ভুঁইয়াগড়ের ঐতিহ্য ও এক বধূমাতার বলি প্রথা প্রতিরোধের লড়াই  | The struggle to resist the sacrificial practice in Bhuiyagarh

ভুঁইয়াগড়ের ঐতিহ্য ও এক বধূমাতার বলি প্রথা প্রতিরোধের লড়াই।

The struggle to resist the sacrificial practice in Bhuiyagarh.

ডঃ বিভাসকান্তি মন্ডল।


আষাঢের জল জলদর্চিয়েখরার মতো সেই অপরূপ-রূপ লাবণ্যের উপর দূরনিলীমার দূরত্বভরা এক প্রভা “থির বিজুরী রেহা'র সার্থক আলংকারিক মূর্তি, পঁচিশ বসন্তের পলাশ রঙ যেন স্থির হয়ে আছে মিশরের মমির মতো কিংবা রামকিংকরের ভাস্কর্যের মতো আশি ছুঁয়ে থাকা এক নারীকে, মহারানিকে। সেই নিখুঁত ভাক্ষর্যের উপর সময়ের রেখাচিত্র এসে মিলেছে; যেন মোনালিসার তৈলচিত্রে অনিবার্য কালের ছায়া। শুভ্ররূপৌজ্জ্বল শ্বেতার মতো, শরতের রহস্যভরা মেঘের মতো, কল্পনার ডানা মেলাপরীর মতো, জোৎস্নার পুলকিত স্নিগ্ধতার মতো, কালবৈশাখী স্নাত নিশ্চুপ বর্ণময় প্রকৃতির মতো এক নারীমূর্তি, রানিমূর্তি যার সম্মুখে বসে নিজেকে ইতিহাসের চরিত্র মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন দূরাগত ধ্বনি সমুদ্রের উপর দিয়ে ভেসে এসে বঙ্গোপসাগরের তীরে ভূঁইয়াগড়ে আছড়ে পড়ছে সুর হয়ে। আলাপ থেকে বিস্তার সেই ধ্রুপদী রাগ যেন রূপমূর্তিতে দ্যুতিত হচ্ছে সুষমা দেবীর অবয়ব জুড়ে। সেই সূক্ষ্ম বিন্যাসের হর্মরাজীর মধ্যে, সেই রাজ মহিয়োষীর আলোকজ্জ্বল বলয়ের মধ্যে নিজেকে তো ইতিহাসের কোন ধূসর কালে স্থাপিত বলে মনে হয়। মনে হয় ইতিহাসের কথকতার কোন এক কথক-ঠাকুর।

ভুঁইয়াগড়ের ঐতিহ্য ও এক বধূমাতার বলি প্রথা প্রতিরোধের লড়াই  | The struggle to resist the sacrificial practice in Bhuiyagarh
ভুঁইয়াগড়। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

“এত রক্ত কেন!!" ঝন্ ঝন্ না দ্রিম্ দ্রিম্ কোন্ শব্দে উচ্চারিত হল এ বাণী! রানির এ বাণী বিদ্যুৎচমকের মতো আমাকে চকিতে চমৎকৃত এবং বিস্মিত করল। “কেন এত রক্ত!" আবারও উচ্চারণে, জলদগন্তীর ধ্বনিতে, ভয়ংকর ও ভীষণ অনুভবি প্রতিবাদী দৃপ্ত স্বরে আশি ছুঁয়ে থাকা রাজরানি নয় যেন বাইশ বসন্তের এক রুদ্রাণী | বধু বীরাঙ্গণার স্মিত-দৃঢ-দৃপ্ত কথা। যেন সেই অতীত থেকে উঠে আসছে কোন অলৌকিক ধ্বনি। যেন বসে আছেন সেই রক্তপ্রবাহের সম্মুখে। যেন সুষমাই হয়ে উঠছেন অপর্ণা, নাটকের নয় বাস্তবের শ্বশুরকুলের শাক্ত সাধনার ক্রমাগত বলিতে বয়ে চলেছে এ রুধির স্রোতধারা। বিসর্জনের পাঠ এভাবেই দৃশত উঠে আসে সুষমার সুম্মুখে ভূঁঞ্যাগড়ের শাক্ত দেবালয়ের মৃত্তিকাসিক্ত পশুর রক্তস্রোতে। রবীন্দ্রচেতনা আর পিতৃকুল ঐতিহ্য তাকে প্রাণিত করেছিল এই প্রতিবাদী উচ্চারণে এবং সাফল্য আনয়নে। প্রেরণার কেন্দ্র জানার আগ্রহী প্রশ্নে তাই উঠে এসেছিল ঐ নাটকীয় রাবীন্দ্রিক সংলাপ - ভূঁঞ্যাগড় যেন ত্রিপুরার রাজ বাড়ীরই এক ক্ষুদ্র সংস্করণ তখন। তখন ১৯৫২ সাল। সুষমা তখন বাইশ। অন্ত:পুরবাসী রাজবধু। পঁচেট থেকে এসেছেন চোদ্দ পুরণের আগেই। তবুও পঁচেট কন্যার রক্তে প্রবাহিত পিতৃকুল ঐতিহ্য। সেখানে জীবন পাঠের যে আয়োজন ছিল তার মধ্যে ছিল সুর। রবীন্দ্র সঙ্গীত গুরু স্বয়ং যদুভট্ট অবস্থান করে গেছেন পঁচেট গড়ে। সে পথ দিয়ে গেছেন স্বয়ং চৈতন্যদেব। প্রেম-ভক্তি আর সুরের বর্ণাধারায় শ্নাত হয়েছে যে পঁচেট, যেখানে রাধারমনের মোহনীয় রাসলীলা, নিত্যপুজা, যেখানে এখনো বৃন্দাবনের মতো বাঁশী বাজে... সেই সুর-ভক্তি, প্রেম-ভক্তি, অন্তরে নিয়ে যে কন্যা গিয়েছে স্বামীর ঘরে সে তো কোমল বাঁশীর সুরই শুনতে চাইবে! তার স্থানে কিনা নিত্যবলি! প্রাণ বলি!! নিত্যই কেঁপে উঠেন বধু সুষমা, দেবী সুষমা, রবীন্দ্রনাথের অপর্ণা । অথচ শক্তির উপাসক, তন্ত্রের সাধক শ্বশুরকুলে তিনি বালিকা বধূ। চিরকাল শক্তি, তন্ত্র পুরুষানুক্রমে টেনেছে ভূঁঞ্যাগড়ের প্রাণপুরুষদের। করাল বদনীর তান্ত্রিক রূপ মোহে বলি হয়েছে এ বংশের একাধিক পূর্বপুরুষ । সে ইতিহাসের পাতা উল্টে অর্থাৎ গল্প শুনে হতবাক সুষমা, ছোট্ট রাজবধূর বিস্ময়ের সীমা থাকে না!

তখনো ভূঁঞ্যা পদবী বা উপাধি পায়নি সিংহ বংশ। রাজা সাতসিংহ ছিলেন তেমনি একজন পূর্বপুরুষ যিনি তান্ত্রিকতায় ডুবে ছিলেন। “সিংহ' পদবীর চিহ্নটুকু এখন রয়েছে কেবল দলিল দস্তাবেজে। উত্তরপুরুষ মনোজাদিত্য দাসমহাপাত্র, মনীষীভূষণ দাসমহাপাত্রদের কাছে রক্ষিত এক দলিল বীরকুল পরগণার (ভূঁঞ্যাগড়ের পরগণা বীরকুল) বলিয়ার সিংএর নাম রয়েছে। তবে তিনি কততম পুরুষ তা উল্লিখিত নয়। এরা সকলেই কোন না কোন ভাবে কামাক্ষার সঙ্গে যুক্ত, তন্ত্রের পূজারী । সাতসিংহতে এর চরম বিকাশ শুরু। ভয়ংকর এক তান্ত্রিক সাধক হয়ে এলেন রাজ আশ্রিত। গভীর রাতে তিনি কোথায় বের হন কেউ তা জানে না। রাজা সাতসিংহ একদিন ধরলেন তিনি নিশা-অভিযানে তান্ত্রিকের সঙ্গে যাবেন। তন্ত্র সাধনা বড় গোপন ধন। কঠোর ও কঠিন সে পথ তো রাজার নয়! দশমহাবিদ্যার সে সাধনার সিদ্ধি হয় কামরূপ কামাক্ষায় তা কিভাবে রাজাকে জানাবেন তিনি! কিন্তু রাজা যে নাছোড়বান্দা। তিনি যে রাজা! নিরুপায় তান্ত্রিক তখন কামাক্ষায় মায়ের আদেশ শুনতে যান। প্রয়োজনীয় নির্দেশ নিয়ে ফিরে আসেন। রাজা সাতসিংহের দেরী আর সয় না। তান্ত্রিক কিছু শর্ত আরোপ করলেন। রাজা সানন্দে রাজি। সমস্ত কঠোর ও কঠিন পদ্ধতি অবলম্বন করতে তিনি রাজি। সব কৃচ্ছসাধন করেও তিনি পেতে চান সেই পরম শক্তিকে । জানতে চান শক্তির রহস্য। তার জন্য চক্ষুমুদে তান্ত্রিকের সঙ্গে যেতে রাজি রাজা। শর্ত কিন্ত চোখ খোলা যাবে না এবং তান্ত্রিক যেভাবে নিয়ে যাবেন সে ভাবেই যেতে হবে।

গভীর রাত! অমাবস্যার কৃঞ্ঝটিকা। নিশুতি রাতে স্তব্ধ ধরণী। তান্ত্রিকের সময় হল এবার। রাজা উঠে এলেন। গোপন নির্দেশে দ্বারে ছিল না কোন আগল। প্রহরীরা নিদ্রামগন, আফিমের বরাদ্ধ সেদিন বেশী ছিল। জানল না কেউ চললেন, রাজা চললেন। সাধনায় চললেন রাজা পেছনে রইল পড়ে রাজমহল, রানি, দাসদাসী আর রাজত্ব। রাজা চললেন প্রভূত শক্তির সন্ধানে। অলৌকিক ক্ষমতার আশায়। তবে রাজাকে চলতে হল না। মহা ক্ষমতাবান তান্ত্রিক সাধক রাজাকে চোখ বেঁধে বসালেন চালুনী গাছের উপর। বসতে রাজার কষ্ট হল। কিন্তু সইলেন। শর্ত গাছ থেকে নামা যাবে না। যতক্ষণ না হুকুম হয়। তার আগে নামলেই বিপদ। আর ফিরে আসতে পারবেন না। ফলত সিদ্ধিলাভ করে ফিরে আসতে হলে গাছে নীরবে বসে থাকতে হবে। রাজা সাতসিংহ, সিংহ পুরুষ, অমিত শক্তি লাভের প্রত্যাশায় গাছে বসে তিনি বুঝলেন যে তিনি কোন ভয়ানক বিদ্যার কবলে পড়েছেন। গাছ জাপটে ধরে বসে থাকলেন। কি গাছ, কোথাকার গাছ, কোন সে পথ কিছুই বুঝলেন না গাঢ় অন্ধকারে । তবুও রাজা অকৃতোভয়। তিনি রাজা তিনি সিংহ পুরুষ। আর এরপর সেই অলৌকিক কাহিনি! সেই চিরায়ত শোনা গাথা । চলল ... গাছ চলল। তীর বেগে। ঝড়ের মতো উড়ে যাচ্ছে বা কখনো। নদী-নালা, খানা-খন্দ, ঘর-বাড়ী পেরিয়ে মালভূমি পাহাড় ডিঙিয়ে কখনো উড়ে কখনো হেঁটে চলেছে গাছ। এভাবেই রাতের ভেতর পৌঁছে যাবে কামাক্ষ্যায়। কামরূপ-কামাক্ষ্যায় সর্ববিদ্যার রহস্য জেনে নেবেন তিনি। ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে যান। আবার ভাঙেও। তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। কতরাত তাও জানেন না সাতসিংহ। মনে হল গাছ মন্থর। রাজা প্রকৃতির ডাক অনুভব করলেন। কোন এক অলৌকিক বলে গাছও তা বুঝে গলে। থেমে গেল সে। নেমে পড়লেন রাজা । মহাশক্তির কাছে যেতে তখনো বাকি। রাজা ভুল করলেন। হয়ত বা দেবীরই কৌতুক! রাজার নামা আর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার মধ্যেই ঘটে গেল বিপর্যয়। গাছ উধাও । তান্ত্রিকও। স্থানটি কোথায় যে নিজেই ঠাহর করতে পারলেন না রাজা । স্মরণ নিলেন মহাশক্তি চন্ডিকার, দেবী কামাখ্যার। কিন্তু যা ঘটার ঘটে গেছে। দেবীর রহস্যময় নির্দেশেই কি রাজা নির্বাসিত হলেন! সাতসিংহ ভাবলেন নিশ্চয় কাছেই দেবীর স্থান। ভোর হলেই পাবেন তার সন্ধান। কিন্তু হায়রে বিধাতা! রাজার কপাল! উষার আলোয় ভরে যেতে থাকে বিশ্বপ্রকৃতি, চারদিক পাহাড় ঘেরা অপরপ প্রকৃতি, ঢাল বেয়ে রচিত হয়েছে যেন সবুজের ছন্দ। দূরে ঝর্ণার শ্রোত। ধ্বনি-মাধূর্যে মুখরিত ভোরের রূপ। মহাশিল্পীর সেই মহৎ রচনা পর্বতভূমির অনির্বচনীয় সৌন্দর্য দেখার ও রসাম্বাদন করার মানসিক অবস্থা নয় তখন সাতসিংহের। এলেন গুপ্ত মহাবিদ্যার জন্য আর প্রকৃতির এ কোন মন্ত্রগুপ্তির মধ্যে তিনি পড়লেন। রাজা দু-চোখ ভরে একবার দেখলেন বিশ্বপিতার এই খেলাকে। নমস্কার করলেন। পরক্ষণেই হতাশায় ডুবে গেলেন। এখন কী উপায়?

ভুঁইয়াগড়ের ঐতিহ্য ও এক বধূমাতার বলি প্রথা প্রতিরোধের লড়াই  | The struggle to resist the sacrificial practice in Bhuiyagarh
ভুঁইয়াগড়। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

রাজা দুর্গা নাম জপতে জপতে চলতে থাকেন। তিনিই তারক। চলতে চলতে ক্লান্ত হন। পাথরে ছিন্ন হয় বন্ত্র পা উঠে ভারি হয়ে। ক্লান্ত পদে এক সময় চেতনাই হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরে দেখেন তার সেবা করছেন স্বয়ং মহাকালী। প্রাণপন শক্তিতে উঠে দেবীর আশীর্বাদ পেতে চান। দেখেন দেবী নন এ আদিবাসী রমনী এক। তিনি ভাবেন এ কোথায় এলেন? একবার ভাবেন দেবীর ছলনা, স্বয়ং কামাক্ষ্যা এসেছেন আবার ভাবেন কোন শুদ্রের হাতে পড়লাম! সব গুলিয়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন আবার। ধীরে ধীরে স্মৃতি লুপ্ত হয়ে যায়।

এভাবেই কেটে যায় এক যুগ অর্থাৎ ১২ বছর। এই ১২ বছর কাল ছিল অভিশাপের কাল। দেবীর পরীক্ষার কাল। বহু খুঁজতে থাকেন পথ। মহাশক্তি কামাক্ষ্যার পদপ্রান্তে এসে পড়েন তিনি। ক্ষমা চান অলৌকিক ক্ষমতা লাভের লালসার জন্য। বলেন এবার সাধন করে তুষ্ট করবেন মা'কে। সাতসিংহ রাজার চোখ ফোটে জল আসে। মনে পড়ে স্বদেশকে, তার ভূমি, তার গৃহ আর আদরের সংসার... । ক্রমাগত জল গড়িয়ে যায় রাজার ।দেবী প্রসন্ন হল। ফিরে যাবেন তার ভূমিতে তবে দেবী বাশুলী রূপে তার কাছে নিত্য পূজা নেবেন। অমাবস্যার রাতে বলি। রাজা প্রতিমাসেই ছাগ বলি দেবেন। কিন্তু ফিরে যেতে হবে সেই একই ভাবে অর্থাৎ গাছে চড়ে কিন্তু নামা যাবে না। চোখ থাকবে বন্ধ। রাজা রাজি। আবার ফিরে পাবেন রাজ্যপাট ও ভূমি। এবার কিন্তু রাজার চোখ বন্ধ, নিদ্রা নেই। উত্তেজনায় থরথর সাতসিংহ। কখন ভোর হয়, কখন ভোর হয়। এক সময় গতি থেমে যায় গাছের। ভূঞ্যাগড়ের নিকটে এসে গেছে। পানা হাটের কাছে তখন। আর কতটুকু । ঝড়ের বেগ থেমে গেছে, পৌঁছে গেছে ভেবেই উত্তেজনায়, আবেগে রাজার চোখ আপনা থেকেই খুলে যায়, দেখবেন তার সাধের রাজপ্রাসাদ। চোখ খোলা মাত্র থেমে গেল গাছ। গেল না গৃহ পর্যন্ত, তাতে কি। এ আর এমন কি দূর! এ তো দেখা যায় রাজ প্রাসাদ। গাছ রইল পাটনা হাটের কাছে বিদ্যাপুকুরের পাড়ে । রাজা ছুটলেন প্রাসাদের পথে।

চমকে গেলেন! থমকে গেলেন! একি! এসব কী চলেছে, রাজবাড়ীর পথে? শ্রাদ্ধের সব উপকরণ না? হ্যা তাই তো বটে। কার জন্য, কে গেল, রাজা উদ্বিগ্ন! জিজ্ঞেস করে জানলেন আজ সাতসিংহ রাজার শ্রাদ্ধ! চমক ভাঙল সাতসিংহের। তিনি যে এক যুগ নেই, সে তো তার খেয়াল নেই তখন। এদিকে নিরুদ্দেশের ১২ বছর পূর্ণ হওয়ায় শ্রাদ্ধের আয়োজন করছেন রাজবাড়ী, শত দুঃখ যন্ত্রনা সহ্য করে তার পত্রী বিধবার সাজ পরেছেন। আজ-ই শ্রাদ্ধের দিন। সাতসিংহ আর এগোলেন না। বসলেন। স্মরণ করলেন দেবী কামাক্ষ্যাকে। এই খানেই দেবীর মন্দির বানাবেন।

লোকজনকে বললেন খবর দাও “আমি সাতসিংহ এসেছি” । “গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে”। রাজবাড়ী ধেয়ে এল, রানিসহ সব দাস-দাসী কর্মচারী। রাজা আত্মপ্রকাশ করলেন। কিন্তু একি! রানি বিধবা! এয়োতির চিহ্ন মুছে গেছে তার। কিভাবে আর রানি থাকেন তিনি। আবার তো বিবাহ সম্ভব নয়। অথচ রাজা থাকবেন কিন্তু তার রানি বিধবা এই বা কেমন করে হয়! সুতরাং সহজ পন্থা রানি বাদ। এ যে রাজমহিমা! যে রানি উদ্বেগের সঙ্গে ১২টা বছর প্রতি প্রহর গুনে কাটিয়েছেন, পথ চেয়ে বসে থেকেছেন, আগলে রেখেছেন তার সংসার সেই আজ ব্রাত্য! যে রানি খবর পেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে বেরিয়ে এসেছেন সব গণ্ডী ভেঙে, কি পোষাকে আছে তা চিন্তা না করেই সেই রানিই বাদ! তিনিই চলে যাবেন সকল পর্দার আড়ালে, চিরতরে! বিধান বড় কঠোর, বিধাতা বড় কঠিন। চলে যেতে হয়। পাহাড় প্রমাণ অভিমান নিয়ে, নিঃসীম যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে চিরদুঃখী সেই নারী জানিনা কোন দুঃখের সাগরে না সমুখের বঙ্গোপসাগের কোথায় হারিয়ে গেলেন!

রানি বলি দিয়েই শুরু হল সাতসিংহের নূতন রাজ্যপাট। সাতসিংহ রাজত্ব পেলেন, রানি পেলেন নতুন, বাঙালীর মন্দির হল। বলি চলন মহাসমারোহে। পুরুষনুক্রমে চলল এ প্রথা। এভাবেই স্থায়ীভাবে শক্তির প্রতিষ্ঠা ভূঞ্যাগড় রাজবংশে। আর সাতসিংহ দেবীর দাস হয়ে হলেন দাসমহাপাত্র। আর এখানো সেই কামরূপ থেকে দেবী কামান্ষ্যার প্রসাদ, ফুল, বেলপাতা বছরে একবার আসে এ শক্তিদেবী বাশুলীর মন্দিরে । জয়ন্ত দাসমহাপাত্ররা আজও স্মরণ করেন সেই প্রাচীন ঐতিহ্যকে। তবে এতো বাইরের বিষয়, এ বলি তো বউরানি সুষমার চোখে পড়ে না, কেবল শুনেন। কিন্তু দুর্গাপূজা যা কিনা রাজবাড়ীর অন্দরে হয় তাতেও বলি হয়, এ যে অসহনীয়। মধুর মরলীধারীর উপাসিকা কিশোরী বধূর বুকে বড় বাজে, করুণ সুরে বাজে প্রাণের আর্তনাদ। কিন্তু প্রশ্ন হল বাইরে বাশুলী তো রয়েছেন তা হলে অন্দরে সেই শক্তি দুর্গার আবাহন আবার কেন?

আবার এক গল্পে। গল্পের পর গল্প! রোমাঞ্চিত সব কাহিনি ভূএ্যাগড়ের পাথরে পাথরে গড়ে উঠেছে প্রাসাদের মতো। দুর্গাপূজা অনেক পরে একথা সত্য। ১৮৫০ এর কাছাকাছি এই শক্তির আবাহনের পেছনে আছে আর এক রোমহর্ষক কাহিনি।

সাতসিংহের কোন উত্তরপুরুষে আবার বর্তাবে দেবীর লীলা। এ যেন দৈবী বাণী। বর্তাল অক্ষয় নারায়ণের কালে। তিনিও শক্তির প্রতি আকৃষ্ট হলেন। বাশুলীর পুজা করে তিনিও সিদ্ধি লাভ করতে চান, যেতে চান কামাক্ষ্যায়। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে রাজাকে যেতে দেওয়া হয় না। সবাই আগলে রাখতে চায়। কিন্তু ইতিহাস তার পথেই চলে। কয়েক পুরুষ পরে তাই রাজা অক্ষয়নারায়ণ দাসমহাপাত্র একদিন উধাও হয়ে গেলেন। দেবী বাশুলীই কী (কামরূপ) খোজ করেও মেলেনা তার সন্ধান। এ কোন অভিসম্পাদ! পেরিয়ে গেল ১৪টি বছর। তারপর একদিন বাশুলী মন্দিরের চারপাশে ঝাকড়া চুল আর মুখভরতি দাড়িসহ এক দিব্যকান্ত পুরুষকে দেখা গেল। দেখলেই মনে হবে রাজপুরুষ চেহারার। আবার রটে গেল বার্তা...। আবার পড়ল আলোড়ন। ইতিহাস কি এভাবেই নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে! ধেয়ে এল রাজবাড়ি । কিন্তু, কী আশ্চর্য রানি এলেন ধীর লয়ে। সকলের চোখ রাজার দিকে। রানির চলার গতি মন্থর অথচ এলোমেলো । দেখল না কেউ রানির শ্বাস উঠা-পড়ার আলোড়ন, তার ভিতরের অস্থিরতা চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা। এত চেষ্ঠা করেও নিজেকে সামলে রাখতে পারছেন না তিনি। এ দৃশ্য অক্ষয়নারায়ণের চোখ এড়াল না। আসলে রানি তো খবর শুনেই বেরিয়ে আসছিলেন উন্মাদের মতো। জোরে ঠোক্কর খেলেন দরজায়। পড়ে গেলেন। কেউ যেন ফিসফিস করে বলে দিল “ভুল করিস না, ভুল করিস না”। মুহূর্তে বুঝে গেলেন সব।

না না, তা হতে দেওয়া যায় না। তার আদরের ধন বসন্তকুমার এখন রাজা । তাকে কত কষ্টে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। এ বংশের কত কুটকৌশল। রানি হয়েই ধরেছিলেন হাল। সমস্ত চত্রান্ত ব্যর্থ করে বসন্তকুমারকে প্রতিষ্ঠিত করতে বুঝতে হয়েছে অনেক রাজনীতি। রানি বুঝে গেলেন কেন এই দৈববাণী। কী তার করা উচিত। তবুও তো নারী তিনি। বয়ে চলে ঝড় অন্তরে অন্তরে। দুই হাতের মুষ্টি দ্বৈধতা রাজা অক্ষয়ানারায়ণের চোখ এড়াল না। রানিকে দেখে অক্ষয়নারায়ণ বিমুঢ় বিস্ময়ে কাতর কাতর চোখে তাকিয়ে। রানি ক্ষণমুহূর্তে সব ভুলে ছুটে রাজার নিকটে এসেও থমকে গেলেন। যেন সেই দৈববানী কানে শুনতে পেলেন আবার “ভুল করিস না, সব শেষ করিস না সাতসিংহের রানির মতো ।”..চিনতে পারলেই নিজের বিসর্জন! কথা বলতে গিয়ে স্বরবিকৃত হয়ে গেল, তবুও প্রাণপণে জোরে চিৎকার করে বললেন, না - এ রাজা নয়, একে চিনতে পারছি না...। দ্রুত ফিরে গেলেন অন্তঃপুরে। কেঁপে কেঁপে উঠল বিছানা । সাধারণ মানুষ এখন অন্য রাজার অধীন, তাছাড়া এ যেন সত্যিই অন্য একরকম মানুষ । হবে না? ১৪ বছরে চেহারা বদলাবে, ধরন-ধারণও কিছু। ফিরে চলল সকলে। নিঃসঙ্গ রাজা। ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়েও হলনা । এক রানি প্রত্যাঘাত হয়ে বুঝিয়ে রানি হলেও । সাতসিংহের সেই রানির খবর জানে না কেউ, কেউ মনেও রাখেনি তার কি হল। সেই রানিই যেন দৈবযানী করে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল অক্ষয়নারায়ণের রানিকে। তাই ইতিহাস দেখল এবার এক রানি প্রত্যাখ্যান করল রাজাকে । তবে এ রাজার পরবর্তী ইতিহাস জানা আমাদের।

রাজা প্রত্যাখ্যাত হলেন। নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস? নিঃসঙ্গ অক্ষয়নারায়ণ শূন্যদৃষ্টি মেলে আকাশের দিকে চাইলেন। হঠাৎ কোমল স্পর্শ অনুভব করলেন। দেখলেন অন্য এক নারীকে, যে তাকে একদিন আমোদ দিয়েছিল। তারই বিনোদনের জন্য মেলে দিয়েছিল সকল শরীর। সেই রমণীই তাকে চিনলেন। রাজা রক্ষিতার গৃহে চললেন। কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বীকার করলেন সেই নারীর অন্তরের ঐশর্যকে। তার সন্তানরা রাজা উপাধি অর্থাৎ দাসমহাপাত্র পদবি বহন করার অধিকার পেল। এখনও তাঁর উত্তর পুরুষরা তা বহন করে চলেছেন। রাজাকে কেউ ঘাঁটাল না। কিন্তু, এই পর্ব এভাবেই কী চলবে? বাশুলীদেবী রাজহর্ম্যের বাইরে, তাই কী এই অভিশাপ? এবার নিয়ে আসা হোক ভিতরে । তাই আবাহন দুর্গার। বাশুলী রইলেন প্রতিষ্ঠিত মূর্তিতে। দুর্গা আসবেন মৃন্ময়ী হয়ে। কিন্তু, তাতেও থাকল বলি। এ যে শক্তি সাধনার বংশজ প্রথা।

ভুঁইয়াগড়ের ঐতিহ্য ও এক বধূমাতার বলি প্রথা প্রতিরোধের লড়াই  | The struggle to resist the sacrificial practice in Bhuiyagarh
ভুঁইয়াগড়। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

কিন্তু, অভিশাপ মুক্তির জন্য কী বলি প্রয়োজন? ছাগবলি! মা কী তার কোনও সন্তানের রক্ত পান করেন? সকল জীব তার সন্তান। অহরহ ভাবেন সুষমাদেবী। ক্রমাগত পথ খোঁজেন, কীভাবে এই প্রথা বন্ধ করা যায়। ইতিমধ্যে দীক্ষা নিয়েছেন আর্য ঋষিকুলের গুরু স্বামী জগদানন্দ ভক্তিশাস্ত্রীর কাছে। গুরুদেবের শরণাপন্ন হন। দিন দিন সময় বদলাচ্ছে। স্বামী বিক্রমাদিত্যকেও পাশে পেলেন। কিন্তু রানিমাতা দুর্গামণি! আর একমাত্র সন্তানের যদি কিছু হয়! এ বংশে কত অভিশাপ! রানি দুর্গামণির সাধারণ মানুষের মন। রব উঠল ঘোর অমঙ্গল হবে। যেন বিসর্জন নাটকেরই এক দৃশ্য কিন্তু, তবুও সময়ের বদলে কত মানুষ পাশে আসে। সব থেকে বড়ো কথা স্বামী ওষ্কারনাথ এবং জগদানন্দ ভক্তিশান্ত্রী দু'জনেই বধুমাতার শুভ ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছেন। ওষ্কারনাথ আবার দুর্গামণির গুরু। ফলে ধীরে ধীরে জয়ী হলেন পঁচেটকন্যা, ভূঞ্যাগড়ের বধূ সুষমাদেবী।

কেবল দুর্গাপুজোর নয়, বাশুলীর বলিদানও উঠে গেল সেই ১৯৫২ সালে। আজ থেকে ৬০ বছর আগে। ২২ বছরের সেই দৃপ্ত দীত্তিময়ী নারী এখন আশি ছয়ে, ভূঁঞ্যায়াগড়ের “ভূঁঞ্যানী”। এখন "ভূঁঞ্যানী” নিজ হাতে সামলান পুজোর আয়োজন। ৬০ বছর আগে দুর্গোৎসবে স্বামী ওক্কারনাথ ও স্বামী জগদানন্দ বেদান্ত শাস্ত্রী বধূমাতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গিয়েছিলেন। আমরাও তাঁকে সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাই।


midnapore.in

(Published on 04.04.2021 / প্রথম প্রকাশঃ বর্তমান, ৩০ অক্টোবর, ২০০৭ / দ্বিতীয় প্রকাশঃ মেদিনীকথা পুস্তকে, প্রকাশক - অরিন্দম'স, ২০১২)