সন্তু জানা।
এক বিরাটাকার প্রস্তরমূর্তি ছায়াঘন গাছ-গাছালির প্রেক্ষাপটে, নিস্তব্ধতা বুকে আগলে রেখে জেগে আছে সহস্রকালেরও অধিক সময় ধরে । নিকষ কালো প্রস্তরমূর্তিটির মাথা থেকে হাঁটু অবধি মাটির উপরে মৃদু দণ্ডায়মান । মোট দৈর্ঘ্য ৩ ফুট ৫ ইঞ্চি । আয়তনে এই বৃহদাকার প্রস্তরমূর্তিটি সমগ্র রাঢ় অঞ্চলে বিরল । সাধারণ মানুষের কাছে ইনি "জটাধারী বাবা" ,আবার কোন কোন গবেষকের চোখে ইনি বৌদ্ধ যুগের কোন মহাযানী ভিক্ষু, যিনি প্রায় ১৫০০ বছর ধরে সময়ের প্রবহমানতা অনুভব করছেন ।
দাঁতনের উত্তর রায়বাড় গ্রামে জনৈক তারাপদ মিশ্রের বাড়িতে একটি বিশালকায় কালো পাথরে খোদিত এই মূর্তিটির দেহের নিম্নভাগ কিন্তু এখনও মাটির অভ্যন্তরে । প্রশস্ত চেহারা ,কাঁধের দৈর্ঘ্য প্রায় ২ ফুট ,চওড়া ছাতির মাপ প্রায় ৩ ফুট ১০ ইঞ্চি । মাথায় পাগড়ির বন্ধন ,আবার সাধনার প্রতীক জটাজালও হতে পারে ।লম্বা গোঁফ ও ঘন দাড়িতে ঋত্বিকের গাম্ভীর্য বিদ্যমান । বুকে কৌলীন্য পৈতে সহ ক্ষুদ্রকায় কৌপীন পরিহিত মূর্তিটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই বোঝা যায় যে ,মূর্তিটি কেবলমাত্র ভগ্ন নয়, বরং বলা যেতে পারে বলপূর্বক আঘাতপ্রাপ্ত , হিংসার শিকার।
পদযুগলের কিয়দংশ একটি বেদীর উপর অবস্থান করছে ।বাকি শরীরটি বামদিকে পড়ে রয়েছে ,কিছুটা মাটিতে নিমজ্জিত ।কারুকার্যময় বেদীর উপর দুইদিকে দুটি একই রূপের শিষ্যাচার্য বা ব্যাজনকারী দণ্ডায়মান । অনুমান করা যায় মূর্তিটি কোন "বৌদ্ধভিক্ষু"-র হতেই পারে । বহুযুগ আগে শত্রুর করাঘাতে দুটি বাহু ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেলেও বৌদ্ধভিক্ষুর হস্তশোভাবর্ধক প্রস্তরনির্মিত বজ্রের মাথা এখনও বিরাজ করছে ওরই আশেপাশে । নব আবিষ্কৃত মোগলমারির বৌদ্ধবিহারের অবস্থান এখান থেকে মাত্র ৫ কিমি হওয়ায় মূর্তিটি বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য হতে পারে, এমনটা মনে করা যেতেই পারে । আবার অপর একটি মত অনুসারে বলা যায় ,খড়গ্পুর গ্রামীণ এলাকার জিনসর বা অতীতের 'জৈন-শহর', বেলদার 'যুগী-দেউল', নারায়নগড়ের 'দামদমা' এবং দাঁতনের মোগলমারি ও কাকরাজিত এলাকায় ইতিপূর্বে শিষ্য পরিবৃত হয়ে বেশ কিছু জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি আবিষ্কৃত হওয়ায় দক্ষিণ মেদিনীপুর অঞ্চলের এই 'জটাধারী-বাবা' মূর্তিটির সঙ্গে জৈন ধর্মের মিল থাকতে পারে বলে অনুমান করা যেতে পারে ।
১৯৫২ সালে 'দাঁতনের ইতিহাস' নামক গ্রন্থে ভূমিপুত্র ললিতমোহন সামন্ত সর্বপ্রথম জটাধারী বাবার কথা লিখেছিলেন । নীল কালিতে ছবিও এঁকেছিলেন তৎকালীন পত্রিকার পাতায় । সেই বছর দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকার পাতায় মূর্তিটি সংরক্ষণের জন্য আবেদনও করেছিলেন তিনি । পরবর্তীকালে প্রয়াত লোকগবেষক ড.বঙ্কিম মাইতি মূর্তিটি পর্যবেক্ষণ করে একে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য রূপে স্বীকৃতি দেন । তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী : "মাথায় কুণ্ডলীকৃত জটাজাল ।ডানহাতে বুকের কাছে ধরে থাকা পুঁথি -পেটিকা ।নিমীলিত চক্ষু ।মাথার পেছনে দেবতার প্রভামন্ডল নেই, দণ্ডায়মান পদতলে পদ্ম নেই ।সব দেখে মনে হয় ইনি কোন এক মহাযানী বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য ।আকৃতির বিশালতায় ,দৈহিক ঋজুতায় মুখমণ্ডলের গাম্ভীর্যে ও সৌকুমার্যে এতদ্অঞ্চলে প্রাপ্ত শিলামূর্তিগুলির শিরোভাগ দখল করে আছেন তিনি ।"
একবিংশ শতকের বহু গবেষক এই শতাব্দীপ্রাচীন "জটাধারী বাবা"-র মূর্তিটিকে আবার শৈবাচার্য রূপে প্রমাণ করতে চান । স্থানীয় গবেষক বিশ্বজিত ঘোষ দাঁতন টাউন লাইব্রেরীতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বলেন যে -"বানগড় প্রভৃতি এলাকাতেও একই সঙ্গে শৈবমঠ ও বৌদ্ধমন্দির অবস্থান করার প্রমাণ পাওয়া গেছে ।দাঁতনের সাতদেউলা অঞ্চলে প্রাপ্ত শৈব মূর্তিগুলির আবিষ্কার প্রমাণ করে যে মোগলমারির বৌদ্ধ বিহারের কিছু দূরে অবস্থান করা এই সমগ্র অঞ্চল এককালে একটি সমৃদ্ধ শৈব অঞ্চল রূপে বিরাজ করত ।"
এছাড়াও, দাঁতন থেকে দক্ষিণে ওড়িশার বারিপদা ও খুরদাতেও একইরকম শিষ্য পরিবেষ্টিত শৈবাচার্য মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে ।
সম্প্রতি দ ণ্ড ভু ক্তি পত্রিকার পক্ষ থেকে গবেষণার কাজে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার খিচিং অঞ্চলে কিচকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে অবস্থিত প্রাচীন গাছের তলদেশে বাঁধানো বেদীর উপর একই প্রকার ভগ্নপ্রায় প্রস্তর মূর্তি চাক্ষুষ করেছি । ছবি সংগ্রহ করেছি ।
শুনেছি বহুবছর আগে ক্ষেত্রসমীক্ষক অনিমেষকান্তি পাল দাঁতনে এসে জটাধারী বাবার ছবি তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন ।কলকাতায় ছবিটি দেখে অধ্যাপক সুকুমার সেন বলেন এটি একটি ঋষি মূর্তি । ভারতীয় ধ্রুপদী শিল্পকলা বিষয়ক গবেষক তথা প্রখ্যাত সিংহলী তামিল শিক্ষাবিদ আনন্দ কেন্টিশ মুথু কুমারস্বামীর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ - The history of indian and indonesian art সম্পূর্ণ পাঠ করে ঋষি অগস্ত্যের সঙ্গে এই ধরনের মূর্তির মিল খুঁজে পেয়েছি । এইরকম শিদ্ধাচর্যের মূর্তি প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথা গণশক্তি কাগজের পাতায় লিখেছেন গবেষক ভাস্করব্রত পতি । তাঁর লেখা পড়ে জানা যায় , কাঁথির বাহিরী থেকে পাওয়া একটি জটাধারী সাধুর মূর্তি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়ামে রাখা আছে । নিচে পরিচিতি দেওয়া আছে "a brahmin king " ।
২০১৮ সালে কলকাতা থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপন দাঁতন এসেছিলেন । সঙ্গে ছিলেন চিন দেশীয় এক গবেষক । বর্তমান লেখক তথা দ ণ্ড ভু ক্তি পত্রিকা সম্পাদকের সহায়তায় সারাদিন দাঁতন অঞ্চল জুড়ে তাঁরা প্রাচী "অসুর" সংস্কৃতির ছায়া খুঁজে বেড়ান । তাঁদের ধারণা , সহজ সরল 'অসুর 'দের সাধারণ জীবনযাত্রা উপেক্ষা করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ন্যায় দক্ষিণ - পশ্চিম সীমানা এলাকাতেও বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নিজ ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছিল । অসুরদের পতনের মতই কালের নিয়মে বৌদ্ধ রাও প্রায় ধ্বংসের মুখে পতিত হয় ।
ইতিহাস সাক্ষী আছে , পরবর্তীকালে প্রবল বৌদ্ধ বিদ্বেষী শৈব ধর্মাবলম্বী গৌড়রাজ শশাঙ্ক বৌদ্ধদের মঠ ও মূর্তি নষ্ট করে দেন । সেই মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণ থেকে দক্ষিণে দাঁতন সীমানা অতিক্রম করে গৌড়- বাংলা রাজ্যের সীমান্ত ওড়িশার গঞ্জাম পর্যন্ত বিস্তার করেন । আরও পরে ১৫৭৫ সালের ২৩ মার্চ সুবর্ণরেখা নদীর তীরে তুকারুই-এর যুদ্ধে মোগল-পাঠান ভীষণ যুদ্ধে দাঁতন অঞ্চলের মন্দির-মঠের কারুকার্যময় দেব-দেবী মূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । সম্ভবত , পরাক্রমী দুষ্কৃতী পাঠান সেনাপতি কালাপাহাড়-এর নিষ্ঠুর তরবারির কোপেই দ্বিখণ্ডিত হন জটাধারী বাবা।
যাইহোক ,যুগের পর যুগ ধরে বহু ঘাত -প্রতিঘাত সহ্য করে মহাকালের প্রতীক হয়ে এখনও টিকে আছে এই দুষ্প্রাপ্য মূর্তিটি ।তবে কেবল মূর্তি রূপে নয় ।জাগ্রত দেবতারূপে । নিয়মিত ফুল ,বেলপাতা সহযোগে পূজিত হন তিনি । ফলপ্রসাদ গ্রহণ করেন ।ভক্তবৃন্দ আসেন ,মানত করেন ।শুধু আঞ্চলিক নয়, বহুদূর থেকে মেদিনীপুর ,কলকাতা ,এমনকি ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুর থেকেও ভক্তবৃন্দ পায়েসভোগ দিয়েছেন ।সম্প্রতি টাটানগর শহরের বাসিন্দা জনৈক অলোক মিত্র, পেশায় অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার সাহেব শ্রদ্ধাবনত হয়ে এই কথা জানালেন । সত্যি কথাই বটে , এই ভক্তিভাবই তো রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে দিনের পর দিন যেন প্রাণদান করে চলেছে প্রাচীন মূর্তিটির ।
মূর্তিটির কোন সঠিক বয়সকাল নির্ধারণ করা যায়নি ঠিকই ,তবে মনে করা হয় এটি মোগলমারির বৌদ্ধবিহারের সময়কালীন , অর্থাত প্রায় খৃষ্টীয় পঞ্চম - ষষ্ঠ শতকের । জৈন প্রসঙ্গ সঠিক হলে আরও কিছুকাল পিছিয়ে যেতে হবে যদিও ।প্রসঙ্গত ,মনে রাখতে হবে যে গৌড়রাজ শশাঙ্ক কিন্তু শৈব ছিলেন এবং দাঁতনের জেনকাপুর - আঁতলা থেকেই শশাঙ্কের তাম্রশাসন পাওয়া যায় ।
বর্তমানে মূর্তিটি উত্তর রায়বাড় গ্রামে অবস্থান করছে ।মনে রাখতে হবে --দাঁতনের উত্তর রায়বাড় গ্রামটিও কিন্তু বেশ ইতিহাসখ্যাত । এই উত্তর রায়বাড় গ্রামেই দাঁতনের রাজবংশের সূত্রপাত । বর্তমানের বীণাপানি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে পুকুরটি থেকে বহু প্রাচীন মূর্তি পূর্বে উদ্ধার করা হয়েছে । এমনকি পুকুর পাড়ে একটি উঁচু বৃহৎ ঢিবি রয়েছে ,যেখানে অতীতে কোন সৌধ বা প্রত্নস্থান ছিল বলে অনুমিত হয় ।
কিন্তু , দাঁতনের যত্র-তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এরকম অসংখ্য মূর্তি ,প্রত্নবস্তু যারা দেবতারূপ পেলেন না ,তাদের কেমন অবস্থা ? তারা কী বুক চিতিয়ে সহ্য করছে না প্রকৃতির চোখ-রাঙ্গানি ,অথবা আধুনিক মানুষের চরম খামখেয়ালীপনা ? সময় এসেছে অরক্ষিত এইসমস্ত প্রত্নবস্তুকে রক্ষা করার ,প্রকৃত পদ্ধতিতে সংরক্ষন করে অতীত ইতিহাসকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার ।
midnapore.in