রামগড় গ্রামের কথা , Ramgarh, ਰਾਮਗੜ, रामगढ़, Chandrakona, Paschim Medinipur

মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায়

Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय

মন্টু পান।


গুরু নানক জী ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের জন্য দুই অনুচর বালা এবং মর্দানা কে সঙ্গে নিয়ে পাঞ্জাব থেকে পুরী যাবার সময় যে যে স্থানে বিশ্রাম নিয়েছিলেন প্রায় সেই সমস্ত স্থানেই গুরু নানকের বড় পুত্র শ্রীচন্দ দেব একটি করে উদাসীন মঠ বা আখড়া স্থাপন করেছিলেন। বাঁকুড়া শহর থেকে কিছু দুরে দুর্গাপুর রোডের উপর একটি গ্ৰামে বেলবনী আশ্রম, যেখানে আছে উদাসীন সম্প্রদায়ের একটি মঠ। আবার বিষ্ণুপুর শহরের সংলগ্ন দক্ষিণ দিকে বড় রাস্তার উপর বিশাল আয়তনের আরেকটি উদাসীন মঠ নাম 'তুড়কী মঠ'।


মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় । ছবিঃ অনির্বান পান।

গুরু নানকের জন্ম ১৫ এপ্রিল ১৪৬৯ খৃষ্টাব্দ। যখন উনি চল্লিশ বছরের তখনই মেদিনীপুর হয়ে পুরী যাবার পথে ১৫১০ খৃষ্টাব্দের জুন মাসে চন্দ্রকোনাতে এসেছিলেন এবং কয়েক দিন অবস্থান করেছিলেন। শিখ ধর্মগ্ৰন্থে গুরু নানক দেবের অমুল্য বানী ছাড়াও উনার ভারত ভ্রমণ কাহিনীর কথা গুরুমূখী ভাষায় লেখা আছে। সেখানে পরিস্কার উল্লেখ করা হয়েছে চন্দ্রকোনার রামগড় গ্ৰামের কথা। এই গ্ৰামে তিনি, তিন চার দিন অবস্থান করেছিলেন।



গুরু নানক দেবের দুইটি পুত্র সন্তান ছিলেন। বড় শ্রীচন্দজী, ছোট শ্রীলক্ষ্মীজী। এই বড় পুত্রটি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে উদাসীন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করেন। শ্রীচন্দ জন্ম গ্ৰহণ করেন ১৪৯৪ খৃষ্টাব্দে। কথিত আছে ইনি প্রায় ১৩৫ বৎসর যাবত লীলা করেছেন, যা মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। কেউ কেউ মনে করেন ইনি মারা যাননি, আবার কেউ কেউ মনে করেন ইনি ১৬২৯ খৃষ্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। এই দীর্ঘ সময়ের পরেও বেশ কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। কয়েকজন শিখ ধর্ম গুরু ইনার ঐশ্বরিক ক্ষমতা দেখে তাদের কাছের মানুষ এমনকি নিজের পুত্রকেও ইনার সেবায় নিয়োজিত করেন। বহু পরেও ১৬৫৫ খৃষ্টাব্দে গুরু অর্জন সিং ইনার দেখা পেয়েছেন। গুরু অর্জন সিং দেখা করে নিজের মনের কথা বলেন। আমি গুরু নানকের বাণী সংগ্ৰহ করে লিখতে চাই, আপনি আশির্বাদ করুন এবং আপনার কাছে যদি হাতে লেখা কিছু থাকে সেটা দয়া করে আমাকে দিন। শ্রীচন্দ দেব ইনার মনের আশা পুরণ করেন। তখন গুরু অর্জন সিং নিজের পুত্রকে শ্রীচন্দ জীকে দিয়ে দেন। আরো আগে গুরু অমর সিং তার বড় পুত্রকে ইনার নিকট থেকে সেবা ও তপস্যা করতে বলেন। প্রভুত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এই শ্রীচন্দ দেব। ইনার ছোট ভাই শ্রী লক্ষীজী শিকারি হয়ে বনে বনে পশু পাখি শিকার করে বেড়াতেন। শ্রীচন্দ একবার ভাইকে নিষেধ করেন। কাজ না হওয়াতে আরো কয়েক বার নিষেধ করেন। তাতেও যখন লক্ষ্মী কথা শুনছেন না তখন শ্রীচন্দ বলেন এর খেসারত একদিন তোকে দিতে হবে।


মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় । ছবিঃ অনির্বান পান।


মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় । ছবিঃ অনির্বান পান।

জনশ্রুতি যে, বেশ কয়েকটি বছরের পর হটাৎ একদিন শ্রী লক্ষ্মীর পুত্র ও স্ত্রী বিপদে পড়ে আকাশ মার্গে চলে যাচ্ছেন। গুরু নানকের বংশ থাকবে না। এদের বাঁচাতে হবে এই অনুরোধ নিয়ে শ্রীলক্ষ্মী ও বহু শিখ সহ শিখ গুরু এই শ্রীচন্দ দেবের কাছে আসেন। সবকিছু শুনে শ্রীচন্দ দেব মাটিতে বসেই নিজের বামহাত আকাশের দিকে তুলে ধরেন। দেখতে দেখতে হাতটি অনেক লম্বা হয়ে আকাশ মার্গে থাকা শ্রী লক্ষ্মীর পুত্রকে জীবিত অবস্থায় নামিয়ে আনেন। এই শ্রীচন্দদেবের কথা লিখে শেষ করা যাবে না।


মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় । ছবিঃ অনির্বান পান।


মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় । ছবিঃ অনির্বান পান।

এই সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য অযাচক জীবন ধারণ করা। অনাহত ধ্বনি অনুসরণ করা। জীবের প্রধান জৈবিক চাহিদা খাদ্য গ্রহণ করা, ইনারা কোনো পরিস্থিতিতেই কাউকে খাদ্য চাইবেন না। জাগতিক সমস্ত বিষয়ে উদাসীন থাকা, কঠোর সাধনা করা ছাড়া অন্য কোনো বিষয় এনাদের ভাবনাতেই থাকে না। সমস্ত উদাসীন সম্প্রদায় আজও তাদের আদিগুরু/জগৎ গুরু শ্রীচন্দ জী বলেই জয়ধ্বনি দিয়ে থাকেন। ভারতের বিভিন্ন স্থানে উদাসীন সম্প্রদায়ের বহু মঠ আছে। হরিদ্বারে এদের মূল মঠ বা আখড়া আছে। প্রতি বছর কুম্ভ মেলায় চার সম্প্রদায়ের মধ্যে উদাসীন সম্প্রদায়ের বিশেষ ভূমিকা লক্ষ্য করার মতো। গুরু নানকের ছোট পুত্র শ্রীলক্ষ্মীজী সংসার জীবনে প্রবেশ করেন এবং কিছুটা নাস্তিক হয়ে শিকার করে বেড়ান। তার পরিনতি পূর্বে বলা হয়েছে। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে শ্রীচন্দ বরাবর অন্য সকলের মতো শিখদেরও সাহায্য করেছেন। এই গুরু নানক দেবের শিখ ধর্ম ও নানক পুত্র শ্রীচন্দর উদাসীন ধর্মের মিলন ভুমি ভারত বর্ষের একমাত্র স্থান মেদিনীপুর জেলার এই রামগড় গ্ৰাম। তবে এই ইতিহাস বেশি পুরানো নয়।


মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় । ছবিঃ অনির্বান পান।


মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় । ছবিঃ অনির্বান পান।

১৯৮৪-খৃষ্টাব্দে ইন্দিরা গান্ধী মারা যাবার পরের ঘটনা। যখন গোটা দেশ শিখ তথা পাঞ্জাবী নিধনে মত্ত হয়ে পড়ে, তখনই খড়গপুর থেকে বেশি বেশি এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু কিছু শিখরা এসে এই নির্জন উদাসীন মঠে আত্মগোপন করেন। এই মঠের মোহান্ত মহারাজ বাবা শরণ দাস ইনাদের আশ্রয় দান করেন। আশ্রয় হীনকে আশ্রয় দান করা প্রার্থিব মানুষের ধর্ম। শান্ত নির্জন মঠে বিশাল পাথরের প্রাচীর ছিল কিন্তু থাকার জন্য তেমন বাড়ি ঘর ছিল না। অসংখ্য বিভিন্ন প্রজাতির গাছ এবং ছোট্ট পোক্ত ঠাকুর মন্দিরও বেশ কয়েকটি সমাধী। যে গুলি এখনও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা সময় যেতেই শিখরা, শরণ দাস জীকে অনুরোধ করে পাকাপোক্ত ছোট দালান বাড়ি তৈরী করে। ১৯৮৬-খৃষ্টাব্দে প্রথম শিখেরা এই স্থানে বাড়ি নির্মাণ করে। পরে পরে প্রয়োজন বুঝে আরো দালান বাড়ি তৈরি হয়। এই সব দালান বাড়ি শরণ দাস জীর অনুমতি নিয়েই তৈরী করা হয়। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধী প্রধান মন্ত্রী হয়েই অডিন্যন্স জারি করেন। তাতে বলা হয় যেখানে শিখ ধর্মের ঝান্ডা ও গ্ৰন্থ সাহেব থাকবে সেটি গুরুদ্বোয়ারা। কোনো গুরুদ্বোয়ারায় কোনো রূপ অপারেশন বা জনগণের অত্যাচার বরদাস্ত করা হবে না, ভারতের সরকার এই দায়িত্ব পালন করবে। এই আদেশ বাবা শরণ দাস উদাসীনের জানা ছিল না। মঠের বাইরে দেশে কোথায় কি ঘটনা ঘটে চলেছে তার জন্য কোনো মাথাব্যথা উনার ছিল না।

মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
উদাসীন মন্দিরের বাইরের অংশ। ছবিঃ অনির্বান পান।

উদাসীন মঠে একটি করে ঝান্ডা লাগানো থাকে, এখানেও তাই ছিল। পতাকা পুরাতন হয়ে গেছে, পরিবর্তন করতে হবে। আরো বড় এবং ভালো পতাকা লাগিয়ে দিচ্ছি বলে উনার অনুমতি নিয়ে নেন খড়গপুর বাসিন্দা শ্রী খেয়াল সিং। জনরোষ ও গনধোলাই খেতে খেতে মনের মধ্যে এমনি ভয়ের উদ্ভব হয়েছে, যে কোনো উপায়ে তার থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে হবে। প্রয়োজনে কিছু মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলেও রাজী আছি, এই মতো চিন্তা ভাবনা, আর সেই মতো কাজও হয়ে যায়। বেশ কয়েকটি বছর পর শরণ দাস উদাসীনের শিষ্য এখানে এসে বিষয়টি লক্ষ্য করেন। উদাসীন ঝান্ডা ও শিখ ঝান্ডা প্রায় একই রকম দেখতে। আলাপ আলোচনা করে পুনরায় নতুন ভাবে আরো একটি উদাসীন সম্প্রদায়ের ঝান্ডা লাগিয়ে দেন।



মঠে দুইটি ঝান্ডা বিরাজিত হতে শুরু করেছে সময় টা ১৯৮৫- খৃষ্টাব্দ। দেখতে দেখতে আরো কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। শিখ সম্প্রদায়ের বিস্তার ঘটতে দেখে উনার শিষ্যরা চিন্তায় পড়ে যান। ভাবতে ভাবতে সকলে মিলে একটি উপায় স্থির করেন। শরণ দাস বাবা তাঁর ছোট শিষ্য কল্যান দাস কে রেজিস্টী দলিল দ্বারা পরবর্তী সেবাইত নিয়োগ করেন। যাতে করে উদাসীন সম্প্রদায়ের হাতেই এই মঠের দায়িত্ব থাকে। উদাসীন মঠে সংসারী মানুষের মতো স্ত্রী পুত্র পরিবার নিয়ে শিখ সম্প্রদায়ের বসবাস শুরু হয়ে গেছে। উদাসীন বাবা কল্যান দাস জীর ভালো লাগে না তাই এই উদাসীন সাধু ভারতের বিভিন্ন তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। তিনি আর ফিরে আসেন নি। একা শরণ দাস বৃদ্ধ বয়সে যখন অসুবিধায় পড়েন, তখন উনার গুরু ভাই পুরুষোত্তম বাবা তার এক চেলা, বৃন্দাবন কে পাঠিয়ে দেন। বৃন্দাবন দাস বেশ ভালোভাবেই শরণ দাস মহারাজের যত্ন ও খেয়াল রাখেন। খেয়াল সিং চক্রান্ত করে বৃন্দাবনের বিরুদ্ধে মনভারী করে তুলেছিলেন। বৃন্দাবন খারাপ সাধু তার সব কিছুই খারাপ ধীরে ধীরে শরণ দাসজীকে এটাই বুঝানো হয়েছে। এই কাজটি খেয়াল সিং ও তার সঙ্গী গন মিলে করেছেন। তবে শরণ দাসের মনের মধ্যে বৃন্দাবন কে ভালোবাসার প্রমাণ পরবর্তী সময়ে পাওয়া গেছে। এই ভাবে কিছুটা সময় যেতেই, শিখ সম্প্রদায় ক্রমাগত বয়স্ক বাবা শরণ দাসকে ভুল বুঝিয়ে কল্যান দাসকে দেওয়া রেজিস্ট্রি দলিল বাতিল করে, খড়গপুর বাসিন্দা খেয়াল সিং নামে জনৈক শিখ সম্প্রদায়ের নামে পুনরায় রেজিস্ট্রী ডিড ইংরেজিতে লিখিয়ে নেন। উনাকে চিকিৎসা করানো হবে ডাক্তার দেখাতে যেতে হবে বলে মঠ থেকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়।

মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
ধ্বুনি। ছবিঃ অনির্বান পান।

বৃন্দাবন গোপনে খবরাখবর রাখেন, জানতে পারেন রেজিস্টি অফিসে গিয়েছিল। শরণ দাস ইংরেজি লেখা ও পড়া জানতেন না। উনাকে বুঝানো হয়েছিল এখানে এসে যাতে শিখরা গ্ৰন্থ সাহেব পাঠ করতে পারেন। সেই জন্য রেজিস্টি অফিসে গিয়ে এই টুকু লিখে দিতে হবে। কোনো ভাবে বাধা দিতে পারবে না সেই সব লেখা আছে। সরল উদাসীন সাধু শরণ দাস তাই দলিলে বিনা ক্লেশেই স্বাক্ষর করেন। কিন্তু দলিলের মধ্যে যাবতীয় ভূ-সম্পত্তি খেয়াল সিং কে দেওয়া হলো লেখা ছিল। সত্য প্রকাশ হতে খুব বেশি সময় লাগলো না। শরণ দাস জীর সেবক বৃন্দাবন দাস জী দলিলের নকল বের করে সকলের নজরে বিষয়টি আনেন। তখনই বিরাট একটি সভা ডাকা হয় ঐ সভাতে শরণ দাসের উপস্থিতি তে খেয়াল সিং কেও উপস্থিত রাখা হয়েছিল। সভাতে স্থির হয় খেয়াল সিং কে দেওয়া দলিল বাতিল করে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে ঐ বোর্ডের সভাপতি উদাসীন সম্প্রদায়ের মোহন্ত যিনি এই রামগড় মঠে অবস্থান করবেন, তাকে করা হবে, বর্তমানে শরণ দাসজী ঐ পদে আসীন থাকবেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুনরায় রেজিস্টার সাহেব আনিয়ে কমিশন গঠন করে রেজিস্ট্রী দলিল করা হয় এই ঘটনা ঘটেছে ইংরেজীর ১৯৯৬ খৃষ্টাব্দে। এই সব ঘটনার পাশাপাশি শিখরা অনেকগুলো বড় বড় দালান ও গুরুদ্বোয়ারা নির্মাণ করেছেন। উভয় পক্ষের মধ্যে ঐ সময় থেকেই কোর্ট মামলা মোকদ্দমা হয়েছে, যার নিস্পত্তি এখনো পর্যন্ত হয়নি।



এবার আবার ফিরে আসতে হবে সেই পনের শতক থেকে ষোলো শতক খৃষ্টাব্দে। শ্রীচন্দ জী প্রবর্তিত উদাসীন সম্প্রদায়ের এক জন উদাসীন সাধু নাম "বৈশাখী বাবা" প্রথম ১৫৬৯ খৃষ্টাব্দে, রামগড় গ্ৰামের নানক ভিটাতে আসেন। কঠোর তপস্যা করে তিনি মানুষ থেকে হয়ে উঠেন মহা মানব।ইনার তপস্যা দেখে তখন চন্দ্রকোনার রাজা, রাজ কর্মচারীদের দিয়ে ঐ স্থানীয় দেবত্তোর ভূসম্পত্তি দান করেন। শোনা যায় উনি জীবিতাবস্থায় নিব্বিকল্প সমাধী লাভ করেন। তখন চন্দ্রকোনা এলাকায় পাথর কেটে মন্দির তৈরী করা হতো। পাথরের মন্দির বহু বছর ঠিক থাকে। আজও "বৈশাখী বাবার" সমাধী মন্দির স্বমহিমায় দাড়িয়ে আছে । ভক্তরা প্রার্থনা করে এই সমাধীতে নিজের মনের শান্তি খুঁজে পায়। বৈশাখী বাবা নামে ইনি জনগণের কাছে অতি পরিচিত।

মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
বহু পুরানো উদাসীন সমাধী। ছবিঃ অনির্বান পান।

মঠের একদম পাশে অযোধ্যা মহল্লার কায়স্থ দম্পতি এই মঠের মধ্যে সাধনা করতেন। শুদ্ধভাবে এই দম্পতির সাধনা এবং উদাসীন সাধুর কৃপা দৃষ্টিতে চরম অবস্থায় উঠেছিলেন। এই দম্পতি আশা করেছিলেন দুই জনে একস্থানে একসঙ্গে এই নশ্বর দেহত্যাগ করতে চান। যেমন চাওয়া তেমনটিই ঘটে। উনাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে অযোধ্যা গ্ৰামের মানুষ একটি স্মৃতি বেদী স্থাপন করেন। এ বেদীতে নিদৃষ্ট দিনে পূজা প্রার্থনা হয়। এই স্মৃতি বেদী সতীলক্ষ্মী নামে মানুষের মধ্যে পরিচিত।



এই ক্রমেই ক্রমাগত ১/বাবা রামদাস উদাসীন ২/বাবা গুরুমূখ দাস উদাসীন ৩/ বাবা গোপাল দাস উদাসীন ৪/ বাবা সন্ত দাস উদাসীন৫/ বাবা মাধব দাস উদাসীন ৬/ বাবা প্রেম দাস উদাসীন ৭/ বাবা হরিভজন দাস উদাসীন ৮/ মৌনী বাবা উদাসীন ৯/ বাবা বুদ্ধন দাস উদাসীন ১০/বাবা শরণ দাস উদাসীন ১১/ বাবা হরিকৃষণ দাস উদাসীন ১২/বাবা নরসিং দাস উদাসীন ১৩/বাবা শীতল দাস উদাসীন। এই সব উদাসীন সম্প্রদায়ের সাধু সন্তগন এই মঠের মধ্যে নিজেরা সাধন ভজন করেছেন এবং মঠের মধ্যে বিষ্ণু শিব সহ রাম সীতা রাধা কৃষ্ণ ইত্যাদি বিভিন্ন ঠাকুরের সেবা পূজা করে আসছেন। এই সমস্ত সাধু মোহান্তদের অনেক গুলি বহু পুরাতন সমাধী লক্ষ্য করা যায়। শোনা যায় এই সব উদাসীন মোহন্তরা প্রচণ্ড ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। মৌনী বাবা দুরারোগ্য ব্যাধি উপশম ও সম্পূর্ণ আরোগ্য করে তুলতেন। কেউ কেউ বাক্ সিদ্ধ ছিলেন, মুখে যা বলে দিতেন তাই হয়ে যেতো শোনা যায়। কেউ কেউ হট্ যোগী ছিলেন। যোগ সাধনার বলে হটাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতেন।

মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
বাবা শরণ দাস উদাসীনের সমাধী। ছবিঃ অনির্বান পান।

কথিত আছে ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে বাবা রামদাস উদাসীন যখন এখানে এসে তপস্যা শুরু করেন তখনই ইংরেজ কোম্পানি জমিদারী ব্যবস্থা সবে শুরু হয়েছে। মেদিনীপুর জমিদারী কোম্পানির কোনো একজন ইংরেজি সাহেব রামদাস বাবার কঠোর তপস্যা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। রামগড় নানক অস্থল তথা উদাসীন অস্থল সেবক রামদাস উদাসীনের নামে, বগড়ী পরগনার অর্ন্তগত বেশ কয়েকটি মৌজার ভূ সম্পত্তি হস্তান্তর করে ইনাকে দান করেন। রামগড় ,কাদড়া, কড়শা,লোছনগড় প্রভৃতি মৌজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এর বেশ কয়েক বছর পর যখন বাবা মাধব দাস এই মঠের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তপস্যা করছেন তখন বর্দ্ধমান রাজা পুনরায় চন্দ্রকোনা সহ পাশাপাশি কয়েকটি মৌজায় ভূসম্পত্তি দান করেন। শ্রীনগর ঢোকার পূর্বে একটি বিরাট বড় পুকুর ও দিয়েছিলেন। শোনা যায় গরমকালে পাঁচটি কাঠের ধূনী জ্বালিয়ে তার মধ্যে অনাহারে দিন রাত কঠোর তপস্যা করতেন। শীতের সময় নানক পুকুরে নাক পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে অনাহারে অনুরূপ কঠোর তপস্যা করতেন। আগুনের মধ্যে তপস্যাকে পঞ্চতপা এবং জলের মধ্যে তপস্যা কে জলশায়ণ বলা হয়।



মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা মানুষ !!! বেশ কিছু অসৎ মানুষের চক্রান্তে বাবা প্রেম দাস উদাসীন এর সময় বহু ভূ সম্পত্তি হস্তান্তর হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন বাবা প্রেমদাস একটু অন্য প্রকৃতির উদাসীন ছিলেন। সেই কারণে দুষ্টমতি মানুষের সুবিধা হয়েছিল। যখন মৌনী বাবা এখানে ছিলেন, তখন নাড়াজোল রাজা উনার সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে আসেন। মৌনী বাবা মৌনতা অবলম্বন করে থাকেন, কারো সঙ্গে কথা বলেন না। রাজা নিজের পরিচয় দিয়ে বহু চেষ্টা করেও কথা বলাতে পারেন নি। মৌনী বাবা ইসারা করে উনাকে অপেক্ষা করতে বলেন। বিষ্ণু -শিব মন্দিরের বারন্দার বাইরে দুজনে মিলে বসে আছেন। রাজার অনুচর গন দুরে বাইরে অপেক্ষা করছে। মন্দিরের ভিতরে শ্রী বিগ্ৰহ ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। হটাৎ মন্দিরের ভেতর থেকে নাড়াজোল রাজার মনের কথা এবং তার যথাযথ তাৎপর্য রাজার উদ্যেশে শব্দ ব্রম্ভ্রের দ্বারা রাজাকে প্রভাবিত করে। রাজা অতি প্রসন্ন হয়ে মঠের কাছাকাছি চন্দ্রকোনা শহরের সংলগ্ন রাধাবল্লভ পুর ও কুঁয়াপুর মৌজায় বেশ কিছু সম্পত্তি দান করেন।

মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
বৈশাখী বাবা সমাধী। ছবিঃ অনির্বান পান।

কিন্তু প্রার্থিব সমস্ত বিষয়ে এই সম্প্রদায়ের সন্তগন প্রকৃত পক্ষে উদাসীন থাকায়, বহু অসৎ মানুষ বেশিরভাগ সম্পত্তি হস্তান্তর করে নেয়। বর্তমানে কেবলমাত্র রামগড় মৌজায় এখনো পর্যন্ত কিছু সম্পত্তি আছে। তাও আবার শিখ বনাম উদাসীন ট্রাস্ট্রীর মধ্যে মামলা চলছে। কালের বিবর্তনে চন্দ্রকোনার বহু মঠ মন্দির ধ্বংস হয়ে গেছে। হয়তো বা এই প্রাচীন মঠের ভবিষ্যৎ এই শিখ সম্প্রদায়ের জন্য আরো অনেক বেশি সময় স্থায়িত্ব পাবে। কারণ যখন বাবা শরণ দাসকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে তখন উনি জানিয়েছিলেন - "ওরা যাই করুক এখানে করছে, এখন থেকে কিছু নিয়ে পালিয়ে যেতে পরবে না।" এখন এখানে মানুষ জন বেশি আশে ,উদাসীন দের এই সব ভালো লাগে না। তারা নির্জনে নিরালায় তপস্যায় লিপ্ত থাকতে ভালোবাসে। নানক জীর পদরজ সিক্ত এই ভূমিতে যদি শিখেরা গ্ৰন্থ সাহেব পাঠ করে তাতে ক্ষতি কি হবে। সব ধর্মের সার তো একটাই। ঈশ্বর কে জানা। নিজের মধ্যে ঈশ্বর কে খুঁজে পাওয়া।



এই শরণ দাস জীর দুটি সিদ্ধি ছিল। যার প্রমাণ বহু মানুষ পেয়েছিলেন। অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। মঠের সংলগ্ন অযোধ্যা মহল্লার একটি পাড়া মঠের একেবারেই পাশে রামরঙ্গীতে গ্ৰামের পিছিয়ে পড়া মানুষের সঙ্গে ইনার মাঝে মাঝেই ঝামেলা হতো। ঐ সমস্ত অবুঝ লোকজন ছুটে এসে মঠে অত্যাচার ঘটনার বারবার চেষ্টা করে বিফল হতো। ইনি অদৃশ্য হয়ে যেতন। লোকজন বিভ্রান্ত হয়ে স্থির ভাবে বেশ কিছু ক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে যখন মঠ ছেড়ে সরযূ খাল পেরোতে যায় ওমনি দেখে সাধু বাবা তাদের পাড়া থেকেই হাসতে হাসতে ফিরছেন। শোনা যায় বহু মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটলে ইনার কাছে এসে সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে ফিরেছেন। ইনি ১৯৯৬ খৃষ্টাব্দের শেষের দিকে ইহলোক ত্যাগ করেন।

মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
শিবলিঙ্গ মন্দির। ছবিঃ অনির্বান পান।

বর্তমানে মঠের আলোচনা করার পূর্বে এই উদাসীন মঠ ও গুরু দোয়ারা অবস্থান সংরক্ষণ বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। এ ব্যাপারে আমার মতো সামান্য মানুষের মধ্যে সেই ক্ষমতা নেই। পাঠক গন সুবিবেচনা করে পরামর্শ বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন। আমার মনের আশা উভয় সম্প্রদায়ের সম্প্রতি বাজায় রেখে নিজের নিজের মতো অবস্থান করুক। মঠের উত্তর দিকের অংশে উদাসীন। দক্ষিণ দিকে গুরু দোয়ারা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি প্রচীরের মধ্যে উভয় সম্প্রদায় নিজের নিজের কর্মসূচি পালন করছেন। প্রতি দিন নিয়ম করে ভোর থেকে শুরু করে চব্বিশ ঘন্টাই ধর্ম পালন করে। উদাসীন সম্প্রদায় বছরে কয়েকটি বিশেষ অনুষ্ঠান করেন। ভাদ্র মাসে এক মাস যাবৎ অখণ্ড হরিনাম যষ্ণ্য (সংকীর্ত্তন)। প্রতিদিন লীলা কীর্তন এবং হাজার হাজার মানুষের প্রসাদ পাওয়া (নিরামিষ আহার)।



প্রায় দশ কিলোমিটার জুড়ে তোলপাড় শুরু হয় ঐ হরিনামে। প্রতিদিন দূরদুরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। যার যেমন মনের ভাব তার তেমনি লাভ। গুরু দোয়ারা তে প্রতিটি পূর্নিমায় হাজার হাজার শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ উপস্থিত হয়ে প্রার্থনা করে। পূর্নিমার দুই দিন পূর্ব থেকে গ্ৰন্থ সাহেব পাঠ শুরু হয় চলে পূর্নিমার পর দিন পর্যন্ত। পাঠ চলে অখণ্ড ভাবে। পাঁচ শতাধিক বছর আগে গুরু নানক দেব যে অশ্বথ বৃক্ষের নিচে বসেছিলেন, সেটি পুরোপুরি পঞ্চবটি বৃক্ষ। পঞ্চবটি বৃক্ষটি দুই সম্প্রদায়ের মধ্যস্থলে রয়েছে। এই বৃক্ষের নিচে বসে কিছু প্রার্থনা করলে পূরণ হয়। বহু মানুষ প্রার্থনা করে কৃতকার্য হয়, এমনই শোনা যায়। উদাসীন সাধুদের সংরক্ষণ করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। উদাসীনরা ক্রমশ ক্ষয়িঞ্চু। তবে পৃথিবীতে জীবন সংগ্ৰামে সকলেই টিকে থাকতে চায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হবে না। পাশের কয়েকটি গ্ৰামে উদাসীন দের সংসারী শিষ্য আছে। তারা মাঝে মধ্যে মঠে আসে খোঁজ খবর নেয়, সাহায্য করে। যেটুকু জমি আছে তার স্বত্ত এখনো উদাসীনরা পেয়ে চলেছেন।

মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
হরেকিশন দাস বাবাজীর সমাধী। ছবিঃ অনির্বান পান।

ছেলে বেলায় মাঝে মধ্যে নানক অস্তলে যাতায়াত হতো। এই আশ্রমের পাশ দিয়ে যেতে হতো প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিভিন্ন ধরনের ফলের আশায় আমরা দল বেঁধে লুকিয়ে লুকিয়ে বোল্ডারের উচু প্রাচীর টপকে ঢুকে যেতাম। আম, বেল, লিচু, বেদনা, কামরাঙ্গা, আমলকি, কলা ,আনারস ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফল পাওয়া যেত। বহু বহু গাছ গাছালি ভরা এই উদাসীন মঠ। শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা গল্পে পড়েছিলাম। জন্ম ও শৈশব যে ক্বর্ণ মুনীর আশ্রমে হয়েছিল। ক্বর্ণ মুনির আশ্রম আর এই আশ্রম তার বর্ণনার হুবুহু মিলে যায়। বাংলা শিক্ষক দূর্গাচরন মিশ্র এই গল্পটি নিয়ে যখনই ক্বর্ণ মুনির আশ্রমের বর্ণনা করতে বলতেন তখনই ছেলে বেলার স্মৃতি টেনে এমন বলে দিতাম গোটা ক্লাস মুগ্ধ হয়ে যেতো। কেন যেন আমার মনে হয় এই বুঝি সেই ক্বর্ণ মুনীর আশ্রম। নির্জন শ্যমল বনানী ঘেরা ছোট্ট একটি ভূমি। একেবেকে এক দিকে বয়ে চলছে সরযূ খাল। সুদূর বিস্তৃত ধু ধু মাঠ, বহু দূরে গুটিকয়েক মানুষের বসবাস। অপরদিকে নীলাকাশ পেরিয়ে অস্ত যাওয়া রবি ঐ গহন বনে হারিয়ে যায়। শান্ত শীতল গাছের ছায়ায়, পাখির ডাকে অতি মনোরম পরিবেশ। অশান্ত হৃদয়ে মনে বেদনা নিয়ে কেউ খানিক সময় এখানে এসেই শান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে আসে। বিশাল বড় মঠের মধ্যে একটি মানুষ দিন রাত আপন মনে প্রতিনিয়ত রাম রাম করে। যারা দেখেছেন তারা স্মরণ করুন, যারা দেখন নি তারা অনুভব করুন, প্রতিটি শ্বাসে নিশ্বাসে প্রতিটি অবস্থায় কি ভাবে জিহ্বা রাম রাম করে তার প্রতিমূর্তি বাবা শরণ দাস। বেশিরভাগ সময় গাছের ফল খেয়ে কাটিয়ে দিতেন। প্রথম যখন উনি এখানে আসেন, এই নানক ভিটাতে তখন একটানা ৩৯-দিন কেবলমাত্র গাছের পাতা ফল এবং পুকুরের জল খেয়ে কাটিয়ে ছিলেন। তারপর মঠে কেউ এসেছে এটা একজন বুঝতে পারে। পুনাত্মা সুরেন্দ্র নাথ সাঁতরা ধামা ভরে চাল ডাল সহ যাবতীয় রান্নার সরঞ্জাম নিয়ে এসে হাজির হয়। মহারাজ এই গুলি গ্ৰহণ করুন, কতদিন না খেয়ে থাকবেন, ইত্যাদি বলে নিবেদন করেন। তখন ঐ উদাসীন নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন - "বাবা ব্রম্রদাস জী আমার গুরু। আমি শরণ দাস, আমাদের তো ভিক্ষা করা বা চেয়ে নিতে নেই, আমাদের বিশ্বাস ঈশ্বর প্রতিটি মানুষের কেন প্রতিটি জীবের জন্য সুন্দর ব্যবস্থা করে রেখেছেন। ঈশ্বরই তোমাকে এখানে টেনে এনেছে, নাহলে তোমার আশার ক্ষমতা কি।"



আমার খুব ছোট বেলার কথা একবার মনে আছে অনেক হাতি, ঘোড়া, উট নিয়ে বেশ কয়েক হাজার উদাসীন সাধু এসে কয়েক দিন ছিলেন। বিভিন্ন পোশাক পরিহিত, গায়ে ছাই-ভস্ম মাখা, মাথায় জটাজুট বিশালাকার বপু,কোমরে মোটা ধাতব শেকল, সরু কৌপিন ভিন্ন গোটা শরীর দীগম্বর। কারো কারো হাতে লোটা-কম্বল এবং বিরাট বিরাট চিমটা। আঠারো বিঘা জমি নানক কালা জুড়ে তাদের ভিন্ন ভিন্ন থাকা। এতো মানুষ কি সুন্দর নিয়ম শৃংখলা পরায়ন ভাবে প্রায় মাসাধিক কাল এখানে থেকে গেলেন। লোকের মুখে শোনা, এই দলকে জাউত এসেছে বলে ডাকতো। এনারা নাকি বার-বছর অন্তর আসেন। হ্যাঁ সত্যি কথা ঠিক ১২-বছর পর ১৯৮১-খৃষ্টাব্দে পুনরায় এই জায়গায় এসেছিল। এবার হাতি ঘোড়া, উঠ সংখ্যা কম ছিল তবে অনেক গুলি ভিন্ন ধরনের মোটর যানও এসেছিল। উদাসীন সন্ত (সাধু) সংখ্যা প্রায় দুই হাজার মতো। রূপের বর্ণনা ঠিক আগের মতো। জটাজুট মাথায়, যখনই নানক পুকুরে ডুব দিয়ে স্নান করে, উঠতে উঠতে ঐ জটা খুলে নিংড়ে নিতে দেখেছি। জটা লম্বায় দশ ফুটের বেশিও আছে। যাদের বেশি লম্বা জটা তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে দেখেছি অন্য জনকে। স্নান সারা হবার পর গোটা শরীরে ছাই-ভস্ম মাখা। বেশিরভাগ সাধু ধ্যান জপের পর কেবলমাত্র দুধ ঘি পান করেন। খুব সামান্য পরিমাণ সাধু অন্ন বা মিষ্টান্ন সাকার খাদ্যে গ্ৰহণ করতেন। ইনাদের যাবতীয় দায়িত্ব শরণ দাস বাবার। প্রতিটি সাধু পৃথকভাবে ধ্বুনি জ্বালিয়ে তার কাছে বসে তপস্যা করতেন। না তাদের জাগতিক বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা, না প্রার্থিব লালসা, জপ ধ্যানে মগ্ন থাকায় সময় অতিবাহিত করা। বেদনা যাতনাক্লিষ্ট কোনো মানুষ উপস্থিত হয়ে কাতর আবেদন করলে কখনো কখনো কোন সাধুর কৃপা দৃষ্টিতে তাদের যাতনা লঘব করেন।

মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায় | Udasin and Sikh Community of Chandrakona, Medinipur | मेदिनीपुर का उदासीन और सिख समुदाय
মেদিনীপুরের উদাসীন ও শিখ সম্প্রদায়। ছবিঃ অনির্বান পান।

আমার লেখা কখনোই ভালো হয় নি। যখন কেবল লেখাপড়া নিয়ে ছিলাম তখন পরিক্ষার খাতায় ঠিক গুছিয়ে না লিখতে পারায় বরাবর নম্বর কমে যেতো। অংক ও বিজ্ঞান ছাড়া সবেই মাথায় মাথায়। বাড়ির লোকজন বকাঝকা করলেও আমার পরিবর্তন হয় নি। এখন এই বয়সে অরিন্দম বাবুর তাড়া পেয়ে আমার ভেতরের অজানা কোন শক্তি আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল, আমার গ্ৰামের সত্যি ঘটনা।



midnapore.in

(Published on 17.01.2021)