কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী  | Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता

কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী

Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता

চৈতালি কুণ্ডু নায়েক।


কালুন্দী বা কালিন্দী থেকে কালীঘাই তার থেকে কালিয়াঘাই বা কেলেঘাই। এ এক নদী। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলে উৎপন্ন হওয়া এক নদী। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের বেশিরভাগ নদ-নদীগুলির কতই না দূর এলাকায় উৎপত্তি! তাদের প্রবাহপথও কত দীর্ঘ! কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে এই নদীটির উৎস কিন্তু মেদিনীপুর ও খড়্গপুর ।

কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী  | Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता
অবহেলিত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। পিতলকাটি গ্রাম।

ঝাড়গ্রাম জেলার দক্ষিণ-পূর্বে ঝাড়গ্রাম ও সাঁকরাইল থানার সীমান্তে অবস্থিত দুধকুন্ডি গ্রাম পঞ্চায়েত। বলা হয় এই দুধকুন্ডি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বাদিনা গ্রামের কালিন্দী ঠাকুরের থানের কাছের এক প্রস্রবন থেকে এই নদীর উৎপত্তি হয়েছিল। কারও মতে কালিন্দী ঠাকুরের থানের কাছের জলা থেকে এই নদীটির উৎপত্তি হয়েছিল। লোধাদের পূজিত দেবতা হলেন এই কালুন্দী বা কালিন্দী ঠাকুর। লোধারা মনে করেন কালিন্দী ঠাকুরের আশীর্বাদ পুষ্ট এই জলধারা। তাই তাঁদের পূজিত দেবতা কালিন্দী ঠাকুরের নাম অনুসারেই একসময় এই জলধারার নামকরণ করেছিলেন কালীঘাই। কালীঘাই থেকে কালিয়াঘাই বা কেলেঘাই। কিন্তু বাদিনা গ্রামে পৌঁছে স্থানীয় গ্রামবাসীদের থেকে জানা গেল ওই প্রস্রবন এখন আর নেই, বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কালিন্দী ঠাকুরের থানের কাছেই একটি ছোট্ট জলাভূমি চোখে পড়ল। শোনা গেল খুব বৃষ্টি হলে ওই জলাভূমিতে মানুষ সমান জল হয়ে যায়। যদিও এখন কেলেঘাইয়ের উৎপত্তি স্থল হিসেবে ধরা হয় দুধকুন্ডি গ্রাম পঞ্চায়েতেরই অন্তর্ভুক্ত বাদিনার কাছে কলসিভাঙা গ্রাম। তবে কালিন্দী ঠাকুরের থানের আশেপাশের উঁচু জমি ও জলা থেকে গড়িয়ে পড়া বর্ষার জলধারাতেও পুষ্ট হয় এই নদী।



আমরা জানি পশ্চিমবঙ্গের এই সমস্ত অঞ্চল ছোটোনাগপুরের ক্ষয়প্রাপ্ত মালভূমিরই সম্প্রসারিত অংশ, উঁচুনিচু বন্ধুর। এখানকার ভূমিভাগের বেশিরভাগ অংশই অত্যন্ত কঠিন, রুক্ষ, পাথুরে।কেলেঘাই নদীটি এই পাথুরে ভুমিভাগের বুক চিরে গড়ে তুলেছে তার প্রবাহপথটি। যদিও উৎস অঞ্চলে অতি শীর্ণ তার শরীর। বৃষ্টির জলে পুষ্ট এই নদী বছরের বেশীরভাগ সময়েই থাকে শীর্ণা এবং অতি ক্ষীণ তার জলধারা। বর্ষাকালেই আবার দুধকুন্ডি, গুপ্তমণি ও গুপ্তমণি লাগোয়া সাঁকরাইল থানার কিছু অংশের ঢালু ভু-ভাগের জলে হয়ে ওঠে চঞ্চল ও খরস্রোতা। কেলেঘাইয়ের উৎসস্থলের উচ্চতা সমুদ্রতল থেকে মাত্র ৮২ মিটার। উৎসস্থল থেকে প্রবাহিত হয়ে এই নদীটি পূর্ব মেদিনীপুরের ট্যাংরাখালি ঢেউভাঙাতে কাঁসাইয়ের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। প্রায় প্রতিটি নদীই তার প্রবাহপথে গড়ে তোলে জনপদ। এই নদীটিও তার প্রবাহপথে গড়ে তুলেছে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য জনপদ ও মাহাত্ম্যপূর্ণ স্থান। উৎস অঞ্চলের কাছাকাছি এমনই তিনটি উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে। তিন লৌকিক দেব-দেবীর মাহাত্ম্যপূর্ণ তিন স্থান। এই তিন দেব-দেবীকেই পুজো করেন লোধা পুরোহিত। তিন স্থানের এই দেব-দেবীকে এখানকার মানুষেরা মনে করেন, তিন ভাইবোন। এই তিন লৌকিক দেব-দেবী হলেন কালিন্দী ঠাকুর বা কালুয়াষাঁড়, মা গুপ্তমণি এবং দেবী জয়চন্ডী।

কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী  | Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता
জলাভূমি। কেলেঘাই-এর উৎসের কাছাকাছি। বাদিনা গ্রাম।

গুপ্তমণি থেকে বালিভাসার দিকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ঝাড়গ্রাম থানার অন্তর্গত দুধকুন্ডি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়ে বাদিনা গ্রামটি। এই বাদিনা গ্রামের জনবসতি থেকে একটু দূরে ফাঁকা ধানজমির মধ্যে কুসুমগাছের তলায় এই কালুয়াষাঁড় ঠাকুর বা কালিন্দী ঠাকুরের থান। ষন্ডমূর্তি দেখা যায় না অথচ দেবতার নাম কালুয়াষাঁড়। কিংবদন্তীটি হলো কালু বা কড়েয়া ছিলেন অরণ্যরাজ্যের রাজা। কুড়ুল নিয়ে বাঘ শিকার করতেন তিনি। বন কেটে বসতি স্থাপন ও রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। মনে করা হয় কালুয়াষাঁড় হয়তো এককালে বন্যপশু শিকারি সাঁওতাল দলপতি ছিলেন। বাঘ শিকার করে একসময় সাঁওতাল সমাজের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। ষাঁড় শব্দটি হয়তো তাঁর শৌর্যের চিহ্ণ। ঝাড়গ্রাম রাজকুলের শৌর্যবোধক উপাধি হলো 'উগাল ষন্ডদেব'। কালু নামটি জঙ্গলমহলে সাঁওতাল সমাজে বেশ পরিচিত। মঙ্গলকাব্যে ডোম, ব্যাধ-কালুডোম, কালকেতু আমাদের সুপরিচিত। কালুর সাঁওতালি নামান্তর -'কড়েয়া', যার অর্থ বাদামি ত্বক। কালুয়াষাঁড় হয়তো ছিলেন চিকন কৃষ্ণবর্ণের মানুষ। আদিতে শক্তিশালী দলপতি, পরবর্তীকালে দেবতায় উন্নীত।



বাদিনা গ্রামে পৌঁছতে এগিয়ে এলেন স্বপন মাহাতো, শ্যামল সহিস, কাকলি মাহাতো ও সুনীল মাহাতোরা। সুনীল মাহাতো পথপ্রদর্শক হয়ে চললেন আমাদের সঙ্গে। শরতের কচি সবুজ ধানজমি, সাদা কাশের গুচ্ছ সহ সরু আলপথ ও একহাঁটু জলের নালা পেরিয়ে পৌঁছনো গেল ঠাকুরের থানে। মাথার ওপরে শরতের নীলাকাশ আর দিগন্তজুড়ে কচি সবুজ ধানক্ষেত। যেন প্রকৃতি মা তাঁর সবুজ নরম আঁচল বিছিয়ে রেখেছেন তাঁর সন্তানদের জন্যে। নির্জন প্রকৃতির কোলে দেবতার বাসভূমি! অনেক আগে এখানে কুসুম গাছের তলায় কালো রংয়ের পাথরকে কালুয়াষাঁড় রূপে পুজো করা হতো। তবে বর্তমানে এখানে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরের ভেতরে পোড়ামাটির হাতি, ঘোড়ার সঙ্গে ছোটো পাথরটিকেও দেখা যায়। পুজো করেন লোধা পুরোহিত। যদিও পুজো শুধু বছরে একদিনই হয়, বাৎসরিক পুজো। লোধা পুরোহিতকে বলা হয় দেহুরি। গুপ্তমণির মন্দিরের দেহুরিরাই এখানে পুজো করেন। মাঘমাসের দু তারিখেই বাৎসরিক পুজো হয়। বাৎসরিক পুজোতে পাঁঠাবলি হয়। পুরোহিত প্রথমে নিজের হাত কেটে রক্ত বের করে দেবতাকে উৎসর্গ করেন, তারপর হয় বলি।

কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী  | Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता
শরতের ধানমাঠ। বাদিনা গ্রাম। দূরে কালিন্দি ঠাকুরের থান।

খড়্গপুর থেকে জাতীয় সড়ক ধরে লোধাশুলি যাওয়ায় পথেই পড়ে গুপ্তমণি। পথের ডানদিকেই আছে গুপ্তমণি মন্দির। মা গুপ্তমণি। দেবীর নামেই স্থানের নাম। ইনি শিলা রূপেই পূজিতা। গুপ্তমণিকে দেবী বনচণ্ডীও বলা হয়। দেবী চণ্ডীর অর্চনা প্রায় সমগ্র মেদিনীপুরেই করা হয়। তবে মন্দির নয় চণ্ডীর 'থান'-ই চোখে পড়ে। এঁর মূর্তি সচরাচর দেখা যায় না। ছোটোনাগপুরের ওঁরাও-দের মধ্যে চাণ্ডী নামের এক দেবীর পুজো প্রচলিত আছে। তিনি স্থানীয় আদিম জনগোষ্ঠীদের শিকারে সাফল্য এনে দেন। চন্ডীমঙ্গল কাব্যেও তো দেখা যায় দেবী চণ্ডী ব্যাধের দ্বারা পূজিতা ছিলেন। সমগ্র মেদিনীপুরে চণ্ডীর বহু স্থানীয় নাম আছে। কোথাও খিরাইচণ্ডী কোথাও মঙ্গলচণ্ডী কোথাও আবার বরোজচণ্ডী কোথাও জয়চণ্ডী। আবার সাঁকরাইল থানার কুলটিকরির লতা মৌজাতে আছে কাদুয়াচণ্ডী।



বনচণ্ডী সম্পর্কে এটুকু বলা যায় ঝাড়গ্রাম সহ বর্তমান মেদিনীপুরের অনেকখানিই এককালে ঘোর অরণ্যসঙ্কুল ছিল। ওই অরণ্যসঙ্কুল অঞ্চলে ছিল আদিম জনজাতির বাস যাঁরা শিকার করেই মূলত জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাই দেবী বনচণ্ডীর আরাধনা। গুপ্তমণি থেকে লোধাশুলি পর্যন্ত বেশিরভাগ অঞ্চলই একসময় লোধা অধ্যুষিত ছিল। মন্দিরের গর্ভগৃহের মধ্যে একটি বৃত্তাকার কুন্ডে সিঁদুর, ফুল, বেলপাতায় ঢাকা শিলাফলকই হলেন দেবী গুপ্তমণি। গুপ্তমণি শিলাফলকের কাছেই বনচণ্ডীর বাহন হাতির অধিষ্ঠান। এই হাতির পাশেই আছে আর একটি পাথর যা দেবী মনসা রূপে পূজিতা হন। গুপ্তমণি শিলাফলকের পেছনে দেওয়ালের একপাশে আছে অসুরদলনী দেবী দুর্গা মূর্তি এবং আর একপাশের দেওয়ালে আছে সিংহবাহিনী। মন্দিরের মূল গর্ভগৃহের বাইরের দেওয়ালে যেখানে ঢাকি বসে ঢাক বাজায় সেখানেও বিভিন্ন দেবদেবীর চিত্র খোদাই করা আছে। মন্দিরের সামনে রয়েছে যূপকাঠ। শনি মঙ্গলবারে সাধারণত বলি দেওয়া হয়। মন্দিরটির প্রবেশপথের বামদিকে বাইরে একটি টিনের শেডের মধ্যে মানত স্বরূপ হাতি ঘোড়ার ছলন স্তুপ দেখা যায়।

কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী  | Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता
হাতি ঘোড়ার ছলন স্তুপ। মা গুপ্তমণির মন্দির।

অনেকে মনে করেন মা গুপ্তমণি উর্বরতা ও প্রজনন শক্তির প্রতীক। অম্বুবাচীর সময়ে যোনিপট্টে বলির রক্ত ঢেলে পুজো করা হয়, তা থেকেই এই অনুমান।



এই দেবীকে ঘিরে প্রচুর অলৌকিক কাহিনী গড়ে উঠেছে।

অনেক আগে এই সমস্ত অঞ্চল ছিল ভয়াবহ গভীর অরণ্যে ঢাকা। হিংস্রপশু ও দুর্ধর্ষ লুঠেরা ডাকাতের ছিল বাসভূমি। কোনও একদিন ওই অরণ্য অঞ্চলের এক মানুষ নন্দা ভক্তা দেবী বনচণ্ডীকে স্বপ্নে দেখলেন। দেবী স্বপ্নাদেশ দেন রাস্তার ধারে এক শ্যাওড়া গাছের নীচে ঝোপের মধ্যে যেখানে একটা টাটকা ডাল পোঁতা আছে, সেখানেই মাটির মধ্যে তিনি গুপ্ত অবস্থায় আছেন। নন্দা ভক্তা যেন তার পুজোর ব্যবস্থা করেন। পরদিন নন্দা ভক্তা সেই গাছের নীচে ঝোপজঙ্গল পরিষ্কার করে দেখেন সত্যিই দেবী মাটির নীচে শিলারূপে আছেন। তখন সেখানেই দেবীকে রেখে নিত্যপুজো শুরু করেন নন্দাভক্তা। এখানে বনচণ্ডী মাটির নীচে গুপ্ত ছিলেন বলেই তিনি দেবী গুপ্তমণি নামে পরিচিত।

কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী  | Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता
কালিন্দী ঠাকুরের থান। বাদিনা গ্রাম।

এই মন্দিরকে ঘিরে আরও একটি কাহিনি শোনা যায়। তখন ঝাড়গ্রামে মল্লরাজার শাসনকাল। একদিন রাজার দুটি হাতি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। রাজার সৈন্যসামন্তরা সমস্ত বনজঙ্গল খানাতল্লাসি চালিয়েও হাতিদুটির খোঁজ পায় না। রাজা ভাবলেন বুঝিবা হাতিদুটি এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। রাত্রে বনচণ্ডী স্বপ্নাদেশ দেন হাতিদুটিকে শুগনিবাসার জঙ্গলে, যা এখন গুপ্তমণি স্থান নামে পরিচিত, লুকিয়ে রেখেছেন। যদি রাজা মন্দির গড়ে দেন তবেই হাতি দুটি ছাড়া পাবে। পরদিন রাজা জঙ্গলে গিয়ে দেখেন সত্যিই হাতি দুটি বুনো লতায় বাঁধা হয়ে আছে। রাজা সেই হাতিদুটি ফিরে পাওয়ার পরে ওই ঘন অরণ্যে মন্দির নির্মাণ করে দেন। দেবী হাতিদুটিকে গুপ্ত রেখেছিলেন এখানে তাই গুপ্তমণি।



আবার রাজা নরসিংহ মল্লদেবের হাতিদুটিকে নিয়েই অন্যরকম আর একটি কাহিনিও শোনা যায়। মল্লদেবের রাজপ্রাসাদ ছিল ঘোর অরণ্যে ঘেরা। রাজা মল্লদেব রাজস্ব ও রাজ্যরক্ষার জন্যে একটি গোপনপথ নির্মাণ করেন। এই গুপ্তপথের সাহায্যেই আকস্মিক হামলায় বহু যুদ্ধ জয় করেছেন এই মল্লরাজ। এই গোপন পথের পাহাড়ায় ছিলেন দেবী বনচণ্ডী কেউ বা বলেন উমা। একদিন নন্দা ভক্তা আবিষ্কার করে ফেলেন ওই গোপন পথটি। রাজার হারিয়ে যাওয়া হাতিদুটির সন্ধান পাওয়া যায় গোপনপথটির ঠিক সামনেই। বুনো লতা দিয়ে বাঁধা। তখন মল্লদেব কি আর করেন, ওই গোপন পথ পাহাড়ার দায়িত্ব দেন শবর অধিপতি নন্দা ভক্তাকে। সেই থেকে রাজমহলের গুপ্তপথ আগলে রাখেন শবররাজ নন্দাভক্তা। তখন থেকেই শুরু গুপ্তমণির পুজো। পুজো হয় শিলারূপেই। নন্দা ভক্তার বংশধরেরাই পালা করে মন্দিরে পুজো করেন। মন্দির দর্শনের দিন পুজো করছিলেন রাজু ভক্তা।

কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী  | Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता
কালিন্দী ঠাকুরের থান। বাদিনা গ্রাম1

মনে করা হয় গুপ্তমণি দেবী পথের যাবতীয় বিপদ থেকে পথিকদের রক্ষা করেন। তাই এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় সমস্ত গাড়ির ড্রাইভার ও যাত্রীরা দেবী গুপ্তমণিকে মনে মনে প্রণাম করে পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে যান দেবীর উদ্দেশ্যে যাতে নির্বিঘ্ন হয় যাত্রাপথ।



গুপ্তমণি থেকে কাছেই সাঁকরাইল থানার একটি প্রাচীন ও উল্লেখযোগ্য মন্দির হল জয়চণ্ডী মন্দির। গুপ্তমণি থেকে কুলটিকরি যাবার পথে পড়ে পাথরা।এই পাথরা থেকে পূর্বদিকে বেশ কিছুটা যাওয়ার পরে পিতলকাটি গ্রাম। গ্রামটির উত্তরে প্রায় একমাইল দূর দিয়ে কেলেঘাই নদীটি বয়ে গেছে। এই পিতলকাটি গ্রামের বসতি থেকে অল্প দূরে একটি খোলা জায়গায় জয়চণ্ডী মন্দিরটি অবস্থিত। ভাদ্রের চড়া রোদে দ্বিপ্রাহরিক বেলায় করম, কুচিলা, অশ্বত্থ ও নিমগাছের সুশীতল ছায়ায় মন্দির চত্বরে এসে পৌঁছতে কী শান্তি! সরকারি নথিতে পাথরকাটি নামে গ্রামটির উল্লেখ আছে। সাধারণত বনাঞ্চলের চণ্ডী গাছের নীচেই থাকেন কিন্তু এখানে দেবী জয়চণ্ডীকে মন্দিরে পুজো করা হয়। এই পিতলকাটি গ্রাম অতীতে দিগপারই পরগণার মধ্যে ছিল। দেবী জয়চণ্ডীকে নিয়েও নানা কাহিনি শোনা যায়।

কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী  | Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता
মা গুপ্তমণি

অতীতে যখন এই সমস্ত অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা সেই সময় নন্দরাম মাহাতো নামে জনৈক ব্যক্তি ময়ূরভঞ্জ থেকে তাঁর হারিয়ে যাওয়া মহিষের সন্ধানে এই অরণ্যে এসে উপস্থিত হন। পথের ক্লান্তিতে তিনি ওই জঙ্গলে ঘুমিয়ে পড়ার পরে স্বপ্নে দেখেন দেবী জয়চণ্ডী এক মধ্যবয়সী রমণীর ছদ্মবেশে তাঁর সামনে এসে উপস্থিত হয়েছেন। দেবীর আশীর্বাদেই তিনি তাঁর হারানো মহিষ ফেরত পান। এরপরে দেবীর আদেশ স্বরূপ তাঁরই সম্প্রদায়ের মানুষ মাহাত বা কুর্মিদের এই স্থানে নিয়ে আসেন। দেবস্থান চিহ্নিত করে দেবীমূর্তির প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই পিতলকাটি গ্রামে মাহাতরা বসবাস করছেন।



যে দেবী যত জাগ্রত ততই মিথ তাঁকে ঘিরে। বর্তমানে লোধা দেহুরিদের পূর্বপুরুষ তালাই গ্রামের রাম লোধাকে নিয়েও এক মিথ শোনা যায়। পিতলকাটি গ্রামের অনতিদূরেই আছে তালাই গ্রাম। সেও প্রায় অনেককাল আগের কথা। একদিন রাম লোধা এই ঘোর অরণ্যে শিকারের অন্বেষণে এসেছিলেন। সারাদিন শিকারের সন্ধানে ঘুরেবেড়িয়েও কোনও শিকার পাননি। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ওখানেই এক করম গাছের নীচে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সেই সময় দেবী জয়চণ্ডী স্বপ্নে তাঁকে পুজো করার আদেশ দেন। সেই সঙ্গে বলেন যদিও জাগতিক কল্যাণ এই পুজোর উদ্দেশ্য তবে লোধা সম্প্রদায়ও তাদের জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে শিকার পাবেই ওই অঞ্চলে। এরপর রাম লোধা ওই করমগাছের নীচে পাথরের স্তুপের মধ্যে দেবীকে খুঁজে পান তারপর ওখানেই মাটির বেদী প্রতিষ্ঠা করে ভক্তিভরে পুজো শুরু করেন। রাম লোধার বংশধরেরাই উত্তরাধিকার সূত্রে এখনও দেবী জয়চণ্ডীর পূজারি।

কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী  | Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता
মা গুপ্তমণির মন্দির

অনেকদিন আগে এই অরণ্য অঞ্চল খড়্গপুর থানার অন্তর্ভুক্ত বনপাটনার ব্রাহ্মণ জমিদার সৎপথী জমিদারদের অধীনে ছিল। তাঁরা ১৮২০ সালে জয়চণ্ডী মন্দিরের তখনকার পুরোহিত রাম লোধার বংশধর টুকুমণি লোধাকে এখানকার ৫০ একর জমি মন্দিরের পূজাক্রিয়াদি চালানোর জন্যে দানপত্র করে দেন। কিন্তু ১৮৭৭ সালে এই সমস্ত এলাকার জমিদারি বালিয়াবেড়ার প্রহরাজ ও ষড়ঙ্গী বংশীয়দের হাতে চলে যাওয়ায় তখন তারা লোধা পূজারির পরিবর্তে উৎকল শ্রেণির ব্রাহ্মণ পূজারি দিয়ে জয়চণ্ডী দেবীর পুজো চালু করেন। কিন্তু এই ব্যবস্থা লোধারা মেনে নিতে পারেন না। তখন তারা দেবী জয়চণ্ডীকে বালিভাসার জঙ্গলে বীরঘঁসা নামে এক স্থানে নিয়ে গিয়ে পুজো শুরু করেন।



শেষপর্যন্ত একটা সমঝোতা হয়, তাতে লোধা ও ব্রাহ্মণ দুই সম্প্রদায়ই পুজোর অধিকার পান। লোধা পুজারি সেই দেবীমূর্তি আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এখানে, অবশেষে পুজোও আবার শুরু হয়।

কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী  | Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता
মা জয়চণ্ডী মন্দির। পিতলকাটি গ্রাম।

তবে পরে টুকুমণি লোধার বংশধরেরা কোনও কারণে জমির অধিকার হারিয়ে ফেলেন কিন্তু পুজোর অধিকার তাঁদের থেকে যায়। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে দুর্গাপুজো ও অন্যান্য কয়েকটি বিশেষ দিন ছাড়া পুজো করেন লোধা পুরোহিত। কিন্তু দুর্গাপুজোর চারদিন লোধা পুরোহিত ব্রাত্য। দুর্গাপুজোর ওই চারদিনের শাস্ত্রীয় আচারে শুধু ব্রাহ্মণেরই আছে অধিকার। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে পুজোর জোগাড়ে সাহায্য করেই লোধা পুরোহিতকে সন্তষ্ট থাকতে হয় ওইসময়।



লোধা পুরোহিতকে দেহুরি বলা হয়। লোধারা নিজেদের মুখ্য বা মৌলিক পূজার অধিকারী বলে ভাবেন। সেই কারণে তারা মন্দিরের চাবি তালা রাখার অধিকার পেয়েছেন। বর্তমানে তাঁরা পৈতেও ধারণ করেছেন। সমস্ত জাতির মানুষেরাই এখানে পুজো দিতে আসেন। মন্দিরটি আয়তাকার ও দক্ষিণমুখী। মার্বেল পাথরের মেঝে এবং নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে মন্দিরটি। মন্দিরের ভেতরে সিঁদুর, ফুল ও লাতাপাতায় ঢাকা মূর্তিটি সঠিক ভাবে নির্নয় করা যায় না। বিগ্রহের বাম পাশে একটি বিরাট পোড়ামাটির হাতি রয়েছে। মন্দিরের বাইরে করম গাছের নীচের স্থানটিতেই দেবী প্রথমে অধিষ্ঠিত ছিলেন বলে মনে করা হয়। জনশ্রুতি মন্দিরটি ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে বালিয়াবেড়ার প্রহরাজ বিশ্বম্ভর দাস মহাপাত্র এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। গ্রামের অধিবাসী সুরেন্দ্রনাথ মাহাতো বলেন দেবীর উদ্দেশ্যে পশুবলির প্রথা আছে। মন্দিরের সামনে দুটি হাড়িকাঠ পোঁতা আছে দেখা গেল। একটি ছাগল বলি ও অন্যটিতে মহিষ বলির জন্যে। তবে মহিষ বলি সাধারণত দুর্গাপুজো ও পৌষ সংক্রান্তিতে হয়। বলির রক্ত মাটির সরায় ধরে নিয়ে প্রথমে দেবীকে নিবেদন করা হয়। এছাড়াও পোড়া মাটির হাতি ঘোড়াও অনেকে মানসিক করেন। গাছের নীচে দেবীকে উৎসর্গ করা মাটির হাতি ঘোড়ার স্তূপ ও চোখে পড়ে।

কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী  | Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता
মা জয়চণ্ডী। পিতলকাটি গ্রাম।

আর্য ও অনার্যদের পুজিতা দেবী জয়চণ্ডী। বনদেবী চণ্ডীর আর্যীকৃত রূপই হলেন জয়চণ্ডী। একই দেবীকে ব্রাহ্মণ ও লোধা পুরোহিত পুজো করছেন এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। আসলে একসময়ে সাঁকরাইলের এই দিগপারই অঞ্চল ছিল অনার্যদের বাসভূমি অনেক পরে ব্রাহ্মণেরা এখানে প্রবেশ করেছেন। ফলে আর্য ও অনার্য সভ্যতা মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। অনেকে মনে করেন কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের এই তিন লৌকিক দেবদেবীর মধ্যে কালুয়াষাঁড় হলেন ভাই, দেবী জয়চণ্ডী হলেন বোন এবং গুপ্তমণি হলেন সকলের বড়দিদি।



এই পিতলকাটি বা পাথরকাটি গ্রামটির দক্ষিণ দিকে একটি নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। বৃটিশ আমলে নীলকরেরা নীলগাছ পচানোর জন্যে পাথর কেটে কেটে চৌবাচ্চা তৈরি করেছিলেন ও নীল মাড়াইয়ের স্থান তৈরি করেছিলেন তাই নাম পাথরকাটি। ল্যাটেরাইট পাথরে নির্মিত ছয়টি করে দুটো সারিতে মোট বারোটি চৌবাচ্চা, চুল্লি ও মাড়াইয়ের স্থান ছিল। ছিল সাহেবপুকুর। চৌবাচ্চার গায়ে প্রতিষ্ঠাকালের যে উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিল তাতে দেখা গিয়েছিল ১৮৮২ সালে নির্মিত।

কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী  | Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता
পিতলকাটি গ্রাম। পুকুরে জেগে থাকা পাথরের সিংহ মূর্তি।

তবে এই পিতলকাটি গ্রামটি পু্রাতাত্বিক দিক থেকেও বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। যে পুরাতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষটি এখানে পাওয়া গিয়েছিল সেটি হল প্রায় দুই একর আয়তন বিশিষ্ট এলাকায় মাকড়া পাথরের প্রাচীর ঘেরা প্রাচীন সৌধের এক ধ্বংসস্তপ। গ্রামের অধিবাসী কমল মাহাতো ওই ধ্বংসস্তুপের ওপরেই বাড়ি তৈরি করেছেন। মাটির নীচে থাকা স্তুপটি ১৯৭৭-৭৮ সালে একটি পুকুর খনন করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে। মাটির নীচে স্তরে স্তরে সজ্জিত মাকড়াপাথরের অসংখ্য ব্লক দেখতে পাওয়া যায়। পাওয়া যায় কারুকার্য খচিত মুগনি পাথরের কয়েকটি ফ্রেম। কতগুলি হাতি, ঘোড়া ও সিংহমূর্তিও পাওয়া যায়। মুগনি পাথরের কারুকাজ করা একটি সুন্দর ফ্রেমে দেখা যায় ফুলের নক্সার সাথে বুদ্ধ মূর্তি খোদাই করা যা কলকাতার ভারতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এক শরতের দুপুরে কমল মাহাতোর বাড়ি পৌঁছে জানা গেল উনি প্রায় পাঁচবছর আগে মারা গিয়েছেন। ওনার এক পুত্র ভবতোষ মাহাতো যাদুঘরে রাখা ফ্রেমটির ছবি দেখালেন। ওনার স্ত্রী সেই পুকুরটি দেখালেন যেটি খনন করার সময় অনেক মূর্তি পাওয়া যায়। ঝোপজঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত অব্যবহৃত পুকুরটির মধ্যে একটি বিরাটাকার পাথরের সিংহমূর্তি এখনও আছে। আরও কয়েকটি এমন মূর্তি আছে কিন্তু ঘন ঝোপজঙ্গলে যা অদৃশ্য। আর একটি উল্লেখযোগ্য জিনিস দেখালেন ওনারা তা হলো বাস্তুর মধ্যে অব্যবহৃত একটি বৃহৎ বেড়ের ইঁদারা। ভবতোষ বাবুর স্ত্রী বলেন ইঁদারাটি একদম নীচের তল পর্যন্ত মাকড়া পাথরের ব্লকে পরপর সাজানো এবং অবাক ব্যাপার কোথাও কোনও সিমেন্ট বা কোনও কিছুরই ব্যবহার নেই নির্মাণশৈলিতে। তবে ইঁদারার একদম ওপরের অংশটুকু কমল মাহাতো যখন সংস্কার করেছিলেন তখন পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে ছিলেন। ভবতোষ বাবুর স্ত্রী আরও বলেন সংস্কার করার সময়ে যে সমস্ত প্রত্নদ্রব্য উঠে আসে তার মধ্যে বেশ কিছু পুরাদ্রব্য সাঁকরাইল থানায় জমা পড়ে। ওনাদের বাড়ির সামনে গাছের তলায় একটি পাথরের মূর্তি এখনও পড়ে আছে তাও দেখা গেল। তালাই গ্রামে মুগনি পাথরে নির্মিত একটি দশহাতযুক্ত মূর্তিকে লোধা-শবরেরা বনদুর্গা হিসেবে পুজো করেন। তালাই গ্রাম, বেলেবেড়া, মানিকঝাটিয়াতেও বেশ কিছু পুরাবস্তু সেইসময় পাওয়া যায়।



তাই ক্ষেত্রসমীক্ষকেরা অনুমান করেন প্রত্নক্ষেত্রটি আয়তনে দু একর হলেও এর বিস্তার ছিল জয়চণ্ডী মন্দির থেকে কমল মাহাতোর বাড়ি হয়ে বেলেবেড়া, মানিকঝাটিয়া গ্রাম পর্যন্ত প্রায় দু কিমি।পু্রাতাত্বিকেরা অনেকে এটিকে অতীতের জৈন বা বৌদ্ধ বিহারের নিদর্শন বলেই মনে করেছেন। যদিও সঠিক ভাবে তা চিহ্নিত করা যায়নি। কারণ মানুষের উদাসীনতায় তা সমীক্ষার আগেই এবং যে সঠিক পদ্ধতিতে খনন করার দরকার ছিল তা না করার ফলে একপ্রকার বিলুপ্তই হয়ে গেছে।

কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী  | Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता
ভারতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত মুগনি পাথরের নকশা। পিতলকাটি গ্রামে খননে প্রাপ্ত।

ওই ধ্বংসস্তুপটি বৌদ্ধ অথবা জৈন বিহার ছিল এমন অনুমান কিন্তু অসঙ্গত নয়। কারণ আমরা ইতিহাস থেকে জানি সম্রাট অশোকের সময় উড়িষ্যায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটেছিল। সাঁকরাইল ও নয়াগ্রামের সীমান্ত থেকে কাছেই সুবর্ণরেখা নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মোগলমারির কথাতো আমরা জানিই। এছাড়াও ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুর থানার বিভিন্ন জায়গায় মাটির ভেতর থেকে বেশ কয়েকটি বুদ্ধ মূর্তি পাওয়া যায়। গোপীবল্লভপুরের কাছেই চিরকালডিহিতে কুঁয়ো খুঁড়তে গিয়ে যে বুদ্ধ মূর্তিটি পাওয়া গিয়েছিল ১৯৭৮-৭৯ সালে তা ভারতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।



অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন পিতলকাটির এই জয়চণ্ডী দেবী বৌদ্ধ মহাযানী তান্ত্রিক গোষ্ঠীর উপাস্য দেবতা দেবী উগ্রচণ্ডী। পাথরকাটির এই বিহার সম্ভবত মহাযানী তান্ত্রিক চর্যাশ্রয়ী বৌদ্ধদের বিহার ছিল। তাই এই পাথরকাটি সহ তালাই গ্রাম, কুলটিকরি, রোহিনী অঞ্চল জুড়ে নানা ধরণের সম্পূর্ণ ও ভাঙা চণ্ডী বা দুর্গা মূর্তি মাটির তলা বা পুকুরের তলা থেকে পাওয়া গেছে। কুলটিকরি শীতলামন্দিরে শীতলা মায়ের পেছনেই যে মূর্তিটি আছে তা কুলটিকরির কদমাপুকুর থেকেই পাওয়া।

কেলেঘাইয়ের উৎস অঞ্চলের তিন লৌকিক দেবদেবী  | Three folk deities near the source region of the river Keleghai | केलेघई नदी के स्रोत क्षेत्र के पास तीन लोक देवता
বৃহৎ বেড়ের ইঁদারার অংশ। পিতলকাটি গ্রাম।

আবার কোনও কোনও ইতিহাসবিদ মনে করেন একসময় এই দিগপারই এলাকাতে জৈন ধর্মের প্রাধান্য ছিল। তবে জৈনধর্মের প্রাধান্য যে একসময় সমগ্র জঙ্গলমহল জুড়ে কিছুটা ছিল তার তো বেশ কিছু প্রমাণ আছে। প্রাচীন জৈন গ্রন্থ আচারঙ্গ সূত্রে মহাবীর ও তাঁর শিষ্যদের রাঢ়দেশ পরিভ্রমণের উল্লেখ আছে। ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মতে "জৈন পুরাণের ঐতিহাসিকত্ব স্বীকার করিলে বলিতে হয় মানভূম, সিংভূম, বীরভূম ও বর্ধমান এই চারিটি স্থান নাম মহাবীর বা বর্ধমানের সঙ্গে জড়িত"। পার্শ্বনাথ স্বামীর পরে শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর বর্ধমানে আসেন ধর্মপ্রচারের জন্যে তাই তাঁর নাম অনুসারেই হয় বর্ধমান যা অনেকে অনুমান করেন। মেদিনীপুর ও জঙ্গলমহল এলাকার বেশ কিছু জায়গায় জৈন ধর্মের বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। কুলটিকরির অনতিদূরে কিয়ারচাঁদের বিভিন্ন গ্রামেও তো এখনও বেশ কিছু জৈন মূর্তি দেখা যায়। তাছাড়া অতীতের দিপাকিয়ারচাঁদ রাজ্যটির রাজা জহর সিংহের পাথু্রে সৈন্যদেরও পুরাতত্ববিদ তারাপদ সাঁতরা অনুমান করেছেন, ওগুলো ছিল দেউলাকার মন্দিরের ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি যা দেখা যায় পুরুলিয়ার টুইসামা গ্রামে এব়ং উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরের কাছে খন্ডগিরিতে জৈন মন্দিরের চত্বরে। আমাদের খুব কাছেই খড়্গপুরের কাছে জিনশহরও তো তার প্রমাণ।



দিগম্বর সম্প্রদায়ের লোকেরাই পরবর্তী কালে এই দিগপারই অঞ্চলে যুগী সম্প্রদায় হিসেবেই পরিচিত হন। এখনও যুগী নামে গ্রাম ও পুকুর আছে এই এলাকায়। এই দিগপারই পরগনায় আছে যুগীশোল গ্রাম। কাল্লই গ্রামে শিব মূর্তি বলে যা পুজো হয় তা আসলে দিগম্বর জৈনমূর্তি। এই দিগপারই এলাকাতেই জৈনধর্মের পরে অঘোরপন্থী বা তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের প্রাধান্য দেখা যায়। কারণ এই অঞ্চল ছিল একসময়ে অনার্য প্রধান, ছিল জঙ্গলে পরিপূর্ণ আর ছিল দস্যু তস্করের উপদ্রব। একসময় জয়চণ্ডীর মন্দিরে শক্তি উপাসনা ও নরবলি হতো। অন্য আর একটি ঐতিহাসিক মত হল বৌদ্ধ যুগের শেষ পর্যায়ে বৌদ্ধ ধর্ম নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। সেইসময় বৌদ্ধ মহাযান সম্প্রদায়ের এক অবক্ষয়িত অংশই নাথ যুগী রূপে সাঁকরাইলের নানা জায়গায় গ্রামের প্রান্তদেশে বসবাস শুরু করেছিল। এরা সমাজের নীচুতলার বাসিন্দা ডোম, হাড়ি, চণ্ডালদের মধ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছিল। এরাই নিজেদের নাথযুগী বলে পরিচয় দেয়। ঝাড়গ্রাম জেলায় শৈব-নাথ-ভৈরব-বৌদ্ধ-জৈন প্রভৃতি সম্প্রদায়ের পাশাপাশি এই অরণ্যাঞ্চলে কোল-দ্রাবিড় ও আর্য রক্তেরও সংকরায়ণ হয়েছে।

নদী বা স্বাভাবিক প্রবহমান জলধারাইতো জনপদ গড়ে তোলার প্রথম শর্ত। নদী তো লালন করে আমাদের। সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক তো নদীই। একদিন উৎস অঞ্চলের এই শীর্ণা কেলেঘাই নদীকে কেন্দ্র করেই তো গড়ে উঠেছিল আদিম অরণ্যচারী মানুষের জীবন। গড়ে উঠেছিল তিন লৌকিক দেব-দেবী মাহাত্ম্যপূর্ণ স্থান। তবে পরবর্তী কালে আর্য সম্প্রদায় এখানে বসতিস্থাপন করার পরে নদীর উৎস অঞ্চলে আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণে গড়ে উঠেছে এক মিশ্র সংস্কৃতির মেলবন্ধন। বিভিন্ন লৌকিক উৎসব করম, টুসু, বাঁধনা পরবের সঙ্গেই সাড়ম্বরে পালিত হয় দুর্গাপুজো, দীপাবলি। নদীই পারে বোধহয় এমন মেলবন্ধন ঘটাতে।


midnapore.in

(Published on 10.10.2021)
তথ্যঋণ:
১. সাঁকরাইল থানার কথা - সত্যেন ষড়ংগী।
২. মেদিনীপুরের ইতিহাস - দ্বিতীয় পর্ব। সংকলন, সম্পাদনা - কমল চৌধুরী।
৩. জৈনধর্ম: রাঢ় ও মেদিনীপুর - তারাপদ সমাদ্দার। মেদিনীপুরের ইতিহাস - দ্বিতীয় পর্ব। সংকলন, সম্পাদনা - কমল চৌধুরী।
৪. মেদিনীপুরের 'হাতি ধরা মা '- দীপঙ্কর দাস। মেদিনীপুরের ইতিহাস - দ্বিতীয় পর্ব। সংকলন, সম্পাদনা - কমল চৌধুরী।
৫. কেলেঘাই - মন্মথ নাথ দাস। মেদিনীপুরের নদ-নদী কথা। সম্পাদনা - তাপস মাইতি।
৬. সুবর্ণরেখা অববাহিকায় লোকায়ত সংস্কৃতি-বঙ্কিমচন্দ্র মাইতি।
৬. ধর্ম বিন্যাস - ড.মধুপ দে। জঙ্গলমহল কথা। সম্পাদনা - তাপস মাইতি।
৭. ঝাড়গ্রাম - ইতিহাস ও সংস্কৃতি। মধুপ দে।
৮. পাথরকাটি - ঝর্ণা আচার্য্য। মেদিনীপুরের গ্রামের কথা। সম্পাদনা - তাপস মাইতি।
৯. উইকিপিডিয়া।

বিশেষ কৃতজ্ঞতা:
১. বাদিনা গ্রামের -সুনীল মাহাতো, স্বপন মাহাতো, শ্যামল সহিস, কাকলি মাহাতো।
২. পাথরকাটি গ্রামের- ভবতোষ মাহাতো, সুরেন্দ্রনাথ মাহাতো।
৩. আলোকচিত্র: আনন্দরূপ নায়েক। চৈতালি কুণ্ডু নায়েক।