শহীদ প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য, शहीद प्रद्योतकुमार भट्टाचार्य, Martyr Pradyot Kumar Bhattacharya, Midnapore, Medinipur

শহীদ প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য

शहीद प्रद्योतकुमार भट्टाचार्य | Martyr Pradyot Kumar Bhattacharya

অরিন্দম ভৌমিক।


(২ নভেম্বর ১৯১৩ - ১২ জানুয়ারি ১৯৩৩)


১৯৩২ সালের ৩০ শে এপ্রিল। সারা দেশ জুড়ে আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল মেদিনীপুরের দ্বিতীয় জেলাশাসক মিঃ ডগলাস হত্যার সংবাদ। মেদিনীপুরের নাম আবার সংবাদের শিরোনামে।



মেদিনীপুর শহরেই জেলাবোর্ডের এক জরুরি সভায় ডগলাস এসেছেন অন্যান্য অফিসারদের নিয়ে। গত বছর বিপ্লবীদের হাতে জেলাশাসক পেডি'র হত্যা তিনি ভোলেন নি। তাই গুলিভরা রিভলবার তার পকেটে নয়, হাতেই রয়েছে। বিপ্লবীরা কাছে এলেই গুলি করে উড়িয়ে দেবেন। সশস্ত্র দুজন পার্সোনাল আর্দালী (দেহরক্ষী) দুইপাশে রয়েছে। এ ছাড়াও সন্ত্রী-সেপাই-ওয়াচার সবসময় তাকে ঘিরে রয়েছে। এক কথায় আজকের দিনের জেড-প্লাস সিকিউরিটি।

শহীদ প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য, शहीद प्रद्योतकुमार भट्टाचार्य, Martyr Pradyot Kumar Bhattacharya, Midnapore, Medinipur
২০২২ সালে শহীদ প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্যের জন্মদিনে মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) -এর স্মরণ-শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ডগলাস নিজের জায়গায় বসার পরে সভার কাজ শুরু হল। হটাৎ কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সামনের দরজা দিয়ে (ডগলাস দরজার দিকে পেছন করে বসেছিলেন) দ্রুম দ্রুম শব্দে বিপ্লবীদের গুলি আঘাত করল ডগলাসকে। তিনি চেয়ারে যেমন বসেছিলেন তেমনই বসে রইলেন, আর উঠলেন না। ঘড়িতে তখন ৫ টা ৪৫ মিনিট। লোকজন এবং অফিসাররা উধাও হয়ে গেছে। কেউ কেউ ভয়ে টেবিলের নিচে বা আলমারির পেছনে লুকিয়ে পড়েছে।

শহীদ প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য, शहीद प्रद्योतकुमार भट्टाचार्य, Martyr Pradyot Kumar Bhattacharya, Midnapore, Medinipur
২০২০ সালে শহীদ প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্যের বলিদান দিবসে মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) -এর স্মরণ-শ্রদ্ধাঞ্জলি।

দুজন বিপ্লবীকেই সবাই দেখেছেন। একজন অল্প বয়স্ক কিশোর এবং অন্যজন ভোজপুরি-দারোয়ানদের মত গোঁফ ওয়ালা স্বাস্থবান যুবক। গুলি চালিয়েই নিমেষের মধ্যে বারান্দা থেকে লাফিয়ে উত্তর দিকে রাস্তা ধরে দৌড় লাগালেন। ডগলাসের দেহরক্ষীরা দৌড়োচ্ছে পেছনে। তাদের পেছনে দৌড়োচ্ছে আরো অনেক সেপাই। প্রায় দশ-বারো হাত দূর থেকে বিপ্লবীদের লক্ষ করে গুলিবৃষ্টি শুরু করল সেপাইরা। বিপ্লবীদের মাথার উপর দিয়ে ও কানের পাশ দিয়ে প্রচন্ড শব্দে বুলেট ছুটে যেতে লাগল।

অল্প বয়স্ক কিশোর বিপ্লবী প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য এবং ভোজপুরি-দারোয়ানদের মত গোঁফ ওয়ালা স্বাস্থবান যুবক হলেন প্রভাংশু পাল। ডগলাসকে গুলি করতে গিয়ে প্রভাংশুর রিভলবারের সমস্ত গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বোর্ড অফিস থেকে দৌড়োতে দৌড়োতেই আবার রিভলবারের গুলি ভরে নিলেন এবং ফিরে দাঁড়িয়ে দু-চারটে গুলি ছুড়তেই দেহরক্ষীরা পিছিয়ে পড়ল। প্রদ্যোৎ ও প্রভাংশু আবার দৌড় লাগালেন।



সেপাইরাও ধাওয়া করল তাঁদের। তমলুকের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট জজসাহেবও রিভলবার হাতে দৌড়োলেন বিপ্লবীদের ধরতে। প্রদ্যোৎ ও প্রভাংশু বড় রাস্তায় পৌঁছে পূর্বদিকে 'অমর লজ' পর্যন্ত একসঙ্গে দৌড়োলেন। তারপর হটাৎ প্রভাংশু অমর লজের পাশের রাস্তা ধরে উত্তর-পূর্ব দিকে দৌড়োলেন। কয়েকজন সেপাই পিছু নিতেই প্রভাংশু ঘুরে দাঁড়িয়ে গুলি চালালেন। এদিকে সেপাইদের গুলি শেষ, তারা ভয়ে পিছিয়ে পড়তেই নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে গেলেন প্রভাংশু।

এদিকে প্রদ্যোৎ বড় রাস্তা ছেড়ে দক্ষিণ দিকে দৌড়োলেন। অধিকাংশ সেপাই ও অফিসাররা তাঁর পেছনেই দৌড়োচ্ছিলেন। মিঃ জর্জ, ঝাড়গ্রামের নৃপেন মিত্র ও দেহরক্ষীরা সবাই প্রদ্যোৎ -এর পেছনে এসে গেছে। প্রদ্যোৎ হটাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে গুলি চালাতে লাগলেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবসত তাঁর রিভলবার থেকে একটাও গুলি বেরোলো না। আবার দৌড়োলেন, 'সাইন্স-লজ' নামে একটি ভাঙা-পোড়ো বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। প্রচুর সেপাই ঘিরে ফেলল বাড়িটি। ধরা পড়লেন প্রদ্যোৎ।

তাঁর পকেটে পাওয়া দুটি কাগজের একটিতে লাল কালিতে বাংলায় লেখা ছিল -


"হিজলি অত্যাচারের ক্ষীণ প্রতিবাদ। ইহাদের মরণেতে বৃটেন জানুক। আমাদের আহুতিতে ভারত জাগুক। বন্দেমাতরম। "


অন্যটিতে ইংরেজিতে লেখা ছিল -


"A fitting reply to premeditated and prearranged barbarous & cowardly attempt on the patriotic sons of Bengal revolutionaries."


১৯১৩ সালের ২ নভেম্বর মেদিনীপুর শহরের অলিগঞ্জ অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দাসপুরের গোকুলনগর (বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা) গ্রামে ছিল তাঁর পৈতৃক ভিটে। পিতা ভবদাচরণ ভট্টাচার্য এবং মাতা পঙ্কজিনী ভট্টাচার্য। আইনজীবী ভবদাচরণ মেদিনীপুরে রেভিনিউ এজেন্ট ছিলেন। বড় ভাই ছিলেন ডাক্তার এবং ছোট ভাই চাকরি করতেন রেলে। ১৯৩০ সালে মেদিনীপুরের হিন্দু স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে পাস করে ভর্তি হলেন মেদিনীপুর কলেজে। হিন্দু স্কুলে পড়ার সময়েই বেঙ্গল-ভলেন্টিয়ার্সের সংস্পর্শে এসেছিলেন। প্রদ্যোৎ কেবল সৈনিক ছিলেন না। ছিলেন সংগঠক, সাহিত্যপ্রেমী এবং সুলেখক। জেল থেকে তাঁর লেখা চিঠিগুলিই তার প্রমান। দেশ-বিদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস তাঁকে উদবুদ্ধ করেছিল।

শহীদ প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য, शहीद प्रद्योतकुमार भट्टाचार्य, Martyr Pradyot Kumar Bhattacharya, Midnapore, Medinipur
২০২০ সালে শহীদ প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্যের বলিদান দিবসে মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) -এর স্মরণ-শ্রদ্ধাঞ্জলি।

তাঁর বাড়ির পাশেই থাকতেন ক্ষুদিরামের মাতৃসম দিদি অপরূপা দেবী। প্রদ্যোৎ যখন-তখন অপরূপা দেবীর কাছে ক্ষুদিরামের গল্প শুনতে চাইতেন। এমনকি ডগলাসকে মারার দিনও সকালে ঐ বাড়িতে অনেক্ষন কেরাম খেলেছিল প্রদ্যোৎ। কিন্তু কেউ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি যে কিছুক্ষন পরেই তিনি ডগলাসকে মারতে যাবেন।


শহীদ প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য, शहीद प्रद्योतकुमार भट्टाचार्य, Martyr Pradyot Kumar Bhattacharya, Midnapore, Medinipur
২০২০ সালে শহীদ প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্যের বলিদান দিবসে মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) -এর স্মরণ-শ্রদ্ধাঞ্জলি।

জেলে তাঁর উপরে অমানুষিক অত্যাচার শুরু হল। কোন অত্যাচারই তাঁকে টলাতে পারলো না। উল্টে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্য তিনি একটি স্টেটমেন্ট দিলেন - "আমার সঙ্গে ছিলেন কলকাতার হিমাংশুদা। ..... তাঁর সঙ্গে আমার কলকাতার একটি পার্কে আলাপ হয়েছিল। .... তিনি অস্ত্র আনেন এবং আমরা এই কাজ করি।" পুলিশ কলকাতা ও মেদিনীপুরে তন্য তন্য করে খুঁজতে লাগল বিরাট গোঁফওয়ালা (গোঁফগুলি নকল ছিল) ঐ হিমাংশুদাকে।



একদিন ভুপেন দারোগা প্রদ্যোৎকে বললেন - "ছিঃ প্রদ্যোৎ, তোমার মত একটি বুদ্ধিমান ছেলে কিনা এমন একটা রিভলবার নিয়ে গেল, যা একটুও সাড়া দিল না !"

প্রদ্যোৎ তাঁর বেড়ি পরানো হাতদুটো কপালে ঠেকিয়ে বলেছিলেন -


"Irony of fate. Bhupen Babu ! Had my revolver spoken out. I would not have been here and in this condition, the story would have been otherwise."


তাঁর বিচারের রায় বেরোয় ১৯৩২ সালের ১৫ জুন। কোর্ট লোকে লোকারণ্য। ফাঁসির হুকুম হল। সেপাইরা তাঁকে বাইরের প্রাঙ্গনে আনলে, নিস্তব্ধ জনতার উদ্দেশে তিনি বললেন -


"এতে ভয় পাওয়ার কি আছে ? মৃত্যুর তুহিন-স্পর্শে আমি অমরতার গান শুনতে পাচ্ছি।".....


শহীদ প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য, शहीद प्रद्योतकुमार भट्टाचार्य, Martyr Pradyot Kumar Bhattacharya, Midnapore, Medinipur
২০২১ সালে শহীদ প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্যের বলিদান দিবসে মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) -এর স্মরণ-শ্রদ্ধাঞ্জলি।

১৬ অগাস্ট আপীল-শুনানির তারিখেও ফাঁসির হুকুম বহাল থাকল।

ফাঁসির অপেক্ষায় অপেক্ষমান প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য মা পঙ্কজিনী দেবীকে লিখলেন (চিঠির অংশ বিশেষ) -


মাগো,


আমি যে আজ মরণের পথে আমার যাত্রা সুরু করেছি তার জন্য কোন শোক কোরোনা। ............ যদি কোন ব্যারামে আমায় মরতে হোত তবে কি আপশোষই না থাকতো সকলের মনে, কিন্তু আজ একটা আদর্শের জন্য প্রাণ বিসর্জন করছি, তাতে আনন্দ আমার মনের কাণায় কাণায় ভরে উঠছে, মন খুশিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। ............ ।

একথা মনেও স্থান দিও না 'মা' যে আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত চিন্তা সমস্ত আশাও লোপ পেয়ে গেল। সব রয়ে গেল আমার বাংলার ছেলে মেয়েদের মনে, আর আমার বাংলার মায়েদের অন্তরে।

'মা' তোমার প্রদ্যোৎ কি কখনো মরতে পারে? আজ চারিদিকে চেয়ে দেখ, লক্ষ লক্ষ 'প্রদ্যোৎ' তোমার দিকে চেয়ে হাসছে। আমি বেঁচেই রইলাম, 'মা' অক্ষয় হয়ে।


বন্দেমাতরম্ ............।


ইতি

কচি (ডাকনাম)।


১৯৩৩ সালের ১২ জানুয়ারি হাঁসি মুখে ফাঁসির মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। জল্লাদ গলায় ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দেওয়ার পরে প্রদ্যোৎ বললেন -


VIDEO - ২০২০ সালে শহীদ প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্যের বলিদান দিবসে মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) -এর স্মরণ-শ্রদ্ধাঞ্জলি।

"মা আমি যেন আবার তোমার কোলে ফিরে এসে তোমার সেবা করতে পাই। ভারত থেকে অত্যাচারী ইংরেজ উচ্ছেদ হোক; বিপ্লবী ভারত জয়যুক্ত হোক। আমার দেহের প্রতি রক্তবিন্দু ভারতের ঘরে ঘরে বিপ্লবী সৃষ্টি করুক।"


অরিন্দম ভৌমিক।

midnapore.in

(Published on 12.01.2021)