাঁদ - চৈতালী কুণ্ডু নায়েক
● বাঙালির ইতিহাস - আদি পর্ব - নীহাররঞ্জন রায়
● মেদিনীপুরের ইতিহাস - যোগেশ চন্দ্র বসু
● উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য সাইট।

ছবি :
● নিজস্ব।