দাঁতন থেকে নিউইয়র্কঃ  ১৮৭০-৮০র দশকে মেমসাহেবের প্রেরিত পত্রগুচ্ছে আবেগের সুর | Dantan to New York: Emotional melody in letters sent by baptist missionary during 1870’s to 80’s.

ভাদ্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে দক্ষিন পশ্চিম সীমান্ত বাংলার

'সরদেশী ষষ্ঠী' বা 'ষষ্ঠী বুড়ি'-র পূজা।

পবিত্র পাত্র।


দক্ষিন পশ্চিম সীমান্ত বাংলার পৌরাণিক দেবীদের মধ্যে মা ষষ্ঠী অন্যতম।শিশুর কল্যানার্থে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দক্ষিনে সীমান্ত অঞ্চলে এই দেবীর পূজার্চনা লৌকিক আচারে পরিনত হয়েছে এবং বর্তমানেও দেবী ষষ্ঠীর আরাধনায় ব্রতী রয়েছেন সন্তানমঙ্গলকামী মায়েরা। দেবী ষষ্ঠীর পূজোর স্থানভেদে ভিন্ন প্রকারভেদ থাকলেও উক্ত অঞ্চলে বিশেষ ভাবে যে রূপে দেবী পূজিতা হন তা হল,'সরদেশী ষষ্ঠী' বা 'ষষ্ঠী বুড়ি'। পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্যত্র অন্য রূপে দেবী পূজিতা হন,তা হল-'মন্থন ষষ্ঠী', 'আঁতুড় ষষ্ঠী', 'কোণ ষষ্ঠী', 'ছত্র ষষ্ঠী', 'ঘাটষষ্ঠী', 'জলষষ্ঠী' প্রভৃতি।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকে জানা যায় দেবী ষষ্ঠী হলেন সন্তানদাত্রী দেবী,তিনি শিশুদের রোগের প্রকোপ থেকে রক্ষা করেন এবং সদ্যোজাতদের মঙ্গল করেন। উল্লিখিত বিভিন্ন ষষ্ঠী দেবীর পূজো বিভিন্ন সময়ে হয়ে থাকে।দক্ষিন পশ্চিম সীমান্ত বাংলার দাঁতন সহ সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ষষ্ঠী পূজোটি পুকুরের পাড়ে বা কোন জলাশয়ের পাড় সংলগ্ন বাড়ির উঠোনে হয়ে আসছে। ভাদ্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে এই পূজো হয়। পুকুরের পাড়ে অবস্থিত বেলগাছ, তুলশীতলায় বা মনসা গাছের তলায় এই পূজোর আয়োজন করেন বাড়ির মায়েরা।

ভাদ্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে দক্ষিন পশ্চিম সীমান্ত বাংলার 'সরদেশী ষষ্ঠী' বা 'ষষ্ঠী বুড়ি'-র পূজা।
ভাদ্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে দক্ষিন পশ্চিম সীমান্ত বাংলার 'সরদেশী ষষ্ঠী' বা 'ষষ্ঠী বুড়ি'-র পূজা।

এই পূজোর জন্য প্রথমেই বেছে নেওয়া হয় পুকুর বা গাড়িয়া সংলগ্ন কোন বেল বা সিজ বা বিশ্রি গাছ,তারপর তার তলা গোবর দিয়ে নিকোনো হয় এবং সেখানে তৈরী করা হয় মাটির বেদী। সেই বেদীর উপরেই কাঁচা মাটি সহযোগে তৈরী করা হয় দেবী মূর্তি। সেই দেবীমূর্তির পদযুগল থাকে প্রসারিত এবং পায়ে হাতে পরানো হয় মাটির তৈরী অলঙ্কার।অনেকে সাময়িক ভাবে সোনা রূপাও পরিয়ে দেন মা কে। এরপর দেবীর পদযুগলের মাঝখানে মাটির তৈরী কাল্পনিক শিশু প্রতিস্থাপন করা হয়।বিশ্বাস করা হয় ষষ্ঠী দেবী হলেন মা আর সেই মাটির পিন্ডগুলি সংসারের সমস্ত সন্তান। এই পূজোতে যে সমস্ত সামগ্রী দেওয়া হয় তার মধ্যে 'মঁথনি' প্রধান এই মঁথনি বা মন্থন দন্ড হল আসলে নানান বৃক্ষ শাখা। একটা বাঁশের সরু ডাল কাটা হয় তাতে বাঁধা হয় তালপাতা,বাঁশপাতা,কচুপাতা,কেয়া পাতা প্রভৃতি। এই পূজোতে দেবী ষষ্ঠীর প্রতিমা তৈরী হলে চোখ হিসেবে ছোট ছোট মার্বেল ব্যবহার করেন মায়েরা। মঁথনিটিকে দেবীর পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।অনেকে মঁথনির মাথায় শঁশা বা ওই জাতীয় ফল গেঁথে রাখেন। এছাড়া লাগে একটি হলুদ কাপড় বা হলদি কানি (কানি অর্থে ছোট কাপড়), লাল সালু,শিলনোড়া বা পুতা,কাজলপাতি,জুলডালা যা মেহতোর (মেথর) বাড়ি থেকে, ওই সম্প্রদায়ের লোকেরা পূজোর দিন যথাসময়ে দিয়ে যান।

ভাদ্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে দক্ষিন পশ্চিম সীমান্ত বাংলার 'সরদেশী ষষ্ঠী' বা 'ষষ্ঠী বুড়ি'-র পূজা।
ভাদ্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে দক্ষিন পশ্চিম সীমান্ত বাংলার 'সরদেশী ষষ্ঠী' বা 'ষষ্ঠী বুড়ি'-র পূজা।

পূজোর সমস্ত সামগ্রী আনা হয়ে গেলে পুরোহিত এসে পেতলের ঘটিতে পুকুর থেকে মন্ত্র সংযোগে জল এনে মায়ের সামনে রাখেন।ঘটির গায়ে জড়িয়ে দেন হলুদ কাপড় এর পর আমগাছের শাখা ডুবিয়ে সিন্দুর, পিঠালো বা চালবাটার মিশ্রন এবং হলুদ বাটার একত্রে ছিটিয়ে ষষ্ঠী বুড়িকে কাপড় পরিয়ে পূজো শুরু করেন। শঙ্খ-কাঁসরে,ধূপে-ধুনায় ভরে ওঠে গৃহস্থের উঠোন। এরপর প্রথমেই মঁথনির উপরে দুধ ও জল ঢালেন এবং মায়ের কাছে রাখেন কেয়া গাছ,তালপাতা,হলুদ পাতা,ধান গাছ, আম পাতা,জুল ডালা সহ বিভিন্ন তরি তরকারির কশি বা একেবারে ছোট্ট অবস্থার সব্জি যেমন-ঝিঙা বা তরিই ,আতা,পেয়ারা বা পেহেড়া কশি ইত্যাদি। এছাড়া মায়ের ভোগ বা প্রসাদ এর স্বাতন্ত্র্য বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়।প্রথমেই তেরী করা হয় গুড়ের মুড়কি বা উখড়া,সেই উখড়া রাখা হয় নতুন বাঁশেন তৈরী ডালাতে বা পেতলের বাসনে। ভাজা হয় চালভাজা বা কড়কড়াও বলা হয়।তৈরী করা হয় আট কড়কড়া যা হল বিভিন্ন শস্য যেমন-মুগ, বিরি, অরহর, ছোলা, মটর, ভুট্টা, তিল, কালো সরিষা ইত্যাদি সমূহের একত্রে ভাজা। এই ভাজাটি তৈরী করেন বাড়ির বয়স্কা কোন মহিলা। যিনি সারাদিন উপবাসে থাকেন,নতুন বস্ত্র পরিধান করে মাটির পাত্রে গরম বালিতে ভেজে নেন এই শস্যসমূহ। এটি বিশেষ ভোগ হিসেবে বিবেচিত এবং এই আট কড়কড়া ছড়িয়ে দেওয়া হয় মুড়কি ও চালভাজার উপরে। এছাড়াও সাধারন পূজোর মতোই এ পূজোতেও লাগে বিভিন্ন ফলমূল,নাড়ু,আতব চাল,সব্জি ইত্যাদি। তা দিয়েও ভোগ করা হয়। তবে গ্রামে সবার বাড়িতে এই পূজোর চল নেই। কিছু কিছু বাড়িতে পূজো হয় এবং পার্শবর্তী বাড়ির মায়েরা সবাই পূজো সাজিয়ে নিয়ে চলে আসেন যথাস্থানে। সবাই হাতে হাত লাগিয়ে সাজিয়ে তোলেন প্রতিমা,পালন করেন সব নিয়ম।

তবে অনেকে মনে করেন সন্তানদের বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্যই ষষ্ঠী মায়ের আরাধনা করা হয়ে থাকে। উক্ত সীমান্ত বাংলায় বাড়ি বাড়ি পুকুর রয়েছে,সেই পুকুর থেকেও যেন মায়েদের সন্তানেরা সুরক্ষিত থাকেন এবং পার্শবর্তী সুবর্ণরেখা নদী থেকেও যেন সুরক্ষিত থাকে তার জন্য এই বিশেষ পূজোর গুরুত্ব অপরিসীম। তাই বলা যায় এই ষষ্ঠী বুড়ির পূজোর সাথে জলের সম্পর্ক রয়েছে।

পূজো শেষ হয়ে গেলে পুরোহিত সহযোগে উপস্থিত সকলে পুষ্পাঞ্জলি দেন। তারপর যে সমস্ত মায়েরা ষষ্ঠী বুড়ির কাছে মানত করেছেন সন্তান লাভের জন্য তাঁরা মানত পূরণ করেন আবার নতুন বধূরা মানত করেন।প্রাপ্ত সন্তানদের অনেকে মায়ের সামনে গড়িয়ে নেন,তাতে সন্তানের মঙ্গল হয় বলেই বিশ্বাস।

ভাদ্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে দক্ষিন পশ্চিম সীমান্ত বাংলার 'সরদেশী ষষ্ঠী' বা 'ষষ্ঠী বুড়ি'-র পূজা।
ভাদ্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে দক্ষিন পশ্চিম সীমান্ত বাংলার 'সরদেশী ষষ্ঠী' বা 'ষষ্ঠী বুড়ি'-র পূজা।

এই ভাবে নানান নিয়ম ও ভিন্ন ভিন্ন সামগ্রী সহযোগে ষষ্ঠী বুড়ির পূজো সুসম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রত্যেক বছর এই পূজো হয়ে আসছে।এই পূজো সমগ্র জাতির মানুষ ই করে আসছেন কালের নিয়মে। ষষ্ঠী ঠাকুর কে সবাই বুড়ি কেন বলেন, তার উত্তরে অনেক বৃদ্ধারা বলেছেন,মা ষষ্ঠী হলেন আমাদের পরিবারের দেবী অত্যন্ত কাছের,মাতৃস্নেহদাত্রী,সন্তান রক্ষক দেবী। তিনি যেন যুগ যুগান্তর ধরে সমগ্র অঞ্চলের সন্তানদের রক্ষা করে আসছেন।

সুবর্ণরৈখিক মিশ্র ভাষার কবিতা: ষষ্ঠী বুড়ি

ভদর মাসের শুক্লা তিথি আজ ষষ্ঠী পূজার দিন

রাখচো ভালা ছেনামেনকে,বাড়ছে তুমার ঋণ

বেলগাছটার তলে মাগো আইসিকরি বুসো

মাটির লেদা লাদি দিনেই চাঁদের মতো হাসো

তুমার সামনে উখড়া খই চালায় সাজিই রাখি

আট কড়কড়া,ফল-মূল কিছো রাখিনি বাকি

বাঁশ কঁনচায় মঁথনি বাঁধি,শিলে পিঠালো বাটি

লাড়িয়া,আখু,কলা আপেল পঁনখি দিকি কাটি

কাঁচগুটির চোখ তুমার হিরার মতো দেখায়টে

বিলিই কেনে তুমার বাহন,সউ ভাবনা ভাবায়টে!

তুমিতো মোর ঘরেরই মা,তুমাকে ষষ্ঠী বুড়ি কই

ছেনেপেনার কিছো হিনে পরে,তুমার পাশেই সই

ফলে মূলে ধূপে ধুনায় আনন্দে ভরিউঠে সকাল

হাঁড়িয়ালি-চৌঠি আগে হয় পরে আঁরাধ পাখাল

বছর ঘুরি ভদর মাস তুমার পূজা ঘরে ঘরে হউ

তুমার দয়ায় ছেনাপেনা সব ভালায় ভালায় রউ।


midnapore.in

(Published on 27.08.2020)