Weaver Ant, Green Ants, Genus Oecophylla

কুট্ কুট্ | কুরকুট

Weaver Ant | Green Ants | Genus Oecophylla

রাকেশ সিংহ দেব।


Home » Medinikatha Journal » Rakesh Singha Dev » Weaver Ant


১৬ আগস্ট ২০১৭ : প্রতিদিনের মত স্কুল থেকে ফিরছি। ভাদুতলার জঙ্গলে নজরে এল দুজন যুবক জঙ্গলের ধারে তাদের বাইক দাঁড় করিয়ে হাতে থাকা লম্বা বাঁশের লাঠি দিয়ে শালগাছের উপর থেকে কি যেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পাড়ছে। কৌতুহলী হয়ে বাইক দাঁড় করিয়ে তাদের কাছে গেলাম। কথা বলে জানলাম তাদের বাড়ি আনন্দপুরে। তারা একটি মাছ ধরা প্রতিযোগীতায় যোগদান করতে চলেছে তাই মাছের চার হিসেবে জঙ্গল থেকে কুরকুট সংগ্রহ করতে এসেছে। কুরকুটের সাথে আমার আজন্ম পরিচয় থাকলেও এও কাছ থেকে কুরকুট সংগ্রহের অভিজ্ঞতা ছিলনা। তাদের কুরকুট সংগ্রহের যন্ত্রটি এবার কাছ থেকে ভালোভাবে দেখলাম। একটি লম্বা সরু বাঁশের ডগায় একটি আঁকশি লাগানো। আঁকশির কিছুটা গোড়ার দিকে একটি মশারি দিয়ে বানানো ছোট ছাঁকিজাল এমনভাবে ঝোলানো যাতে আঁকশি দিয়ে কিছু পাড়লে তা সেই জালের ভেতরে পড়ে। বেশ কিছুক্ষন তাদের এই কুরকুট সংগ্রহ দেখে মোবাইলে কিছু ছবি তুলে, তাদের প্রতিযোগীতার জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।

ভাদুতলার জঙ্গলে কুরকুট সংগ্রহ। ছবিঃ রাকেশ সিংহ দেব।

জঙ্গলমহল এলাকার অপেক্ষাকৃত ঊষর ও বন্ধুর এলাকার গহীন শালজঙ্গলের ডালপালায় দেখা মেলে সার সার লাল পিঁপড়ের দল। স্থানীয় ভাষায় এই লাল পিঁপড়েদের বলা হয় ‘কুরকুট’। আমাদের রাজ্যের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় বসবাসকারী জনজাতির একাংশ জঙ্গল থেকে এই ‘কুরকুট’ ও তার ডিম সংগ্রহ করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। পাহাড় ও জঙ্গলের আদিবাসীদের প্রিয় খাদ্যলগুলির মধ্যে একটি হল এই কুরকুট। এই পিঁপড়ে ও তার ডিম –লবন, আদা, কাঁচালঙ্কা ও সরষের তেল দিয়ে বেটে একটা টক-টক, চটপটে ও মুখরোচক আচার বা চখা বানিয়ে ভাতের সাথে খায় জঙ্গলমহলের উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষজন। ‘কুরকুট’-এর ডিম রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হয় চড়া দামে, ছিপে মাছ ধরবার অতি জনপ্রিয় চার বা টোপ হিসাবে।

ব্রীজ বানিয়ে দূরের পাতা ধরার চেষ্টা। ছবিঃ সুরজিৎ মাহাত।

এই লাল পিঁপড়ে ও তাদের ডিম এই সমস্ত এলাকার মানুষজনের পৌষ্টিক চাহিদা পূরনের অন্যতম উপায়। জঙ্গলমহলের জঙ্গল লাগোয়া স্থানীয় দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষজন, যারা তাদের দৈনিক প্রোটিনের চাহিদা পূরনে অপারগ; তাদের কাছে এই টক স্বাদের ‘কুরকুট’ বন্য প্রকৃতির এক অমূল্য পুষ্টিকর উপহার। প্রোটিনে ভরপুর এই কুরকুটে রয়েছে নানান ঔষধী গুণাগুণ। আদা, রসুন, লবণ দিয়ে কুরকুট বেটে চায়ের মতন ফুটিয়ে গরম গরম স্যুপ খেলে জমা কফ বেরিয়ে যায়। কোষ্ঠকাঠিন্য ও পেট পরিষ্কারের অব্যর্থ ওষুধ এই কুরকুট। ‘কুরকুট’ খেলে দেহের স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় ফলে শীতের সময় ঠান্ডা লাগে কম। ‘কুরকুট’ আরও বিভিন্ন উপায় এবং কারনে ব্যবহার হয়ে থাকে। নিয়মিত ‘কুরকুট’ খেলে জ্বর, ঠাণ্ডা লাগা, সর্দি-কাশি-এর মত নিত্যনৈমিত্তিক অসুখ বিসুখের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ‘কুরকুট’ তো দুর্ভিক্ষপীড়িত জঙ্গল এলাকার খাবার, শখ করে কেই বা ‘কুরকুট’ খাবে? হ্যাঁ, এটাই সত্যি । জঙ্গলমহলের কয়েকটি জঙ্গল লাগোয়া প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষকে একটা সময় বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন হয়ে উঠেছিল এই কুরকুট। একসময় এই কুরকুটের হাত ধরেই সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছিল দীর্ঘদিন অনাহারে ধুঁকতে থাকা অখ্যাত আমলাশোল!

খাদ্য সংগ্রহ। ছবিঃ অর্পণ বেরা।

এই বিবিধ গুনের অধিকারী ‘কুরকুট’ বা লাল পিঁপড়েদের সম্বন্ধে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক্। এদের আকার সাধারণত দুই থেকে আট মিলিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। গায়ের রঙ তামাটে-বাদামী এবং এদের মাথা ও পেটের দিকের অংশ অপেক্ষাকৃত গাঢ় কালচে রঙের হয়ে থাকে। একই বাসার মধ্যে বিভিন্ন আকারের পিঁপড়ে দেখতে পাওয়া যায়। এরা এমন এক বাসার ভেতর বসবাস করে যার বাইরের দিকে কোনও নির্দিষ্ট ঢোকার বা বেরানোর গর্ত থাকেনা। এই লাল পিঁপড়েরা সমাজবদ্ধ প্রাণী। এরা নিজেদের প্রয়োজনে অনেক সময় বড় বড় বাসা তৈরি করে। এরা সাধারণত কোনও উঁচু এবং বড় পাতাওয়ালা গাছের (যেমন- শাল, আম, পিয়াশাল, অর্জুন ইত্যাদি) সবুজ পাতাকে এদের লার্ভার লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত একপ্রকার চটচটে তরল এবং মাকড়সার আঁশ দিয়ে একসাথে জুড়ে ঠোঙার মত দেখতে বাসা বানায়। এদের বাসাকে জঙ্গলমহলের স্থানীয় ভাষায় বলে 'কুরকুট পটম'। এগুলি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শীতকালে। এক-একটি কুরকুট পটমে থাকে কয়েক হাজার পিঁপড়ে।

পাতা সেলাই করে বাসা বানাচ্ছে শ্রমিক পিঁপড়ে। ছবিঃ সুরজিৎ মাহাত।

এই পিঁপড়েদের জীবনযাত্রা বড় অদ্ভুত! রানি এবং পুরুষ পিঁপড়ের ডানা থাকে। মিলনের পর রানি পিঁপড়ে তার ডানা ত্যাগ করে এবং পুরুষ পিঁপড়েদের সাহায্য ছাড়াই শ্রমিক পিঁপড়েদের নিয়ে নতুন বাসা বানায়। পুরুষ পিঁপড়েরা মিলনের পর সাধারণত মারা যায়। একটি রানি পিঁপড়ে বহুবছর ধরে ডিম পাড়তে সক্ষম। ডিম থেকে বেরোনো বেশিরভাগ লার্ভা পরবর্তীকালে শ্রমিক পিঁপড়ে হয়। শ্রমিক এবং সন্তানধারণে অক্ষম স্ত্রী পিঁপড়েরা বাসার ভেতর প্রয়োজনীয় টুকিটাকি সরবরাহ করে থাকে। এই লাল পিঁপড়েরা খাদ্যাভাসে সর্বভুক প্রকৃতির। এরা গাছের বিভিন্ন অংশ এবং ছোট ছোট পোকামাকড় শিকার করে খায়। এরা শক্ত খাবার খেতে পারেনা। মাকড়সাদের মত বিশেষ রাসায়নিক পদ্ধতিতে এরা প্রথমে শক্ত খাবারকে তরল বানিয়ে তারপর তা খেয়ে থাকে।

খাদ্য সংগ্রহ। ছবিঃ রাকেশ সিংহ দেব।


কুট্ কুট্, কুরকুট। ছবিঃ রাকেশ সিংহ দেব।

এই লাল পিঁপড়েরা এদের আক্রমণাত্মক আচরনের জন্য সুপরিচিত। এদের কামড় অত্যন্ত যন্ত্রনাদায়ক এবং কামড়ানোর পর সেই স্থানে তীব্র জ্বালা অনুভূত হয়। যদিও লাল পিঁপড়েদের কোনও হুল থাকেনা। এরা খুব জোরে কামড়ায় এবং এদের পেটের থলিতে থাকা ফরমিক অ্যাসিডের কারনে কামড়ানোর স্থানে অসহ্য জ্বালা ও যন্ত্রনা অনুভূত হয়। এই ভয়ানক কামড়কে অগ্রাহ্য করে জঙ্গলমহলের মানুষজন দীর্ঘকাল ধরে সকাল থেকে দুপুর এদের বাসা সংগ্রহ করে থাকে। লাল পিঁপড়ের বাসা সংগ্রহকারীরা গাছে উঠে বা লম্বা বাঁশের মাথায় কাস্তে বেঁধে তৈরি করা আঁকড়শি (স্থানীয় ভাষা) বা আঁকশি দিয়ে ‘কুরকুট’ সংগ্রহ করে। প্রথমে গাছের নীচে এক বড় এলুমিনিয়াম বা টিনের গামলা রাখা হয়, অনেক সময় পুরানো করগেটেড শীট নেওয়া হয়। ধাতুর পাত্র বা করগেটেড শীটটিকে আগুন বা রোদে সেঁকে গরম করে নেওয়া হয়। এবার গাছের উপর থেকে পিঁপড়ের বাসা কেটে তা নীচে ফেলা হয়, এরফলে গরমে পিঁপড়েরা মারা যায়। পাতার বাসার ভেতর থাকে বলে মৃত পিঁপড়ের দেহ আর তাদের ডিম অক্ষত থাকে। বাসা সংগ্রহের পর পিঁপড়ে ও তাদের ডিম বাঁশের কুলো বা চালুনিতে নিয়ে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে যথাক্রমে পিঁপড়ে, পিঁপড়ের ডিম, লার্ভা, পিউপা আলাদা করে বালতিতে রাখা হয়। অনেকটা হাতে করে চাক ভেঙে মধু বের করে আনার মতো ব্যাপার।

পাঁচখুরির হাটে বিক্রি হচ্ছে কুরকুট। ছবিঃ রাকেশ সিংহ দেব।


জঙ্গল থেকে সংগ্রহ, গুড়গুড়িপাল, মেদিনীপুর। ছবিঃ রাকেশ সিংহ দেব।

নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি শীতের এই সময় জুড়ে জঙ্গলে জঙ্গলে চলে লাল পিঁপড়ের বাসা সংগ্রহের পালা। উঁচু গাছের বড় সবুজ পাতা জুড়ে বানানো বাসায় তাদের ডিম রাখে পিঁপড়েরা। জঙ্গলের উঁচু গাছের উপর বাসা বানানোর জন্য জঙ্গলের আগুন থেকেও এরা নিরাপদে থাকে। এই প্রকারের লাল পিঁপড়েরা খুব দ্রুত ও ব্যাপকহারে নিজেদের সংখ্যাবৃদ্ধি করে থাকে ফলে নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে ‘কুরকুট’ সংগ্রহের পরেও এদের অস্তিত্বের ভারসাম্যে বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। এই লাল পিঁপড়ে ও তাদের ডিম পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাঞ্চলের জঙ্গলে বর্তমানে ঝাড়গ্রাম জেলার আমলাশোল, ভুলাভেদা, বেলপাহাড়ি, কাঁকড়াঝোড়, গিধনি, লালজল, কুলটিকিরি, গোপীবল্লভপুর, নয়াগ্রাম, শিমূলপালের মতো জঙ্গলঘেরা, চড়াই-উতরাই ভূমিরূপ বিশিষ্ট এলাকার গ্রামীণ সাপ্তাহিক হাটগুলোতে আজও শালপাতার দোনায় (স্থানীয় ভাষা) বা ঠোঙায় করে বিক্রি হয়।

পাতা সেলাই করে বাসা বানাচ্ছে শ্রমিক পিঁপড়ে। ছবিঃ সুরজিৎ মাহাত।


কুরকুটের বাসা (ঘর)। ছবিঃ রাকেশ সিংহ দেব।

বর্তমানে এলাকা থেকে বিভিন্ন পাইকারদের হাত ধরে কেজি কেজি ‘কুরকুট’ চলে যাচ্ছে ঝাড়খণ্ডের টাটানগর কিংবা পশ্চিমবঙ্গের শিয়ালদহ এর বড় বড় বাজারগুলিতে। আজ এই ‘কুরকুট’-এর বিপণনের হাত ধরে কিছু পয়সার মুখ দেখছেন জঙ্গলমহলের জঙ্গল লাগোয়া এলাকার মানুষজন। শুকনো করে রাখলে ‘কুরকুট’ বহুদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখা যেতে পারে। এই কুরকুটের ডিম আদিবাসী লোধা শবর সম্প্রদায়ের মানুষেরা জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে এনে ১৫০-২০০টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীদের। পরে ব্যবসায়ীরা খুচরো বাজারে ৭০০-৮০০টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন সাধারণ মানুষকে। শুকনো কুরকুট চার-পাঁচ হাজার টাকা কিলো ও টাটকা কুরকুট ২৫০-৩০০টাকা কিলো দরে আজও ঝাড়গ্রাম বাজারে বিক্রি হয়। মেদিনীপুর শহর লাগোয়া পাঁচখুরির প্রসিদ্ধ সাপ্তাহিক হাটেও মেলে কুরকুট।

ভাদুতলার জঙ্গলে কুরকুট সংগ্রহ। ছবিঃ রাকেশ সিংহ দেব।


রানী পিঁপড়ে ও লার্ভা। ছবিঃ অর্পণ বেরা।

এখনও যদি এই কুরকুটের প্রতি সম্মান না জাগে, তবে এক ব্রিটিশ রেফারেন্স দিই। কারন, ইংরেজি জানা আমরা একটু সাহেবি রেফারেন্স না পেলে জিনিসটাকে বিশেষ পাত্তা দিইনা। লন্ডনের বিখ্যাত শেফ গর্ডন রামসে (Gordon Ramsay) তাঁর ' Top 5 Indian Dishes'-এর তালিকায় 'তুম্বা বিরিয়ানি' বা 'চিকেন টিক্কা মশালা’-এর সাথে কুরকুটের চাটনিকেও (Red Ant Chutney) নথিবদ্ধ করেছেন।

লন্ডনের বিখ্যাত শেফ গর্ডন রামসে (Gordon Ramsay) এর 'Top 5 Indian Dishes' ভিডিও থেকে কুরকুটের চাটনি অংশটি আপনাদের জন্য দেওয়া হল।

midnapore.in

(Published on 12.09.2020)