শ্যামল বেরা।
সাহিত্য-শিল্পাশ্রয়ী লোকসংস্কৃতির মধ্যে বিয়ের গান খুবই তাৎপর্যবহ। বিয়ের গান অন্তঃপুরের গান। বিয়ের গান নারীদের দ্বারা সৃষ্ট, নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা সমাজজীবনের চিত্রায়ন। আমাদের সমাজ বিবর্তনের ধারাটি বুঝতে হলে এইসব লোকায়ত গানের দ্বারস্থ হওয়া প্রয়োজন। কেননা, "বিবাহপ্রথা ও পদ্ধতিকে ভিত্তি করে যে-সব প্রাচীন সংস্কার নিয়ম (convenances) প্রচলিত ছিল বা আছে, তার ইতিহাস আলোচনা করলেই সংশ্লিষ্ট সমাজ সম্প্রদায়ের ইতিহাস অনেকটা বোঝা যাবে১। বিয়ের গান বিয়ের লৌকিক বা স্ত্রী-আচারের সঙ্গে যুক্ত।
মেদিনীপুর জেলা বহু জনগোষ্ঠীর, বহু সংস্কৃতির মহামিলন ক্ষেত্র। সংগ্রামে, সৃষ্টিতে, আত্মীয়তায় মেদিনীপুরের দোসর মেলা ভার। কিন্তু কেমন ছিল আমাদের অতীতের দিন যাপন, কেমন ছিল আমাদের কলাসৃষ্টির অভিব্যক্তি - তার তেমন কোন রেকর্ড নেই। তবে ক্রমবিলীয়মান ঐতিহ্যের যেটুকু আজও টিকে রয়েছে, তা সংগ্রহ করতে পারলেও অনেকখানি কাজ হয়। বিশেষ করে বিয়ের গানের ধারাটি যেভাবে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে, তা এখনই সংগ্রহ করতে না পারলে কয়েক বছর পরে একেবারেই লুপ্ত হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। মেদিনীপুর জেলার বিয়ের গানের মূল লালন-পালন চলেছে আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে, তার পরে পাঞ্জাবী, গুজরাটী, জৈন, বিহারী প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে। বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীতে ধারাটি খুবই ক্ষীণ। মেদিনীপুর জেলার বিয়ের গানের যে ব্যাপ্তি এবং এসব গানে মানব মনের অনুভব উপলব্ধির উৎসমুখ থেকে যে সৃষ্টিতরঙ্গ, তা বহু ধারায় উৎসারিত হয়ে আমাদের লোকমেধাকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। এসব গান আজও লিপিবদ্ধ হয়নি। মৌখিকভাবে সৃষ্ট এই বিয়ের গান রয়েছে মানুষের স্মৃতিতে এবং গানগুলি গীত হয় লোকসঙ্গীতের বিশেষ সুরে। গানগুলির মধ্যে লোকসাহিত্যের বৈশিষ্ট্যগুলি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। যাই হোক আমাদের আলোচ্য বিষয় মেদিনীপুরের মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিয়ের গান। যখন রেডিও, মাইক, টিভি-র দাপট ছিল না, তখন মূলত বয়স্ক মহিলারাই বিয়ের আসর মুখর করে রাখতেন এইসব গানের মধ্য দিয়ে। আজও বিয়ের সে গান হয়, তার সুর তরঙ্গ কে ছাপিয়ে গর্জন করে. চলে মাইকে ছায়াছবির মুখরোচক গান কিংবা ভিডিওর তাণ্ডব। এসব কিছুর মধ্যে দেখা যায় গানগুলি তার প্রাণস্ফৃর্তি ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে।
মেদিনীপুর জেলার মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ঐতিহ্যের লালন-পালনের বিশেষ কিছু হেরফের হয়নি, তবে বিত্তবান পরিবারে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। পাশাপাশি, বিয়েকে কেন্দ্র করে যে গীতের চল ছিল, তা আজ অচল হয়ে পড়েছে। গীত যারা শোনাতেন, তাদের বয়সও পড়ন্ত বেলার দিকে। সৃষ্টি সুখের উল্লাস নেই - কি ব্যক্তিজীবনে, কি সমাজজীবনে। নীরবে, নিভৃতে অতি মন্থরভাবে কাটে তাদের দিন যাপনের প্রহরগুলি। যে দু'একজনের স্মৃতিতে ও সব গান আজও টিকে রয়েছে, তাদের কাছ থেকে গানগুলি সংগ্রহ করাও খুব কঠিন কাজ। সময়-শ্রম-অর্থের প্রসঙ্গ ছাড়াও মূল যে বিষয় উল্লেখ করতে হয়, তা হল - গায়িকাদের মুখের কথাকে উচ্চারণ মতো লিখতে গিয়ে কিছু কিছু-বিপত্তি ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না; কখনোবা গায়িকারা নিজেদের মতো করে এমন শব্দ ব্যবহার করেন কিংবা বদলে দেন - যার অর্থ করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যাই হোক, এবার গানের প্রসঙ্গে আসা যাক।
আলোচ্য নিবন্ধে ১৫টি গানের প্রকাশ ও প্রসঙ্গ এসেছে। গানগুলির পাঠ গ্রহণ করলে মেদিনীপুরের মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিয়ে কেন্দ্রিক এক চালচিত্রের সাথে পরিচিত হওয়া যায়। প্রথম গানটি 'কালা গেছে মেদিনীপুর' রঙ্গরসিকতার গান। 'ঢোলক' বাজিয়ে 'তালি' মেরে সামান্য কোমর দুলিয়ে গানটি গীত হয়। প্রাণের অফুরান আবেগ ও উল্লাস ব্যক্ত হয় গানটি পরিবেশনার সময়। কখনো একক কণ্ঠে, আবার কখনো বা মিলিত কণ্ঠের এ গানে রয়েছে 'কালা' অর্থাৎ কৃষ্ণের অনুষঙ্গ, এসেছে নানাবিধ অলংকারের তালিকা। উল্লেখ্য, গানটি এক এক অঞ্চলে একটু ফিরিয়ে গীত হয়ে থাকে। যেমন, একটি ভিন্ন রূপের কয়েক পংক্তি এইরকম -
এরপর একে একে বিভিন্ন অলংকারের নাম যুক্ত হয়ে, গানটি বর্ধিত হয়ে গীত হয়।
২ নং গানটি থেকে আমরা বরের পোশাকের একটি বিবরণ পাই। বরের হাতে রেশমি রুমাল, মাথায় জরির টুপি, গায়ে সিল্কের জামা। বরের পোশাকের পাশাপাশি জানা যায় আলো ব্যবহারের প্রসঙ্গটিও। আলো বলতে মশাল কিংবা “ঝাড়মোমের বাতি'র ব্যবহার।
৩ নং গানটির বিষয় ভাবনায় রয়েছে - ছেলে বিয়ে করতে যাবে, যদি কোন বিপদ ঘটে তাই নিয়ে মায়ের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা। ছেলে যাতে দুশমনের হাতে না পড়ে, তার জন্য মা দুশমনকে মন্ত্রে জব্দ করার প্রার্থনা প্রকাশ করেছে।
৪নং গানে রয়েছে স্নিগ্ধ মধুর ছবি। রয়েছে 'শ্যাম'-এর অনুষঙ্গ, বিয়ের চিঠি লেখার অনুষঙ্গ । স্নিগ্ধ মধুরতার মধ্যেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের আধিপত্য এবং নারীর নত নম্র হয়ে আপন পুরুষকে সুখী করার মধ্যে সুখ পাওয়ার দিকটি যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে 'শ্যাম তুমি খাবে চিরকাল' পংক্তিটির মধ্যে।
৫ নং গানটি গায়ে হলুদের গান। উল্লেখ্য, “ধর্মান্তরিত অন্যান্য সমাজের ন্যায় বাঙালি মুসলমান সমাজেও. চিরাচরিত হিন্দু সমাজের অনেক লোকাচার পালিত হয়। যেমন, বিবাহের পূর্বে বরকনেকে আশীর্বাদ করা, আইবুড়োভাত বা থাল দেওয়া, গায়ে হলুদ দেওয়া, জল আনা...।”২ মেদিনীপুর জেলার মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে এসব লোকাচার দৃষ্ট হয়। “মুহম্মদ আয়ুব হোসেন বঙ্গীয় রাঢ় অঞ্চলের মুসলমান সমাজে প্রচলিত বিবাহরীতি বিষয়ে” এইসব লোকাচারের কথা উল্লেখ করেছেন।৩ আলোচ্য গানটিতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান তথা স্ত্রী আচারের একটি ছবি পাওয়া যায়।
বিবাহ অনুষ্ঠানের সময় প্রায় সারারাত জেগে কাটিয়ে দেন অন্তঃপুরের মহিলারা। তখন যেসব গান গীত হয়, তার একটি গান হল ৬ নং গান। নারী-হৃদয়ের স্বপ্প-সাধ উৎসারিত হয়েছে এই গানে। দামাদলাল (স্বামী) শাড়ি, ব্লাউজ, চুড়ি দিয়ে ভরিয়ে দেবে তার বধূকে। প্রসন্ন কৌতুক রস তরঙ্গায়িত হয় এই গানে।
৭ ও ৮ নং গান বিষণ্ণতার গান। বীতশোক রমণীর স্থিতধী উচ্চারণের প্রকাশ ঘটেছে গান দুটিতে। ৯ ও ১০ নং গানে রয়েছে যৌতুকের প্রসঙ্গ। সাইকেল, ঘড়ি, মোটর সাইকেল, সেইসাথে টাকাও চাই যৌতুক হিসাবে।
বিয়ের পর কন্যা চলে যাচ্ছে শ্বশুরালয়ে। তাই ভরা ঘর ভাসিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছে কন্যা, পিতা-মাতা (১১ নং গান)। কন্যা তার প্রিয় ভূমি ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছে, তাই সে ড্রাইভারকে বলছে; ড্রাইভার যেন আস্তে আস্তে গাড়ি চালায়; যতক্ষণ দেখা যায় তার ফেলে আসা শৈশবের ছবি (১২ নং গান)। শ্বশুরালয়ে এলে দামাদ (স্বামী) তার বধূকে সান্তনা দেয় (১৩নং গান)। বিয়ের পর কাজের জন্য স্বামী গেছে দূর দেশে। তার জন্য ভারাক্রান্ত মনে দিন কাটানর ছবি রয়েছে ১৪নং গানে। ১৫নং গানে স্নেহময়ী জননীর বাৎসল্য রসের উৎসারণ ঘটেছে। অনেকদিন পর কন্যা আসবে জননীর কাছে, তার জন্য প্রতীক্ষায় সর্বকালীন মাতৃহৃদয়ের মধুরভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। বঙ্গভূমির মৃত্তিকায় ও জলবায়ুতে আমাদের যে জীবনযাপন, আশা-স্বপ্ন, কামনা-বাসনা - তাই এইসব গানে বিধৃত হয়েছে। গোপালের জন্য মা যশোদা, উমার জন্য মা মেনকা যেভাবে তাদের অন্তরকে প্রসারিত করেছেন, 'মেরীজুন'-এর (আদরের কন্যার) জন্য তার মাও কম করেননি। 'মেরীজুন' এলে তাকে আগে দেবে তৃষ্ণার জল, দেবে পাখার বাতাস; তারপর কোথায় শোবে, কী খাবে, তা নিয়ে মায়ের চিন্তার অন্ত নেই। এই মা সর্বকালের, সকলের মা। আমাদের সমাজের নারীরা এমন সব সুন্দর ভাবনার সার্থক প্রকাশ ঘটাতে পেরেছেন তাদের গানে। কিন্তু এসব গানের কথা বলবে কে? মেদিনীপুর জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চায় এসব লোকায়ত গান আজও উপেক্ষিত, অনালোচিত।
midnapore.in
১. দক্ষিণ চবিশ পরগণার মুসলমান সমাজের বিয়ের গান। নির্মলেন্দু ভৌমিক, লৌকিক উদ্যান, মে ১৯৯৭ , পৃষ্ঠা ২১৩।
২. ভারতের বিবাহের ইতিহাস। অতুল সুর, পৃষ্ঠা ২০৬।
৩. ভারতীয় সমাজ ও বিবাহ। নৃপেন্দ্র গোস্বামী, পৃষ্ঠা ২০৬। এছাড়া, বর্তমান নিবন্ধকারের 'লোকায়ত' জানুয়ারী '৯৮-এ প্রকাশিত 'মেদিনীপুর জেলার বিয়ের গান' রচনার অংশবিশেষ বর্তমান নিবন্ধে ব্যবহৃত হয়েছে।
যাঁদের কাছে গানগুলি সংগৃহিত হয়েছে তাঁরা হলেন -
ক) জাবেদা বিবি (৬৫) - শান্তিপুর, থানা - কোলাঘাট।
খ) মোসম্মদ পেয়ারজান বিবি (৬৭) - মেছেদা, থানা - কোলাঘাট।
গ) সায়রা বিবি (৪১) - চিড়িয়া, থানা - তমলুক।
ঘ) রসিমা খাতুন (৮৫) - বাবুয়া, কোলাঘাট।
ঙ) আসপিয়া খাতুন (৭০) - বাবুয়া, কোলাঘাট।
গানগুলি সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে কবি-বন্ধু আবদুল মান্নান এবং স্নেহভাজন সাহালাম খান ও ফারুক হোসের সহযোগিতা পেয়েছি। সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।