মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মহাপ্রভু শ্যামানন্দের বৈষ্ণব আন্দোলন
Vaishnava Movement by Mahaprabhu Shyamananda over a vast area of Medinipur
সুদর্শন নন্দী।
বাংলাদেশে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব এবং পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে ভক্তি আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। খৃস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্যদেব যখন মেদিনীপুর ও খড়গপুর হয়ে জগন্নাথধাম পুরীতে যান তখন এসব অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন। চৈতন্যদেবের এই ভক্তি আন্দোলনের ঢেউয়ে আন্দোলিত হয়েছিল সমগ্র মেদিনীপুর অঞ্চল। পরবর্তীকালে বৈষ্ণবদের মধ্যে গোষ্ঠীবিরোধ দেখা দিলে সেই বিরোধ থেকে পরিত্রাণ পেতে সক্রিয় ভূমিকা নেন এখানকার পরম বৈষ্ণব শ্রীশ্রী শ্যামানন্দ। আর মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের পর যে তিনজন বৈষ্ণব প্রভুর আবির্ভাব হয় শ্রীশ্রী শ্যামানন্দ তাঁদের একজন। অন্যেরা হলেন শ্রীনিবাস ও নরোত্তম ঠাকুর। শ্রীনিবাস মধ্যবঙ্গে এবং শ্যামানন্দ দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গে ভক্তি আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন।
মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মহাপ্রভু শ্যামানন্দের বৈষ্ণব আন্দোলন | Vaishnava Movement by Mahaprabhu Shyamananda over a vast area of Medinipur | Photo Courtesy : Dr. Demian Martins
শ্যামানন্দ অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ধারেন্দা গ্রামে ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামটি খড়গপুরের কলাইকুণ্ডার কাছে অবস্থিত। তবে অনেকের মতে তাঁর জন্মস্থান ছিল দণ্ডেশ্বর নামে গ্রামে। কিন্তু আজও ধারেন্দাতে শ্যামানন্দের আবির্ভাবতিথি পালিত হয় এবং নিত্যসেবা হয় (এই নিবন্ধকারও গিয়ে দেখে এসেছেন)। শ্যামানন্দের পিতার নাম ছিল শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল ও মাতার নাম ছিল দুরিকাদেবী। জাতিতে সদগোপ শ্রীকৃষ্ণ মণ্ডল ছিলেন খুবই কৃষ্ণভক্ত। শ্যামানন্দের বাল্যকালের নাম ছিল দুখিয়া। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর ছিল কৃষ্ণপদে মন। বৈষ্ণবকথা ও কীর্তন শুনলেই তাঁর চোখ বেয়ে নেমে আসত প্রেমাশ্রু। খুব কম সময়ের মধ্যে তিনি ব্যাকরণ শাস্ত্রাদি পাঠ শেষ করেন এবং বৈষ্ণবসঙ্গ লাভ করেন। মনে নেমে আসে বৈরাগ্য ভাব। এরপর তিনি দীক্ষা নেন হৃদয়চৈতন্য প্রভুর কাছে। হৃদয়চৈতন্য ছিলেন গৌর নিত্যানন্দের প্রিয় পার্ষদ শ্রী শ্রী গৌরদাস পণ্ডিতের প্রিয় শিস্য । দীক্ষার পর দুখীর নাম হল কৃষ্ণদাস। এরপর বৃন্দাবনে শ্রীজীব গোস্বামীর কাছে দীক্ষা নেবার পর তাঁর নাম হয় শ্যামানন্দ। বৃন্দাবনে এলে তিনি শ্রীনিবাস আচার্য এবং নরোত্তম ঠাকুরের পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। পাঠ করেন ভক্তিশাস্ত্র গ্রন্থ। শ্রীজীব গোস্বামীর আদেশে এবার শ্যামানন্দ মেদিনীপুর অঞ্চলে ধর্মপ্রচারে মন দেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হয়। শ্রীজীব গোস্বামী গৌড়ে বৃন্দাবন থেকে অনেক বৈষ্ণবগ্রন্থ পাঠাচ্ছিলেন। এ কাজে নিযুক্ত ছিলেন শ্রীনিবাস আচার্য, নরোত্তম ঠাকুর, শ্যামানন্দ।
কিন্তু মল্লভুম ( আজকের বিষ্ণুপুর ) পার হবার সময় সেসব গ্রন্থ সোনাদানা ভেবে লুঠ করে নিয়ে যায় রাজা বীরহাম্বিরেরে সৈন্যরা। সেই ঘটনায় সবাই বিহ্বল হয়ে পড়েন ও কাঁদতে থাকেন। শ্রীনিবাসের পরামর্শে শ্যামানন্দ ফিরে যান বৃন্দাবনে। পরে সেসব বৈষ্ণবগ্রন্থ উদ্ধার হয় এবং রাজা বীরহাম্বির বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন। সে আরেক কাহিনী। যাইহোক শ্যমানন্দকে শ্রীজীব গোস্বামী এবার উৎকল তথা আজকের মেদিনীপুর অঞ্চলে পাঠান বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করতে। শ্যামানন্দ সেই হরিনাম বিলানোর কাজ এতো পরিশ্রম সহকারে করেছিলেন যে হাজার হাজার মানুষ সামিল হয়ে গেলেন এই বৈষ্ণব আন্দোলনে। অসংখ্য মানুষ দীক্ষিত হলেন বৈষ্ণবধর্মে। এলাকার অসংখ্য জমিদার যাদের কাজ ছিল দরিদ্র শোষণ, অত্যাচার তারাও সামিল হলেন এই আন্দোলনে। শোষক শোষিতের ভেদাভেদ মুছে যেতে লাগল। এক সাম্যঅবস্থা দেখা দিল সমাজে। শ্যামানন্দের অক্লান্ত পরিশ্রমেই তা সম্ভব হয়েছিল। শ্যামানন্দের প্রধান শিষ্য হলেন রসিকানন্দ। সুবর্ণরেখা নদীর অদূরে রোহিণী গ্রামে রসিকানন্দের জন্ম হয় ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে। ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন ভাগবত অনুরাগী। দীক্ষিত হন শ্যামানন্দের কাছে। শ্যামানন্দ পেলেন এক আদর্শ ও ভক্তিপ্রাণ সহযোগী।
মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মহাপ্রভু শ্যামানন্দের বৈষ্ণব আন্দোলন | Vaishnava Movement by Mahaprabhu Shyamananda over a vast area of Medinipur | Photo Courtesy : Holy Dham
গুরুদেব শ্যামানন্দের সাথে তিনি বলরামপুর, বগড়ী, বসন্তপুর, চাকুলিয়া, ঘাটশিলা, বালেশ্বর প্রভৃতি তিনি বৈষ্ণবধর্ম প্রচারে মেতে ওঠেন। শ্যামানন্দের বৈষ্ণব আন্দোলনে অস্থির সমাজে ফিরে আসে সুস্থির ও শান্তির পরিবেশ। রাজা-প্রজা-জমিদার নির্বিশেষে সবাই মেতে ওঠেন ভাগবত প্রেমে। তাছাড়া বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণের ফলে আদিবাসী সম্প্রদায়েরও অসংখ্য মানুষ আপ্লুত হন ভাগবতপ্রেমে। শ্যামানন্দ ও তাঁর শিষ্যরা যে বিভিন্ন অঞ্চলে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেছিলেন তাঁর বিবরণ রয়েছে নরহরি চক্রবর্তী রচিত ভক্তি-রত্নাকর গ্রন্থে। রয়েছে গোপীজনবল্লভদাস রচিত শ্রীশ্রী রসিকমঙ্গল গ্রন্থে। এ বিষয়ে উল্লখ করা যেতে পারে যে গোপীজনবল্লভের পিতা রসময় দাস শ্যামানন্দের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। শ্যামানন্দের অন্যান্য শিষ্যের মধ্যে দামোদর যোগী ও পাঠানশাসক শের খাঁর নামও উল্লেখযোগ্য । জাতধর্ম নির্বিশেষে মানুষ বৈষ্ণবধর্মে আকৃষ্ট হবার ফলে এক আশ্চর্য সাধনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল এখানকার বিস্তৃত অঞ্চল। কমে গেল জাতপাতের নোংরামি। একলীন হয়ে গেল ব্রাহ্মণ- চণ্ডাল- মুসলমান সবাই। অন্যতম শিষ্য রসিকানন্দ পরে সুবর্ণরেখার অপর তীর গোপীবল্লভপুরে গোপীবল্লভজীউয়ের বিগ্রহ স্থাপন করেন। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের উপর তাঁর ( রসিকানন্দের) বংশধরেরা এখনো বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করে চলেছেন।
আসি প্রভু শ্যামানন্দের কথায়। ছোটাছুটি করে শরীর তাঁর ভেঙ্গে পড়েছিল। ১৬৩০ খৃষ্টাব্দের স্নানযাত্রার পূর্ণিমার ঠিক পরে কৃষপ্রতিপদের দিন নৃসিংহপুরগ্রামে তিনি চৈতন্যলোকে গমন করেন। শেষ হল বৈষ্ণব আন্দোলনের একটি অধ্যায়। শ্যামানন্দ বৈষ্ণব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে প্রেমের বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন , সমাজ সংস্কার করেছিলেন সেই সহবস্থান-সংস্কৃতি সহনশীলতা ও ভক্তিভাব আজও দেখা যায় মেদিনীপুর অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় ।
midnapore.in
(Published on 19.12.2020)
সহায়ক গ্রন্থঃ
১। মেদিনীপুরঃ তরুণদেব ভট্টাচার্য।
২। সারস্বত মেদিনীপুরঃ মেদিনীপুর গনতান্ত্রিক লেখক সমিতি
৩। মেদিনীপুর পুরাকীর্তিঃ তারাপদ রায়
৪। শ্রী শ্রী শ্যামানন্দ চরিতামৃতঃ শ্রী কানাইলাল পঞ্চতীর্থ।