দীপঙ্কর দাস।
জ্ঞানন্দ্র মোহন দাসের অভিধান মতে কাঁথা সংস্কৃত কন্থা, জীর্ণ বস্ত্র রচিত আস্তরণ, শীত বস্ত্র বিশেষ। কন্থা (কম্, অভিলাষ করা) + থন্। শীতার্তগণ শীত নিবারণের জন্য যাকে অভিলাষ করে, জীর্ণ বস্ত্র রচিত শীত নিবারক বস্ত্র। ধোকড় = ধৌতকট, সূত্র রচিত ভণ্ডম, মোটা সুতার কাপড় বা মোটা কাপড়। সংস্কৃত থেকে পালি প্রাকৃত হয়ে বাংলা ভাষার বয়েস পন্ডিতদের মতে হাজার বছর। ফার্সি চাদরের বয়স মেরে কেটে পাঁচশো বছর. চাদরের একটা সম্ভাব্য বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে `উড়া-গড়া'। গড়া হলো মোটা সুতোর কাপড়, খাটো বহরের ধুতি -শাড়ী। উড়া, পরিধান করা, পরা। আওয়াজ শুনে জামাটা উড়ে লিয়ে বারিয়ে আসছি। বাঁকুড়া জেলার কোন কোন স্থানে পরিধান করা অর্থে উড়া শব্দের ব্যবহার প্রচলিত। উড়াগড়া অবশ্য শয্যা আস্তরণ নয়, উড়ানির মত পরিধান করার গড়া। পর্তুগিজ Godrim থেকে গুদড়, গুদড়ী, গুধড়ী, আড়াইশো বছরের বেশি নয়। হাজার বছর আগে কি বঙ্গবাসী জড়ের সময় জানু সম্বল করে কুকুর কুন্ডলি হয়ে ঘুমোতো?
`কাঁথ' শব্দটা দেশজ, অর্থ মাটির দেয়াল, কাঁথড়া ভগ্নদেয়াল। কাঁথের ঘরে যারা বাস করতো, তাদের কাঁথা নামক শয্যা বস্ত্র ব্যবহার বাধা কোথায়? বাধা পন্ডিতম্মন্যরা। বাংলার কোন আভিধানিক, ভাষাতত্ত্ববিদ, দেশজ শব্দ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি। ফলে কাঁথ থেকে কাঁথা বুৎপন্ন হতেপারে কিনা, তা বলার লোক নেই।
শয্যাবস্ত্র যাইহোক গাত্রাবরণ বোধক একটি দেশজ শব্দ আছে বাংলায়, `দোলাই', উড়াগড়ার মত কল্পিত সমাস নয়। গোড়ায় সম্ভবত দুপাট বা চারপাট জীর্ণবস্ত্র গায়ে চাপিয়ে কাঁধে গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। একশো বছর আগেও দোলাই এর যথেষ্ট প্রচলন ছিল। পরে হাড়ের ছুঁচের ফোঁড় সেলাই (উলিক করার জন্যে এমন ছুঁচের ব্যবহার জনজাতি বিশেষের মধ্যে ছিল) দিয়ে পোক্ত করার পদ্ধতি দেখা দেয়। গবীব -গুর্বোর ঘরে ঐপর্যন্ত, নক্সী কাঁথার জন্ম সম্পন্ন গেরস্তের ঘরে, খুব বেশি হলে আড়াইশো বছর আগে, চারশো বছরের পুরানো নক্সী কাঁথার দাবি অলীক।
কাঁথা একরকম নিখরচার সামগ্রী। জীর্ণ বস্ত্র মানে পরিধানের অযোগ্য, বাতিল ধুতি-শাড়ি। সুতোটাও বাজার থেকে কিনতে হয়না, কাপড়ের পাড় থেকেই পাওয়া যায় রঙ – বেরঙের সুতো। এই সুতো দু / তিন খি, এক সঙ্গে পাকিয়ে নিতে হয়, সেজন্যে এর ছুঁচ, সাধারণ ছুঁচের চেয়ে মোটা এবং পশ্চাতের ছিদ্রটি ফাঁদালো, এই ছুঁচকে বলে গুণ ছুঁচ, না হাড়ের ছুঁচ নয় কলাই করা ইস্পাতের। এই ইস্পাতের কলাই করা ছুঁচ নক্সী কাঁথার বয়েসের অন্যতম নির্দ্ধারক দিক চিহ্ন। ঐআড়াই শো বছর আগেই বাজারে ইস্পাতের ছুঁচ কিনোতে শুরু করে, তখনতা ছিলো বিলিতি মাল, এখন দিশি । ঐএকটা জিনিসই নগদ পয়সা দিয়ে কিনতে হতো: তা একপাতা ছুঁচেই ঠাকুমার জীবন কাল কেটে যেতো, সম্পন্ন গেরস্ত তাই এটাকে খরচা বেল গণ্য করতো না।
নানা আকারর নক্সী কাঁথা হতো। নবজাতকের জন্যে একহাত চওড়া, দুহাত লম্বা, সে কাঁথায় শিবলিঙ্গ, বেলপাতা, পদ্মফুল, ষষ্টি বন্দনার মোটিফ থাকতো। দেড় বিঘত x দেড়বিঘৎ ঘুঞ্চিপোষ, কুটুম বাড়িতে পাঠানো তত্ত্বের আবরণ, ফুল লতা পাতার মোটিফ। বরাসন ও ফুলশয্যার পাতনিতে নানা মোটিফ, ফুল - লতা – পাতা ছাড়া রামসীতা , হরপার্বতীর নাম লেখা এমন কি ছুঁচের ফোঁড়ে তাদের স্কেচ। অনেক সময় ঠাকুমা তাঁর পাঠশালে পড়া নাতিকে দিয়ে মোটা অক্ষরে নামগুলো লিখিয়ে নিতেন। আর আটপেৌরে গায়ের কাঁথা ও পাতিনিতে আয়তক্ষেত্রের আকার ক্রমশ কমিয়ে আনা। কচিৎ ঘূর্ণিত চক্রের আকারে পরিসর ক্রমশ বাড়িয়ে আনা, অর্থাৎ দ্বিতীয়টি প্রথমের বিপরীত প্রক্রিয়া। তবে দ্বিতীয় মোটিফও একটি চতুষ্কোণ বর্ডার থাকতো কিনারা বরাবর। আটপেৌরে কাঁথায় সচরাচর অন্য মোটিফ অনুপস্থিত।
কাঁথার রমরমার যুগ আমাদের প্রপিতামহী প্রমাতামহী, তাঁদের পদাঙ্কে পিতামহী মাতামহী এমনকি আমাদের মাতা পিসিমাতাদের আমলেও পোক্তা সেলাইদিয়ে আটপেৌরে পাতার ও গায়ে দেবার কাঁথা দান করার রেওয়াজ গড়ে উঠেছিল।
এই সম্পন্ন ঘরর বৌ-ঝিরা অবশ্যই বঙ্গীয় লোকসমাজের অন্তর্গত একটি উপলোকসমাজ এবং তাঁদের প্রস্তুত করা কাঁথা অবশ্যই লোক শিল্প।
পরবর্তীকাল ঐসম্পন্ন ঘরের বৌ ঝিদের হাতধরে দেখা দেয় একটি ব্যতিক্রমী ধারা। চৈতন্যোত্তর বঙ্গীয় সমাজে অনেক বৈষ্ণব আখড়া - আশ্রম - গুরুপাট গড়ে উঠে ছিলো। যদিও জীর্ণবাস বা ছেঁড়া কাঁথাই বৈরাগীর পরিধেয় কিন্তু পরবর্তী কালে এই সব আখড়া - আশ্রম-পাটে গৃহী শিষ্যাদের তরফে নক্সী কাঁথা দান করার প্রথা দেখা দেয়। সেই সব কাঁথা আক্ষরিক অর্থেই নক্সী কাঁথা, ছুঁচের ফোঁড়ে নানা মোটফের ছড়াছড়ি। কৃষ্ণনাম গৌরনাম তো বটেই, কাঁথার জমি ভর্তি করে কতরকমের ফুল - লতা –পাতা, হাতি- ঘোড়া, পালকী-বেহারা এমনকি মাছ। হ্যাঁ গৃহী বৈষ্ণব অনেক দিনই মাছ ধরে ছিলো, তাই মাছ হয়ে গেছে বাঙালী হিন্দুর ক্রিয়া-কর্মের মত, বৈষ্ণবীয় আচারেও মাঙলিক চিহ্ন। এই সব কাঁথা জীর্ণবস্ত্রের নয়, শক্তপোক্ত নতুন কাপড়ের। তবে এগুলোর সম্পন্ন গেরস্তের রুচি বিকার, আশ্রম – পাটের বাইরে দুর্নীরিক্ষ্য।
কাঁথার প্রথম প্রতিস্থাপক `বালাপোষ' দুঘোল কাপডে়র মধ্যে পেঁজা তুলো পাতলা করে বিছানো, ঐআয়তক্ষেত্রিক ফোঁড় সেলাই সেরা। এই শব্দটি এসেছে পালি ভাষা থেকে, পালি ভাষায় এই শব্দ কিভাবে, সংযোজিত হয়, সে সম্পর্কে বাঙালী অভিধানকার নীরব। কারণ যাইহোক বঙীয় সমাজে বালাষো বিশেষ সমাদৃত হয়নি, অন্তঃপুরে আদেৌ প্রবিষ্ট হতে পারেনি। বালাপোষকে প্রতিস্থাপিত করে আলোয়ান (আরবি আলবান) এবং ইংরিজি র্যাপার। এদুটি বস্তু পশমে বোনা, ফোঁড় সেলাই এর বালাই নেই। তবে বড় লোকের আলোয়ানে নানা মোটিফের সূচীকর্ম থাকে তাকে বলা হয় জামিয়ার (ফার্সি জামাহবার) বা শাল (এটিও ফার্সি শব্দ)। কাঁথায় শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছে লেপ (সংস্কৃত লিপ্ +অ) এবং তোষক (ফার্সি তোশক্)। এই দুটি শয্যাদ্রব্যই ঐ আয়তক্ষেত্রিক ফোঁড় সেলাই দিয়ে দুখোল কাপডে়র ভিতর পেঁজা তুলোর পুরু ও ভারি নির্মিতি।
কাঁথা আর ফিরব না, ফেরার যো নেই। বাঙালী পুরুষ অনেক দিনই ধুতি ত্যাগ করেছে, বর্তমানে বাঙালী কন্যারাও ধরেছে শালোয়ার কামিজ। তাছাড়া হাল আমলের বাঙালী কন্যারা সূচীকর্ম কি জানে না, আজকাল আর বালিকা বিদ্যালয়ে সূচীকর্ম শেখানো হয় না, বাড়িতেও সে পাট নেই। তবে যেসব গৃহ বধূর হাতে অবসর আছে তাঁরা ইচ্ছে করলে সৌখীন মজদুরিতে একআধখানা টেবিলক্লথের বিকল্পে কাঁথার পাতনি উৎসব – পার্বনের দাওয়াতে ব্যবহার করতে পারেন,তাতে ঐতিহ্যের পরম্পরাটুকু ধরা থাকবে ঘরের আবহে।
midnapore.in
উৎস্যমুখ
১) ক্ষেত্র সমীক্ষা
২) Scrap Book of the Author