মেদিনীপুরে করনা যুদ্ধ, বর্তমানে করনীয় নিয়ে আরো কিছু কথা | Corona situation in Medinipur – DO’s and DON’Ts.

মেদিনীপুরে করনা যুদ্ধ, বর্তমানে করনীয় নিয়ে আরো কিছু কথা | Corona situation in Medinipur – DO’s and DON’Ts.

দীপঙ্কর দাস।


মেদিনীপুরে করনা সংক্রমণের তিনটি সূত্রের কথা জানা গেছে; ১) দিল্লীর তবলিগ জমায়েত থেকে আসা জমায়েতি ও প্রতিনিধীবৃন্দ। এই প্রতিনিধীরা এসেছে মুখ্যত মায়নামার-মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ থেকে। মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর শহরে, বিশেষ করে পাঁচবেড়িয়াতে এরা কয়েকটি জমায়েত করে। দিল্লীতে এবং মেদিনীপুরে এই জমায়েতের জমায়েতি ও প্রতিনিধীদের কোনো রকম স্বাস্থ্য পরিক্ষা করা হয়নি। অনেক দেরিতে দিল্লী কঠোর ভাবে কোয়েরেনটাইন কার্যকর করলেও খড়্গপুরে এখনো পর্যন্ত তা করা হয়নি। ভারতবর্ষে ভোট রাজনীতিতে সর্ব প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে বরদাস্ত করা হয়ে থাকে, যে নিয়মে, এক্ষেত্রে তারই আত্যন্তিক প্রকাশ দেখা গেছে। ২) দিল্লী-মধ্যপ্রদেশ-ঝাড়খণ্ড থেকে আসা আর পি এফ জওয়ান, এদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও ব্যবস্থা প্রশ্নের উর্দ্ধে নয়। ৩) দিল্লী-মহারাষ্ট্র-গুজরাট থেকে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিক, এরা সংখায় যেমন বেশি, কেন্দ্রের অপরিকল্পিত করনা এক্সপ্রেস এবং নিজেদের উদ্যোগে মোটরে আসা ঢল সামলাবার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাজ্যে না থাকায়, এবং এদের একাংশের অসহযোগী মনোভাবের কারণে গোষ্ঠী সংক্রমণ দেখা দিয়েছে, যদিও সরকারী ভাবে স্বীকার করা হচ্ছে না।


সার্বিক ভাবেও করনা নিয়ে বিভ্রান্তি বেড়ে চলেছে। সংক্রমণের উৎস্য চৈনিক বাদুড়, এমন কথা প্রথম দিকে শোনা গেছলো, কথাটার বিশ্বাসযোগ্যতা আছে; মনুষ্যেতর প্রাণীর ভাইরাস ঘটিত নানা রোগ মনুষ্য সমাজে মহামারি ডেকে আনার দীর্ঘ ইতিহাস আছে; বসন্ত-প্লেগ-ডিপথেরিয়া-জলাতঙ্ক-এ্যানথ্রাস-সোয়াইন ফ্লু। অনেক মানুষের মৃত্যুর পর হার্ড ইমিউনিটি অর্থাৎ বৃহৎ সংখ্যক মাননুষের শরীরে প্রতিরোধ শক্তি অর্জিত হবার পর রোগ প্রশমিত হয়েছে। কিছু কিছু রোগের প্রতিষেধকও আবিস্কৃত হয়েছে; যেমন বসন্ত-ডিপথেরিয়া-জলাতঙ্ক। এবং এই সব রোগ মহামারি হয়ে ওঠার পিছনেও আছে একদিকে অজ্ঞতা অন্যদিকে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ। সুতরাং চীনা উৎস্য আবিশ্বাস যোগ্য নয়, এখন আবার চীনারাই সে কথা আস্বীকার করছে, তার পিছনে কতটা সত্য আছে বলা মুস্কিল, তাছাড়া চীনে আবার নতুন ধরণের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে বলে খবর।


এখন শোনা যাচ্ছে করনা ভাইরাস গুরু মস্তিষ্কের রক্তবহা ধমনীর মধ্যে বাসা বেঁধে অবরোধ সৃষ্টি করার ফলে সেরিব্রাল এ্যাটাকও হতে পারে (এই সময়, ১৫ /৬ /২০২০)। ভারতবর্ষে এরকম একজন মাত্র রোগী পাওয়া গেলেও ইউরোপে বেশ কয়েকজন এরকম রোগী পাওয়া গেছে, অস্যার্থ করনা ভাইরাসের মিউটেশন ভিন্ন পথ ধরেছে। আরো শোনা গেছে উপসর্গহীন রোগীরা বেশি বিজ্জনক কিন্তু এমস এর প্রাক্তন ডিরেকটর মহেন্দ্র মিশ্র বলেছেন, এই আশঙ্কা অমূলক. কারণ হাঁচি-কাশির উপসর্গ না থাকায় ড্রপলেট সংক্রমণের সম্ভাবনা নেই, আক্রান্ত ব্যেক্তির সঙ্গে দীর্ঘ সময় ঘনিষ্টভাবে কথা-বার্তা বললে অবশ্য সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা আছে (আনন্দবাজার, ২৬ /৬ /২০২০); এই মন্তব্য ত্রুটিযুক্ত, দম্পতি থেকে পরিবারের অন্যরা একে একে সংক্রমিত হতে পারেন, তবে তিনি যে বলেছেন; টোটোচালক-ফলবিক্রেতা ইত্যাদি যারা ক্রমান্বয়ে বহুলোকের সংস্পর্শে আসে, তারা সংক্রমণের বড় উৎস্য, সে কথা বিবেচনার যোগ্য।


আর একটি খবর উদ্বেগজনকঃ ১৬ই জুনের এই সময়ে বলা হয়েছে যে ল্যানসেট ও নিউইয়র্ক জার্নালে প্রকাশিতি পৃথক দুটি প্রবন্ধে ক্লোরোকুইন ও হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন এই দুটি ওষুধ রোগীর চিকিৎসায় যথেষ্ট ফলপ্রদ তো বটেই, প্রতিষেধক হিসেবেও কার্যকর বলা হয়েছিল, এই মন্তব্যের ভিত্তি সার্জিস্ফিয়ার করপোরেশন প্রদত্ত পরিসংখ্যান কিন্তু সার্জিস্ফিয়ার যে সব হাসপাতালে এই সব ওষুধ ব্যাবহার করে সুফল পাওয়া গেছে তার তালিকা দিতে রাজি হয়নি। ফলে তাদের দেওয়া তথ্য কতটা নির্ভরযোগ্য এই প্রশ্নে গবেষণাপত্রদুটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। যার অর্থ গবেষকরা সরজমিন সমীক্ষা ছাড়াই স্রেফ উড়ো খবরের ভিত্তিতে প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। এই প্রবণতা অবশ্যই নিন্দার্হ তবে শেষ পর্যন্ত তাঁরা সততার পরিচয় দিয়ে গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করেছেন বলে একই সঙ্গে ধন্যবাদর্হ। যথেষ্ট বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলেও রোগের চিকিৎসায় ওষুধ দুটির কার্যকারিতা পরীক্ষা বন্ধ হওয়া বাঞ্চনীয় নয়। আমেরিকান মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন বলছে (যুগশঙ্খ, ২৮ /৬ /২০২০) যে গেঁটেবাতের ওষুধ কোলকিসিন প্রয়োগে করানা রোগীরা দ্রুত আরোগ্য হচ্ছেন, এই ওষুধের কার্যকরিতাও পরীক্ষণীয়। কোভিড থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের প্লাজমা থেকে পাওয়া এ্যান্টিবডি প্রয়োগে দ্রুত আরোগ্যলাভের কথা বলেছে এমস (২৭ /৬ /২০২০ আনন্দবাজার)। এ্যান্টিবডি শুধু ভাইরাস ঘটিত রোগে নয়, অন্যান্য রোগের চিকিৎসতাতেও ফলদায়ক। নিমের উপকারী এ্যলকালয়েড এবং ফ্যাটি এ্যাসিডের রোগ প্রশমন ক্ষমতা এবং আদা-মধু-তুলসীপাতার উপাদানগুলি নিয়ে পরীক্ষার কথা কেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ভাবছনে না বোঝা দুস্কর। যাইহোক উল্লিখিত ওষুধগুলি ব্যাবহার করা যেতেই পারে কিন্তু প্রতিষেধক আবিস্কার না হওয়া পর্যন্ত করনার দাপট কমানো যাবে না, মৃত্যুহার বাড়তেই থাকবে। প্রতিষেধক নিয়ে তাড়াহুডে়াও বিপজ্জনক, পরীক্ষা-নিরীক্ষার বৈধ ধাপ না পেরিয়ে পতিষেধক ঘোষণায় একদিকে প্রতিষেধক গ্রহণকারীদের যেমন অনিষ্ট হতে পারে, তেমনি সতর্কতা বর্জনের ফলে সংক্রমণ অতি মহামারির আকার নিতে পারে।


এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের করনীয় কি? অবশ্যই কিছু করনীয় আছে। রাস্তায় বেরিয়ে দোকান-হাট করার সময় মুখা (Mask) ব্যাবহার এবং ছাতা মাথায় দেবার কেরালিয়ান পরামর্শ আবশ্যিক অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। কারণ ড্রপলেট থেকে আত্মরক্ষা ও সোসাল ডিষ্টেনস রক্ষা করে চলা-ফেরা ছাড়া নিজে বাঁচা এবং অন্যদের বাঁচানোর অন্য কোনো উপায় সাধারণ মানুষের হাতে নেই। বহিরাগতদের কোয়ারেনটাইনে থাকা বাধ্যতামূলক স্বেচ্ছা অভ্যাস হওয়া দরকার। আর সামাজিক দায়বদ্ধতাবোধ গড়ে তুলতে হবে। আক্রান্তরা যাতে ওষুধ ও পথ্য পান সেদিকে নজর রাখতে হবে, সর্বহারাকে আহার যোগাতে হবে। শেষের দুটি কাজ করার জন্যে এলাকাভিত্তিক স্বেচ্ছা সংগঠন তৈরি করা দরকার। এসব কাজ ঠিক-ঠাক হচ্ছে না; ছেলে-ছোকরা থেকে বুডে়া-হাবড়া অনেকে মুখা ব্যাবহার করছেন না, যত্রতত্র কফ-থুতু ফেলছেন, ঠেকের আড্ডায় সোসাল ডিসটেন্স লঙ্ঘিত হচ্ছে, বহিরাগতদের অনেকেই কোয়ারেটাইনে যাবার গরজ দেখাচ্ছেন না। ফলে করনা যুদ্ধ ক্রমশ কঠিন হচ্ছে। হুঁশিয়ার।


midnapore.in

(Published on 01.07.2020)