১৯৫৮ সালে মৌলিশোল গ্রামে (খড়্গপুর ব্লক) জন্ম। পিতা স্বর্গীয় সুবোধ মাহাত এবং মাতা কমলা দেবী মাহাত। ছোটবেলাটা কেটেছে মৌলিশোল গ্রামেই। ছোটবেলায় তিনি খুব দুষ্টু ছিলেন। ঘর থেকে স্কুলের পথে যেতেন ঠিকই কিন্তু স্কুলে পৌঁছতেন না। সারাদিন খেলে বেড়াতেন মাঠে ঘটে। মাছ ধরে বেড়াতেন খালে বিলে। ছোট থেকেই ছিলেন পরোপকারী। খেলতে খেলতে হয়ত দেখলেন কোথাও বয়স্ক মানুষের হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে যেতেন, পৌঁছে দিয়ে আসতেন বাড়ি পর্যন্ত।
১৯৭৪ সালে খড়্গপুরের আরামবাটী গ্রামের সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন। অভাবের সংসারে ৪ ভাই ও ৩ বোনের ঠিকমত খাওয়ার জুটতো না। তাই মাধ্যমিকের পরে আর পড়া হল না। অধিকাংশ দিনই চাল কেনার পয়সা জুটতো না, তাই ভুট্টার ছাতু (পালই) খেয়ে কাটাতে হত। সংসার চালানোর জন্য লোকের বাড়িতে কাজ করতেন।
তাদের দুরাবস্থা দেখে মামাবাড়ি থেকে ডাক আসে। ১৯৭৫ সালে মায়ের হাত ধরে চলে আসেন ইন্দ্রাবনী গ্রামে মামাবাড়িতে। সেই থেকে ইন্দ্রাবনী গ্রামের বাসিন্দা।
কয়েক বছর পরে একদিন তিনি জানতে পারেন যে গ্রামের কয়েকজন দল বেঁধে মায়াপুর ঘুরতে যাবেন। তারও মনে সাধ জাগলো মায়াপুর যাওয়ার। কিন্তু যাবেন কিভাবে ? তার কাছে তো কোন পয়সা নেই। মায়াপুর যাওয়ার জন্য স্টেশনে কুলির কাজ শুরু করলেন। কিছু টাকা সংগ্রহ হতেই রওনা দিলেন মায়াপুরের উদ্যেশ্যে। যাওয়ার সময় ট্রেনে ভিক্ষে করেই জোগাড় করে নিয়েছিলেন ফিরে আসার টাকা।
Indrabani Grameen Nari Shishu Bikash Kendra | ইন্দ্রাবনী গ্রামীন নারী শিশু বিকাশ কেন্দ্র | इंद्रबनी ग्रामीण नारी शिशु विकास केंद्र
মায়াপুরে কিছুদিন থাকার পরে তার মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ হয়। হরিনাম সংকীর্তনের প্রতি আকৃষ্ট হন। গ্রামে ফিরে এসে শিখে ফেললেন খোল (বাদ্যযন্ত্র)। গ্রামে গ্রামে ঘুরে হরিনাম সংকীর্তন করতে শুরু করলেন। অবসর সময়ে শ্রী রামকৃষ্ণ, মা সারদাময়ী ও স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী পড়তেন।
১৯৮০ সালে বীরেন্দ্রনারায়ণ গোস্বামীর কাছ থেকে দীক্ষা নেন এবং ধুতি পাঞ্জাবি পরা শুরু করেন। খোল বাজিয়ে যে টাকা উপার্জন করতেন, তার কিছুটা সংসারে দিয়ে বাকিটা দরিদ্র অসহায় মানুষের জন্য খরচ করতেন। ১৯৮১ সালে তার বিয়ে হয় ভারতী মাহাত'র সঙ্গে। মনের মধ্যে একটা তীব্র ইচ্ছা ছিল যে, যদি তিনি কোনভাবে গরিব বা অনাথ শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারতেন।
Wife Bharati Mahat at the kitchen door | রান্নাঘরের দরজায় স্ত্রী ভারতী মাহাত | रसोई के दरवाजे पर पत्नी भारती माहात
একদিন তার মনে প্রশ্ন জাগে যে, যদি একটা মেলা কমিটি বা ক্লাব নিজেদের এলাকায় চাঁদা তুলে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে মেলা বা দূর্গাপূজা করতে পারে, তাহলে তিনি সারা বছর বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষা করে কয়েকটা অনাথ বা দুঃস্থ শিশুর শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারবেন না কেন ?
Indrabani Grameen Nari Shishu Bikash Kendra | ইন্দ্রাবনী গ্রামীন নারী শিশু বিকাশ কেন্দ্র | इंद्रबनी ग्रामीण नारी शिशु विकास केंद्र
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন "ইন্দ্রাবনী গ্রামীন নারী শিশু বিকাশ কেন্দ্র" নামে সমাজ সেবা মূলক প্রতিষ্ঠান (যা আজ ইন্দ্রাবনী আশ্রম নামে বেশি পরিচিত)। শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। সঙ্গে পান জয়ন্তী সিং নামে আরেক সমাজসেবীকে। অভাবের জন্য বা অন্য কোন কারণে যে সমস্ত মেয়ে স্কুলে যায় না, দুজনে মিলে তাদের খুঁজতে লাগলেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ২৫ জন সাঁওতালি ও সবর জাতির ছাত্রী নিয়ে শুরু হয় পথ চলা। সঙ্গ দেন স্ত্রী ভারতী দেবীও। তাদের পড়াশোনা, থাকা, খাওয়ার সমস্ত খরচ তিনি দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে এবং খোল বাজিয়ে হরিনাম সংকীর্ত্তন করে সংগ্রহ করে চলেছেন। এভাবেই চলতে চলতে, বর্তমানে ছাত্রীর সংখ্যা মোট ষাট (৬০) জনে দাঁড়িয়েছে।
Indrabani Grameen Nari Shishu Bikash Kendra | ইন্দ্রাবনী গ্রামীন নারী শিশু বিকাশ কেন্দ্র | इंद्रबनी ग्रामीण नारी शिशु विकास केंद्र
শুরুর দিকে এমন সময় গেছে যে রাত্রে রান্নার চাল না থাকায় আটার ভূসি সেদ্ধ করে নিজেরাও খেয়েছেন এবং মেয়েরাও খেয়ে রাত কাটিয়েছে। আবার কোন কোন দিন ভাত আর শাক সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটিয়েছেন ছাত্রীদের সঙ্গে।
Indrabani Grameen Nari Shishu Bikash Kendra | ইন্দ্রাবনী গ্রামীন নারী শিশু বিকাশ কেন্দ্র | इंद्रबनी ग्रामीण नारी शिशु विकास केंद्र
বিধায়ক, সাংসদ সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে বহুবার সাহায্যের আবেদন করেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনরকম সাহায্য পৌঁছয়নি তাদের কাছে। তবে ধন্যবাদ জানাতে হয় ঝাড়গ্রাম পঞ্চায়েত সমিতিকে। তারা ২০১৭-১৮ সালে থেকে চারটি (৪) টয়লেট ও দুইটি (২) স্নান ঘর করে দিয়েছিলেন। জলের জন্য সাবমারসেবল (submersible pump) অনিল পাটোয়ারী নামে এক ভদ্রলোক। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার জন্য একটি টোটো কিনে দিয়েছেন কৌশল্যা দেবী। এইভাবেই কেটে গেছে এই সংস্থার ১২ বছর।
Indrabani Grameen Nari Shishu Bikash Kendra | ইন্দ্রাবনী গ্রামীন নারী শিশু বিকাশ কেন্দ্র | इंद्रबनी ग्रामीण नारी शिशु विकास केंद्र
এই সংস্থার কাজের পাশাপাশি তিনি অসহায় অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাওয়া, প্রয়োজনে রক্তদান ইত্যাদি কাজ নিয়মিত করেন। আবার বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে আশ্রমের মেয়েদের জন্য যেমন নতুন জামা কিনে দেওয়া হয়, তেমনই দরিদ্র অসহায় মানুষদের জন্যেও অন্ন ও বস্ত্র তুলে দেন।
Indrabani Grameen Nari Shishu Bikash Kendra | ইন্দ্রাবনী গ্রামীন নারী শিশু বিকাশ কেন্দ্র | इंद्रबनी ग्रामीण नारी शिशु विकास केंद्र
শ্রী প্রদীপ মাহাত অবহেলিত, অসহায় মেয়েদের স্বপ্ন গড়ার কারিগর। তাঁর কর্মকান্ড অনুপ্রেরণা দেবে ভবিষ্যত প্রজন্মকে। তিনি হয়ত পেশাগত ভাবে শিক্ষক নন, কিন্তু নিজের উদ্যোগে অক্লান্তভাবে শিক্ষাদান করে চলেছেন সমাজের অনাথ বা দুঃস্থ পিছিয়ে পড়া পরিবারের শিশুদের (বিনামূল্যে)। সমাজের কাছে তিনি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই বছর (২০২১) 'মিডনাপুর-ডট-ইন' এর তরফ থেকে এই ব্যাতিক্রমী শিক্ষক'কে "মেদিনী-আচার্য" সম্মানে সম্মানিত করা হল।
অরিন্দম ভৌমিক।
midnapore.in
Published on 26.09.2021 (202 Birthday of Pandit Iswar Chandra Vidyasagar)
From 2020 onwards ‘Midnapore-Dot-In’ is celebrating Vidasagar’s English & Bengali birthday as ‘TEACHERS DAY’ of undivided Medinipur District.