গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের জামিদারী: পুরাকীর্তি ও বংশের ইতিহাস
Zamandari of Gohaldanga Roy Family: Antiquities and family history
গোহালডাঙ্গা, চন্দ্রকোনা, পশ্চিম মেদিনীপুর
কৃষ্ণেন্দু রায়।
সংক্ষিপ্তসার
এই বিষয়টি উল্লেখের কোন প্রয়োজন নেই যে সামাজিক ক্রম বিবর্ধনের ধারায় বংশের ইতিহাস সম্পর্কে জানা একান্ত জরুরী। এই প্রসঙ্গে মার্কাস গর্ভায় এর একটি উক্তি তুলে ধরলাম। “A people without the knowledge of their past history, origin and culture is like a tree without roots.” আলোচ্য প্রবন্ধে আমি গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের জমিদার বাড়ির ইতিহাস, স্থাপত্য ও শিল্প রীতি নিয়ে চর্চা করেছি। এই জমিদার বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে দীর্ঘ দিন ধরে পড়াশোনা ও তথ্য অনুসন্ধানের পর অবশেষে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য নথি পাওয়া গিয়েছে যা এই বংশের ইতিহাস ও পূরাকীর্তি সম্বন্ধে লিখতে সাহায্য করেছে। এই প্রবন্ধ মূলত তথ্যমূলক, ব্যাখ্যামূলক ও বর্ণনামূলক। আজ থেকে ১০৭ বছর আগে প্রকাশিত এক সংহিতায় এই বংশের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং শুধু উল্লেখ নয় এই গোহালডাঙ্গা জমিদার পরিবার যে হুগলির মাধবপুর এর নিকটে দিহি বায়রা গ্রাম-এর রাজা রণজিৎ রায়-এর বংশধর সেই প্রমাণ ও পাওয়া যায়। আরও জানা গেছে যে এই জমিদার বংশের এক পূর্বপুরুষ বুন্দেলখন্ড থেকে এসে বায়ড়া গ্রামে রাজ বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য প্রমাণাদি সহ সবিস্তারে নিচে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের জমিদারি আমলের স্থাপত্য ও শিল্প রীতি সম্পর্কে গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে এই স্থাপত্য ও শিল্পরীতি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকের শিল্প রীতি অর্থাৎ আনুমানিক ১৭৫০-১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে (১৬৭২ শকাব্দ-১৭১২ শকাব্দ) নির্মিত। এই সিদ্ধান্ত মূলত ডেভিড ম্যাকক্যাচিওন সাহেব এর লেখা Late Mediaeval Temples of Bengal: Origins and Classification থেকে প্রভাবিত যেটা সম্পূর্ণ যুক্তি নির্ভর ও আমাদের বংশের ইতিহাসের ধারার সাথে সম্পূর্ণ ভাবে মিলে যায়। এই প্রবন্ধ বংশের ঐতিহাসিক স্মৃতিগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং এই নির্দিষ্ট বংশের প্রতিটি প্রজন্মকে তারা কে এবং কোথা থেকে এসেছে সে সম্পর্কে ধারণা রাখতে সহায়তা করবে বলে আশা করা যায়।
প্রাসঙ্গিক শব্দসমূহ (Keywords)
গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের জমিদার বাড়ি, গোহালডাঙ্গা, রাজা রণজিৎ রায়, হুগলি দিহি বায়রা, অষ্টাদশ শতাব্দীর স্থাপত্য ও শিল্পরীতি, পুরাকীর্তি , বুন্দেলখন্ড
ভূমিকা
ইতিহাসের আলোচনা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইতিহাস বহুমুখী। ইতিহাস বিষয় কেন্দ্রিক। এক কথায় বলতে গেলে ইতিহাস হল " ঐতিহাসিক ও তাঁর তথ্যের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার এক স্বতঃস্ফূর্ত ও অব্যাহত প্রক্রিয়া, বর্তমান ও অতীতের মধ্যে এক অন্তহীন সংলাপ"১ । ইতিহাস চর্চায় আঞ্চলিক ইতিহাসের গুরুত্ব অপরিসীম। আঞ্চলিক ইতিহাস অনেকাংশে কিংবদন্তি নির্ভর। তবে তার যৌক্তিকতা বিচার করতে গেলে সামগ্রিক ভাবে বৃহৎ ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। ভারতেবর্ষের অন্যতম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। এই প্রবন্ধে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত চন্দ্রকোনা থানার গোহালডাঙ্গা গ্রামে অবস্থিত রায় বাবুদের জমিদার বাড়ির ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে যা মূলত আঞ্চলিক ইতিহাস । যদিও বর্তমানে এই জমিদার বাড়িটি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত, তবুও ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে বারবার হুগলি জেলার উল্লেখ থাকবে কারণ এক সময় চন্দ্রকোনা ও ঘাটাল সংলগ্ন এলাকা হুগলি জেলার অন্তর্গত ছিল২।
গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের জামিদারী: পুরাকীর্তি ও বংশের ইতিহাস | Zamandari of Gohaldanga Roy Family: Antiquities and family history
গোহালডাঙ্গাতে অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি আয়তনে বিশাল ও এক অনন্য স্থাপত্য কীর্তির সাক্ষ্য বহন করে, যা ইহার গৌরবময় ইতিহাসের ইঙ্গিত দেয়। যদিও এই জমিদার বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে প্রকাশিত কোনো বিস্তারিত নথি পাওয়া যায় না। যা পাওয়া গেছে তা হলো দুটি বংশ তালিকা ও স্থানীয়দের থেকে জানা কিছু অসংলগ্ন তথ্য যা আংশিক সত্য। গোহালডাঙ্গার স্থানীয় সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের উপর খুব একটা নির্ভর করা যায় না, কারণ তা অতিরঞ্জিত ও অনেক ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে বিকৃত, যদিও বিভিন্ন সাংবাদিক সেই বিকৃত তথ্যই কখনও কখনও প্রকাশ করেছেন। একটি বংশ তালিকা থেকে সর্বশেষ যে পূর্বপুরুষের নাম পাওয়া যায় তা হলো দামোদর রায় এবং জানা যায় যে ইনি হুগলির মাধবপুর হইতে গোহালসিনি হয়ে গোহালডাঙ্গা আসেন। আরও একটি বংশ তালিকা থেকে সর্বশেষ পূর্বপুরুষের নাম পাওয়া যায় অচ্যুতানন্দ রায় যিনি দামোদর রায়ের এক পূর্বপুরুষ। এছাড়া দামোদর রায় বা অচ্যুতানন্দ রায়ের সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো আলোচনা এইখানে পাওয়া যায় না। ফলস্বরূপ হুগলি জেলার কোন্ বিখ্যাত জমিদার / রাজ বাড়ির সাথে এই বিশেষ জমিদার বাড়ির যোগ আছে তা অজ্ঞাত রয়ে যায়, যেটি জানা একান্ত জরুরী, না হলে বংশের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। উপরে উল্লিখিত অজানার বিষয়ে অনুসন্ধান করে এই গবেষণা গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের জমিদার বংশের ইতিহাস সম্পর্কে অনেকখানি আলোকপাত করতে সক্ষম হয়েছে। জানা গেছে যে এই জমিদার বংশের পূর্বপুরুষ নরেন্দ্রনারায়ন বুন্দেলখন্ড থেকে এসে হুগলি জেলার আরামবাগের দুই মাইল পূর্বে অবস্থিত বায়ড়া গ্রামে একটি রাজ বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর এক উত্তর পুরুষ হলেন বিখ্যাত সাধক পুরুষ রাজা রনজিৎ রায়। আবার এই রনজিৎ রায়ের এক উত্তর পুরুষ দামোদর রায় হুগলি থেকে গোহালডাঙ্গাতে আসেন এবং গোহালডাঙ্গাতে জমিদারির গোড়াপত্তন করেন আনুমানিক ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে। শ্রী মোক্ষদা প্রসাদ রায় চৌধুরীর লেখা ‘সদগোপ্ কুলীন সংহিতা’য় এই বিষয়ে প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে।
বংশের ইতিহাস
গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের বংশের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়টি জানা একান্ত প্রয়োজন। এই বিষয়টি সুধীর কুমার মিত্র বিদ্যাবিনোদ প্রণীত 'হুগলি জেলার ইতিহাস' ( শিশির পাবলিশিং হাউজ, কলকাতা ) নামক পুস্তক থেকে সংগৃহীত৩।
এই বিষয়টিতে গোহালডাঙ্গার রায় বাবুদের কোনো প্রত্যক্ষ উল্লেখ নেই, শুধুমাত্র অচ্যুতানন্দ রায় ও তাঁর পুত্র হরিশচন্দ্র রায় এই দুটি নাম ছাড়া। এই নাম দুটি গোহালডাঙ্গা রায়বাবু দের বংশ তালিকা থেকেও পাওয়া গিয়েছে। অতএব মাত্র দুটি নামের মিল থেকে সিদ্ধান্তে আসা কঠিন, অর্থাৎ এই বিষয়ে আরও অনুসন্ধান প্রয়োজন। সেই কারণেই আমি 'প্রতিহার' নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। অসংখ্য তথ্য অনুসন্ধানের পর আজ থেকে 107 বছর আগে শ্রী মোক্ষদা প্রসাদ রায় চৌধুরীর লেখা 'সদগোপ্ কুলীন সংহিতা'য় ৪ প্রতিহার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় যা গোহালডাঙ্গা রায় বংশের ইতিহাসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ন। প্রতিহার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিম্নে দেওয়া হল।
স্পষ্টতই সুধীর কুমার মিত্র বিদ্যাবিনোদ প্রণীত 'হুগলি জেলার ইতিহাস' গ্রন্থে উল্লিখিত রাজা নরেন্দ্রনারায়ন ও শ্রী মোক্ষদা প্রসাদ রায় চৌধুরীর লেখা 'সদগোপ্ কুলীন সংহিতা'র নরনারায়ণ একই ব্যক্তি। নরেন্দ্রনারায়নের উত্তর পুরুষদের নামও উভয় তথ্যে হুবহু এক। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এই যে দ্বিতীয় তথ্যে অর্থাৎ শ্রী মোক্ষদা প্রসাদ রায় চৌধুরীর লেখা 'সদগোপ্ কুলীন সংহিতা'য় এই বংশের গোহালডাঙ্গাতে গিয়ে বসবাস করার প্রত্যক্ষ উল্লেখ পাওয়া যায়। আমরা আগেই দেখেছি যে উভয় তথ্যই এই বংশের হুগলির দিহি বায়ড়া থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন মাধবপুর, দিঘড়া, সালালপুর, গোহালডাঙ্গা, জীবটে, দেশড়া, আমদহি প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ার কথা বলে। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই যে দ্বিতীয় তথ্যেও অচ্যুতানন্দ রায় ও তাঁর পুত্র হরিশচন্দ্র রায়ের উল্লেখ, অর্থাৎ গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের বংশ তালিকায় উল্লিখিত অচ্যুতানন্দ রায় ও তাঁর পুত্র হরিশচন্দ্র রায়, এই বংশের বংশধর। অতএব এইখান থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে গোহালডাঙ্গার দামোদর রায় যিনি অচ্যুতানন্দ রায়ের উত্তরপুরুষ তিনি বুন্দেলখন্ড থেকে আগত হুগলির বায়ড়ায় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্রনারায়নের বংশধর।
এখন দেখা যাক সময় সারণি। রাজা রনজিৎ রায়ের দিঘি খনন করা হয় ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে৫। ইতিহাসে চোদ্দ পুরুষ সময়কালকে ৩০০ বছর ধরে নেওয়া হয়, এটা সর্বজন বিদিত প্রমাণ হিসাব। এই হিসাব ধরে নিয়ে এগোলে দামোদর রায়ের গোহালডাঙ্গা আগমন আনুমানিক ১৭৩৫ খ্রিস্টাব্দে, এবং এই হিসাবেই দামোদর রায়ের এক পূর্বপুরুষ কালিপ্রশাদ রায়ের জন্ম আনুমানিক ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে। এই হিসাবের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় গোহালডাঙ্গার পাশর্বর্তী ক্ষীরা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত শান্তিনাথের মন্দিরের ফলক দেখে ( চিত্র: প্রথম সারির বাম দিকে ) যেখানে উল্লেখ আছে শ্রী শ্রী দুর্গা শিবঃ, এই নূতন মণ্ডপ শকাব্দ ১৭৮৫ (অর্থাৎ ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে) গোহালডাঙ্গার শ্রীল শ্রী কালিপ্রশাদ রায় মহোদয়ের ইচ্ছায় (ঠিক বোঝা যায় নি, খুবই অস্পষ্ট) শ্রী বেহারিলাল মিস্ত্রি কর্ত্তিক নির্মিত। এই হিসাবের আরও এক প্রমাণ পাওয়া যায় কালিপ্রশাদ রায়ের পুত্র অক্ষয় রায় ও অখিল রায়ের নামাঙ্কিত এক সীল (স্ট্যাম্প) ( চিত্র: প্রথম সারির মাঝে) থেকে যেখানে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ গোহালডাঙ্গাতে রায় বাবুদের বসবাস আজ থেকে প্রায় ২৮০ - ২৯০ বছর আগে শুরু হয়, এবং ধরে নেওয়া যায় যে দেবী দূর্গার উপাসনা তখন থেকেই শুরু হয়ে আজও চলছে।
গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের জামিদারী: পুরাকীর্তি ও বংশের ইতিহাস | Zamandari of Gohaldanga Roy Family: Antiquities and family history
গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের জমিদারি নাড়াজোল রাজের অধীনে ছিল বলে জানা যায়, এই সংক্রান্ত নথি রয়েছে। শোনা যায় যে বর্ধমান রাজের অধীনেও রায় বাবুরা জমিদার ছিলেন, তবে এই ব্যাপারে কোনো নথি এখনও অবধি পাওয়া যায়নি, অনুসন্ধান চলছে।
বর্তমানে রায় বাবুদের অনেকই গোহালডাঙ্গাতে বসবাস করেন, অনেকেই আবার কর্মসূত্রে পৃথিবীর অন্যান্য অংশে বসবাস করেন। তবে প্রতি বছর দেবী দূর্গার আরাধনায় এই বংশের সকলেই গোহালডাঙ্গাতে আসেন।
এখানে গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের একটি বংশ তালিকা দেওয়া হলো।
রায় বাবুদের স্থাপত্য কীর্তি
গোহালডাঙ্গাতে রায় বাবুদের দালান বাড়ি, শিব মন্দির, রাস মন্দির, শুভমঙ্গলচন্ডী মন্দির প্রভৃতি রয়েছে। দালান বাড়ি সহ অন্যান্য মন্দির গুলি এক অনন্য পোড়ামাটির কাজের পাশাপাশি সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করছে ( চিত্র: প্রথম সারির ডান দিকে, তৃতীয় সারির ডান দিকে)। এই স্থাপত্যগুলির রীতি ও আনুমানিক নির্মাণকাল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের জামিদারী: পুরাকীর্তি ও বংশের ইতিহাস | Zamandari of Gohaldanga Roy Family: Antiquities and family history
প্রথমে আসা যাক দালান বাড়ির কথায় ( চিত্র: দ্বিতীয় সারির বাম দিকে)। ‘দালান’ একটি ফরাসি শব্দ যার অর্থ 'লম্বা পাকা ঘর'। ধনীদের বাসগৃহ রূপে এই দালান নির্মিত হয়েছে। ধনী ব্যক্তি ও জমিদারেরা দূর্গা ও কালী পুজোর জন্য আঠারো-উনিশ শতকে বাংলায় অনেক ‘দালান’ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন ৬। ঐসব দালান ‘দূর্গা দালান’ বা ‘কালী দালান’ নামে পরিচিত। যেকোনো বর্ধিষ্ণু গ্রাম বা শহরে এই ধরনের দালান লক্ষ্য করা যায়। গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের দালান বাড়িও ইহার ব্যতিক্রম নয়। আমরা জানি যে গোহালডাঙ্গাতে এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা দামোদর রায়। তিনি নামকরা একটি রাজ বংশের পুরুষ ছিলেন, তাই তিনি নিশ্চয় শূন্য হাতে গোহালডাঙ্গা তে আসেননি বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। তাই এটাও ধরে নেওয়া যেতে পারে যে গোহালডাঙ্গাতে আসার পর ধীরে ধীরে তিনিই দালান বাড়ি নির্মাণ শুরু করেন, অন্তত বাংলায় দালান বাড়ির প্রচলনের সময়কাল সেই রকমই ইঙ্গিত করে।
শিব মন্দিরগুলি আটচালা রীতির। আটচালার গঠন বৈচিত্র লক্ষ্যণীয় ( চিত্র: দ্বিতীয় সারির ডান দিকে)। নীচের চারচালাটি উপরের তুলনায় এতো বড়ো যে উপরের চালাটিকে শুধুমাত্র অলংকরণ বলে মনে হয়৬ । এই ধরনের গঠনও সাধারণত আঠারো শতকের শেষ দিকের স্থাপত্য রীতি। এই আটচালা শিব মন্দিরগুলির কারুকার্য চোখে পড়ার মতো।
গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের জামিদারী: পুরাকীর্তি ও বংশের ইতিহাস | Zamandari of Gohaldanga Roy Family: Antiquities and family history
শুভ মঙ্গলচন্ডী মন্দিরটি রত্ন মন্দির রীতির, এটি পঞ্চরত্ন মন্দির ( চিত্র: তৃতীয় সারির বাম দিকে)। রত্ন মন্দিরের অধিক সমাবেশ দেখা যায় বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা, রামজীবনপুর, খড়ার, দাসপুর, নাড়াজোল প্রভৃতি স্থানে। চন্দ্রকোনার রঘুনাথবাড়ির লালজীউ মন্দিরে রক্ষিত শিলালিপি থেকে জানা যায়, চন্দ্রকোনার ভান রাজাদের আমলে গিরিধারীলালের নবরত্ন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে ৬ । এটিই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার প্রাচীনতম রত্ন মন্দির। আর এই জেলার প্রাচীনতম পঞ্চরত্ন মন্দির হলো নবগ্রামের সিংহবাহিনী ১৭০৯ খ্রিস্টাব্দ। এই অঞ্চলে ১৭১৫ থেকে ১৭৭০ অবধি ব্যাপক হারে পঞ্চরত্ন মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয় ৭। আলোচ্য শুভমঙ্গলচন্ডী পঞ্চরত্ন মন্দিরটিও এই সময়কার। এই পঞ্চরত্ন মন্দিরটির রত্নের শিখরাংশ সমান্তরাল ভাবে খাঁজ কাটা এবং নীচের অংশ বাঁকানো কার্নিশযুক্ত চালা রীতিতে তৈরি হয়েছে।
এই অঞ্চলের রাসমঞ্চগুলিও রত্ন রীতির। রাসমঞ্চগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নবরত্ন ও সপ্তদশ রত্ন বিশিষ্ট। রাসমঞ্চের রত্নগুলি এক বিশেষ শৈলীতে তৈরি, রত্নগুলি কতকটা রসুনের কোয়ার মতো স্থূলাকৃতি হয়ে শীর্ষে ক্রমসূক্ষভাব ধারণ করেছে। দাসপুরের সূত্রধরেরা এর নাম দিয়েছেন ‘বেহারী রসুনচূড়া’ ৮, ৯। আঠারো শতকের শেষ দিকে ও উনিশ শতকের শুরুতে রত্ন বিশিষ্ট রাসমঞ্চ প্রচুর সংখ্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই রীতির রাসমঞ্চ গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের দালান বাড়ির দক্ষিন- পশ্চিম কোনে প্রতিষ্ঠিত ( চিত্র: তৃতীয় সারির মাঝে)। এটি নবরত্ন বিশিষ্ট।
গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের জামিদারী: পুরাকীর্তি ও বংশের ইতিহাস | Zamandari of Gohaldanga Roy Family: Antiquities and family history
উপরের আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে এই স্থাপত্য ও শিল্পরীতি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকের শিল্প রীতি অর্থাৎ আনুমানিক ১৭৫০-১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে (১৬৭২ শকাব্দ-১৭১২ শকাব্দ) নির্মিত।
উপসংহার
এই গবেষণায় গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের প্রায় ২৮০ - ২৯০ বছরের প্রাচীন বংশের ইতিহাস ও স্থাপত্য কীর্তি সম্বন্ধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আলোচিত হয়েছে। এই আলোচনা বংশের ঐতিহাসিক স্মৃতিগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং এই নির্দিষ্ট বংশের প্রতিটি প্রজন্মকে তারা কে এবং কোথা থেকে এসেছে সে সম্পর্কে ধারণা রাখতে সহায়তা করবে। শুধু তাই নয় এই আলোচনা আঞ্চলিক ইতিহাসকেও সমৃদ্ধ করবে। এই বংশের ভবিষ্যতে প্রজন্মের কাছে এই গবেষণা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে আশা করা যায়।
গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের জামিদারী: পুরাকীর্তি ও বংশের ইতিহাস | Zamandari of Gohaldanga Roy Family: Antiquities and family history
গোহালডাঙ্গা রায় বাবুদের জামিদারী: পুরাকীর্তি ও বংশের ইতিহাস | Zamandari of Gohaldanga Roy Family: Antiquities and family history
কৃতজ্ঞতা
গবেষক মনোজিৎ রায়, স্বাগত রায় ও বিবেক রায় কে নিরবিচ্ছিন্ন উৎসাহ প্রদান করার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ জানায়। এছাড়া তথ্যসমীক্ষায় সনৎ রায়, স্বপন রায়, মনোজিৎ রায় ও স্বাগত রায়, ক্ষেত্রসমীক্ষায় স্বাগত রায় এবং চিত্র গ্রহনে কৃশানু রায় কে বিশেষ সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জানায়। গবেষক এই প্রকল্প অর্থায়ন এর জন্য স্ব-টান গোহালডাঙ্গাকে ধন্যবাদ জানায় (গ্রান্ট নং. Swa-taan/AHCS/1/2017-18)। সবশেষে গবেষক গোহালডাঙ্গা রায় পরিবার এর সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই তাদের নিরবিচ্ছিন্ন সমর্থনের জন্য।
midnapore.in
Published on 03.04.2022 (প্রথম প্রকাশ: স্বটান, ২০২০)
সূত্র নির্দেশ :
১. ‘ইতিহাস কাকে বলে?’ ই এইচ কার ও আর ডবলিউ ডেভিস সম্পাদিত, অনুবাদ: স্নেহোৎপল দত্ত ও সৌমিত্র পালিত। কে পি বাগচী অ্যান্ড কোং, কলকাতা, 2006
২. ‘A brief history of the Hughli Distric’t by D.G. Crawford, Bengal Secretariat Press, 1903, digitization: Wellcome Library, 183 Euston Road, London NW1 2BE, UK.
৩. হুগলি জেলার ইতিহাস, মিত্র বিদ্যাবিনোদ, সুধীর কুমার, শিশির পাবলিশিং হাউস, কলকাতা।
৪. 'সদগোপ্ কুলীন সংহিতা', শ্রী মোক্ষদা প্রসাদ রায় চৌধুরী, এন. মিটার বার্ডওয়ান প্রেস।
৫. Nandi Parthasarathi, Milan Kanti Biswas, Legends and Local History of Hooghly District in the Perspective of Folkloristics Analysis Based on Field Work, http://hdl.handle.net/10603/216490
৬. বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য, প্রনব রায়, পূর্বাদ্রি প্রকাশনী, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
৭. বাংলার মন্দির, হিতেশ রঞ্জন সান্যাল, কারিগর পাবলিশার্স, ২০১২।
৮. ‘Late Mediaeval Temples of Bengal: Origins and Classification’ by David McCutchion, (Calcutta: The Asiatic Society, 1972)
৯. Brick Temples of Bengal: From the Archives of David McCutchion, (Princeton, N.J.: Princeton University Press, 1983), his research collected, interpreted and published by George Michel.