মেদিনীপুর জেলের নিচে কয়লা খনি ! খোঁজ দিয়েই বেপাত্তা কয়েদি  | Coal block under Midnapore Central Jail (midnapore central correctional home)

মেদিনীপুর জেলের নিচে কয়লা খনি ! খোঁজ দিয়েই বেপাত্তা কয়েদি | Coal block under Midnapore Central Jail

অতনু মিত্র ।


শুরু হয়েছিল ‘খোঁড়’ ‘খোঁড়’ বলে। শেষ হল ‘খোঁজ’ ‘খোঁজ’ রবে। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের নিচে নাকি একটি বিশাল কয়লা খনি আছে! আর সেখানেই মিল্বে বেশ উৎকৃষ্ট মানের কয়লা। তার নমুনাও মিলেছে। মেদিনীপুরে কয়লা খনি! তাহলে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘কালো হীরে’র মালিক হয়ে যাবে। প্রচুর মুনাফাও করতে পারবে।


মেদিনীপুর জেলের নিচে কয়লা খনি ! খোঁজ দিয়েই বেপাত্তা কয়েদি  | Coal block under Midnapore Central Jail (midnapore central correctional home)
Midnapore Central Correctional Home (মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার)।

প্রায় দেড়শ বছর আগে জেলের এক কয়েদি দাবি করেছিল, মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের নীচে কয়লা খনির অস্তিত্বের কথা। কয়েদির দাবি অনুযায়ী জেল চত্ত্বরে খোঁড়াখুড়ি শুরু হয়েছিল। প্রায় এক বছর ধরে চলল খনন। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ এক কয়েদির তোলা ধুয়োয় ধুন শুরু করল কেন? সে বিষয়ে নিরদিষ্টত্থ্য মেলে না। এই কয়েদি ছিল ইউরোপের কোনও এক দেশের বাসিন্দা। তার সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় না। জেল কর্তাদের হন্যে হয়ে কয়লা খনি খোঁজার আর একটি কারন হতে পারে, কয়েদিটি হাতে গরম প্রমাণ হাজির করেছিলেন। সেই নমুনা পরীক্ষা করে জানা গিয়েছিল উৎকৃষ্ট মানের কয়লা রয়েছে জেল চত্ত্বরের নীচে। তা শুধু তোলার অপেক্ষা। তারপর?


রাজা সলোমনের হিরের খনির খোঁজের মতো অভিযানের শেষটা জানার আগে জেলের শুরুটা জানা দরকার। তাহলে খোঁড়াখুঁড়ির প্রেক্ষাপটটি বোঝা যাবে।

মেদিনীপুর জেলের নিচে কয়লা খনি ! খোঁজ দিয়েই বেপাত্তা কয়েদি  | Coal block under Midnapore Central Jail (midnapore central correctional home)
Midnapore Central Correctional Home (মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার)।

মেদিনীপুর শহরের কেন্দ্রে এখন যেখানে মেডিক্যাল কলেজ তার ঠিক পেছনে ছিল পুরাতন জেলখানা। আসলে এটি ছিল একটি প্রাচীন দুর্গ। সম্ভবত মেদিনীপুর নগর প্রতিষ্ঠার সময়ে এই দূর্গ নির্মিত হয়েছিল। সেই সময় তার মধ্যে একটি মসজিদ ছিল। সেখানে মদিনী বাদশা আলমগির পীরের সমাধি আছে। মোগল আমলে এই দুর্গে তাদের প্রধান সেনা-নিবাস ছিল। মারাঠা আক্রমণ দমন করার জন্য সেনা সমাবেশ করে ১৭৫০ সালে নবাব আলীবর্দী খাঁ মেদিনীপুর শহরে কিছুদিন ছিলেন। নবাব সিরাজৌদ্দোলা, মীরজাফর, মীরকাসেম এই দুর্গে বহুদিন বসবাস করেছিলেন। সেই থেকে মেদিনীপুর শহরের কিছু জায়গার নাম অলিগঞ্জ, সুজাগঞ্জ, মীরবাজার, মীর্জাবাজার, পাঠানমহল্লা, শাহমহল্লা, দেওয়াননগর নাম হয়েছে বলে ঐতিহাসিকগণের ধারণা। অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সারা দেশে যে তিনটি জেলা গড়ে তুলেছিল তার মধ্যে মেদিনীপুর জেলা গঠিত হয় ১৭৬০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর।


মেদিনীপুর জেলের নিচে কয়লা খনি ! খোঁজ দিয়েই বেপাত্তা কয়েদি  | Coal block under Midnapore Central Jail (midnapore central correctional home)
Midnapore Central Correctional Home (মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার)

জেলা গঠনের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে এই দূর্গটি তাদের সেনা-নিবাসে পরিনত হয়। এখানে বহু সেনা থাকত। তখন গড়ে উঠল কর্ণেগোলা, সিপাহী বাজার, খাপ্রেল বাজার প্রভৃতি। এই দুর্গের চারিদিকে সুবিশাল কেল্লা মাঠ ছিল। সেই মাঠে হিন্দু, মুসলিম, ইংরাজদের মধ্যে জয়-পরাজয়ের বহু ইতিহাস আছে। ১৭৪৬ ডিসেম্বরে মেদিনীপুরে বাংলার নবাবের সাথে যুদ্ধে মারাঠাদের পরাজয় ঘটে। ১৭৬৮সাল পর্যন্ত মেদিনীপুরের রেসিডেন্ট (ম্যাজিস্ট্রেট)-কে মারাঠারা ব্যতিবস্ত করেছিল। এখন সেই অবশিষ্ঠ কেল্লা মাঠই কলেজ মাঠ। পরবর্তী কালে গড়ে উঠেছে কলেজিয়েট স্কুল (বালক ও বালিকা), মেদিনীপুর কলেজ, ছাত্রাবাস, ডাকঘর, জেলা পরিষদ, বিদ্যাসাগর স্মৃতি হল, হাসপাতালসহ বহু সরকারি ও বেসরকারি বাড়িঘর। ফাঁকা মাঠটি এখন মেদিনীপুর কলেজ ও কলেজিয়েট স্কুলের খেলার মাঠ। শত্রুর অতর্কিত আক্রমণ থেকে পরিত্রাণের জন্য এই দূর্গের ভিতর থেকে গোপগড় পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গপথ ছিল বলে জনশ্রুতি আছে। সেনা-নিবাস উঠে যাওয়ার পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছে এটি ছিল মেদিনীপুর জেলা জেলখানা। পরে নানা কারনে এই জেল খানা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যায় কোম্পানী। এখনও সেটি পুরাতন জেলখানা বলেই মেদিনীপুরবাসি জানেন।

মেদিনীপুর জেলের নিচে কয়লা খনি ! খোঁজ দিয়েই বেপাত্তা কয়েদি  | Coal block under Midnapore Central Jail (midnapore central correctional home)
মেদিনীপুর সংশোধনাগার থেকে তৈরী হবে ঔষধি, চাষ করছেন বন্দীরা (Photo Courtesy - Asianet News Media & Entertainment Private Limited)।

এই জেলখানা সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পিছনেও একটি এতিহাস আছে। সেই সময় ভারতীয় জেলগুলির অবস্থা ছিল ভয়ঙ্কর। সেই অমানবিক অবস্থা দেখে ১৮৩৫ সালের ২১ ডিসেম্বর ভারতের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে একটি রিপোর্ট জমা দেন আধুনিক জেলের স্থপতি লর্ড টি বি ম্যাকুলে। এক একটি জেলে কয়েদির গাদাগাদি অবস্থা, অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি, খাদ্যের অভাব, বস্ত্র নেই, বিনা চিকিৎসায় বহু কয়েদি মারা যাচ্ছে। জেল সংস্কারের জন্য তিনি একটি কমিটি নিয়োগের পরামর্শ দেন। ১৮৩৬ সালের ২ জানুয়ারি লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক প্রথম প্রিজন ডিসিপ্লিন কমিটি এবং ১৮৬২ সালে লর্ড ডালহৌসি দ্বিতীয় কমিটি নিয়োগ করেন। তারপরেই ১৮৪৬ সাল থেকে সেন্ট্রাল জেল তৈরি হয়। মেদিনীপুরও সেন্ট্রাল জেল তৈরির পরিকল্পনা হয়।


পরিকল্পনা রুপায়ণের আগেই ঘটে যায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ১৮৬৪ সালের ৫ অক্টোবর মেদিনীপুরে প্রবল বন্যা হয়। খেজুরী বন্দর ধ্বংস হয়ে যায়। ১৮৬৬ সালের দুর্ভিক্ষে মেদিনীপু্র বিধ্বস্থ হয়। ১৮৬৭ সালের ১৫ অক্টোবর মেদিনীপুরে ঝড়ে হাজার হাজার মানুষ মারা যান। পুরাতন জেলখানার অবস্থাও সঙ্গিন। তখন ১৮৬৮ সালে মেদিনীপুরে ৯২ বিঘা জারগার উপর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার একটি জেল তৈরি করেন। সেটাই এখন মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল। ১৯৭৭ সালে তার নতুন নাম হয় মেদিনীপুর কেন্দ্রিয় সংশোধনাগার। পুরাতন জেলখানাটি দেড়শ বছর আগে তৈরি নতুন মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তরিত হয় । জেল তো হল। কিন্তু জেলে যে জলের খুব সমস্যা। তখন জেলের ভিতরে জলের খুব সমস্যা ছিল। নতুন কুপ খনন করার সিদ্ধান্ত হল। ব্রিটিশ সরকারের তৈরি এই জেলে ছিল এক ইউরোপিয়ান কয়েদি। আর্টেজিয় কূপ খনন করার দায়িত্ব পড়ল সেই ইউরোপিয়ান কয়েদির উপর। তিনি ১৮৬৯ সালে খনন শুরু করলেন।


কূপ খনন হওয়ার পর তাঁর জেল খাটার মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। জেল মুক্ত হয়ে তিনি জেল কর্তৃপক্ষের কাছে অত্যন্ত গোপনে জানালেন, এখানে জেলের নিচে অতি মূল্যবান কয়লার খনি আছে। কূপ খনন করার সময় ১১৮ ফুট নিচে তিনি সেই কয়লার স্তর পেয়েছেন। তার নমুনাও তিনি জেল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেন। প্রশাসন পরীক্ষা করে দেখে তা সত্যিই উন্নতমানের দামী কয়লা। চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল। জেলের নিচে কয়লার খনি আবিষ্কার! সকলেই খুব উত্তেজিত। এবার আবিষ্কর্তার ভবিষৎবাণীর সত্যতা যাচাই করার জন্য ১২১ ফুট পর্যন্ত খনন করে ঘোষণা করা হল কয়লার স্তরে পৌঁছানো গিয়েছে। ১৩০ ফুট পর্যন্ত কয়লার স্তর রয়েছে বলে খননকারিদের ধারণা। ইংল্যান্ড থেকে জরুরী টেলিগ্রাম এলো আরও অতিরিক্ত খনন করার জন্য। কয়লা খনি পেলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর লাভ। উনিশ শতাব্দী পর্যন্ত কয়লাই ছিল শক্তির অন্যতম বাণিজ্যিক উৎস। ১৮৫৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে চালু হওয়ার পর কয়লা আহরণের কাজ খুব বেড়ে যায়।


জিওলজিক্যাল সার্ভের সুপারিন্টেনডেন্টের অধীনে খনন চলতেই থাকল। শেষ পর্যন্ত পলি মাটি আর মোরাম ছাড়া আরও কিছুই পাওয়া গেল না। কিন্তু সকলেই নাছোড়বান্দা। কয়লা যখন পাওয়া গিয়েছে কয়লা খনি আছেই। কোনো বিতর্কে না গিয়ে এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনীয়ার বীট মেথোড পদ্ধতিতে ধারাবাহিক ভাবে পরীক্ষা করার নির্দেশ দিলেন। এক বছর ধরে খনন আর নানা পরীক্ষার পরও কিছুই পাওয়া গেল না। অবশেষে ১৮৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে খনন স্থগিত করে দেওয়া হয়।


এবার ডাক পড়ল সেই ইউরোপিয়ান কয়েদির। খোঁজ খোঁজ। দলে দলে পুলিশ ছুটল তার খোঁজে। কিন্তু মিলল না। তিনি ফেরার। পুলিশ আধিকারিক সকলেই তাঁর ঘরে গিয়ে তল্লাসী শুরু করলেন। এবার আসল রহস্য উদ্ঘাটন হল। ঘরের মধ্যেই পাওয়া গেল সেই ‘অতি মূল্যবান দামী কয়লা’ ভর্তি বস্তা। তদন্ত করে জানা গেল, কূপ খনন করার যন্ত্রপাতি আনার সময় সেই কয়লা এনেছিল সে। খনন করার সময় লুকিয়ে কিছু কয়লা সে গর্তে ফেলে দেয়। খনন করার সময় সেই কয়লার টুকরোই উঠে আসে। বহু অর্থ ব্যয় এবং ১২ মাসের পণ্ডশ্রমের কথা ও’ম্যালী তাঁর ‘মেদিনীপুর ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার’-এ এই ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন। ব্রিটিশ প্রশাসনের আধিকারিক, ইঞ্জিনীয়ার, পুলিশকে বোকা বানিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গেল প্রাক্তন ইউরোপীয়ান কয়েদি। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে ইংল্যান্ড পর্যন্ত কর্তৃপক্ষকে নড়িয়ে দিয়েছিল সেই কয়েদি।

কিন্তু সময়টা ছিল ডিসেম্বর। ১ এপ্রিল হলে কয়েক শতাব্দীর সেরা ‘এপ্রিল ফুল’ হত জেলের নীচে কয়লা খনির খোঁজ।


midnapore.in

(First Published on 28.09.2018 (ABP) / Republished here on 12.07.2020)