বহুদিন হোলো আপনার কোন কুশল সংবাদ পাই নাই, আশা করি কুশলে আছেন। মা আজ আমার ....... সুখ অনুভব করিতেছি তাহা আমি নিজেই বুঝিতে পারিতেছি না। কে যেন আলো দেখিয়ে বলছে "আয়, আয়, ফিরে আয়, ওখানে তোর স্থান হবে না, এই অন্তরের কোলে তোর স্থান"। তাঁর ডাকে আত্মহারা হয়ে ছুটে চলেছি। কোথায় চলেছি ও কেন চলেছি তাহা কিছুই জানি না। মাগো, তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি বলে তুমি দুঃখ কোরো না কারণ এখানে যাহারাই আসিয়াছে, তাহাদিগকে ফিরিয়া যাইতে হইবে। এই পৃথিবী ঠিক যেন একটি বাজার স্বরূপ বাজার করুক বা না করুক ফিরিয়া যাইতেই হইবে। যাঁহার ইচ্ছাতেই এই পৃথিবী চলিতেছে সেই অনন্ত পুরুষ যাঁহার অঙ্গুলি হেলনে সমস্ত দুনিয়া ওলোট পালোট হয়ে যেতে পারে তাঁহার ডাক আসিলে সকলকেই চলিয়া যাইতে হইবে। "তাঁরই ইচ্ছা হবেই পূর্ণ সকল জীবন মাঝে"।
শহীদ রামকৃষ্ণ রায় | सहीद रामकृष्ण राय | Martyr Ramakrishna Roy
মাগো, আমি আপনার হতভাগ্য সন্তান। পৃথিবীতে এসে কেবল আপনাকে দুঃখ এবং অশান্তিই দিয়ে গেলাম। আপনার প্রতি আমি কোন কর্তব্যই করিতে পারিলাম না। তাহার জন্য আমায় ক্ষমা করিবেন। বহু তপস্যা ও আরাধনার পর আমি আপনার মোট মা পেয়েছিলাম কিন্তু বিধাতা আমায় বেশী দিন আপনার চরণে স্থান দিলে না। মা আজ পর্যন্ত দুঃখ ও কষ্ট দিয়েই গেলাম। শুধু এই আসা নিয়ে গেলাম আপনার মত মা জন্ম জন্ম যেন পাই। মাগো আমার শুধু মনে হয় যে আপনি আমার জন্য চিন্তা করিয়া পাছে শরীর নষ্ট করেন, তাহা যেন না হয়। তাহলে আমি শান্তি পাবো না। গনা, ভুজঙ্গ, খোকন, ডলি ও মেজদার খোকা এদেরকে দেখে আমাকে ভুলতে চেষ্টা করবেন এই আমার অনুরোধ। আপনি আমার শতকোটি ভুমিষ্ট প্রণাম গ্রহণ করিবেন। .............. আমি তবে এবারের মত আসি মা। তোমার কোল হতে চির বিদায় নিয়ে চল্লাম। গীতাটি দিয়ে গেলাম।
প্রণত :
আপনার স্নেহের-
রামকৃষ্ণ।
রাত্রি শেষ প্রহর। ঝন ঝন করে লোহার দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকল একজন অফিসার ও সশস্ত্র পুলিশ। "প্রস্তুত ?" উত্তর এল "সম্পূর্ণ প্রস্তুত"। মাথা উঁচু করে এগিয়ে চলল একটি কিশোর সঙ্গে সশস্ত্র প্রহরীরা। সশস্ত্র প্রহরীদের মধ্যেও কেউ কেউ সবার অগোচরে চোখের জল মুছল। ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে গিয়ে তুলল, ধর্মের নামে অভিনয় হল ! তারপর একটি শব্দ 'খট'। "মা - মাগো" শেষ কথা। ২৫ শে অক্টোবর বৃহস্পতিবার ১৯৩৪ সাল ভোর ৫ টা।
কেউ হরিধ্বনি দিল না- বন্দেমাতরম বলল না - কেউ আর্তনাদ করে কেঁদে উঠল না। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের উত্তর-পশ্চিম পশে একটি বাগানের মধ্যে জ্বলে উঠলো একটি চিতা- লেলিহান অগ্নি শিখা স্পর্শ করল আকাশ, বিদেহী অমর আত্মা হাসতে হাসতে দেবলোকে চলে গেলেন।
২০১৯ সালে মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) কর্তৃক শহীদ রামকৃষ্ণ রায়ে'র বলিদান দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
অগ্নিযুগের অমর শহীদ রামকৃষ্ণ রায় জন্মেছিলেন ৯ জানুয়ারি ১৯১৩ সালে মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর থানার অন্তর্গত জকপুরের বিখ্যাত রায় মহাশয় বংশে। পিতা কেনারাম রায়, মাতা ভবতারিণী দেবী। রামকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন মেদিনীপুর শহরের চিড়িমারসাই এলাকায়।
পাঠশালায় পড়া শেষ করে, রামকৃষ্ণ মেদিনীপুর টাউন স্কুলে ১৯২২ সালে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হয়। ঐ ক্লাসেই তার পরবর্তী কালের সহকর্মীগন- ব্রজকিশোর, অমর চট্টোপাধ্যায়, ফানি দাস প্রভৃতি ভর্তি হয়। ছোটবেলা থেকে রামকৃষ্ণের শরীরচর্চা, মানুষের সেবা, বন্ধুদের সাহায্য করা ইত্যাদিতে আগ্রহ দেখা যায়। ১৯২৪ সালে যখন মহাত্মা গান্ধী মেদিনীপুরে এসেছিলেন তখন বালক রামকৃষ্ণ সেচ্ছাসেবক বাহিনীতে সারাদিন ব্যাস্ত। ১৯২৬ সালে বাংলার হীন রাজনীতির চক্রের বিরুদ্ধে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল যখন পৌরসভার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন, রামকৃষ্ণ তাঁর হয়ে ভোট সংগ্রহ করেছেন। ১৯২৮ সালে যখন জেল থেকে বেরিয়ে সুভাষচন্দ্র এলেন তখনও ছোটাছুটি করতে দেখা গেল প্রাণচঞ্চল রামকৃষ্ণকে।
ঠিক এইরকম সময়েই মেদিনীপুরের যুবকদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মেদিনীপুরে এলেন বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত। মেদিনীপুর কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হলেন। আসল উদেশ্য বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স -কে শক্তিশালী করা।
রামকৃষ্ণের তখন অস্থির চিত্ত। সে তখন বিবিগঞ্জ ছোট শিব মন্দিরের আব্দুল্লীর আখড়ার একজন অন্যতম সদস্য। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আর্তের সেবায় সে সর্বদা আগে ছিল। রামকৃষ্ণ তখন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স -এর সদস্য নয় কিন্তু সে বুঝতে পারছিল যে মেদিনীপুরে এমন একটা কিছু হচ্ছে যাতে সে নেই। মনটা তাঁর ছটপট করছিল।
২০১৯ সালে মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) কর্তৃক শহীদ রামকৃষ্ণ রায়ে'র বলিদান দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
এদিকে কাজ পাগল ফনী কুন্ডু (দীনেশের সহকর্মী) খুঁজছে কয়েকটি ছেলে যারা তার কাজে সাহায্যে করবে। ফনী কুন্ডুর নজর পড়ল আব্দুল্লীর আখড়ার দিকে। সবার আপত্তি অগ্রাহ্য করে রামকৃষ্ণকে দলে নিয়ে এলো। বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স -এর একশন প্ল্যান করাই ছিল, দরকার ছিল কিছু সাহসী যুবকের। রামকৃষ্ণ দলে আসার কিছুদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল। তারই অনুপ্রেরণায় অল্প সময়ের মধ্যেই একদল নতুন ছেলে দলে যোগ দিল।
২০২০ সালে মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) কর্তৃক শহীদ রামকৃষ্ণ রায়ে'র জন্মদিন উদযাপন।
রামকৃষ্ণ বসে থাকার ছেলে নয়, দলে আসার পর থেকেই কাজ দাও কাজ দাও করতে লাগল। এই সময় হটাৎ শোনা গেল ১৯৩০ সালে পেডি সাহেব তমলুক থেকে মেদিনীপুর ট্রেনে আসছে। ফনী কুন্ডু ঠিক করল কুখ্যাত জেলাশাসক পেডিকে হত্যা করতে হবে। কিন্তু ছুরি ছাড়া কোন অস্ত্র নেই। রামকৃষ্ণ ছুরি নিয়েই যেতে প্রস্তুত। কলেজ থেকে পটাসিয়াম সায়ানাইড এনে ভেসলিন দিয়ে ছুরিতে লাগানো হল এবং ঠিক হল খড়্গপুর স্টেশনে ছুরি দিয়ে রামকৃষ্ণ পেডিকে আক্রমণ করবে এবং নিজে আত্মহত্যা করবে।
নিদৃষ্ট দিনে রামকৃষ্ণ বেরিয়ে গেল। ভালোবাসার টানে দলের নেতা ফনী কুন্ডু দলের নিয়ম ভেঙ্গে তার পিছু নিল। খড়্গপুর স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। দরজা বন্ধ চারদিকে পুলিশে ছয়লাপ। কিছুতেই পেডির কামরায় যাওয়া যায় না। তবুও রামকৃষ্ণ এগিয়ে চলল - ট্রেনের জানলার ফাঁক দিয়ে পেডিকে মারার জন্য। অসম্ভবকে সম্ভব করবে রামকৃষ্ণ। হটাৎ পেছন থেকে টান পড়ল - ফনী কুন্ডু বাধা দিলেন। নেতার নির্দেশ মানতেই হবে। রামকৃষ্ণ আফসোসে কেঁদে ফেললো। ঠিক হল মেদিনীপুর স্টেশনে আবার চেষ্টা হবে। মেদিনীপুরেও একই জিনিস, ট্রেনের কাছেও ঘেষতে পারলো না রামকৃষ্ণ। শহীদ হওয়ার সুযোগ পেলোনা রামকৃষ্ণ। বেশ কিছুদিন মুষড়ে পড়লেন।
২০২০ সালে মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) কর্তৃক শহীদ রামকৃষ্ণ রায়ে'র জন্মদিন উদযাপন।
কিছুদিন পরে হত্যা করা হল পেডিকে। ফনী কুন্ডু রামকৃষ্ণকে সেই অভিযানে নেয়নি। দলের নেতারা ধরা পড়ল। যারা বাইরে থাকল তাদের অনেকেই মার্কা মারা। সেই তালিকায় ছিল রামকৃষ্ণ ও ব্রজকিশোর। ঠিক হল কিছুদিন গা ঢাকা দিতে হবে। পুলিশ যেন কিছুতেই ধরতে না পারে। ফনী কুন্ডু জেলে, দীনেশ গুপ্তর ফাঁসি হয়ে গেছে। তাই ঠিক হল রামকৃষ্ণ ও ব্রজকিশোর পেছনে থাকবে, কিছুতেই সামনে আসবেনা। ধীর স্থির ব্রজকিশোর মেনে নিল। ব্রজকিশোর সেইসময় দল তৈরির দায়িত্বে ছিল - ব্রজই গোপন স্থান নির্বাচন করত এবং সেই রাখতো অস্ত্র, তারই সঙ্গে সবার পরিচয় - ব্রজ ছিল যোগসূত্র। সেই ব্রজকিশোর চলে গেল গোপনে। পূজারী বামুন সেজে ছোট কাপড়, বড় পৈতে পরে বাড়ি বাড়ি পূজার মাধ্যমে ছেলে জোগাড় করতে শুরু করল। পুলিশ ভাবল পেডি হত্যা মামলায় খালাস পেয়ে ব্রজ ভয় পেয়ে ঘরে ঢুকে গেছে, তাই পুলিশ তার পিছন ছেড়ে দিল।
২০২০ সালে মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) কর্তৃক শহীদ রামকৃষ্ণ রায়ে'র জন্মদিন উদযাপন।
এদিকে রামকৃষ্ণ অস্থির চিত্ত। মাণিক নন্দীর পুকুর পাড়ে একটা ছোট কুঁড়ে ঘরে সে থাকত। ব্রজর মত দলের নির্দেশ সে মেনে নিতে পারে নি। রাত্রের অন্ধকারে প্রায়ই সে তার সহকর্মীদের কাছে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে। অনুরোধ করে যে তাকে বাদ দিয়ে যেন অন্য কেউ আত্মবলিদানের সুযোগ না পেয়ে যায়।
এদিকে ডগলাস হত্যার সময় চলে এসেছে। রামকৃষ্ণকে কিছুই বলা হয়নি। জানতে পারলে তাকে আটকানো যাবেনা। ঠিক হল ডগলাস হত্যার পরে ব্রজ ও রামকৃষ্ণকে সামনে আনা হবে। ডগলাস হত্যা হয়ে গেল, খবর পেয়ে রামকৃষ্ণ শহীদ না হতে পারার ক্ষোভ প্রকাশ করল। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী দলের দায়িত্ব এলো ব্রজ ও রামকৃষ্ণর উপরে। তারাও তৈরী ছিল। এদিকে প্রদ্যোতের ফাঁসি হয়ে গেল, অন্য সবাই জেলে। কাজ বেড়েছে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের সজাগ দৃষ্টি বেড়েছে। তৃতীয় অত্যাচারী জেলাশাসক বার্জকে হত্যা করতে হবে - পরিকল্পনা ঠিক হল, কিন্তু পুলিশের সজাগ দৃষ্টিতে সব বিফল হল।
২০২০ সালে মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) কর্তৃক শহীদ রামকৃষ্ণ রায়ে'র জন্মদিন উদযাপন।
এল শুভদিন - ১৯৩৩ সালের ২রা সেপ্টেম্বর। বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় - অনাথবন্ধু পাঁজা ও মৃগেন দত্তর গুলিতে বার্জ ধরাশায়ী হল পুলিশ মাঠে। অনাথ ও মৃগেন পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিল। মেদিনীপুরের অগণিত যুবকসহ ধৃত হল রামকৃষ্ণ ও ব্রজকিশোর, চলল তাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার। রামকৃষ্ণ ও ব্রজকিশোর অচল অটল, কিছুতেই পুলিশ তাদের মুখ খোলাতে পারলো না।
১৯৩৪ সালে বিচারের প্রহসন হল। রামকৃষ্ণ, ব্রজকিশোর ও নির্মলজীবনের ফাঁসির আদেশ হল। অন্যদের দীপান্তর হল। ১৯৩৪ সালের ৮ই অক্টোবর রামকৃষ্ণের বড় দাদা নরেশ কৃষ্ণ রায়ের কাছে (লালু বাবু) জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের একটি চিঠি এল।
From,
Superintendent.
Midnapur Central Jail.
No. 4847 A-B/3
To,
Babu Naresh Krishna Roy.
Chirimarshai, Midnapore Town.
Dear Sir,
I Write to inform you that your brother Ramkrishna Roy who has been condemned to death desires to have an interview with you.
Will you please come to the jail gate at 3.30 p.m. on 10th instant if you desire to see him. The District Magistrate has no objection to permit you to see your brother.
Yours faithfully
S/D Illegible.
Major I.M.S.
Superintendent
VIDEO - ২০১৯ সালে মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) কর্তৃক শহীদ রামকৃষ্ণ রায়ে'র বলিদান দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
১০ই অক্টোবর নরেশবাবু জেল গেটে শেষ দেখা করলেন। প্রসন্ন মুখ, বলিষ্ঠ দেহ দাদার পায়ের ধুলো নিয়ে বললেন - "দাদা চললাম - মাকে দেখো, আমি আবার আসবো"।
VIDEO - ২০২০ সালে মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) কর্তৃক শহীদ রামকৃষ্ণ রায়ে'র জন্মদিন উদযাপন।
১৯৩৪ সালে ২৫শে অক্টোবর মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি হল রামকৃষ্ণ ও ব্রজকিশোরের। পরের দিন ফাঁসি হল নির্মলজীবনের। রামকৃষ্ণের মা ফাঁসির খবর পেয়ে একটি মাত্র কথা বলেছিলেন - "এই তিনটিকে মেরেও ইংরেজ তোমাদের রাজত্ব থাকবে না"। তারপর থেকে তিনি আর কথা বলেন নি।
অরিন্দম ভৌমিক।
midnapore.in
(Published on 09.01.2021)
২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ "রামকৃষ্ণ রায়"।