football player Bikram Bahadur Thapa (Midnapore), বিক্রম বাহাদুর থাপা

বিক্রম বাহাদুর থাপা | Bikram Bahadur Thapa

সুশান্ত ঘোষ।


হঠাৎ চোখে পড়ে যাওয়ায় প্রথমেই চমকে উঠলাম। ক্ষয়িষ্ণু চেহারা, চোখে মুখে চিন্তার ভাঁজ, মলিন ও অগোছালো পোষাক, ধপধপে ফর্সা চেহারা টাও তামাটে হয়ে গেছে, পরিপাটি স্টাইলিস্ট মাথার চুল উধাও হয়ে উসকো খুশকো ও কাঁচা পাকাতে ভরে গেছে। যেন বয়সের তুলনায় অনেক বেশি বয়স্ক মনে হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন তবুও চিনতে আমার একটুও ভুল হয়নি "বিক্রম বাহাদুর থাপা" কে। এত সহজে কি তাকে কেউ ভুলতে পারে ?

football player Bikram Bahadur Thapa (Midnapore), বিক্রম বাহাদুর থাপা
বিক্রম বাহাদুর থাপা | Bikram Bahadur Thapa

তবে ফুটবল জীবনের সেই আকর্ষণীয় সুন্দর বলিষ্ঠ চেহারার সঙ্গে এই চেহারার কোন মিলই যেন নাই। সেই শাল গাছের গুড়ির মতো থাই, সিক্স প্যাক বডি একেবারে উধাও কালু থাপার। এই 'কালু থাপা' নামটাই জনপ্রিয় ছিল ফুটবল মহলে। সাধারণত ফুটবল খেলোয়াড়'রা খেলা ছাড়ার পর তাদের শরীরে সাধারণ মানুষের তুলনায় একটু বেশিই মেদ জমে। অন্যান্যদের তুলনায় একটু বেশি তাড়াতাড়ি মোটা হয়ে যান (যারা শরীরচর্চা চালিয়ে যান তাদের কথা আলাদা)। কিন্তু কালু থাপা'র ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উলটো দেখলাম।

শুনলাম তার ফুটবল জীবনের পরবর্তী কাহীনী। আসলে অভাব অনটনই ও মানসিক চিন্তাই এর জন্য দাই। বিক্রম বাহাদুর থাপা বর্তমানে কলেজিয়েট স্কুলে খুব সামান্য বেতনের অস্থায়ী কর্মী। স্বপ্নকে ছুঁতে না পারার মানসিক যন্ত্রনা তার সবসময়ের সঙ্গী। আসলে ফুটবল কে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল বিক্রম বাহাদুরের।

অবিভক্ত মেদিনীপুরের (বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুর) কাঁথি মহকুমার রামনগরে ১৯৭৩ সালে জন্ম বিক্রম বাহাদুর থাপা'র। খুব অল্প বয়সেই নজরকাড়া ফুটবল খেলে ফুটবল প্রেমিদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন এই কালু থাপা। পড়তেন মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে, স্কুল টিমের অধিনায়ক ও অন্যতম ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন কালু থাপা।

মেদিনীপুরের আরেক ফুটবল প্লেয়ার (দুরন্ত স্টপার ব্যাক, বর্তমানে শিক্ষক) গৌতম দেবের মুখে শুনেছিলাম বিক্রম বাহাদুর থাপার উত্থান কাহিনী। আদতে কালু থাপা'র বাড়ী ছিল দিঘার কাছে রামনগরে, সেই সময় মেদিনীপুরের রিক্রিয়েশন ক্লাব দীঘা'তে একটা টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়েছিল। সমস্ত খেলোয়াড় সঠিক সময়ে পৌঁছতে না পারার কারনে একজন অতিরিক্ত খেলোয়াড়ের প্রয়োজন পড়ে। সেই সময় এগিয়ে আসে কালু থাপা, প্রথম খেলাতেই দারুণ পারফরম্যান্স দেখায় বিক্রম থাপা। তার খেলা ভাল লেগে যায় গৌতম দার, তাকে রিক্রিয়েশন ক্লাবে খেলার প্রস্তাব দেন গৌতম'দা। সেই সময় কালু থাপা'র বাবা সামান্য বেতনে একটি ব্যাঙ্কে অস্থায়ী নিরাপত্তা রক্ষীরর কাজ করতেন। ফলে অভাবের সংসার, তাই না বলেনি কালু থাপা। সেই থেকেই মেদিনীপুরে রয়ে গেছেন কালু থাপা। পরে গৌতম দেবের প্রচেষ্টায় কলেজিয়েট স্কুলে অস্থায়ী কাজের ব্যবস্থা হয়। গৌতম'দা সহ রিক্রিয়েশন ক্লাবের কর্ম কর্তারা চেষ্টা করেছিলেন স্থায়ী চাকরির, কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেটা আর হয়নি।

আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও স্কুল টিমের খেলা দেখতে মাঠে দর্শকদের ঢল পড়ে যেত মেদিনীপুর শহরে। মাঠে কাসর ঘন্টা, ঝাঁঝ, এমন কি চকলেট বোম নিয়েও প্রিয় স্কুল দলকে উৎসাহিত করতে হাজির হয়ে যেতো স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা। বিশেষ করে কলেজিয়েট স্কুলের খেলা থাকলে থাপাদা'র খেলা দেখতে মাঠে দর্শকদের ঢল পড়ে যেত। অল্প বয়সেই তার দুর্দান্ত স্কিল, স্পিড, ড্রিবলিং, রিসিভিং, সুটিং ছিলো প্রতিষ্ঠিত ফুটবলারদের মতো। প্রায় একক দক্ষতায় কলেজিয়েট স্কুল'কে জিতিয়ে মাঠ ছাড়তেন। অধিকাংশ খেলাতেই গোলের বন্যা বইয়ে দিতেন। যার ফলে অন্যান্য স্কুল টিমের কাছে 'থাপা' নামটা ছিল আতঙ্কের। স্কুল টিমে দুর্দান্ত খেলার কারনে খুব অল্প বয়েসেই জেলা দলে সুযোগ পেয়ে যায় বিক্রম বাহাদুর থাপা, সেখানে ভালো খেলায় সরাসরি মেদিনীপুরের তৎকালীন সেরা ফুটবল দল স্পোর্টসম্যান রিক্রিয়েশন ক্লাবে ( প্রথম ডিভিশন) বড় বড় নামজাদা ফুটবলারদের পাশে নিজেকেও সেরা ফুটবলার রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন তিনি। তার বিক্রমে ও বাহাদুরি'তে ভুগতে হতো সুভাষ কর্নার, গোল্ডেন, যুগের প্রতিক, স্যানটাফোকিয়ার মতো সেরা দলগুলিকেও। বিপক্ষ দলের পোড় খাওয়া স্টপার দের হিমশিম খাইয়ে ছাড়তেন বিক্রম বাহাদুর। বাম পায়ের সুদক্ষ ও কুশলি খেলোয়াড় ছিলেন থাপা'দা। খেলতেন লেফট উইং -এ, উইং দিয়ে তার দৌড় ছিল মারাত্মক, সেন্টার ফরোয়ার্ড'দের মাপা ক্রশ বাড়ানোয় সুদক্ষ ছিলেন। সঙ্গে দুর্দান্ত আউট সাইড, ইন সাইড ডজ করে ভেতরে ঢুকে নির্ভুল ক্রশ অথবা নিজেই গোল করে বেরিয়ে আসতেন। দলের প্রয়োজনে ও বিপক্ষ দলের আক্রমনের সময় ওভার ল্যাপিং এ নিচে নেমে ডিফেন্স কেও সাহায্য করতেন।

বহু নামকরা টুর্নামেন্টে খেলেছেন থাপা'দা। এমনিই একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে এই মহূর্তে। বর্তমানে জঙ্গল মহলের রামগড়ে একটি বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছিল আমাদের টিম (স্থানীয় রাঙামাটি সিটিজেন ক্লাবের হয়ে আমরা খেলতে গিয়েছিলাম) থাপাদাই ছিলেন আমাদের অধিনায়ক। আমি ও থাপা'দা দুজনেই লেফট উইঙ্গার (left winger) ফলে আমাকে লেফট ব্যাকে জীবনের প্রথম বার খেলতে হয়েছিল। আমাদের বিরুদ্ধে ফাইনালে উঠেছিল সারেঙ্গা সুপার ইলেভেন, দারুণ শক্তিশালী দল। প্রথমার্ধেই আমাদের দু'গোল মেরে দেয় সারেঙ্গা, পরে দশ মিনিটের মধ্যে আরও এক গোল। তিন গোলে পিছিয়ে থেকেও আমরা সেদিন দেখেছিলাম বিক্রম বাহাদুরের বাহাদুরি। প্রায় একক দক্ষতায় হ্যাটট্রিক করে সমতায় ফিরিয়ে আনে আমাদের। শেষে আমরাই ট্রাইব্রেকারে জয়ী হই। ম্যাচের শেষে থাপা'দা কে সমর্থকরা কোলে তুলে নাচতে শুরু করে দেয়। এমনই ছিলো বিক্রম বাহাদুরের বাহাদুরি। খেলেছেন রিক্রিয়েশন ক্লাব ছাড়াও সুভাষ কর্নার, পুলিশ অ্যাথলেটিকস্ ক্লাব সহ জেলার অনেক নামজাদা ক্লাবে।

football player Bikram Bahadur Thapa (Midnapore), বিক্রম বাহাদুর থাপা
সেই মাঠ, সেই বল, সবই আছে - নাই শুধু বিক্রম বাহাদুর থাপা।

তাই এ হেন ফুটবলার কে অনেকদিন পরে দেখার পরেও চিনতে কোন অসুবিধা হয়নি। মনে হয়তো খুব কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু আমরা তো সকলেই জানি আমাদের জেলা থেকে ফুটবলকে পেশা করে রাজ্য বা জাতীয় স্তরে পৌঁছে যাওয়াটা অনেকটা স্বপ্নেরই মত। তাই বিক্রম বাহাদুরের মতো অনেকের জীবনই আজ অন্ধকারাচ্ছন্ন, এটাই স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক বলে দেওয়াটা যতটা সহজ, মেনে নেওয়া ততটা সহজ নয়। আমরা কি সত্যিই পারিনা কিছু করতে ? আমরা যারা ফুটবল প্রেমী, পারিনা সবাই মিলে এগিয়ে এসে কিছু করতে ?


midnapore.in

(Published on 23.08.2020)