মেদিনীপুরের ট্রামলাইন  | Tram line in Midnapore

মেদিনীপুরের রাস্তা সাজল ট্রামলাইনে,

স্মৃতি শুধু ট্রাম গলি

অতনু মিত্র ।


বহুদিন আগে এক ছড়াকার লিখেছিলেন ট্রাম নিয়ে ছড়া। ‘আমার নার টেরাম/ বাড়ি সুতানুটি গেরাম’। অর্থাৎ বাংলায় ট্রাম মানে তা কলকাতায়। সুতানুটি তো সেই শহর কলকাতা গড়ার তিনটি গ্রামের অন্যতম। কিন্তু মেদিনীপুর শহরও হতে পারত ট্রাম-গর্বী গ্রাম বা জনপদ। মেদিনীপুরে এক সময় ট্রাম চালানোর চেষ্টা হয়েছিল। পাতাও হয়ে গিয়েছিল ট্রাম লাইন। কিন্তু ... ।

ঠিক কী কারণে মেদিনীপুরে ট্রাম চালানোর চেষ্টা হয়েছিল তা নিয়ে দ্বিমত আছে। সে প্রায় একশ বছর আগের ঘটনা। তবে কার্যকারণ সম্পর্ক থেকে কাছাকাছি কিছু অনুমান করা যায়।

মেদিনীপুরের ট্রামলাইন  | Tram line in Midnapore
মেদিনীপুরের ট্রামগলি।

মেদিনীপুর শহরের কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ডের ঠিক পেছনে বিগত ঊনবিংশ শতকের শেষার্দ্ধে গড়ে উঠেছিল বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। সেই থেকে এই জায়গাটির নাম পাওয়ার হাউস। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি গড়ে তোলে বি এন ইলিয়াস এন্ড কোম্পানি নামে একটি পার্সি সংস্থা। তৎকালীন ভারতের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী এন বি ইলিয়াস পিতা বেঞ্জামিন নিসিম ইলিয়াসের নামে কলকাতায় এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তারা নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর এবং মেদিনীপুরে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলে। কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে দেখেছেন বি এন ইলিয়াস এন্ড কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কোষাধ্যক্ষ ধীরেন পাল। তিনি জানান, এই পাওয়ার হাউসে মোট দুটি বয়লার ছিল এবং চারটি ডায়নামো চলত। তার থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ শহরে সরবরাহ হতো। ১৯২৪ সালে নির্মিত মেদিনীপুর শহরের জল ট্যাঙ্কটিতে জল ভরার জন্য পাম্প চালাতে এই বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হত। প্রায় একশ বছর আগে সারা শহরে সেই ট্যাঙ্ক থেকেই পানীয় জল সরবরাহ করা হতো।

এক সময় তমলুক বন্দর দিয়ে রূপনারায়ণ কাঁসাই হয়ে জলপথে মেদিনীপুরের সাথে যোগাযোগ ছিল। পোস্তার মহারাজ সুখময় রায়ের অর্থে মেদিনীপুর থেকে পুরী পর্যন্ত কটক রোড তৈরি হওয়ার সময় মেদিনীপুরের জগন্নাথ মন্দিরের কাছে একটি ঘাট ছিল। ষোড়শ শতকে শিখ গুরু গুরুনানক কাঁসাই নদী পথে এই ঘাটে এসেছিলেন। ঘাট থেকে পালকিতে শহরে এসে এখানে সঙ্গত করেন। সেই থেকে এই এলাকার নাম সঙ্গতবাজার। তখন মেদিনীপুরে কয়লা আসতো লঞ্চে। পরে কলকাতা থেকে কয়লা ভর্তি লঞ্চ হুগলী দামোদর রূপনারায়ণ কাঁসাই হয়ে মেদিনীপুরে আসতো।

মেদিনীপুরের ট্রামলাইন  | Tram line in Midnapore

জলপথে পরিবহন খরচ কম হওয়ায় নদী পথে আরও বহু মালপত্র মেদিনীপুরে আনা হত। এই কয়লা ও অন্যান্য মালপত্র নতুন বাজারের কাছে পাথরঘাটায় এবং রেল ব্রীজের কাছে স্টীমার ঘাটে খালাস করা হত। লঞ্চ থেকে মালপত্র নামিয়ে রাখার জন্য কাঁসাই নদীর উপর রেল ব্রীজের কাছে আকড়শা বাবার মাজারের পাশে দুটি গুদামঘর তৈরি করা হয়েছিল। মেদিনীপুরের জগন্নাথ মন্দিরের অদুরে পাথর বাঁধানো ঘাটের জন্য স্থানটির নাম হয় পাথরঘাটা।

কলকাতা থেকে আসা কয়লা এই পাথরঘাটা লঞ্চঘাট থেকে ট্রামে করে বাসস্ট্যান্ডের কাছে পাওয়ার হাউসে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করে বি এন ইলিয়াস এন্ড কোম্পানি। তৈরি হল ‘নরমপুর ট্রামওয়ে কোম্পানি’। ট্রাম লাইন বসানো থেকে ট্রাম চালু পর্যন্ত সমস্ত দায়িত্ব পড়ল তাদের হাতে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, মোহনপুরে অ্যানিকেত সেচ বাঁধ নির্মাণ করতে প্রচুর পাথরের প্রয়োজন ছিল। নরমপুর মৌজা থেকে সেই পাথর পাথরঘাটায় আনার জন্য এই ট্রাম লাইন পাতা হয়েছিল। সেই জন্য এই পাথরঘাটা থেকে নদীর পাড় বরাবর জগন্নাথ মন্দিরের কাছে ১৮ নং ওয়ার্ড অফিসের সামনে দিয়ে সাঁই আস্তানায় ব্লাইন্ড মাদ্রাসা স্কুলের পাশ দিয়ে ট্রাম লাইন পাতার পরিকল্পনা হয়। লোহার পাতও এসে যায়। কাজও শুরু হয়ে যায়। ট্রাম চালু হয়নি। আজও শহরের মানুষজনের কাছে সেই রাস্তা ট্রাম গলি বলেই চিহ্নিত।

কেন ট্রাম লাইন পাতা সত্ত্বেও কাজ সম্পূর্ণ হল না? এর পিছনে দু’টি কারণ আছে বলে মনে করা হয়। প্রথমত, নতুন লাইন পাততে প্রচুর পাথরের প্রয়োজন ছিল। নরমপুর থেকে সেই পাথর এনে লাইন পাতার কাজ খুবই বিলম্ব হয়। দ্বিতীয়ত, এই প্রকল্প লাভজনক হবে না বলে অনেক বিলম্বে কোম্পানির মনে হয়েছে। তার পর পর ট্রেন চালু হয়ে যায়। তখন আসানসোল থেকে ট্রেনে কয়লা আসতে শুরু করে। তাই ট্রাম লাইন পাতার কাজ শুরু করেও বন্ধ করে দেয় কোম্পানি। বহু দিন পড়ে থাকে লোহার পাথ। নতুন বাজারে জগন্নাথের মাসী বাড়ির কাছে কয়েকদশক আগেও সেই ট্রাম লাইনের পাত পড়ে থাকতে দেখেছেন পাওয়ার হাউসের উচ্চপদস্ত অবসরপ্রাপ্ত বাস্তুকার সুশীল কুমার সাহু। বিশ বছর আগেও এই ন্যারো গেজ লাইন দেখেছেন জেলা আদালতের অবসরপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিটর দীপঙ্কর দাস।

রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবাগে ১৮৮০ সালে প্রথম ট্রাম চালু হয়। চেন্নাইতে ১৮৮৫ সালে, কলকাতায় ১৯০০ সালে, কানপুর ও মুম্বাইতে ১৯০৭ সালে, দিল্লিতে ১৯০৮ সালে ট্রাম চালু হয়। কলকাতায় তখন ট্রামের সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াইশো। কলকাতার খিদিরপুর থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত প্রথম ইলেকট্রিক ট্রাম চালু হয় ১৯০২ সালের ২৭ মার্চ। তার আগে কলকাতায় শিয়ালদা ও আর্মেনিয়ান ঘাটের মধ্যে ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু হয় ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। এটাই এশিয়ার প্রাচীনতম ট্রাম পরিষেবা। কলকাতার পরে মেদিনীপুরে ট্রাম চলবে! এই খবরে শহরের মানুষ খুবই উৎসাহিত হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত ট্রাম লাইনের পাত বসানো হলেও ট্রাম আর চলেনি। কবি তাপস মাইতির সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘শহর মেদিনীপুরের কথা’ বইতে মতে, মেদিনীপুরের পুরাতত্ব গবেষক চিন্ময় দাশ উল্লেখ করেছেন, সেই পরিকল্পনা সম্পূর্ণ রুপায়ণ হলে মেদি্নীপুরই হত দেশের একমাত্র ট্রাম সমৃদ্ধ জেলা।

ট্রাম না পাওয়ার আক্ষেপ আজও মেদিনীপুরের মানুষের মনে রয়েছে। লাভ- হিসেবের ক্ষতির ফেরে মেদিনীপুর ট্রামহীন হল। শুধু কলকাতার রাস্তাতেই চলল ‘যত অজগর সাপ’। এখনও ‘পিঠে তার ট্রামগাড়ি পড়ে ধুপধাপ’।

আজ সেই রাস্তা শুধুই পড়ে আছে, ট্রাম গাড়ি আর নেই।


midnapore.in

(Published here on 04.08.2018 / প্রথম প্রকাশ আনন্দবাজার পত্রিকায় – ২২.০৪.২০১৯)