ঝাড়গ্রাম জেলার সাঁকরাইল ব্লকের এক উল্লেখযোগ্য লৌকিক দেবী 'সাতভউনির' কাহিনি
The story of Satbhouni a remarkable popular goddess of Sankrail block Jhargram district
চৈতালি কুণ্ডু নায়েক।
সে অনেককাল আগের কথা। এক দেশে এক রাজা ছিল। রাজা রণজিৎ কিশোর তার নাম। ঈষৎ ঢেউ খেলানো রুক্ষ লাল শিলাময় ভূমিতে গড়ে ওঠা যে নিবিড় অরণ্য, তার মধ্যে ছিল তাঁর ছোট্ট রাজ্যটি। এই নিবিড় অরণ্যের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক নদীর গা ঘেঁষে ছিল তার রাজপ্রাসাদ। নদীটির ছিল স্ফটিকস্বচ্ছ জল। সোনালি বালি ও উপলরাশির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সে নদীর জলধারা এত স্বচ্ছ যে রোদ পড়লে সে জলধারায় আয়নার মতো প্রতিবিম্বিত হতো সেখানকার নীল আকাশ ও সবুজ গাছগাছালি, মেঘ। সূর্যের সোনালি আলোয় সেই সুন্দর রাজপ্রাসাদটিও ওই নদীর জলে তার ছায়া ফেলত। রাজার ছিল আদরের সাত সাতটি রূপবতী রানি। তাদের মধ্যে ছিল ভারি ভাব। তেমন বহিশত্রু না থাকায় রাজা তার সৈন্যসামন্ত ও সাত রানিকে নিয়ে নিশ্চিন্তে নিরুপদ্রবে রাজ্যপাট পরিচালনা করতেন। একদিন অকস্মাৎ এই রাজবাড়িতে নেমে এল আতঙ্কের ছায়া। সে ছিল এক বর্ষণমুখর শ্রাবণদিন। সাত রানি সেদিন প্রাসাদের সোপানশ্রেণি ছুঁয়ে যাওয়া নদীটির-এর জলে সবে মাত্র স্নান সেরে উঠে প্রসাধনে ছিলেন মগ্ন। অপরূপ কালো হরিণ চোখে কোনও রানি কাজলের রেখা টেনে আরও আকর্ষণীয় করে তুলছিলেন নিজেকে। আলগোছে কেউ বা খোঁপায় জড়িয়ে নিচ্ছিলেন বনফুলের মালা। কেউ তার সুন্দর কপালে কুমকুম দিয়ে এঁকে নিচ্ছিলেন টিপ। আবার কোনো রানি তার পদ্মের পাপড়ির মতো কোমল পদযুগল আলতায় রাঙিয়ে নিচ্ছিলেন। এই প্রসাধনকালীন সময়ে তারা পরষ্পর হাস্যপরিহাসে ছিলেন রত।
বনপুরার সাতভউনি থান।
এমন সময় অকস্মাৎ এক পরিচারিকা এসে খবর দিল মহারাজ আসছেন। মহারাজ! এমন অসময়ে তিনি রাজঅন্তঃপুরে! রানিরা হয়ে উঠলেন শশব্যস্ত। চিন্তিত মুখে মহারাজ প্রবেশ করলেন অন্তঃপুরে। গভীর উদ্বেগের সঙ্গে রানিদের জানালেন, হিন্দুদের ত্রাস কালাপাহাড় ছুটে আসছে রাজপ্রাসাদের দিকে লক্ষ্য করে। রাজা বললেন, যেমন করেই হোক রোধ করতে হবে তাকে। না হলে কুলবিগ্রহ 'রাখাল রাজাকে' প্রবল হিন্দুবিদ্বেষী কালাপাহাড়ের হাত থেকে রক্ষা করা যাবেনা কিছুতেই। কিন্তু মহারাজ নিজেও জানেন তাঁর সীমিত সামর্থ নিয়ে কিছুতেই দুর্ধর্ষ কালাপাহাড়ের গতি রোধ করা সম্ভব নয়। তাঁকে বাধাদানের অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু। তবুও তিনি প্রাণ দিয়ে রক্ষা করবেন তাঁর 'রাখালরাজা'কে। যেতে হবে সম্মুখসমরে। তাই তিনি এসেছেন রাজঅন্তঃপুরে। তাঁর প্রিয় রানিদের কাছ থেকে শেষবারের মতো বিদায় নিতে। এই দুঃসংবাদ শুনে বিষাদের কালোছায়া নেমে এল রানিদের মনে। তারপর!
কালাপাহাড়ের তান্ডবলীলা থেকে রাখালরাজাকে রক্ষা করতে পারলেন না রাজা। রক্ষা পেলনা রাজা রণজিৎ কিশোরের রাজ্যপাট, রাজপ্রাসাদ। আর রাজার প্রিয় সাত রানি!
বনপুরার সাতভউনি থান।
রাজার মৃত্যু নিশ্চিত জানার পরে প্রাসাদ অলিন্দ থেকে সাত রানি ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই নদীর-এর জলে। ধীরে ধীরে তলিয়ে গেলেন তাঁরা নদীর জলে। হারিয়ে গেলেন নদীটির- পলি ও বালির তলায়। তার ওপর আস্তে আস্তে জেগে উঠল চর।
তারপর সেই নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে অনেক জলরাশি। একদিন এক নবীন কিশোর ওই নদীর জলে মাছ ধরতে গিয়ে তুলে আনল অপরূপ এক পাথর। ওই দিন রাতে সেই কিশোর এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখলে। সাতজন অপরূপ নারী মূর্তি একে একে তাঁর স্বপ্নলোকে আবির্ভূতা হচ্ছেন। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই তাঁরা একে একে অদৃশ্য হতে লাগলেন। সব শেষের নারীমূর্তিটি থেকে বিচ্ছুরিত হলো অপরূপ জ্যোতি। সুরেলা কন্ঠে তিনি বলে উঠলেন- 'আমরা মহারাজ রণজিৎ কিশোরের সাত রানি। এক মায়ের সাতটি মেয়ের মতো, সাত বোন। আমরা এখন সাতজনে মিলে একজন। যে পাথরটি তুমি তুলে এনেছো নদীর বুক থেকে ওটা আমাদেরই প্রস্তরীভুত রূপ। তুমি ওটা চন্দ্রাবলী লতার কুঞ্জে প্রতিষ্ঠা করো। ওখানেই ছিল প্রাসাদের রাজ অন্তঃপুর। আমাদের পুজো করো। ওটাই হবে আমাদের 'সাতবোনের' স্থান।
লৌকিক দেবী 'সাতভউনি' কে নিয়ে গড়ে ওঠা এক মিথ বা কিংবদন্তী হলো ওপরের কাহিনিটি। সাতবোন থেকে উড়িয়া ভাষায় সাতভউনি।
ঝাড়গ্রাম জেলার সাঁকরাইল ব্লকের বনপুরা একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। কাহিনিতে বর্ণিত নদীটির নাম ডুলুং। বনপুরা গ্রামে ডুলুং নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত এই দেবী থানটি। অনেক আঞ্চলিক ইতিহাসবিদদের মতে কোনও এক সময় এরই আশেপাশের কোনও এক এলাকায় একজন অনার্য রাজা বাস করতেন। তারা ছিলেন শোলাঙ্কি রাজবংশের মানুষ। অনেকে বলেন শোলাঙ্কি কথাটি থেকেই সোনাখুলি স্থান নামটি এসেছে। সোনাখুলি গ্রামটির দক্ষিণ ভাগ দিয়ে ডুলুং নদীটি বর্তমানে প্রবাহিত হয়েছে। ওই সোনাখুলি গ্রামে একসময়ে একটি প্রাচীন গড়ের চিহ্ন পাওয়া যায়। সম্ভবত ওই গড়ের প্রাচীরের পাশ দিয়েই একসময় ডুলুং নদীটির প্রবাহপথ ছিল। সোনাখুলি গ্রামটির পার্শ্ববর্তী গ্রাম বনপুরাতে, সাতভউনির থান। লোকশ্রুতি অনুযায়ী, ওই রাজার গড়ের প্রতি দ্বারে চন্ডী মূর্তি স্থাপিত ছিল। অর্থাৎ রাজার গড় রক্ষা করতেন চারদিকের দরজায় চারজন দেবী। এছাড়াও গড়ের বিভিন্ন দিকে ছিলেন অন্য তিনজন দেবী।
গড়ের দক্ষিণ ও সদর দরজায় যাঁর অধিষ্ঠান তিনি দুয়গরসুনী বা দক্ষিণ দুয়ারী নামে পরিচিত ছিলেন। উত্তরের অধিষ্ঠিত দেবীর নাম ছিল শাঁকাড়ি বুড়ি, পশ্চিম দিকে যিনি ছিলেন তিনি দিয়াশী বুড়ি, পূর্ব দিকের দ্বারের দেবীই হলেন সাতভউনি। ইনিই প্রধানা দেবী। আরও তিনজন দেবী হলেন যথাক্রমে কুবড়িয়া বুড়ি, কেঁউবুড়ি, গোপীয় বুড়ি। সম্ভবত এই সাতজন দেবীই পরবর্তী সময়ে সাতভউনি নামে প্রচলিত হয়েছেন।
বনপুরার সাতভউনি থান।
সাতভউনি লৌকিক দেবী। তাই গাছের গোড়ায় পোড়ামাটির হাতিঘোড়ার মাঝেই দেবীর অধিষ্ঠান। পুজো পেয়ে আসছেন বহুকাল ধরে। অতি সুন্দর নির্জন মনোরম পরিবেশের মধ্যে দেবীর অবস্থান। চারিপাশে বড় বড় গাছপালা। শোনা যায় পাখির কলতান। ঘেরা জায়গার মধ্যে গাছপালাগুলির ঘন ছায়ার নীচে রয়েছেন দেবী। দেবী মূর্তি পাথরের।নতুন করে নির্মিত হয়েছে আরও বেশ কিছু দেবী মূর্তি, বড় বড় হাতি ও ঘোড়া। কিন্তু লৌকিক দেবী ও দেবী থানের যে প্রাচীন বা আদিম সৌন্দর্য তার কাছে বড্ড বিসদৃশ্য এই সব নকল মূর্তি।
সাতভউনি থানটি থেকে প্রায় ৬০ মিটার দূর দিয়ে ডুলুং নদীটি বয়ে গেছে। এই দেবীর থানে অনেক আগে পাথরের দুটো বড় কৌটো ছিল। অনেকটা সিঁদুরের কৌটোর মতো দেখতে। যদিও এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না। আঞ্চলিক ইতিহাসবিদেরা দেবী মূর্তির বর্ণনায় বলেছেন দেবী সিংহের মতো মুখবিশিষ্ট। কেউ বা দেবী মূর্তির মাথাটিকে বনবেড়ালের মতো বর্ণনা করেছেন। কেউ বা এই দেবীকে বনচন্ডী বা বনদুর্গা বলে মনে করেন। কারও মতে এই দেবীমূর্তি অনেকটা মহাভারতে বর্ণিত কোকমুখী দুর্গার মতো। জনশ্রুতি ঝাড়গ্রামের এই দক্ষিণের সমগ্র এলাকায় একসময় মহাভারতের পান্ডবরা তাদের বনবাস পর্বের বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন। মহাভারতে বর্ণিত পান্ডব ভ্রাতা অর্জুন বিশেষ ভাবে উপাসনা করে যে কোকমুখী দুর্গাকে তুষ্ট করে আশীর্বাদ চেয়েছিলেন তা এই দেবীই সম্ভবত।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, পান্ডবরা তাদের বনবাসকালে ঝাড়গ্রামের দক্ষিণের এই সমগ্র এলাকার যে সমস্ত জায়গায় বিচরন করতেন তেমনই একটি জায়গার নিদর্শন হল গোপীবল্লভপুরের দক্ষিণে অবস্থিত ভোলাভেলদুয়া গ্রামের কাছে পান্ডুয়া বুড়ির থান ও তার পাশে অবস্থিত একটি ঝোরা। কথিত, বনবাসে থাকাকালীন যুধিষ্ঠির তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লে তৃতীয় পান্ডব অর্জুন ওই পান্ডুয়া বুড়ির থানের মাটিতে বাণ নিক্ষেপ করে জলধারার উৎসমুখ খুলে দিয়ে যুধিষ্ঠিরের তৃষ্ণা নিবারণ করেছিলেন। পান্ডবদের বিশ্রামের স্থান ছিল বলেই জায়গাটার নাম হয়েছে পান্ডুয়া। ওই ঝোরাতে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে জল বেড়ে যেত। বর্তমানে পান্ডুয়া বুড়ির থান প্রায় নিশ্চিহ্ন। অনেক আগে নাকি ওই পান্ডুয়া বুড়ির থানের কাছে মেলা বসতো। তবে যে ঝোরাটি রয়েছে ওখানে পৌষ সংক্রান্তির সময়ে এখনো শ্রীপাট গোপীবল্লভপুরের মহন্ত, ভক্তদের সঙ্গে শোভাযাত্রা করে যান। ভক্তরা ওই ঝোরাতে গিয়ে ওইদিন স্নান করেন পুণ্য লাভের আশায়। এই পান্ডুয়া থান ও ঝোরাকে ঘিরে আর একটি জনশ্রুতি হলো, রসিকানন্দ মহাপ্রভুর আমলে এক সন্ন্যাসী একদিন বাঘের পিঠে চড়ে গোঁসাই এর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি দৈব শক্তিরও অধিকারী ছিলেন এবং খুব দাম্ভিক ছিলেন। তিনি গোস্বামীর সাথে সুবর্ণরেখা নদীতে স্নান করতে যান। তাঁর সঙ্গে ছিল লাঠি, কমন্ডলু, বাঁশি ইত্যাদি । স্নান করার সময় ওই সমস্ত জিনিস স্রোতের বিপরীতে ভেসে যায়। সাধু বুঝতে পারেন এটা গোঁসাই-এরই ছলনা। এরপরে সাধু তাঁর সমস্ত অহংকার ত্যাগ করে গোস্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর ভেসে যাওয়া জিনিসপত্র ফিরিয়ে দিতে বলেন। গোস্বামী বলেন ভেসে যাওয়া জিনিস তিনি ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। এই ভাবে কিছু দিন যায়। একদিন গোস্বামীর সাথে সাধু পান্ডুয়ায় গিয়েছিলেন। সেখানেও সাধু অনুনয় করেন তাঁর জিনিসপত্র বিশেষ করে লাঠিটি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে। কারন তিনি বৃদ্ধ। লাঠি ছাড়া তিনি হাঁটতে পারছেন না। তখন গোস্বামী দৈব বলে সাধুর লাঠিকে সেখানেই স্মরণ করেন। তৎক্ষনাৎ মাটির নীচ থেকে জলের ফোয়ারা উঠে আসে, সেই সঙ্গে সাধুর লাঠিটিও বেরিয়ে আসে। তারপর থেকে জায়গাটা পুণ্যস্থানে পরিনত হয় এবং প্রতিবছর মহাবারুণী মেলা হয়।
তবে লৌকিক দেবী সাতভউনি, এই বনপুরা গ্রাম ছাড়াও সুবর্ণরেখা নদী অববাহিকার উত্তর-পূর্ব দিকে আরও কয়েকটি জায়গায় দেখা যায়। বিশিষ্ট আঞ্চলিক ইতিহাসবিদ ও গবেষক শ্রদ্ধেয় অতনুনন্দন মাইতির কাছ থেকে জানা যায় দাঁতন থানার তররুই গ্রামসংলগ্ন জ্যোতিদুবেড়িয়া মৌজায় ৫১৯ দাগের ৫৭ ডেসিমিল পরিমাপের জায়গায় একটি সাতভউনি থান আছে। ওখানে পুজো হয় মাঘ মাসের ৪ তারিখে। দাঁতন থানা এলাকারই খানিপুর গ্রামেও সাতভউনি দেবী আছেন যদিও ওখানে আষাঢ় মাসে পুজো হয়। আষাঢ় মাসে হওয়া এই পুজোটিকে যাঁথাল পুজো বলা হয়। সব পাথরের দেবী। দাঁতন থানা এলাকার এই দেবীথানগুলি রোহিনী গড়ের শৈলবালা দেবীর জমি এলাকার মধ্যে পড়ে। দাঁতন থানা এলাকার দুটি দেবী থানই যে রোহিনী গড়ের জমিদারদের এলাকার মধ্যে পড়ে সে তথ্য রোহিনী গড়ের সোমনাথ মহাপাত্র বাবুর কাছেও জানা গেল। দাঁতন থানা এলাকার এই দুই সাতভউনি দেবী ছাড়াও কেশিয়াড়ি ব্লকের দক্ষিণডিহাতেও সাতভউনি দেবী আছেন।
বনপুরার সাতভউনি থান।
অতনুনন্দন মাইতি বাবু নদী তীরবর্তী এলাকায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন লৌকিক দেবী প্রসঙ্গে বলেন, একসময় নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে প্রথম এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন হেলে কৈবর্ত এবং জেলে কৈবর্তরা। হেলে কৈবর্তরা নদী তীরবর্তী অঞ্চলের বনজঙ্গল পরিষ্কার করে চাষ-আবাদকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এবং জেলে কৈবর্তরা মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। সাধারণত নদী তীরবর্তী অঞ্চলের এই সমস্ত লৌকিক দেবীদের প্রথমে মাঝি সম্প্রদায়ই পুজো করা শুরু করেন।
সাঁকরাইলের বনপুরা গ্রামের সাতভউনি দেবীকে একসময়ে পুজো করতেন মাঝি সম্প্রদায়। তবে বর্তমানে এই লৌকিক দেবীর পুজো করেন বনপুরার পাশের গ্রামের ব্রাহ্মণরাই। আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বনপুরা গ্রামের সাতভউনি দেবী এবং দাঁতন থানার তররুই ও খানিপুর গ্রামের সাতভউনি দেবী এবং কেশিয়াড়ি ব্লকের দক্ষিণডিহার সাতভউনি থান সবই সুবর্ণরেখা অববাহিকার একই ধারের তীরবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। অর্থাৎ উত্তর এবং উত্তর-পুর্ব দিকে অবস্থিত। এই চারটি এলাকার সাতভউনি দেবী ছাড়াও চতুরাপাল, বালিডাংরিতে যে লৌকিক দেবী আছেন তাঁরাও জেলেদের দ্বারা পুজিতা কিন্তু সাতভউনি নামে এরা পরিচিত নন। তবে এই দেবী থানগুলিও সুবর্ণরেখা অববাহিকার উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। শুধুমাত্র নয়াগ্রাম যেতে জঙ্গলকন্যা সেতুর কাছে সেতাইবুড়ি নামে যে লৌকিক দেবী তিনি সুবর্ণরেখা অববাহিকার দক্ষিণ দিকে আছেন এবং জেলেদের দ্বারা ইনিও পুজিতা।
ফিরে আসা যাক বনপুরা গ্রামের সাতভউনি দেবী প্রসঙ্গে। বনপুরা গ্রামের সাতভউনি দেবী এবং ভোলাভেলদুয়া গ্রামের পান্ডুয়ার থান ও ঝোরাকে নিয়ে মিথ বা লোকশ্রুতি যাই থাকুক না কেন
পৌষ সংক্রান্তির পরের দিন পয়লা মাঘ বেশ বড় করে পুজো হয় বনপুরা গ্রামের এই সাতভউনি দেবীর। সে সময়ে মেলা বসে। স্থানীয় মানুষের কাছে সাঁকরাইল ব্লকের জয়চন্ডী দেবীর মতোই জনপ্রিয় এই সাতভউনি দেবীও। আঞ্চলিক ইতিহাসে অনিসন্ধিৎসু যারা, বিশেষ করে তারা যদি হন আবার প্রকৃতি প্রেমিক- বনপুরা গ্রামের এই লৌকিক দেবীকে একদিন দেখে আসতেই পারেন।
ডুলুং-এর তীরে নির্জন পরিবেশে গাছের স্নিগ্ধ ছায়াতলে অধিষ্ঠিত এই লৌকিক দেবী। পাথরের পশু মূর্তি। চোখ থেকে বেশ কিছুটা অংশ কালো কাপড় বাঁধা আছে। তবে মুখ ব্যাদান দেখে অনেকটা সিংহের মুখের আকৃতিই মতোই লাগছে। নাকি বনবেড়ালের মতো! জানিনা। অনার্য দেবী, যদিও পুজো দেন প্রায় সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষজন। ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের ধারাতে সুদূর অতীত থেকেই এই সমস্ত অঞ্চলে আর্য ও অনার্য সংস্কৃতি মিলে মিশে গড়ে উঠেছে এক মিশ্র সংস্কৃতি।
বনপুরার সাতভউনি থান।
তবে পৌষ সংক্রান্তির দিন এই দেবীর দর্শনে গেলে সীমান্ত বাংলার টুসু পরবের আমেজটুকুকে পুরো মাত্রায় অনুভব করা যাবে। এ এক বাড়তি পাওনা। সীমান্ত বাংলার এই সমস্ত অঞ্চল কয়েকটা দিন টুসু পরবে মজে থাকে সেসময়। শোনা যেতে পারে গ্রাম থেকে ভেসে আসা টুসু গানও। পৌষ সংক্রান্তির দিন হয় টুসুর বিসর্জন। সাধারণত গ্রামে নদী থাকলে নদীতেই বিসর্জন হয় টুসুর। দেখা যেতে পারে সে সব দৃশ্যও। এতো বাড়তি পাওয়া। মন্দ কি!
midnapore.in
(Published on 05.02.2023)
ছবি ঋণ:
গৌতম জানা
তথ্য ঋণ:
১.সাঁকরাইলের উপকথা, কীর্ত্তি ও কাহিনী: সৌরীন ষড়ঙ্গী। শেকড়ের খোঁজে, সম্পাদক আজহারউদ্দীন খান
২.সাঁকরাইলের লোকসংস্কৃতি ও মেলায় মেলায়:গোবিন্দ পট্টনায়ক। শেকড়ের খোঁজে, সম্পাদক আজহারউদ্দীন খান
বিশেষ কৃতজ্ঞতা:
অতনুনন্দন মাইতি, নরসিংহ পৈড়্যা, সুমন বিকাশ মন্ডল