উপমহাদেশের বিদ্যাসাগর (বাহার-উল- উলূম) :মওলানা ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী
The Vidyasagar (Baḥr al-ʿUlūm) of the subcontinent: Maulana Ubaidullah Al Ubaidi Suhrawardy
ওয়াহেদ মির্জা।
Home » Medinikatha Journal » Wyahed Mirza » মওলানা ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী
বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছাড়া আরও কয়েকজন 'বিদ্যাসাগর'(বাহার-উল-উলূম) উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়। 'বিদ্যাসাগর' উপাধিটি ঈশ্বরচন্দ্রের নামের সঙ্গে ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে এতটাই পরিচিতি পেয়েছে যে, কালের পরিক্রমায় বিদ্যাসাগর বলতে আমরা বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা ঈশ্বরচন্দ্রকেই বুঝি। কিন্তু একথা মনে রাখার প্রয়োজন,বৃহত্তর বাংলা ভূখণ্ডে এই উপাধিটির প্রয়োগ নতুন কিছু নয়। বহু আগে থেকেই এই উপাধির প্রয়োগ হয়ে আসছে। ঈশ্বরচন্দ্রের পূর্বে অন্তত তিন জন ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়, যারা ছিলেন এই বিদ্যাসাগর উপাধিধারী। এ সম্পর্কিত গবেষকরা হয়তো আরও এই উপাধি প্রাপ্তদের সন্ধান দিতে পারবেন।
ঈশ্বরচন্দ্র ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হিন্দু ল' কমিটি কর্তৃক একটি পরীক্ষা গ্রহণের পর এই বিদ্যাসাগর উপাধি প্রাপ্ত হন ১৮৩৯ সালের ১৬ মে। ১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে ব্যাকরণ,কাব্য,অলঙ্কার,বেদান্ত,স্মৃতি,ন্যায় ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন এবং সংস্কৃত কলেজে বারো বছর পাঁচ মাস অধ্যয়নের পর তিনি এই কলেজ থেকে অপর একটি প্রশংসাপত্র লাভ করেন। উল্লেখ্য,১৮৪১ সালের ১০ ডিসেম্বর মাসে তিনি দ্বিতীয় বারের জন্য 'বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ করেন।
মওলানা ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী৷
সাধারণত সংস্কৃত ভাষা সঙ্গে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে পান্ডিত্যের জন্য বাংলায় ১০ জনের বেশি বিদ্যাসাগর উপাধি যুক্ত নাম পাওয়া যায় এবং আরবি ও ফার্সি ভাষার সঙ্গে ইসলাম ধর্ম সমন্ধে পান্ডিত্যের জন্যও বাহার-উল- উলূম ( Ocean of knowledge) অনেক নাম দেখতে পাওয়া যায় বিশ্বজুড়ে৷ আরবি শব্দ "বাহার" কথার অর্থ মহাসগর আর ফার্সি শব্দ " উল- উলূম" মানে জ্ঞান বা বিজ্ঞান ৷বিশ্বজুড়ে বাহার উল উলূম নামে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম দেখা যায়৷ সম্ভবত এই উপাধির জন্ম ইরানে৷অবিভক্ত বাংলায় বাহার -উল -উলূম উপাধি যুক্ত নাম হল :বাহারুল উলুম হযরত শাহ মখদুম রূপোশ রহ:,বাহারুল উলূম আব্দুল আলি, বাহারুল উলুম মোল্লা মাজদুদ্দিন( কলকাতা মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক),বাহারুল উলুম ওবেইদুল্লা আল ওবাইদি সোহরাওয়ার্দী ইত্যাদি৷ অবিভক্ত বাংলায় প্রথম বিদ্যাসাগর ("বাহার-উল-উলূম" )ছিলেন রাজশাহীর হযরত শাহ মখদুম রূপোশ রহ:(১৩৩১খ্রী: ইন্তেকাল করেন)৷এই তথ্যটি বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম " পাঁচ বিদ্যাসাগর" নামে একটি গ্ৰন্থে আছে ৷তাঁদের মধ্যে অন্যতম বাঙালির আরেক বিদ্যাসাগর হলেন মাওলানা ওবায়দুল্লা আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী৷ তিনি ১৮৩২/৩৪ সালে ৮ ই অক্টোবর বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জলার ঘাটাল মহকুমার অন্তর্ভুক্ত চিতওয়া (চেতুয়া) গ্ৰামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন৷তাঁর নামের শেষে পদবী "সোহরাওয়ার্দী" একটি জায়গার নাম বহন করে ৷ আধ্যাত্মিক ঘরানায় "সোহরাওয়ার্দীয়া "একটি সুফি সিলসিলা ৷সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকা এক অর্থে বিশ্বমানবতার জন্য অনন্য উপহার৷বহুকালাবধি অশান্ত পৃথিবীর পথে পথে শান্তির বারি সিঞ্চন করে আসছেন এই সিলসিলার প্রাণপুরুষরা ৷ তাদের সিঞ্চিত বারিধারায় অন্য অনেকের সঙ্গে বিশেষ রূপে সিক্ত হয়েছি আমরা বাঙালিরাও৷ তাই বাংলার আনাচে কানাচে এবং আমাদের মন ও মননের অনেকটা অংশ জুড়ে ছায়া বিস্তার করছে সুফি ভাবনা৷সুফি তরিকা বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মধ্যে সাম্যবাদ দর্শনের অন্যতম দান৷বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি,শিক্ষার শ্রীবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিতে এই পরিবারের ভূমিকা অতুলনীয়৷" সোহরাওয়ার্দী" পরিবার ছিল উপমহাদেশের আলোর দিশারী৷ভারতীয় উপমহাদেশে সোহরাওয়ার্দী পরিবার অনেক সুসন্তানের জন্ম দিয়েছে৷যাঁরা উনিশ ও বিশ শতক জুড়ে শিক্ষাদিক্ষা ,আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ,সাহিত্য সংস্কৃতি,আধ্যাত্মিক মতবাদ,যাদুবিদ্যা ,চিত্রশিল্প,সাংবাদিকতা,দর্শন চর্চা ,চলচ্চিত্রে ,রাজনীতি ,প্রশাসনিক প্রভৃতি নানাক্ষেত্রে নিজ নিজ প্রতিভার স্ফুরন ঘটিয়েছিলেন এই পরিবারের সদস্যরা৷এই খান্দানে লেখক ,তত্ত্ববাগীশ , ভাষাবিদ ,বাকশিল্পী ,আধ্যাত্মবাদী ,কবি ,দার্শনিক ,অ্যাংলো ইসলামিক শিক্ষার অগ্ৰদূত ,বাঙালি ইসলামী স্কলার, বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ,জ্ঞানাকাশে সূর্য, সাহিত্যজগতের পূর্ণ চাঁদ ,প্রাচ্য - প্রতীচ্য রহস্যের অধিকারী ,যুক্তি শাস্ত্রের পতাকাবাহী ,কুরআন -হাদীস সৃষ্ট জ্ঞানের মুখোজ্জ্বলকারী ,কাব্যরাজ্যের অধিপতি ,বাক- নৈপুণ্যের বাদশা ,ওলিদের অগ্ৰনায়ক ,সুফিদের শিরোমণি,জ্ঞানের দীপশিখা রূপে প্রজ্জ্বলিত হয়েছিলেন মওলানা ওবাইদুল্লা আল ওবাইদি সোহরাওয়ার্দী৷পরিবারের ঐতিহ্য অনুসারে ওবায়দুল্লাহ ,নিজ গৃহে আরবি ও ফার্সি জ্ঞান অর্জনে সমর্থ হন৷ যদিও ওবায়দুল্লাহ'র প্রাথমিক শিক্ষা লাভ পটাশপুর মাদ্রাসায়(১৫৬৫-১৫৭৫) হয়েছিল৷তারপরে হুগলি ও জাহানাবাদ -এ তিনি ফারসি ভাষায় জ্ঞান লাভ করেন৷এরপর দশ - এগারো বছর বয়সে আরবি শিক্ষার জন্য কলকাতা যান৷১৮৫৩-৫৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় (ভারত তথা এশিয়া মহাদেশের প্রথম সরকারি সহায়তা ও অর্থানুকূল্যে গঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) আরবি বিভাগে" জামায়াত-ই-সিয়াম" এ ভর্তি হন৷মহাবিদ্রোহের বছর ১৮৫৭ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ফাইনাল সেন্ট্রাল পরীক্ষা বা জামাআত- ই-উলা উত্তীর্ণ হন৷এই বয়সের মধ্যেই তিনি রপ্ত করে ফেলেন আরবি ও ফারসি ভাষা৷ছাত্র জীবনে হাকিম আব্দুর রহীম " তামান্না দাহরী" ও চিকিৎসক-দার্শনিক আব্দুর রাজ্জাক ইস্পাহানীর নিকট বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্ৰহণ করেছিলেন৷পরবর্তীকালে পান্ডিত্য অর্জন করেন ইংরেজি ও উর্দু ভাষাতেও৷ এছাড়া তিনি টিপু সুলতানের পৌত্র শাহজাদা জালালউদ্দিনের টালিগঞ্জের বাড়িতে(১৮৫৮৭-৬০) থেকে আরবি - ফারসি ,ইংরেজি ,সংস্কৃত ,হিন্দি প্রভৃতি ভাষার গ্ৰন্থ অধ্যয়ণ করেন৷কলকাতায় মৌলভী এনায়েত রসুলের চিড়িয়াকোটের কাছে হিব্রু ভাষা শিক্ষার পাঠ নেন৷এছাড়া তাওরত ,ইঞ্জিল এবং ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে গভীর জ্ঞানার্জন করেন৷তাঁর উর্দু ,আরবি ,ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান ছিল ঈর্ষণীয়; এর সঙ্গে বাংলা ,সংস্কৃত ,উড়িয়া ,ব্রজ ,পহলবি ,দারি ,হিব্রু প্রভৃতি ভাষায়ও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন৷উল্লেখ্য ,বাংলাও ভালো জানতেন মওলানা ওবায়দুল্লাহ৷কলকাতা মাদ্রাসায় তিনি ভালো বাংলা শিখেছিলেন এবং এই মর্মে সনদপত্রও লাভ করেন৷উর্দু ও ফারসি ভাষায় তিনি কবিতা রচনা করতেন অল্প বয়স থেকেই৷বাংলার মুসলমানদের মাতৃভাষা রূপে বাংলা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা গ্ৰহণের জন্যে তিনি প্রথম আওয়াজ তুলে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রেভারেন্ড লালবিহারী দে সম্পাদিত "দি বেঙ্গল ম্যাগাজিন" পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন৷এর আগে এই পত্রিকায় অন্য কোনো মুসলমানের লেখা প্রকাশিত হয়নি৷ ফার্সি সাহিত্যের পন্ডিত ,তাঁর শিক্ষক ,যুক্তিবাদী চিন্তাবিদ আবদুর রহীম গোরখপুরীর (১৭৮৫-১৮৫৩) তিনি ছিলেন ভাবশিষ্য৷ মওলানা ওবায়দুল্লাহ তাঁর সাথে যৌথভাবে গিবস 'এর ইংরেজি কল্পকাহিনী(fables) " মাশরিকুল আনোয়ার" নামে ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন৷এছাড়াও তিনি গভীর সংস্পর্শে এসেছিলেন সেকালের মুক্তচিন্তার জনক ও ইংরেজি ভাষার পন্ডিত দেলোয়ার হোসেন আহমদ(১৮৪০-১৯১২)-এর৷এবং ঢাকার নবাব আব্দুল গণি ও নবাব স্যার আহাসানউল্লাহ সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছিল৷আলীগড় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ স্যার সৈয়দ আহমেদ(১৮২৭-১৮৯৫)- এর সঙ্গেও তাঁর ছিল সুসম্পর্ক৷তিনি ছিলেন আলীগড় আন্দোলনের একজন সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক৷ স্যার সৈয়দ আহমদ প্রতিষ্ঠিত আলীগড় মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজের(১৮৭৫) ( অধুনা আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়) উপদেষ্টা ডিরেক্টরও ছিলেন ৷মওলানা ওবায়দুল্লাহ রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে স্যার সৈয়দ আহমেদ খান ও নবাব আব্দুল লতিফের চিন্তাধারার অনুসারী ছিলেন৷ তিনি স্যার সৈয়দ আহমেদ সম্পাদিত উর্দু পত্রিকা " তাহজিবল আখলাক" এ নিয়মিত লেখালেখি করতেন৷এছাড়া উনিশ শতকের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও তৎকালীন ব্রাম্ম্য সমাজের সভাপতি রাজনারায়ন বসু ছিলেন মওলানা ওবায়দুল্লাহর একজন গুণমুগ্ধ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু৷ তিনি রাজা রামমোহন রায় -এর ফার্সি ভাষায় লিখিত " তুহফাতুল মুত্তয়াহেদিন" (১৮০৩) গ্ৰন্থটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন বন্ধু রাজনারায়ন বসুর অনুরোধক্রমেই৷
১৮৬২ সালে তিনি কলকাতায় বড়লাটের ব্যবস্থাপক পরিষদের (কলকাতা হাইর্কোট) মীর মুনসি ( প্রধান) পদে নিযুক্ত হন৷তাঁর কাছ ছিল ব্যবস্থাপক পরিষদের খসড়া আইনগুলোকে উর্দুতে অনুবাদ করা৷এই সময় তিনি মওলানা আবদুর রউফ ওহীদ -এর প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক ফারসি পত্রিকা " দূরবীন" সম্পাদনা করেন৷এছাড়া উর্দু পত্রিকা "গাইড" সম্পাদনা করেছিলেন৷
এই সময়ে তিনি আবার সংক্ষিপ্ত ফার্সি ব্যাকরণ " দস্তরে ফারসি" রচনা করেন৷মওলানা ওবাইদুল্লাহ ওবায়দী ১৮৬৫ থেকে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত হুগলি কলেজের আরবির অধ্যাপক ছিলেন৷সেখানে ত়ার ছাত্র ছিলেন শিক্ষাবিদ ও লেখক সৈয়দ আমির আলী৷বিশেষ করে সৈয়দ কেরামত আলীর" মখজুল উলুমু"-এর ইংরেজি অনুবাদ " A Treatise on the Science (১৮৬৭) ছাত্র সৈয়দ আমীর আলীর সহযোগিতায় সম্পন্ন করেন৷হুগলি (মাদ্রাসা) কলেজের অধ্যাপনার সময় ১৮৭৩ সালে তাঁর মূল্যবান গ্ৰন্থ " এ গ্ৰামার অন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ " প্রকাশিত হয়৷তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের শীর্ষ স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত কলেজ সমূহের ছাত্রদের জন্য এই পুস্তক রচনা করে ছিলেন৷এছাড়াও দীর্ঘদিন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়(১৮৫৭) ও পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের(১৮৮২) পরীক্ষক হিসেবেও কাজ করতে দেখা যায় মওলানা ওবাইদুল্লাহ কে৷১৮৭৪ খ্রীস্টাব্দে ২৫ ফেব্রুয়ারি সরকারি গেজেট -এর মাধ্যমে তাঁকে ঢাকা মাদ্রাসার( বর্তমানে কবি নজরুল সরকারি কলেজ) সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত করা হয়৷ওবায়দুল্লাহ বিভিন্ন বিভাগের উচ্চতর শ্রেণীতে সাহিত্য ,যুক্তিবাদ্যা ,দর্শন ,ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি, তর্কবিদ্যা ,ধর্মীয় বিষয় ও জ্যামিতি শিক্ষা দিতেন৷এই মাদ্রাসায় মওলানা ওবায়দুল্লাহ-র ছাত্র ছিলেন মহাকবি কায়কোবাদ ,খান বাহাদুর আব্দুল আজিজ৷
১৮৭৯খ্রিস্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর, বাংলার সমাজের নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় " ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশন"৷ এই অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন মওলানা ওবায়দুল্লাহ৷নারী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্ৰনায়ক ছিলেন৷স্ত্রী শিক্ষা প্রসারের জন্য তুহফাতুল বানাত ( কন্যাদের উপহার ) প্রভৃতি উর্দু ভাষায় বই লেখেন৷তিনি আরবি ,ফার্সি ,উর্দু ভাষায় সর্ব শুদ্ধ ৪৮ খানি পুস্তক প্রণয়ন করেন৷ আব্দুল লতিফ প্রতিষ্ঠিত " মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি" র অধিবেশনে একাধিক প্রবন্ধ পাঠ করে ছিলেন , তার মধ্যে " ভূগোলের উপকারিতা ও আমেরিকা আবিস্কার" ছিল অন্যতম৷এ দুটি সোসাইটির তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়৷তিনি ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার এবং অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটেরও দায়িত্ব পালন করেছেন সুষ্ঠু ভাবে৷এছাড়াও ১৮৭৭ সালে তৈরি বেঙ্গল সোস্যাল সায়েন্স এসোসিয়েশন সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল গভীর৷তাঁর চিন্তার বিচরণক্ষেত্র ছিল গোটা উপমহাদেশে৷
মওলানা ওবায়দুল্লাহ উর্দু, আরবি, ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় একাধিক মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। বিদেশি ভাষা থেকেও একাধিক বই অনুবাদ করেন।এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরেও তিনি খ্যাতিমান ছিলেন৷এছাড়াও মওলানা ওবায়দুল্লাহ লিখিত উল্লেখযোগ্য গ্ৰন্থগুলি হচ্ছে-
ফার্সি ভাষায়: দস্তুর -এ পারসি আমোজ(ফারসি ব্যাকরণ,ছন্দ ও অলংকার)(১ম ও ৫ম ভাগ),সিয়ারে হুকমায়ে ফেরেঙ্গে ,আততাসিদ ফি মাসালাতিত তাকলিদ ,দস্তান-ই-ইবরাতবার (ফারসি, আত্মজীবনী)প্রভৃতি , আরবি ভাষায়: লুব্ববুল আরাব(আরবি ব্যাকরণ), তদরিবুতুল্লার ফি সিয়াগিল আবওয়াব ,দিরাইয়াতিল আদাব হিসাউল আরব (১ম ,২য় ভাগ)
উর্দু ভাষায়: মিফতাহুল আদাব (উর্দু ব্যাকরণ),(১ম-৩য় ভাগ) দিওয়ান -ই -উর্দু ,তুহফাতুন নিসা , দবিস্তান-ই-দানিশ আমুস (উর্দু, পদার্থবিদ্যা)
ইংরেজি ভাষায়: Mahomedan Education in Bengal (১৮৬৭) শিক্ষাবিষয়ক একখানি মৌলিক গ্রন্থ এবং ১৮৭৩ সালে তাঁর মূল্যবান গ্ৰন্থ " এ গ্ৰামার অন অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ "প্রকাশিত হয়৷
সৃষ্টিশীল রচনা ও জ্ঞানগর্ভ উভয় ক্ষেত্রে তাঁর সমান দক্ষতা ছিল৷ পেশাগত দায়িত্ব পালন করেও তিনি আমৃত্যু বিরতিহীন ভাবে লিখে গেছেন৷যুগের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি বলে আরবি - ফারসি-ইংরেজি লেখনি চালনা করেছেন বেশি৷তাঁর কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছিল কলকাতা থেকে ঢাকায়৷শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি অনেকের তুলনায় অধিক যুক্তিবাদী ও উদারপন্থী ছিলেন৷স্ব- সমাজের উন্নতি কথা চিন্তা করলেও ওবায়দুল্লাহ সাম্প্রদায়িক চোরাবালিতে পা দেননি কখনো৷বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধগুলিতে প্রাই দেখা যেত মুসলমান সমাজের ক্রটি -বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা৷তাঁর চিন্তা ও সাহিত্যকৃতির মূল কথা ছিল মানবতাবাদ৷১৮৭৯ সালে খ্রিস্টাব্দে তিনিই" সমাজ সম্মিলনী" নামে সমাজ শিক্ষামূলক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন৷ এর মূল উদ্দেশ্য ছিল স্ব-সমাজের উন্নতি ,হিন্দু - মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপন ,মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ অর্থাৎ ইংরেজি ভাষা শিক্ষাসহ আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান - বিজ্ঞান চর্চা৷ বলা যেতে পারে ,তৎকালীন ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে প্রথম আলোকিত মনন ও সাংগঠনিক চেতনার বীজ বপনকারী ছিলেন মওলানা ওবায়দুল্লাহ৷ তাঁর আগমনের পর থেকেই ঢাকা -কেন্দ্রীক রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়৷তিনি ছিলেন "Father of modern Islamic education in Bengal"৷জ্ঞান, শিক্ষা ও সমাজের ক্ষেত্রে তাঁর জন্য ভারত সরকার তাঁকে‘বাহার-উল-উলুম’ (বিদ্যাসাগর) উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাহার-উল-উলুম ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী’ স্বর্ণ পদকটি আজও প্রচলিত আছে।
মনীষী মওলানা ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী ১৩০২ হিজরী ১৯ রবিউস সানি ,১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ৯ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ফজরের নামাজের সময় সিজদারত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন৷তাঁর দাফন সম্পন্ন হয় ঢাকার লালবাগ শাহী মসজিদ প্রাঙ্গণে৷ইন্তেকালের পর সুধী সমাজের পক্ষ থেকে " উপমহাদেশের দারাশিকো"বলা হত ৷ মওলানা ওবায়দুল্লাহ-র ইন্তেকালের পর তাঁর সুযোগ্য ছাত্র বাহাদুর আব্দুল আজীজ " ওবেদী বিয়োগ" পুস্তিকায় লিখেছেন৷এছাড়া তিনি "ওবেদী বিয়োগ" এ শোকগাথা কবিতায় রাখেন তাঁর মর্মস্পর্শী উচ্চারণ:' সমভাবে কে দেখিবে হিন্দু আর মুসলমান/ নির্জীব সমাজদেহে করিবে জীবন দাষ; একতা কে শিখাইবে,/ প্রাণে প্রাণে মিশাইবে,/ যবনে 'হনদে' আর কে করিবে এক মন/কে আর সাধিবে আহা! সমাজের সম্মিলন?"
একটু অন্য রকম ভাবে দেখলে মেদিনীপুরবাসী হিসেবে আমরা দুজন " বিদ্যাসাগর " কে পেয়েছি৷ যা মেদিনীপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গৌরবময় করে রাখে, তা হল মেদিনীপুর শহরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মেদিনীপুর মিয়া বাজারে এস. এম. আই. মাদ্রাসা অন্যতম। সোহরাওয়ার্দী পরিবার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ছিল৷এর পুরো নাম হলো সোহরাওয়ার্দিয়া মুরশিদিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা।
এইচ স্ট্রেচি মেদিনীপুরের তৎকালীন বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে পূর্বে একটি মুসলিম কলেজ বলে উল্লেখিত করেছেন ,তবে মাদ্রাসাটি মূলত " একটি অ্যাংলো - ফারসি স্কুল বা সঠিকভাবে বলা ,একটি মধ্য ইংরেজি স্কুল আজও আছে৷ বার্ষিক মহসিন ফান্ড দ্বারা অনুদান পেত৷ এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত ব্যবস্থা অনুযায়ী মেদিনীপুর পৌরসভাও আর্থিক ভাবে সহায়তা করছে মেদিনীপুরের এই মাদ্রাসাকে৷1891-92 সালে মেদিনীপুর মাদ্রাসা 130 রুপি অনুদান পেয়েছিল৷এই মাদ্রাসাটি চরিত্র রুপে ধর্মীয় ছিল না ,অনেক হিন্দুরাও এই মাদ্রাসার ছাত্র ছাত্রী ছিল৷
কিন্তু দু:খের বিষয় মওলানা ওবায়দুল্লা আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দীর ইতিহাস আজও বিস্মিত ৷ কারন স্মরণ করার সেই চিহ্ন টুকু রাখার ক্ষেত্রে সরকারি অবহেলা৷আজও মেদিনীপুরের মির্জাবাজারে সোহরাওয়ার্দী মহল্লা অসংরক্ষিত অবস্থায় হয়ে আছে ৷ সংরক্ষণের উদ্যোগ এবং হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণের অবহেলা দেখা গেছে৷ এবং বলতে গেলেও সোহরাওয়ার্দী পরিবারের কারুর নামে মেদিনীপুরের রাস্তার নামকরণ ,কোন সামাজিক সংগঠন ,বিদ্যালয় ,কলেজ ,তাঁর ভাস্কর্য পর্যন্ত ইত্যাদি গড়ে ওঠেনি৷ আজ যখন মেদিনীপুর বিভক্ত ,পূর্ব মেদিনীপুর আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই দরকার৷ তমলুকের কাছে যায়গাও ঠিক হয়ে শিলান্যাস হয়েছে ,তাই মওলানা ওবায়দুল্লাহ ছিলেন বাঙালি নারী শিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ ৷মেদিনীপুরবাসী হিসেবে দাবী রাখছি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম " মওলানা ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দীর " নামে রাখা হোক৷
M E D I N I K A T H A J O U R N A L
Edited by Arindam Bhowmik
(Published on 20.04.2025)
তথ্যসূত্র -
লেখক আলিমুজ্জমান
সোহরাওয়ার্দী পরিবার ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার
নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।