Home » Medinikatha Journal » Old water tank of Medinipur
অতনু মিত্র ।
কিছু কিছু শহরে এমন একটি করে ল্যান্ডমার্ক আছে যে কেউ তা খুঁজে নিতে পারেন। যেমন হাওড়া স্টেশনে বড় ঘড়ি, খড়্গপুরে বড়বাতি, মেদিনীপুরে জল ট্যাঙ্ক। এই স্থানগুলিকে কেন্দ্র বিন্দু ধরে সেই শহরের যে কোন অজানা স্থানের অবস্থান বা দুরত্ব বা দিক সহজেই জানা যায়। মেদিনীপুর শহরের এই রকম একটি ল্যান্ড মার্ক হল স্টেশনের কাছে পুরাতন জল ট্যাঙ্ক। এই ঐতিহ্যবাহী জলাধারটির প্রকৃত নাম হল ‘রাজা নরেন্দ্রলাল খান ওয়াটার ওয়ার্কস’।
আজ থেকে ১৫০ বছর আগে ১৮৬৫ সালে মেদিনীপুর পুরসভা প্রতিষ্ঠা হলেও তখন আজকের মতো জল সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল না। পুরসভা প্রতিষ্ঠার প্রায় ৬০ বছর পরে জনস্বাস্থ্য দপ্তর ১৯২৪ সালে এই জলাধার তৈরি করে। এই জলাধার নির্মাণের জন্য ময়ূরভঞ্জের মহারাজ পূর্ণচন্দ্র ভঞ্জ, বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ বীজয়চাঁদ মহতাপ, মহিষাদলের রাজা সতীপ্রসাদ গর্গ, নাড়াজোলের বিধান পরিষদ সদস্য দেবেন্দ্রলাল খান, মেদিনিপুর পুরসভার চেয়্যারম্যান বাবু উপেন্দ্রনাথ মাইতি, মেদিনীপুর জেলা বোর্ডের ভাইস চেয়্যারম্যান বাবু রমেশচন্দ্র মিত্র, বিধান পরিষদ সদস্য বীরেন্দ্রনাথ শাসমল সহ মোট ২৮ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি অর্থ সাহায্য করেন। নাড়াজোলের রাজা নরেন্দ্রলাল খান মেদিনীপুরে বিভিন্ন সামাজিক ও উন্নয়নমুলক কাজসহ জলের কল স্থাপনের জন্য প্রচুর অর্থ দান করেছেন। সম্ভবত সেই কারনে এই জলাধার তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে।
পাথুরে লাল মাটির এলাকা এই মেদিনীপুর শহর। জলের স্তর অনেক নিচে। আবার জলবায়ুর কারনেও জলাভাব ঘটতো। শহর বেড়ে ওঠার প্রধান অন্তরায় ছিল জল। তাই বহু প্রাচীন কাল থেকেই এই শহরে জলের অন্যতম প্রধান উৎস কংসাবতী নদী। নদীটি বর্ষায় ভরে থাকলেও গরমের সময় প্রায় শুকনো থাকে। তখন জলের অভাব ভয়াবহ হতো। এই কারণে বহু আগে থেকেই শহরের আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন মানুষজন পাকাবাড়ি বা মন্দির নির্মাণ না করে, জলের উৎস হিসাবে বাড়িতে কুঁয়ো, পুকুর বা দীঘি খনন করতেন। এখনও শহরে এই রকম কুঁয়ো অসংখ্য। পুকুর বা দীঘির সংখ্যাও প্রায় শতাধিক। মল্লিক, মণ্ডল, মাইতি, চক্রব্রর্তী, পিড়ি, দত্ত, পাহাড়ী প্রভৃতি পরিবার ব্যক্তিগত পুকুর খনন করেছেন। সেগুলি তাদের পদবির সাথে যুক্ত। যেমন, মল্লিকপুকুর, পিড়িপুকুর, চক্রবর্তীপুকুর প্রভৃতি। তখন যেসব পুকুরের উপর বহু মানুষ নির্ভরশীল ছিলেন সেগুলি হল জেলখানার কাছে কেল্লাপুকুর, হবিবপুরে কালীপুকুর, সেখপুরায় চ্যালকানা পুকুর, মিঞাবাজারে তালপুকুর, মতিঝিল, কেরানিতলায় বাইজিপুকুর প্রভৃতি। এছাড়াও আছে জজপুকুর, জেল পুকুর, সাহেব পুকুর, রাজার পুকুর, শুকনো পুকুর প্রভৃতি। চৌধুরি পুকুর ও পচা পুকুর নামে অনেকগুলি পুকুর আছে। শহরের বৃহত্তম জলাশয়টি হল নবীনাবাগের লালদিঘী। নাড়াজলের রাজাদের এই পুকুরটি প্রায় ৩৬ বিঘা জায়গার উপর অবস্থিত। দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাশয়টি হল বক্সীবাজারের মুকুন্দ সায়র। বলরামপুরের জমিদার এটি তৈরি করেছিলেন।
কুঁয়োর সংখ্যা অনেক। সেন্ট্রাল বাস স্ট্যান্ডের অদুরে পাওয়ার হাউসের সামনে ফকির কুঁয়ো এখনও বিখ্যাত। এর জল খুবই সুস্বাদু। শোনা যায়, এখানে ঝরনার যোগ থাকায় এই কুঁয়োর জল কখনও শুকনো হয় না। বহু মানুষ এখনও নিয়মিত এখানকার জল পান করেন। সিপাই বাজারের আদিল মসজিদের কাছে দুটো কুঁয়ো আছে। বিশিষ্ট গবেষক চিন্ময় দাশের মতে, সম্রাট শাহজাহানের রাজত্ব কালে এই দুটি কুঁয়ো খনন করা হয়েছিল।
তবে, দেড়শ বছর আগে মেদিনীপুর পুরসভা হওয়ার পর জনবসতি বেড়েছে। ঘরবাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। ফলে অতীতের অনেক জলাশয় ভরাট করেই ঘরবাড়ি বা বহুতল তৈরি হয়েছে। এই ভাবে মীরবাজারের জোড়াপুকুর, ষষ্টী পুকুর, চক্রবর্তী পুকুর প্রভৃতি ভরাট হয়েছে। এখনও কিছু পুকুর রাতের অন্ধকারে ভরাট করা চলছে। কিছু পুকুর আবার পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। সেগুলি এখন আর ব্যবহার হয় না। কোথাও কোথাও মাছ চাষ হয়।
তখন মেদিনীপুর শহরে লোক সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। পুরসভার চেয়্যারম্যান বাবু উপেন্দ্রনাথ মাইতি। কেরানিতলা থেকে স্টেশন যাওয়ার মাঝপথে এই স্থানটি মেদিনীপুর শহরের মধ্যে উচ্চতম স্থান। এখানেই জলাধার নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কোন পিলার দিয়ে নয়। গোলাকার দেয়াল ঘিরে উপরে জলাধার নির্মাণ করা হয়। পুরোটাই ইঁট দিয়ে তৈরি। ভেতরে কংক্রীটের ঢালাই দেওয়া কোনো পিলার নেই। মাঝখানে একটি গাঁথনি দেওয়া গোলাকার পিলার। তাকে ঘিরে বাইরে চারিদিকে আড়াই ফুট চওড়া ইটের দেওয়াল। উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। এর উপরে আছে ট্যাঙ্ক। আভ্যন্তরীণ গঠনশৈলি ঠিক দেওয়াল ঘড়ির মতো। কেন্দ্র থেকে বাহিরের দেওয়াল পর্যন্ত চারদিকে ১২টি আর্চের মতো বিমের অপর আছে এই বিশাল ট্যাঙ্ক। বাইরের দেওয়ালে রয়েছে ১২টি জানালা। ভেতর থেকে উপরের দিকে তাকালে মনে হবে জমিদার বাড়ির ঝাড়বাতি। কোথাও লোহার ব্যবহার নেই। ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করার জন্য মাঝে লোহার একটি উলম্ব সিঁড়ি ব্যবহার করা হয়। জলাধারটির চারিদিকে রাস্তা। একদিকে ফ্লাইওভার রাঙামাটির কাছে কাঁসাই নদীতে বসানো দুটি পাম্প থেকে জল সরাসরি এই জলাধারে উঠে। দেখভালের জন্য রয়েছেন কয়েকজন কর্মী। এখান থেকে সকালে ও বিকালে দিনে দুবার জল সরবরাহ করা হয়। আগে এই ট্যাঙ্ক থেকে পুরো শহরে জল সরবরাহ করা হতো। এখন বিধাননগর, শরৎপল্লী, জজকোর্ট, নান্নুরচক, মিত্র কমপাউন্ড, বাসস্ট্যান্ড, অশোকনগরে জল সরবরাহ করা হয়। স্বাভাবিক নিয়মে উঁচু এই জলাধার থেকে জল শহরের সর্বত্র সরবরাহ হতো। গোল গোম্বুজের মতো এই জলাধারের জল ধারন ক্ষমতা ৫০ হাজার গ্যালন।
জলাধার তো তৈরি হল। কিন্তু সেই সময় জলাধারে জল তোলা হত কি করে? ইতিহাস বলছে, বি এন ইলিয়াস অ্যান্ড কোম্পানি নামে একটি পার্সি সংস্থা সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডের কাছে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করত। সেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হত এই জলাধারে জল তোলার জন্য। রাজ্য সরকার ১৯৭২ সালে এই পার্সি সংস্থাকে অধিগ্রহণ করে। পরে সংস্থাটি উঠে যায়। যে জায়গায় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছিল সেটি ‘পাওয়ার হাউস’ নামে পরিচিত হল। এলাকাটি এখনও সেই নামে লোকে জানেন।
এখনও শহরের বিভিন্ন এলাকায় এই জলাধার থেকে জল সরবরাহ করা হয়। আর চার বছর পরে ২০২৪ সালে এই জলাধারের শতবর্ষ পূর্ণ হবে। গত বছর জলাধারের চারদিকের সব দোকান সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জলাধারটির সংস্কারও করা হয়েছে। এবার এটিকে হেরিটেজ সম্পত্তি হিসাবে ঘোষণা করা যায় কিনা ভাববার সময় এসেছে।
midnapore.in