মেদিনীপুরের পরিচিত অর্কিড কথা
Orchids of Medinipur
রাকেশ সিংহ দেব।
Home » Medinikatha Journal » Rakesh Singha Dev » Orchids of Medinipur
অবিভক্ত মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলের সবুজ বনানী যেন নিজের রূপে অপরূপা। একটা ছাপোষা রংচটা দিনও যেন রূপকথা হয়ে ওঠে তার কোমল সবুজের ছোঁয়ায়। সেই সবুজের ছোঁয়ায় যদি থাকে রঙিন অর্কিডের সান্নিধ্য, তাহলে মন ভাল হতে বাধ্য। অর্কিডের রূপবৈচিত্র্যে মুগ্ধ হননি, এমন মানুষ কমই আছেন। ফুলের রাজ্যে অর্কিডের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ফুল উৎপাদনোক্ষম উদ্ভিদ জগতে অর্কিড একটি বিশাল পরিবার যার প্রায় ৯০০ গণ এবং প্রায় ৩০,০০০ এরও অধিক প্রজাতি রয়েছে। এদের আকর্ষণীয় রঙ, বিভিন্ন ধরনের গড়ন, সুগন্ধ, ঔষধি গুণাগুণ, দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল ফুল প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে এত জনপ্রিয় করে তুলেছে। অর্কিড ফুলের গঠন বৈচিত্র্যে বিস্মিত হয়ে প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা আদর করে এই ফুলের নাম দিয়েছিলেন 'অর্কিস'। কালক্রমে এই নামটিই বিবর্তিত হয়ে 'অর্কিড' হয়েছে। ফুলদানিতে দীর্ঘকাল সজীব থাকে বলে কাটফ্লাওয়ার হিসেবে এর ব্যবহার ও চাহিদা সর্বাধিক। ছোট অবস্থায় এর গাছ ও তার পত্রবিন্যাস শোভা বৃদ্ধি করে। অর্কিডকে অনেকে পরগাছা বলে থাকেন। এরা পরগাছা নয় পরাশ্রয়ী। এরা পুরানো গাছ বা গাছের ডাল আকঁড়ে ধরে এদের ঝুলন্ত বায়বীয় শিকড় দিয়ে বাতাসের আর্দ্রতা শুষে নেয়। অকির্ড নিজেই জল, বাতাস, ধুলোবালি ও আলো থেকে খাবার তৈরি করে। তাই অর্কিডকে যে গাছ ধারণ করে তারা মরে যায় না। এ থেকে প্রমাণ হয় অর্কিড পরগাছা নয়, পরাশ্রয়ী।
অর্কিড (Family : Orchidaceae) হলো সপুষ্পক উদ্ভিদের একটি পরিবার। এরা রঙিন, সুগন্ধি আর বহুলবিস্তৃত হয়। অর্কিড বহুবর্ষজীবী ঔষধি গুনসম্পন্ন এরা পরাশ্রয়ী (Epiphytic) বা ভূমিজ(Terrestrial), কখনও শিলা-উদ্ভিদ (Lithophytic) বা মৃতজীবী (Saprophytic) হয়ে থাকে। পরাশ্রয়ী সদস্যরা প্রধানত ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলের এবং ভূমিজ প্রজাতিগুলি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বাসিন্দা। সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া অর্কিডের জন্য উত্তম। প্রজাতি ভেদে ১০-৩০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় অর্কিড ভালো জন্মে। Terrestrial বা পার্থিব শ্রেণীর জন্য দো-আঁশ মাটি উপযুক্ত। এ ছাড়া উপযুক্ত বায়ু চলাচল এবং জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। বর্ণাঢ্য পুষ্পপুটসহ বাঁকানো গড়ন অর্কিড ফুলের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। সারা বছর কিছু কিছু অর্কিডে ফুল ফুটলেও জানুয়ারি-জুন হলো ফুল ফোটার সময় এবং সর্বাধিক মার্চ-এপ্রিলে। প্রত্যেকটি গাছে কয়েকটি মাত্র ফল ফললেও অতিসূক্ষ্ম বীজের সংখ্যা অগণিত। অর্কিডের স্বাভাবিক বাসস্থানের গাছপালার অবাধ ধ্বংস ও অতিমাত্রায় অর্কিড সংগ্রহের জন্য কিছু পরাশ্রয়ী অর্কিড ইতিমধ্যে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। আমাদের জঙ্গলমহলের বনজঙ্গলে নানা (সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়) প্রজাতির অর্কিড জন্মালেও অধিকাংশ প্রজাতির বাংলা নামকরণ হয়নি। তাই এসব অর্কিডের তাদের স্থানীয় পরিচিত নামেই ডাকা হয়।
জন্মস্থানের উপর ভিত্তি করে অর্কিড প্রধানত দুই প্রকার।
ভূমিজ বা Terrestrial
যেসব অর্কিড অন্যান্য ফুলের মতো মাটিতে জন্মায় এবং সেখান থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে, তাদের ভূমিজ অর্কিড বলে। এদের সুতার মতো সরু গুচ্ছ মূল থাকে।
যেমন- ফায়াস, সিমবিডিয়াম ইত্যাদি ।
পরাশ্রয়ী বা Epiphytic
যেসব অর্কিড অন্য কোন গাছের শাখা বা কাণ্ডের উপর আশ্রিত হয়ে জন্মে তাদের পরাশ্রয়ী অর্কিড বলে। এদের লম্বা, মোটা ও পুরু মূল থাকে, বাতাস থেকে খাদ্য গ্রহণ করে।
যেমন- ডেনড্রোবিয়াম, ভ্যান্ডা, এরিডিস ইতাাদি।
আমাদের জঙ্গলমহল এলাকাতেও বেশ কিছু অর্কিড প্রজাতির দেখা মেলে। ভূমিজ ও পরাশ্রয়ী মিলিয়ে আমি এখনও পর্যন্ত তিনটি প্রজাতির সন্ধান পেয়েছি। ভবিষ্যতে জঙ্গলমহলের শ্যামলিমায় আরও ভিন্ন অর্কিডের খোঁজ পাব এই আশা রাখি। আসুন পরিচয় সেরে ফেলা যাক আমাদের জঙ্গলমহলের পরিচিত অর্কিডদের সাথে।
1.বাংলা নাম - রাসনা
ইংরেজি নাম - Grey Orchid / Checkered Orchid
বৈজ্ঞানিক নাম - Vanda tessellata
বৈশিষ্ট্য - পরাশ্রয়ী বা Epiphytic
রাসনা, Grey Orchid / Checkered Orchid (Vanda tessellata)
রাসনা, Grey Orchid / Checkered Orchid (Vanda tessellata)
রাসনা, Grey Orchid / Checkered Orchid (Vanda tessellata)
আমাদের জঙ্গলমহলের সবচেয়ে পরিচিত ও সহজলভ্য এক অর্কিড প্রজাতি। পূর্ব ভারতে পশ্চিমবঙ্গ সহ প্রায় সব রাজ্যেই এই অর্কিড পাওয়া যায়। বিশেষত আম, তেঁতুল, মহুল, কেন্দুর মতো মোটা ছালযুক্ত গাছে এদের প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। এদের বায়ুমূল বেশ ছড়ানো ও লম্বা। নাতিদীর্ঘ কাণ্ডের দুপাশে ঘনবদ্ধ লম্বা লম্বা পাতা, যেন মনে হয় খাঁজে খাঁজে বসানো আছে। পাতার কক্ষ থেকে গজানো খাড়া ও শাখায়িত ডাঁটায় কয়েকটি ছোট ছোট ফুল হয়। এই অর্কিডের ফুলের পাপড়ি খয়েরি রঙের রেখা ও সাদা রঙের সীমানা সহ হলুদ রঙের হয়। ফুলটি পরিণত হয়ে গেলে হালকা কমলাভ রঙের হয়। এই পরাশ্রয়ী, বহুবর্ষজীবী সপুষ্পক উদ্ভিদটি জ্বর, ব্রঙ্কাইটিস, অর্শ, বাত, স্নায়ুরোগ, প্রদাহ প্রভৃতি চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। বাড়ির পরিবেশে নুন্যতম যত্নে এই অর্কিড খুব ভালোভাবে হয়। অন্যান্য অর্কিডদের মতো এরাও তীব্র রোদ এবং অত্যধিক জল সহ্য করতে পারেনা।
2. বাংলা নাম - শেয়াললেজী অর্কিড
ইংরেজি নাম - Foxtail Orchid
বৈজ্ঞানিক নাম - Rhynchostylis retusa
বৈশিষ্ট্য - পরাশ্রয়ী বা Epiphytic
শেয়াললেজী অর্কিড, Foxtail Orchid (Rhynchostylis retusa) Photo: Pranab Kumar Ojah
শেয়াললেজী অর্কিড এক ধরনের পরাশ্রয়ী অর্কিড। এই অর্কিড জঙ্গলমহলের ওড়িশা ও ঝাড়খন্ড সীমান্তবর্তী বনজঙ্গলে বেশ পাওয়া যায়। Foxtail orchid বাংলাদেশে 'ধ্রুপদীমালা' নামে পরিচিত। এই অর্কিডের ফুলের শাখায় শতাধিক গোলাপি আভাযুক্ত ফুল হয়। শীতের শেষ এবং বসন্তের শুরুতে এদের ফুল ফোটে। জঙ্গলমহলের স্বাভাবিক পরিবেশে পাওয়া অর্কিডের মধ্যে এদের ফুল সবচেয়ে সুন্দর। এদের পাতা একটু ছোট ও চওড়া, পাতার গোড়াগুলো একসাথে জড়িয়ে থাকে, লম্বা বায়ুমূল পুরুষ্টু ও ছড়ানো। পাতার কক্ষ থেকে ২৫-৩৫ সেমি লম্বা ঝুলন্ত মঞ্জরিতে ঠাসা ফুল থাকে। ফুলে সামান্য সুগন্ধ থাকে। এই ফুল ভারতের অঙ্গরাজ্য অরুনাচল প্রদেশ ও আসামের প্রাদেশিক ফুল। এরা ঔষধিগুণসম্পন্ন। সাধারণত আঘাত, ক্ষত, মচকে যাওয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। বাড়ির পরিবেশে নুন্যতম যত্নে এই অর্কিড খুব ভালোভাবে হয়। অন্যান্য অর্কিডদের মতো এরাও তীব্র রোদ এবং অত্যধিক জল সহ্য করতে পারেনা।
3. বাংলা নাম - (অজানা??)
ইংরেজি নাম - Sword-leaved Helleborine / Narrow-leaved Helleborine / Long-leaved Helleborine
বৈজ্ঞানিক নাম - Cephalanthera longifolia
বৈশিষ্ট্য - ভূমিজ বা Terrestrial
Sword-leaved Helleborine / Narrow-leaved Helleborine / Long-leaved Helleborine (Cephalanthera longifolia)
Sword-leaved Helleborine / Narrow-leaved Helleborine / Long-leaved Helleborine (Cephalanthera longifolia)
হেলেববারিন একটি পার্থিব অর্কিড যা প্রায় সমগ্র এশিয়া জুড়ে পাওয়া যায়। এদের ৫ সেমি - ১০ সেমি লম্বা, সরু ও তীক্ষ্ণ অগ্রভাগওয়ালা পাতার এদের সাধারণ ইংরেজি নামটি দেওয়া হয়েছে। এই অর্কিড সাধারণত ১৫ সেমি - ৪৫ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এই অর্কিডের ফুল ফোটে। প্রধান কান্ডের অগ্রভাগ থেকে বের হওয়া একটি পুষ্পদন্ডের চারপাশে ৮ টি থেকে ২০ টি বেলফুল সদৃশ সাদা ফুল সজ্জিত থাকে। ফুলগুলো আকারে ১ সেমি হয়ে থাকে। হিমালয়ান রিজিয়নের ১৮০০ মিটার থেকে ৩০০০ মিটার উচ্চতাতেও এই অর্কিড পাওয়া যায়।
অর্কিডের স্বাভাবিক বাসস্থানের গাছপালার অবাধ ধ্বংস ও পরিবেশ থেকে অতিমাত্রায় অর্কিড সংগ্রহের জন্য কিছু পরাশ্রয়ী অর্কিড ইতিমধ্যে বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
midnapore.in
(Published on 24.04.2022)