রাকেশ সিংহ দেব।
Home » Medinikatha Journal » Rakesh Singha Dev » Termitomyces microcarpus
কোভিড সংক্রমণের কারনে বন্ধ ভ্রমণ। নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ঘোরাঘুরি। কিন্তু থমকে নেই জীবন। চেনা ছকের বাইরে এই দীর্ঘ বন্দীকালে সে খুঁজে নিয়েছে বেঁচে থাকার ‘নিউ নর্মাল’ পথ। স্কুলে বাচ্চাদের পঠনপাঠনের কাজ বন্ধ থাকলেও বন্ধ নেই তাদের মাসিক বরাদ্দ রেশন এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ পৌঁছে দেওয়ার কাজ। গ্রামীণ এলাকার দোকান হাট এখনও স্বাভাবিক নয়। গন পরিবহণ মাধ্যমগুলি অনিয়মিত থাকায় রয়েছে বড় শহর বাজারে আসবার অসুবিধা। কিন্তু এখানকার মানুষের রসদের তেমন অভাব নেই। সরকারি রেশনের পাশাপাশি প্রকৃতি দেবীও যেন সদয় তাঁর আপন সন্তানদের ক্ষুন্নিবৃত্তির সহায় হিসেবে। জঙ্গলের বিভিন্ন ছাতু (wild mushroom), খাম আলু, বন কুঁদরি, বন পেঁয়াজ, বুনোফলের বিভিন্ন খাদ্যসম্ভার এবার বেশ স্বচ্চল। এমাসের বরাদ্দ রেশন অভিভাবকদের মধ্যে বিলি করে স্কুল ছাড়িয়ে কিছুটা যেতেই চোখে পড়ল মোরাম রাস্তার ধারে আমারই কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্র ঝোপের ভেতরে কি যেন সংগ্রহ করে বাঁশের কুলোয় রাখছে। বাইক দাঁড় করিয়ে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে বলল, উই মাকা থেকে ছাতু কুড়োচ্ছি স্যার! সামনে গিয়ে দেখি লাল মাটির এক ছোট্ট উই ঢিবির গায়ে ছাতুর আকারে ফুটে রয়েছে স্বাদের মুক্তো দানা!
বর্ষাকালে জঙ্গলমহলের বৃষ্টি ধোয়া ভিজে স্যাঁতসেঁতে মাটিতে বিভিন্ন রকমের জংলি ছাতুর (ছত্রাক) দেখা মেলে - যার চাহিদা সারা জঙ্গলমহলের বাজার হাটে চোখে পড়ে। প্রাকৃতিক স্বাদে অতুলনীয় এই ছাতু ইলিশ ছাড়াও চিকেন-মাটনকেও হার মানায়। বাজারে ছাতু এলে তাই আজও মাছ মাংস বিক্রেতাদের ব্যবসায় মন্দা পড়ে। প্রকৃতি মায়ের আশীর্বাদে এখানকার লাল ল্যাটেরাইটে যে সমস্ত সুস্বাদু ছাতু পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হল উই ছাতু বা ছোট বালি ছাতু (Termitomyces microcarpus)।
উই ঢিবিকে আমরা জঙ্গলমহলের মানুষ ‘মাকা’ বলে থাকি তাই এই ছাতুকে মাকা ছাতুও বলা হয়। ঢিবির উপরকার সরু বালিযুক্ত মাটি বর্ষার জলে ভিজলেই প্রাকৃতিকভাবে ঢিবির গা ভর্তি হয়ে যায় মুক্তার মতো সাদা ছাতুতে। হালকা বৃষ্টির জল উই ঢিবির উপর পড়লে ঢিবি উপরিস্থিত ছাতুর স্পোরগুলি অঙ্কুরিত হয়ে হাজার হাজার সাদা রঙের ছোট ছোট ছাতুর সৃষ্টি হয়। এই ছাতুর উপরি অংশ ছোট গোল ছাতার মতো মেলা যা সরু এক দণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত। ছাতার উপরিভাগ মসৃণ এবং নীচের দিকটি মাছের কানকোর মতো খাঁজকাটা হয়। আবার অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে উইঢিবি ধুয়ে যায় এবং স্পোরগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ঢিবির উপর থেকে হাতে করে ধীরে ধীরে তুলে আনতে হয় এই ছাতু। খুব নরম হওয়ার কারনে এই ছাতু বেশি নাড়াচাড়া করলে ভেঙে যায় এবং বেশিক্ষণ ফেলে রাখলে নষ্ট হয়ে যায়। এই কারণে এই ছাতু সহজে বাজারের মুখ দেখতে পায়না তাই বেশিরভাগ মানুষ এর স্বাদগ্রহণে বঞ্চিত থেকে যায়।
উই ছাতু জঙ্গলমহলের মায়েরা খুব সাধারণ ভাবে সামান্য উপকরণে রান্না করে থাকে। উপকরণের প্রাচুর্য না থাকলেও পরম্পরার স্বাদ মেশানো তাদের হাতের জাদুতে ছাতুর স্বাদ হয়ে উঠে স্বর্গীয়। এই ছাতু রান্না হয় মূলত দুটি উপায়ে। প্রথমত, ছাতু ভালোভাবে পরিস্কার করে নুন, হলুদ, জিরা, লঙ্কা মাখিয়ে নামমাত্র সরষের তেল দিয়ে সেই মিশ্রণ টিনের বাটিতে কম আঁচে বসিয়ে বাটিপোড়া হিসেবে। দ্বিতীয়ত, সেই মিশ্রণ কাঁচা শালপাতায় ভালোভাবে মুড়ে নিভন্ত উনুনের আঁচে গুঁজে দিয়ে আংরা পোড়া হিসেবে। ছাতু রান্নার স্বাদ বাজার চলতি গুঁড়ো মশলার পরিবর্তে শিলে বাটা মশলায় খোলে ভালো। স্বাদকোরক স্পর্শ করে এই স্বাদ খুঁজে নেয় হৃদয়ের গলিপথ। যারা এখনও এই প্রাকৃতিক ছাতুর স্বাদগ্রহণ করতে পারেননি তাদের নোলার তালিকায় এখনও অনেক কিছু বাদ রয়েছে। চোখের সামনে টিলা আলো করে থাকা ছাতুর মেলা দেখে জিভে জল আর মনে লোভ জমেছিল একথা বললে খুব মিথ্যে বলা হবে। দীর্ঘদিন পরে শৈশবের সেই অমৃত স্বাদের ছাতু দেখে জিভে জল এলেও, ওদের ছাতু নিয়ে যাওয়ার আন্তরিক আবদার হাসিমুখে না জানিয়ে বললাম - এবার তোরা খা, পরের বার আমার পালা।
সাধারণ নাম : উই ছাতু/টিলা ছাতু/ মাকা ছাতু/ ছোট বালি ছাতু/ঝরি চাও
বিজ্ঞানসম্মত নাম : Termitomyces microcarpus
উপযুক্ত পরিবেশ : বর্ষাকালে। একটি বা একসঙ্গে অনেকগুলি উইটিপিতে বা মাটিতে জন্মায়। কখনও কখনও উই ঢিবির পাশে বালি মাটিতেও হয়।
কোথায় পাওয়া যায় : মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম সহ সমগ্র জঙ্গলমহল তথা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় পাওয়া যায়।
টুপি : ১-২ সেমি ব্যাসের, ছোট, মাঝখান উঁচু ঢিবির মতো, ছড়ানো, কিনারা গোলাপী ও মাঝের ঢিবির মতো অংশ বাদামী, মসৃণ।
ডাঁটা : টুপির নীচে মাঝ বরাবর জোড়া, সরু, ৩-৫.৫ সেমি লম্বা, গোড়ার দিকে সামান্য চওড়া।
গিলস : মুক্ত, ঘন, সাদা ৷
রেনুর ছাপ : সাদা বা কালচে হলুদ।
midnapore.in