বাংলার পৌষ মাসের শেষে মহা সমারোহে অনুষ্ঠিত হয় পটাশপুর ও সবং-এর ঐতিহ্যবাহী তুলসী চারার মেলা। পটাশপুরের ও সবং-এর মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে কেলেঘাই নদী। ঝাড়গ্রাম থানার দক্ষিণ-পূর্বে (সাঁকরাইল থানার সীমান্তবর্তী) দুধকুন্ডী গ্রাম পঞ্চায়েতে অবস্থিত বদিনা গ্রাম। এই গ্রামের ভূগর্ভ থেকে উৎসারিত মিষ্টি জলের এক অবিরাম প্রস্রবণই কেলেঘাই নদীর উৎস। সেই বদিনা গ্রাম থেকে আসা কেলেঘাইর আদরে মাখা পটাশপুর থানার গোকুলপুর গ্রামে নদীবক্ষে (কেলেঘাই) অবস্থিত বাকসিদ্ধ পুরুষ বৈষ্ণবসাধক গোকুলানন্দ বাবাজীর তুলসী মঞ্চ। গোকুলানন্দ বাবাজীর তুলসী মঞ্চকে কেন্দ্র করেই হয় এই মেলা।
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ছবিঃ অমলেন্দু নায়েক।
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ছবিঃ অমলেন্দু নায়েক।
সপ্তদশ শতকে চৈতন্য দেবের শুভাগমন ও পরে বৈষ্ণবাচার্য শ্যামানন্দ মহাপ্রভু এবং রসিকানন্দ'র বৈষ্ণব ধর্মে আন্দোলনের ফলে পটাশপুর, সবং, দাঁতন, নারায়ণগড় জনপদে কৃষ্ণভাবনার বিস্তার ঘটেছিল। এই রসিকানন্দ'র কাছে দীক্ষা নিয়েছিল পটাশপুরের পঁচেটগড়ের রাজ পরিবার। তাঁরা মহাপাত্র পদবি থেকে হয়ে যান দাস মহাপাত্র চৌধুরী।
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ছবিঃ অমলেন্দু নায়েক।
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ছবিঃ অমলেন্দু নায়েক।
অষ্টাদশ শতকে পটাশপুরের গোকুলপুরে গোকুলানন্দ বাবাজী বৈষ্ণবাচার্য রূপে বন্দিত। গোকুলানন্দর জন্মস্থান ছিল কেলেঘাইর ওপারে সবং-এর কোলোন্দা গ্রামে এবং পিতৃভূমি ছিল গোকুলপুরে। তিনি সংষ্কৃত শিক্ষালাভের জন্য হালিশহরে যান। সেখানে তিনি বৈষ্ণবসাধক রামানন্দ বাবাজি'র কাছে দীক্ষা গ্রহন করে বৈষ্ণবপুরুষ রূপে খ্যাতি অর্জন করেন। গোকুলানন্দ সবং-এর কোলন্দা গ্রামে নামকরা জমিদার পরমানন্দ ভূঞ্যার পন্ডিতের পদে যুক্ত ছিলেন। বেশির ভাগ সময়ে সাধন ভজনে ব্যস্ততার মধ্যে থাকতেন গোকুলানন্দ বাবাজি। জমিদার পরমানন্দের ছেলে বিপ্রসাদ গোকুলানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। পরমানন্দ তাঁর গুরুর বাসস্থানের জন্য জায়গা দান করেন কিন্তু গোকুলানন্দ বাবাজি সেখানে বসবাস করেননি। গোকুলানন্দ পৈতৃক ভিটাতে চলে যান। সেখানেই সাধনা করতে করতে সমাধিপ্রাপ্ত হয়ে যান।
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ছবিঃ অমলেন্দু নায়েক।
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ছবিঃ অমলেন্দু নায়েক।
জনশ্রুতি আছে গোকুলানন্দ বাবাজি তাঁর শিষ্য বিপ্রসাদ কে ডেকে বলেছিলেন পৌষ সংক্রান্তির রাতে যে ভক্ত নদীতে স্নান করে সেখান থেকে তিন মুঠা মাটি এনে তাঁর সমাধিতে দেবে তাঁর মনোস্কামনা পূরন হবে। তাই ভোর থেকে শুরু হয় পুন্য স্নান। আট থেকে আশি সব বয়সের মানুষ স্নান করেন কেলেঘাইর জলে।
The Kharagpur Post সংবাদপত্রের Editor নরেশ জানা জানিয়েছেন - "আমার বাবা (অমূল্য রতন জানা, বয়স, ৯২ বছর) বলেন, সবংয়ে অধিষ্ঠিত গোকুলানন্দের শিষ্য প্ৰশিষ্যরা ভোরে পবিত্র মকর স্নান সেরে গুরুর সমাধিতে মাটি দিয়ে এসে এপারে মিলতেন, সবাই মিলে পংক্তিভোজন ও কীর্তন করতেন। এভাবেই মেলার উৎপত্তি।"
দুই মেদিনীপুর ছাড়িয়ে জঙ্গলমহল থেকে বহু পুন্যার্থী আসেন গোকুলানন্দ বাবাজীর যোগ মঞ্চে মাটি দিয়ে পুজা নিবেদন করতে। অনেকে পুজার উপকরন হিসেবে চুন দান করেন। ভক্তরা বিশ্বাস করেন গোকুলানন্দের কৃপায় চর্মরোগ ও গোদরোগ সেরে যায়। গোদ সেরে যায় বলে গোকুলানন্দ বাবাজীকে অনেকে 'গোদের ঠাকুর' বলে। কোলোন্দায় ভূঞ্যাদের সপ্তম পুরুষ লক্ষন ভূঞ্যা বাবাজীর শেষ বংশধর জগবন্ধু দাসের একমাত্র বিধবা কন্যা চারুশীলা দেবী যোগমঞ্চে তুলসী গাছ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ছবিঃ অমলেন্দু নায়েক।
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ছবিঃ অমলেন্দু নায়েক।
তুলসী চারার মেলা দুটি খন্ডে বসে। পটাশপুরে গোকুলানন্দর নামাঙ্কিত গোকুলপুরের মেলা বা তুলসী চারার যাত এবং সবং-এ কোলোন্দার মেলা বা ভূঞ্যার যাত। দুটিই মিলিয়েই তুলসিচারার মেলা। ওম্যালি সাহেব তাঁর জেলা গেজিটিয়ারে তুলসী চারার মেলার কথা প্রসঙ্গে বলেছেন- "Another religious fair, called the Tulsi charar jat, is held annually.. some 4,000 to 5,000 persons come on the occasion and make offerings to the god Gokulananda."
২০০৮ সালে বন্যার পরে কেলেঘাই বাঁধ সংস্কারের ফলে ১৩-১৪ একর জায়গা জুড়ে মেলা বসে। আমাদের দাদু ঠাকুমারা বলতেন তুলসী চারার মেলায় ভীমরুল পোকার কামড় ও বাঘের ভয় থাকতো। তখনকার গোকুলানন্দের তুলসী মঞ্চের আশেপাশে জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। ধীরে ধীরে জনবসতি গড়ে ওঠায় বন-জঙ্গল পরিষ্কার হয়েছে। মাঝখানে কেলেঘাই নদী থাকায় যোগাযোগের জন্য তৈরী করা হয় কতগুলো অস্থায়ী বাঁশের সাঁকো। মেলা চলে আট দিন ব্যাপী। প্রাচীন এই মেলার নিরাপত্তার জন্য থাকে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তুলসী চারার মেলা পরিচালনা করেন সবং থানার দশগ্রামের দাসপাড়া। এই বছর কোভিড-১৯ পরিস্থিতির জন্য তুলসী চারার মেলা না বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ছবিঃ অমলেন্দু নায়েক।
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ছবিঃ অমলেন্দু নায়েক।
তুলসী চারার মেলায় ঘুরলে কী পাবেন ?
এই মেলার বিশেষত্ব হলো তুলো। বহুদিন আগে থেকেই এই মেলা নানা ধরনের তুলো কেনা বেচার জন্য বিখ্যাত। মেলার বিশাল অংশ জুড়ে বসে তুলোর দোকান। বৈষ্ণবদের জন্য এই মেলায় খোল (মৃদঙ্গ) বিক্রি হয়। এছাড়াও মাটির হাঁড়ি কলসি, লোহার সামগ্রী, শাক-সব্জির দোকান, মাছের বাজার, সবং-পটাশপুর ও নারায়নগড়ের পরিচিত মাদুর, অমর্ষি ও বাগমারির শঙ্খ, মিষ্টি দোকান, মুদি দোকান, ফলের দোকান, সোনা রুপার গহনার দোকান, ভাত রুটি খাওয়ার হোটেল, চুল কাটার সেলুন, কাপড়ের দোকান, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র,বই দোকান, পাখি বিক্রি (বেআইনি ভাবে), মেডিক্যাল ক্যাম্প, চারাগাছ বিক্রি, নাগরদোলা, ম্যাজিক শো প্রভৃতি।
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ছবিঃ অমলেন্দু নায়েক।
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ছবিঃ অমলেন্দু নায়েক।
কীভাবে যাবেন তুলসী চারার মেলা ?
হাওড়া থেকে খড়গপুর কিংবা মেদিনীপুর লোকাল ধরে বালিচক স্টেশনে নেমে পটাশপুর গামী বাসে দেহাটি ব্রীজে নেমে টোটোতে মেলা প্রাঙ্গণ। এছাড়াও পটাশপুর বালিচক রাস্তায় কনকপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে পূর্বদিকের পিচ রাস্তায় ৪ কিমি দূরে গোকুলপুর গ্রাম পেরিয়ে তুলসী চারার মেলা
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ছবিঃ অমলেন্দু নায়েক।
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ছবিঃ অমলেন্দু নায়েক।
এছাড়াও, এগরা-বাজকুল রাস্তায় টেপরপাড়া। টেপরপাড়া থেকে উত্তরে প্রায় ৫ কিমি দূরে পাথরঘাটার সিংলাইমোড়। সিংলাই মোড় থেকে ভটভটি নৌকায় চেপে যেতে পারেন অথবা তেঁতুলিয়া খেয়াঘাটের (বেহুলার খেয়া) বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে ২ কিমি দূরে তুলসী চারার মেলা।
তুলসী চারার মেলা (পটাশপুর ও সবং)। ভিডিওঃ অমলেন্দু নায়েক।