পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা।
ব্রিটিশ শাসনাধীন সুপ্রাচীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাস অহিংস আন্দোলনের ইতিহাস। আত্মবলীদানের ইতিহাস। সশস্ত্র সংগ্রামের কাহিনী। সে-ইতিহাসে তৎকালীন বাংলাদেশের অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার অবদান অপরিসীম। মেদিনীপুর ছিল বিপ্লবের আঁতুরঘর। বিপ্লবীর ধাত্রীভূমি। সম্পৃক্ত তার স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর কাহিনী। সেখানে বিরাজমান উজ্জ্বল নক্ষত্র সব। গুরুত্ব ও পরিস্থিতি বিচার করে এক বা দুজনের নাম উল্লেখ করে বাকিদের ন্যূনতম সম্মানহানি করবার স্পর্ধা আমার নেই। তাই সে তালিকা আপাতত অনুল্লেখিত রইল। তার চেয়ে বরং মূল বিষয়ে প্রবেশ করা আশু কর্তব্য।
অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন বাদ দিলেও আরও একগুচ্ছ ইন্টিগ্রেটেড ঘটনার ঘনঘটায় উজ্জ্বল মেদিনীপুরের স্বাধীনতার ইতিহাস। সেই ইতিহাসের শেকড় অনুসন্ধান করতে গিয়ে উঠে এল এক ঝাঁক সংগ্রামীর উদ্দিপনাময় জীবন আলেখ্য আর তাঁদের মহান কর্মকাণ্ড। কিন্তু এ কাজ তো মুষ্টিমেয় এক-দুজনের দ্বারা সম্ভব নয়। শত শত স্বেচ্ছাসেবকের সম্মিলিত প্রয়াসের ফসল আজকের স্বাধীনতা। সেই অহিংস অথবা সশস্ত্র সংগ্রামী কর্মযজ্ঞের সফল বাস্তব রূপায়ণে গ্রামস্তর, অঞ্চলওয়াড়ি, জোনভিত্তিক ও ব্লকস্তর অব্দি স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ অভিযানের জন্য প্রয়োজন সুদক্ষ নেতা। একজন সুযোগ্য নেতা-ই পারেন তার স্বকীয় ক্যারিশমায় নিজের অঞ্চলে শাখা সংগঠনের জাল বিস্তার করে জনসাধারণকে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের কর্মসূচিতে যুক্ত করতে।
পরাধীন ভারতে ডেবরা থানা এলাকার তেমনই একজন অহিংসবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা শ্রী নগেন্দ্রনাথ সেন মহাশয়। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বগুণে গোটা ডেবরা থানায় জাতীয় কংগ্রেস তার জাল বিস্তার করতে সমর্থ হয়। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি বিশেষ অবদান রাখে ডেবরা থানা। এ হেন নগেনবাবু মহাত্মা গান্ধীর মতাদর্শে অনুপ্রাণিত একজন বীরপুরুষ। হাজার বিপদের মধ্যেও তাঁর চিত্ত স্থির। লক্ষ্যে অবিচল তিনি। সেজন্যই তিনি 'ডেবরার গান্ধী' নামে বহুল পরিচিত। ডেবরা থানার অন্তর্গত ৩নং সত্যপুর অঞ্চলের চকসরঞ্জা গ্রামে তাঁর জন্ম ১৯০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বারো তারিখে। বাংলা ক্যালেন্ডার মতে, ১৩০৮ সনের ৩০শে মাঘ। কনকনে ঠাণ্ডা এসময়। তাই কোন এক সময় তাঁর আশ্রমের আশ্রমিকগণ তাঁর জন্মদিন পালন করতে চাইলে অত্যাধিক ঠাণ্ডার কারণে ১২-ই ফেব্রুয়ারি দিনটির পরিবর্তে ফাল্গুন মাসের তিরিশ তারিখে হালকা গরমে জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে এখনও সেই নিয়ম মান্য করে আসছেন আলোককেন্দ্র ট্রাস্টি বোর্ডের সকল সদস্য-সদস্যা।
তাঁর পিতা মহেন্দ্রলাল সেন মধ্যবিত্ত অবস্থাসম্পন্ন মানুষ। মাতা শান্তিময়ী দেবী। তাঁর মাতুল শিবপ্রসাদ বেরা মহাশয় ছিলেন একজন স্বাধীন-চেতা উন্নত-মনা মানুষ। বাল্যকাল থেকে অত্যন্ত মেধাবী ছোট্ট নগেন। গ্রাম্য টোলে তাঁর পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয়। পার্শ্ববর্তী জগন্নাথপুর গ্রামে শ্রী জ্ঞানেন্দ্রনাথ ভূঞ্যা মহাশয়ের বাড়িতে বসত পাঠশালা। সেখানে তাঁর প্রখর বিদ্যাবুদ্ধির জ্যোতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এতদঞ্চলে উচ্চ শিক্ষার বন্দোবস্ত তখন ছিল না। বাধ্য হয়ে টোলের পাঠ চুকিয়ে কিশোর নগেন্দ্রনাথ রওনা দিলেন শহর মেদিনীপুর। সেটা ১৯১৩―১৯১৪ সালের ঘটনা। মেদিনীপুর শহরের হিন্দী স্কুলে ভর্তি হলেন। শহরে থাকার জায়গা নেই। থাকলেও বিস্তর খরচাপাতি। তাই বলে-কয়ে স্কুলের মালি ধরণীধর দে'র সঙ্গে কষ্ট করে মালির কোয়ার্টারে একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন। পিতা মহেন্দ্রনাথ মাঝে মধ্যে এসে চাল ও সামান্য টাকাপয়সা দিয়ে যান। শহরে তখন 'বিদেশি বর্জন― স্বদেশী গ্রহণ' আন্দোলনের ঢেউ। এই আন্দোলনের প্রথমে ক্ষীণ অথচ দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব নগেন্দ্রনাথের উপর পড়ে। এই উত্তপ্ত পরিবেশের ভেতরে ম্যাট্রিকুলেশনে ভালো রেজাল্ট করে নগেন্দ্রনাথ। ১৯২০ সালে বৃত্তি পেয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এবার কলেজের দোরগোড়ায় এসে হাজির হলেন তিনি। মেদিনীপুর কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে (I.S.C) ভর্তি হয়ে গেলেন। কিন্তু বেশী দিন স্থায়ী হল না তাঁঁর কলেজ জীবন।
নগেন্দ্রনাথ তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এমন সময় গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন ভারত জুড়ে। উচ্চশিক্ষার মোহ ও জীবনে আর্থিক উন্নতির উচ্চ আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তরুণ নগেন্দ্রনাথ, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। দেশমাতৃকার মুক্তি আন্দোলনে। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাননি। এগিয়ে গেছেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে পাথেয় করে। ১৯২১ সাল থেকে তিনি গৃহত্যাগী। ডেবরা থানার গ্রাম-গঞ্জ রাস্তাঘাট ছিল তাঁর বাসস্থান। তবুও তাঁর পরিবারের লোকেদের গোলা থেকে প্রায় একশত মন ধান আটক করে নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা করে সরকার পক্ষ। নিলাম ডাকার লোক ও ক্রেতার অভাবে অবিক্রিত থেকে যায় ধান। হার স্বীকার করতে বাধ্য হয় সরকার পক্ষ। এসময় থেকে নগেনবাবু গ্রামের বাড়ি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী আলোকেন্দ্রে বসবাস শুরু করেন। তাঁর কাজের জন্য আত্মীয়-পরিজনদের গোরা সেনা প্রায়শই অত্যাচার করত। সেজন্য গৃহত্যাগ করা অবশ্য কর্তব্য মনে করলেন তিনি। যেই ভাবা, অমনি কাজ। আশ্রম তৈরি করে আলোককেন্দ্রে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন তিনি। আশ্রমের প্রাত্যহিক কাজের তালিকা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হত আশ্রমিকদের। তিনিও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। নিয়মের উর্ধ্বে নন তিনি। জীবনে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শিক্ষা, তাঁত পরিচালনা শিক্ষা প্রভৃতি কার্যে নিজেকে নিযুক্ত রাখেন। নিজের বাড়িতে গ্রামের ছেলেদের শিক্ষা দানের জন্য পাঠশালা খুলেছেন। গান্ধীজি প্রবর্তিত চরকা চালনা ও তাঁত শিল্প শিক্ষা দিতেন গ্রামের মানুষদের। নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন তাঁত শিক্ষা কেন্দ্র।
সারাজীবনে ৭―৮ বার ব্রিটিশের অন্যায় নীতির প্রতিবাদ করে কারাবরণ করেছেন। জেলে গিয়ে অকথ্য অত্যাচার সহ্য করেছেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৩৪-এ ডেবরার 'রাজ দরবার' সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। সেবার ১৯৩০ থেকে ১৯৩২ পর্যন্ত পর পর তিনজন গোরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পেডি-ডগলাস-বার্জের হত্যার পর মেদিনীপুরে জেলাশাসক হয়ে এলেন পি. জে. গ্রিফিথ। ডেবরার ডাক বাংলোর পশ্চিম পার্শ্বে বর্তমান হরিমতি স্কুলের মাঠে বসেছে রাজ দরবার। সেখানে উড্ডীন ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা অভিবাদন করতে বলা হয় নগেন্দ্রনাথকে। স্বাধীনচেতা নগেন্দ্রনাথ তা অস্বীকার করলে তাঁর উপর বর্বরোচিত অত্যাচার চালায় গোরা সৈন্য। শ্রদ্ধেয় স্বাধীনতা সংগ্রামী বলাইচন্দ্র হাজরার 'ডেবরা থানার ইতিকথা' বই থেকে জানা যায়― "নগেনবাবুকে বন্দুকের কুঁদার গুঁতা, বুটের ঠোক্কর দিতে দিতে একটি গাড়ীতে উঠাইয়া হাজতে লইয়া যাওয়া হয়"। আরও জানা যায়― "নগেনবাবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরিয়া পেটানো হয় এবং নির্জন থানা হাজতে ইউনিয়ন জ্যাককে সেলাম করিলে কেহ জানিতে পারিবে না এই ভাবে প্রলুব্ধ করা হইলেও তিনি রাজী হইলেন না। ফলে নগেনবাবুকে সঙ্গে সঙ্গে কারারুদ্ধ করা হয়।"
কারাবাস থেকে মুক্তি লাভ করে পুনরায় গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪২-এর ভারতছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাবাস করেন। ১৯৪৩ সালে জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। তখন পঞ্চাশের মন্বন্তর। চারদিকে দুমুঠো ফ্যান-ভাতের জন্য হাহাকার চলছে। আবার দেশের সেবায়, দশের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন নগেনবাবু। দেশসেবকগণের প্রচেষ্টায় ত্রাণকার্য শুরু হয়েছে ডেবরা থানার ৪/৫টি স্থানে। প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য সে আয়োজন।
এরপর ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের পনেরো তারিখে বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা লাভের পরেও থমকে যায়নি তাঁর দেশ গড়ার কাজ। পনেরোই আগস্ট থেকে তিনি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা 'স্বরাজ ও সংগঠন' প্রকাশ করেন। পত্রিকায় সমকালীন ডেবরার সামাজিক, প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক বাছাই-করা সংবাদ পরিবেশন করা হত। সরকারি সমস্ত সুযোগ সুবিধা নিতে তাঁর তীব্র অনীহা। এমনকি অনেক সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাঁকে ভোটে দাঁড়ানোর অনুরোধ করলে সবিনয়ে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। বরং তাঁর আশির্বাদ নিয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে অনেকের সফল হওয়ার ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। তাঁর সাধের আলোককেন্দ্রের ভবিষ্যৎ কল্পনা করে তিনি উইলে এই মর্মে দস্তখত করেন যে, সরকারি অথবা বেসরকারি কোনও অনুদান নেওয়া আইনত সম্ভব নয়। আজ পর্যন্ত যার অন্যথা হয়নি। সেজন্য আজও তাঁর স্বপ্নের আলোককেন্দ্র টালি আর অ্যাসবেস্টস-এর ছাউনি দেওয়া এবং মাটির দেওয়াল ঘেরা ছাপোষা বাড়িটি এক ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শন স্বরূপ অতীতের বহু ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে চলছে; ইঁট-বালি-রড-সিমেন্টের সংস্পর্শে ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট হয়ে যায়নি। বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গের চরণস্পর্শে উজ্জ্বল এই আলোককেন্দ্রে ১৯৮৯ সালের আগস্ট মাসের ছাব্বিশ (বাংলা ৯ই ভাদ্র ১৩৯৬) তারিখে সামান্য রোগ ভোগের পর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ডেবরার প্রাণপুরুষ শ্রী নগেন্দ্রনাথ সেন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে ডেবরা থানায়। তাঁর মৃত্যু মেদিনীপুরের বিপুল ক্ষতি। আজকের পৃথিবীতে তাঁর মতো সৎ, নিরহংকারী, প্রকৃত দেশ-নেতার বড়ই অভাব। এ হেন স্বাধীনতা সংগ্রামীর শ্রীচরণকমলে আমার শত কোটি প্রণাম।
midnapore.in