দুদিকে জঙ্গল, যার মধ্যে অধিকাংশই কাজু-বাদামের গাছ। মাঝের সরু রাস্তা দিয়ে চলেছি, রাস্তার দুপাশে মাটির থেকে বালির ভাগই বেশি। দূর থেকে ভেসে আসছে একটি গান -
"যদি দূঃশাসন মোর ফেড়িব বসন / কূরুসভা মধ্যে আজি ত্যজিবি জীবন
দর্পহারী নাম / লূপ্ত এ ত্রিভূবন / কর লজ্জা নিবারণ চক্রে কুরুবল ছেদি
রখ এ সংকটে সংকট মহুষধি ডাকূচি সংকটে দুঃখিনী দ্রৌপদী"
গানটা শুনে মনটা ভাল হয়ে গেল কারণ যাঁর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে যাচ্ছি এই গানটি তাঁরই রচিত। ভাবছেন অন্য কোন রাজ্য ? না না পশ্চিমবঙ্গেই আছি। পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগর থানা, গ্রামের নাম দেপাল। অধিকাংশ জায়গায় আপনারা মাইকে হিন্দি গান বাজতে শুনেছেন, কিছু জায়গায় চলে বাংলা গান, কোথাও বা শুনেছেন রবীন্দ্র সঙ্গীত। কিন্তু দেপাল এখনো ভুলেনি কবি কৃপাসিন্ধু মিশ্রের গান।
অখন্ড কাঁথি মহকুমায় তিনি ছিলেন প্রথম কবি ও নাট্যকার। কৃপাসিন্ধু মিশ্র আজ থেকে ২০৫ বছর আগে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বেঁচেছিলেন ১০০ বছর। পিতার নাম মহাদেব মিশ্র, পিতামহ কৃষ্ণানন্দ। তখন ভারত পরাধীন, পিছাবনী-কালিনগর ও নরঘাটের কাছে কোন সেতু ছিল না। ফলে রামনগর ছিল একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত। সেই তুলনায় উড়িষ্যার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল অনেক ভাল। স্বাভাবিক ভাবেই উড়িষ্যার ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাব ছিল যথেষ্ট। তাই ওড়িয়া ঘেঁসা বাংলায় রচনা করেছিলেন দেড়শতাধিক পালানাটক, যার অধিকাংশই পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে। কিছু নাটকের উপাদান সংগৃহীত হয়েছে সমসাময়িক কালে প্রচলিত কাহিনি, লোককথা, উপকথা কিংবা রূপকথা থেকে। তাঁর রচিত গানের সুরকার ছিলেন তিনি নিজেই।
দেপাল গ্রামে কবি কৃপাসিন্ধু মিশ্র এই বিগ্রহকেই রোজ পুজো করতেন।
মাত্র পনের বছর বয়সে প্রথম পালানাটকটি লিখেছিলেন। নিজের গ্রামেই মঞ্চস্থ হওয়ার পরে জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। সেই পনের বছর বয়স থেকে অক্লান্তভাবে পালানাটক রচনা করেছেন। গীতিকার-সুরকার-যাত্রাপালাকার কৃপাসিন্দু কখনও কখনও অভিনয়ও করেছেন, শিখিয়েছেন নৃত্যকলাও। তাঁর উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় পালানাটকগুলি হল: ললিতা, মনোহর ফাসরা, ধুলাকুটা, বিনন্দ রাখাল, বিজয়-বসন্ত, সচলাহরণ, প্রফুল্ল-বিজলী, মতিলাল, শশীধর, শ্যামবালা, মোহনমুরারি, রণধীর, ঊষাবতি হরণ, অমর-বিলাস, চম্পাবতী হরণ বা বাগাম্বর পালা, চন্দ্রাবতী পালা, সীতা হরণ, শ্রীবৎস চিন্তা প্রভৃতি।
কবি কৃপাসিন্ধু মিশ্র রচিত পালা'র পুঁথি।
কবি-রচিত গান আজও মানুষজনের মুখে মুখে শোনা যায় এবং এখনো কোথাও কোথাও তাঁর যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হয়ে থাকে। মঙ্গল গানের আসরে গাওয়া হয় কবি রচিত ও সুরারোপিত ভক্তিগীতি। একসময় অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা ও উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলায় কবি-রচিত যাত্রাপালা ও সংগীত জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল। এসব পালানাটকগুলি গীতবহুল, সংলাপের থেকে গানই বেশি। দেড় শতাধিক পালানাটকের রচয়িতা খুব কম করে হলেও তিন হাজার গান রচনা করেছেন। কৃপাসিন্ধু মিশ্রের শ্রেষ্ঠ পালা - ললিতা। এই পালানাটকে কৃপাসিন্ধু এমন ঘরোয়া ভঙ্গিতে নারীহৃদয়ের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন যে দর্শকরা আত্মবিস্মৃত হয়ে নাটকটি দেখত। এখনো এইসব অঞ্চলের মানুষের কণ্ঠে সেই গান শোনা যায় -
ঋতুবতী ঋতুশোভা তড়াগ ভরিলে। গো দ্বিজবর।।
তড়াগে বাহার দিশে পদ্ম যে ফুটিলে। গো দ্বিজবর।।
উদ্যানের শোভা দিশে পুস্প মৌলিলে। গো দ্বিজবর।।
পুষ্পরে যে শোভা দিশে ভ্রমরা আইলে। গো দ্বিজবর।।
ললনাকে শোভা দিশে যুবতী হইলে।।
ভরা ঘট উছি পড়ে বারি পুরইলে। গো দ্বিজবর।।
(আর) যুবতীকে শোভা দিশে কান্ত যে বরিলে।।
মূহে সুধা ভরি যায় কান্ত পরশিলে। গো দ্বিজবর।।
আকাশেতে চন্দ্র নাহি কী করিবে তারা।
যার ঘরে কান্ত নাহি, জীয়ন্তে সে মরা। গো দ্বিজবর।।
তাঁর শব্দপ্রয়োগ ও ছন্দের উদাহরণ স্বরূপ 'পরশুরাম মাতৃহত্যা' নাটকের একটি গানের অংশ -
তুমি দ্বিজশ্রেষ্ঠ তপোবনে উৎকৃষ্ট।
তোমা নাহি রুষ্ট দেখি সব সন্তুষ্ট।।
খাদ্যদ্রব্য শ্রেষ্ঠ নানা রসে মিষ্ট।
সর্বে হই তুষ্ট ভোজন করি যথেষ্ট।।
কবির প্রথাগত শিক্ষা তেমন ছিল না। বিয়ের পরে লেখাপড়া জানা স্ত্রী কোকিলাদেবী কবিকে পালানাটক রচনায় সাহায্য করতেন। কোকিলাদেবী পৌরাণিক কাহিনী, লোককথা, রূপকথা পাঠ করে শুনাতেন। সেই সমস্ত কাহিনী আত্মস্থ করার পরে স্বভাব কবি কৃপাসিন্ধু একের পর এক নাট্যরূপ দিতেন। সংগীতে ভরা পালানাটকগুলি কবি মুখে মুখে বলতেন এবং কোকিলাদেবী লিপিবদ্ধ করতেন। কবির দুই পুত্র গজানন ও ষড়ানন। জ্যেষ্ঠ পুত্র গজাননও ছিলেন কবি এবং কনিষ্ঠ পুত্র ষড়ানন ছিলেন ঢোল, বেহালা, পাখোয়াজ ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের নাম করা শিল্পী। গজাননের একমাত্র পুত্র সুরেন্দ্র ও ষড়াননের জ্যেষ্ঠ পুত্র সুধাকর সঙ্গীত নির্দেশক হিসাবে নাম করেছিলেন। ষড়াননের কনিষ্ঠ পুত্র রাখাল ছিলেন সফল অভিনেতা।
দেপাল গ্রামে কবি কৃপাসিন্ধু মিশ্র'র বাড়ি।
কৃপাসিন্ধু মিশ্র'র সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন কাঁথির চিত্ত সাহু, রামনগরের অংশুমান পঞ্চাধ্যায়ী, উড়িষ্যার জলেশ্বর কলেজের অধ্যাপক সুধাংশু শেখর প্রধান (ওড়িয়া ভাষায়), বালেশ্বর জেলার ভোগরাই অঞ্চলের ডঃ রমাকান্ত বেহেরা, কবির বাড়িতে এসে তথ্য সংগ্রহ করেছেন কটক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা। মধুসুধন জানা, যতীন্দ্রনাথ জানা ও নীতিন্দ্রনাথ জানা বিভিন্ন সময়ে নীহার প্রেস থেকে কবির পালাগান বই আকারে প্রকাশ করেছেন। দেপাল গ্রামে কয়েক বছর আগে পর্যন্তও কুঞ্জবিহারী মিশ্র তাঁর দরাজ গলায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মঞ্চে কবির সংগীত পরিবেশন করতেন (৩ বছর আগে ৮১ বছর বয়সে মারা গেছেন)।
বামদিক থেকে বলাইলাল ত্রিপাঠি, জহরলাল ত্রিপাঠি (গজাননের নাতনির ছেলে) ও গঙ্গানারায়ণ মিশ্র (ষড়াননের পৌত্র)।
কবি বন্দনা করছেন বলাইলাল ত্রিপাঠীর পরিবারের সদস্যরা।
কিন্তু সবথেকে উল্লেখযোগ্য নামটি হল বলাইলাল ত্রিপাঠি। কবির অধিকাংশ গান হারিয়ে গেলেও, কবি পৌত্র সুরেন্দ্র মিশ্রের কাছ থেকে সুধাংশু শেখর ত্রিপাঠী সংগৃহীত সাতখানি যাত্রাপালার প্রায় তিনশ গান বলাইলাল ত্রিপাঠি সংরক্ষণ করেছেন (এছাড়াও ধড়াস গ্রামের রজনীকান্ত সংগ্রহশালায় রয়েছে তিনটি পালার পুঁথি)। শুধু তিনি একই নন, তাঁর পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য থেকে প্রবীণতম সদস্য সবাই কৃপাসিন্ধু মিশ্র'র গুণগ্রাহী। বাড়িতে নিয়মিত গাওয়া হয় কবির গান। বলাইলালবাবু বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কৃপাসিন্ধু মিশ্র সম্পর্কে বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে লিখেছেন বহু গান, প্রকাশ করেছেন পুস্তিকা। বলাইলাল বাবুর রচিত দুটি গান এখানে দেওয়া হল -
কবি বন্দনা করছেন বলাইলাল ত্রিপাঠীর পরিবারের সদস্যরা।
বাণী বরপুত্র যেন সৃষ্টির উল্লাসে
শত-সহস্র সংগীত সৃষ্টি অনায়াসে।
বঙ্গ-কলিঙ্গ প্রদেশ সুরের বন্যায়
ভেসেছিল একদিন - কহনে না যায়।
নৃত্যে গীতে জমজমাট ছিল যাত্রাপালা -
ম'জে ছিল মেদিনীপুর -বালেশ্বর জেলা।
গ্রামে গ্রামে শত শত যত কুশীলব
কবির প্রসাদে তাঁরা পেলেন গৌরব।
রামনগর থানা মধ্যে আদি কবি তিনি
আদি নাট্যকার -আদি গীতিকার জানি।
কবির প্রসঙ্গে কথা প্রকাশ যে পায়
আজও এই বঙ্গের পত্র-পত্রিকায়।
কবি কথা জেলাব্যাপী হয় আলোচিত -
শ্রদ্ধায় স্মরণ করে গুণীজন যত।
গন্ডগ্রাম দেপাল কবির জন্মস্থান।
থানার গৌরব কবি - বটে সুসন্তান।
কবির গৌরবে আজ আমরা গর্বিত।
কবি-কাব্য-পুষ্প গন্ধে নিত্য আমোদিত।
কবি-গুণগাথা আহা কিবা সুধাময় -
জয় কবি কৃপাসিন্ধু - জয় জয় জয়।
বলাই বাবুর উদ্যোগে এবং গ্রামবাসীর সহযোগিতায় তৈরী হয়েছে স্মৃতিসৌধ। প্রতিবছর রামনগরের এক কৃতি ব্যক্তিত্বকে এবং একজন ছাত্র বা ছাত্রী কে "কবি কৃপাসিন্ধু স্মৃতি পুরস্কার" দেওয়া হয়। কবির পরিবার "ওস্তাদ বংশ" পরিচয়ে আজও খ্যাত।
দেপাল গ্রামে কবি কৃপাসিন্ধু মিশ্র'র স্মৃতিসৌধ।
বিঃ দ্রঃ - মিডনাপুর-ডট-ইন এর উদ্যোগে কবি কৃপাসিন্ধু মিশ্র সম্পর্কে প্রকাশিত হতে চলেছে ৯৫১ পৃষ্ঠার একটি পুস্তক।