সত্যপুরের রাসমঞ্চের টেরাকোটা কথা
The Terracotta of Satyapur Rasmancha
সুতনু ঘোষ।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ডেবরার অন্তর্গত একটি পুরাকীর্তিস্থল সত্যপুর । এখানে প্রাচীন মাকড়া পাথরের সত্যেশ্বর মহাদেব জীউর মন্দির রয়েছে । পাইকপাড়ি গ্রামে জীর্ণ জোড়বাংলা মন্দির বর্তমান। পাইকপাড়ি , গড় কিলা , সত্যপুর প্রতিটি এলাকাই কংসাবতী নদী তীরবর্তী এবং ইতিহাস সমৃদ্ধ। সত্যপুরের প্রায় দুশো বছরের বেশি পুরোনো শীতলানন্দ মন্দিরের কাছে বন্দ্যোপাধ্যায়দের একটি অপরূপ নবরত্ন আটকোণা রাসমঞ্চ রয়েছে।
সত্যপুরের রাসমঞ্চের টেরাকোটা কথা | The Terracotta of Satyapur Rasmancha ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।
মল্লভূম বিষ্ণুপুরের রাসমঞ্চটি স্থাপত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন । তবে বাংলা জুড়ে সাধারণত ছোট আকারের অনেক রাসমঞ্চ তৈরী হয়েছে। সত্যপুরের এই রাসমঞ্চটির ওপরের রত্নগুলি বেহারী রসুনচূড়া রীতির এবং প্রতিটির সামনে একটি করে নারীমূর্তির দেখা মেলে । রাসমঞ্চটির টেরাকোটার কাজ উৎকৃষ্ট না হলেও বেশ আকর্ষণীয় বলা চলে ।
বাংলার শিল্পীরা নদীমাতৃকার পলি দিয়ে বিমূর্ত সব টেরাকোটার কাজ রচনা করেছিল । সে ধারা চলেছে প্রায় তিনশো বছরের বেশী সময়কাল ধরে । টেরাকোটার কাজের উৎকৃষ্ট রূপ শিখরে পৌঁছেছিল সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতকে । মন্দির নির্মাণের জোয়ার আসে বাংলা জুড়ে । চৈতন্যদেবের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছোট বড় জমিদারেরা রাধাকৃষ্ণের মন্দির নির্মাণ করেছেন ।
সত্যপুরের রাসমঞ্চের টেরাকোটা কথা | The Terracotta of Satyapur Rasmancha ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।
সাথে নির্মিত হয়েছে রাসমঞ্চ , দোলমঞ্চ , তুলসীমঞ্চ প্রভৃতি । শীতলানন্দ মন্দিরটি শিবের জন্য নির্মাণ কাজ শুরু হলেও একটি দুর্ঘটনার কারণে মন্দিরে কৃষ্ণের পুজো প্রতিষ্ঠিত হয় । নবরত্ন রীতির শীতলানন্দ মন্দিরে টেরাকোটার ফুলের নকশা ছাড়া বিশেষ কাজ নেই । রাসমঞ্চটির টেরাকোটার কাজে রয়েছে দশাবতার মূর্তি । মৎস্য , কূর্ম , বামন , নৃসিংহ প্রভৃতি ফলকগুলি বেশ আকর্ষণীয় ।
রয়েছে ষড়ভুজ গৌরাঙ্গের একটি সুদৃশ্য ফলক । এটি চৈতন্যদেবের একটি বিশেষ রূপ যেটি পূর্ব ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে খুবই জনপ্রিয় এবং বহু ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে এই রূপটির আদলে । এখানে ছয়টি হাতের দুটি তীর ধনুক ধারী দাশরথী রামের , দুটি হাত বংশীধারী কৃষ্ণের , দুটি হাত কমন্ডুল ও দন্ডধারী সন্ন্যাসীবেশ চৈতন্যদেবের । এই রূপের গুণে তা জায়গা করে নিয়েছে সত্যপুরের রাসমঞ্চের গায়ে পোড়ামাটির ফলকে ।জায়গা করে নিয়েছে গৌর নিতাই এর ফলক।
সত্যপুরের রাসমঞ্চের টেরাকোটা কথা | The Terracotta of Satyapur Rasmancha ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।
গণেশ জননী দৃশ্যটিতে জননীর কেশবিন্যাস , অলংকার ও পোষাকের নকশা নজর কাড়ে । গরুড়ের পিঠে বিষ্ণু , ষাঁড়ের পিঠে ডমরু হাতে শিব প্রভৃতি ফলক রয়েছে । কৃষ্ণলীলা ভারতবর্ষের মন্দিরের গুরুত্বপূর্ণ ও সাধারণ বিষয় । এই রাসমঞ্চটিতে অনেকগুলি কৃষ্ণলীলার দৃশ্য রয়েছে।ত্রিভঙ্গ চতুর্ভুজ কৃষ্ণ দর্শন , ত্রিভঙ্গ কৃষ্ণ , বকাসুর বধ , কংসবধ প্রভৃতি পরিচিত ফলকগুলি রয়েছে ।গোদুগ্ধদোহনরত কৃষ্ণ ফলকটি বেশ সুন্দর ।
যমুনা তরীতে রাধাকৃষ্ণের ফলক , কৃষ্ণের দধিভান্ডে হস্তপ্রবেশের দৃশ্য ( প্রসঙ্গত এই ফলকটি মাড়োতলা বাসস্ট্যান্ডের কাছে সত্যেশ্বর মহাদেব জীউ মন্দিরের গায়েও দেখা যায় ) প্রভৃতি ফলক রয়েছে। এছাড়া রয়েছে রাবনের রথকে সুপার্শ্বের গিলতে আসার দৃশ্য , মিথুন দৃশ্য । ফলকগুলিতে পোষাকের বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ।
সত্যপুরের রাসমঞ্চের টেরাকোটা কথা | The Terracotta of Satyapur Rasmancha ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।
সত্যপুরের রাসমঞ্চের টেরাকোটা কথা | The Terracotta of Satyapur Rasmancha ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।
এছাড়া টেরাকোটার নিজস্ব রঙ বজায় থাকায় এবং প্রতিটি কাজ স্থূল হলেও স্পষ্ট হওয়ার কারণে ফলকগুলি চিনতে সুবিধে হয়। রাসমঞ্চটির প্রতিটি দ্বারের দুপাশে গোপীনীদের মূর্তি বর্তমান । স্থাপত্যটির নীচের অংশের টেরাকোটার কাজ ভগ্ন , তুলনামূলক ওপরের অংশের কাজ অনেকটা সুরক্ষিত । কিন্ত গাছপালা গজিয়েছে এর ওপর ।
উপযুক্ত তত্ত্বাবধানের অভাবে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
midnapore.in
(Published on 20.02.2022)
তথ্যঋণ:
শম্ভু ভট্টাচার্য , তারাপদ সাঁতরা , চিন্ময় দাশ মহাশয়ের লেখালেখি এবং ক্ষেত্রসমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য ।