মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি।
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়েছে। অবশেষে যোগেন্দ্র ঠাকুর স্বয়ং এলেন ঠনঠনিয়া কালী মন্দিরে। অনেকক্ষণ আগে থেকেই একটি যুবক তাঁর আসার অপেক্ষায় বসেছিলেন। যোগেন্দ্র ঠাকুরের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষারত যুবকটির চোখ-মুখ সহসা এক খুশির আনন্দে ছলছলিয়ে উঠল। তারপর অকুতোভয় চিত্তে নিজ শরীর হতে রক্ত বের করে স্বাক্ষরসহ প্র্র্তিজ্ঞাপত্র লিখে দিলেন-“ঈশ্বরের নামে শপথ করিতেছি যে দেশোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত কোন বিলাসিতা করিব না, যতদিন না এ সংকল্প সিদ্ধ হয় ততদিন অন্য কাজ করিব না, এই কাজের জন্য জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত রহিলাম এবং প্রত্যহ একটি করিয়া পার্টির সভ্য করিবার চেষ্টা করিব”। ১৯০৭ সালের সেই আগুনঝরা দিনে এই কঠিন শপথ করে যে অসমসাহসী যুবকটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং নেমেছিলেন ইংরেজ তাড়ানোর কাজে তিনি আর কেউ নন, তিনিই হলেন বিপ্লবী বসন্তকুমার সরকার।
জন্মেছিলেন ১৮৮৬ সালের ১৮ মে গড়বেতা থানার অন্তর্গত সন্ধিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন কাতরাবালি গ্রামে। পিতার নাম শ্রীপতিচরণ সরকার। শ্রীপতিচরণ সরকারের ছ’টি সন্তানের মধ্যে বসন্তকুমার হলেন দ্বিতীয় সন্তান। ছেলেবেলা থেকেই বসন্তকুমারের মধ্যে ইংরেজ বিদ্বেষী একটা মনোভাব গড়ে উঠে। ১৯০৩ সালে গড়বেতা স্কুলে পড়তে পড়তে জনৈক শিক্ষক কালী রায় যিনি ‘Impeachment of warren Hastings’ পড়াতেন তার মুখ থেকে শুনেন কেমন করে অন্যায়ভাবে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তার কথা, এবং সেই সঙ্গে নীল চাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের অকথ্য পীড়ন ও নানা অত্যাচার-নির্যাতনের কাহিনি। আর এসব শুনতে শুনতে স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদী, লোভী, দুর্নীতিপরায়ন ইংরেজ জাতির প্রতি তাঁর তরুণ মন বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
এদিকে লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বাংলাকে ব্যবচ্ছেদ করার আইন জারি করলে সারা দেশের মানুষ ক্রোধে ফেটে পড়ে। সর্বত্র শুরু হয় পিকেটিং, আন্দোলন আর বিলাতী কাপড় পোড়ানোর বহ্নুত্সব। এসব প্রত্যক্ষ করে কোনো তরুণ কী স্থির থাকতে পারে? বসন্ত কুমার সরকার তাই ইংরেজ উচ্ছেদ সাধনে সর্বশক্তি নিয়োগ করার কৃতসংকল্প হলেন। বর্ধমান রাজ কলেজে বি এফ পড়তে পড়তে বংশগোপাল টাউন হলে শুনলেন জে. এন. রায়ের এবং বিপিনচনদ্র পালের সুললিত কন্ঠের অগ্নিস্রাবী বক্তৃতা। দেশপ্রেমের আগুন ধরল রক্তে। বিপ্লবীদের দলে নাম লেখালেন। কাজ করতে গিয়ে উপলব্ধি করলেন ইংরেজ তাড়াতে হলে সবার আগে প্র্য়োজন শারিরীক শক্তির সঞ্চয় এবং সংগঠন গড়ে তোলা। তাই বর্ধমানের আর্য মেসে থাকতে থাকতেই পূর্ণ মোদক, ব্রজ মাহাত প্রভৃতি ছাত্রদের নিয়ে স্থাপন করলেন লাঠি খেলার আখড়া। শুধু শহরে নয়, প্রত্যন্ত গ্রামের বুকেও এই সংগঠন গড়ে তুলতে হবে সেই উদ্দেশ্য সামনে রেখে সতীশ অগস্তি, হাবু অগস্তি, মনু ভট্টাচার্য, অরোধ দে, ফণী সিংহ, নীলু হাজরা, প্রভাকর চৌধুরী, চণ্ডী পাল, রাজেন্দ্র ঘটক, সুরেন্দ্র চক্রবর্তী প্রভৃতি যুবকদের নিয়ে নিজ গ্রাম কাতরাবালি সহ গড়বেতার বাঁশদা, বলদঘাটা, বড়াই, সন্ধিপুর ইত্যাদি বিভিন্ন এলাকায় লাঠি খেলার আখড়া গড়ে তুলেন।
এরপর কলিকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বি.এ. পড়তে এলে কলিকাতা অনুশীলন সমিতির সদস্যের খাতায় নাম লেখালেন বসন্ত সরকার। এখানে হিন্দু হস্টেলে থাকার সময়ই ইতালিয়ান বিপ্লবী মাত্সিনী ও গ্যারিবল্ডির ভাবধারা এবং তাঁদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সতীশ সেনগুপ্ত, পঞ্চানন, অমর চ্যাটার্জি, কালী বাডুজ্যে, আশু দাস প্রভৃতি সমবয়সী ছাত্র ও যুবকদের সঙ্গে ইডেন হিন্দু হস্টেলের নিচতলার একটি ঘরে মাত্সীনি সোসাইটি স্থাপিত করেন। আর এখানে থেকেই নিয়মিত শিখতে থাকেন বক্সিং ও যুযুত্সু এবং তলোয়ার খেলা। আর এখানে থাকার সময়ই বসন্ত সরকার বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, যোগেন্দ্র ঠাকুর প্রমুখ দেশবরেণ্য নেতা ও বিপ্লবীদের মধুর সান্নিধ্যে আসেন।
বসন্ত সরকারের বৈপ্লবিক জীবন ছিল যেমনই বৈচিত্র্যময়, আবার তেমনই ঘটনা বহুল। নিজ সাহসের উপর অগাধ আস্থা রেখে ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ করে কখনো দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, আবার কখনো ইংরেজদের তীব্র রোষানলে পড়া কোনো বিপ্লবীকে গোপন আস্তানায় পাঠিয়ে দিয়ে তিনি তাঁর বৈপ্লবিক কর্তব্য পালন করেছেন। যেমন ছিল তাঁর বীরত্বব্যঞ্জক চেহারা, তেমনই ছিল আবার বুদ্ধির প্রচণ্ড প্রখরতা। সেই সঙ্গে ছিল প্রত্যুত্পন্নমতিত্ব। এই প্রত্যুত্পন্নমতিত্বের জোরেই তিনি অনেকবার মৃত্যুর সামনাসামনি দাঁড়িয়েও মৃত্যুকে দূরে ঠেলে দিতে পেরেছেন।
১৯০৮ সাল। অনুশীলন সমিতিগুলোতে দেখা দিয়েছে নিদারুণ অর্থাভাব। আর অর্থ সঙ্কটের দরুন আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুত করা যাচ্ছে না। এই অর্থ সংগ্রহার্থে খুলনা, যশোহর এবং বাংলার বহু স্থানে শুরু হল রাজনৈতিক ডাকাতি। অনুশীলন সমিতির সদস্যরা ঠিক করলেন ২ জুন রাত্রিতে ঢাকার ‘বারহা’ বাজার লুট করবেন। এর আগের দিন অর্থাত্ ১ জুন বোমা, বন্দুক ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাবার ভার পড়ল বসন্ত সরকারের উপর। সঙ্গের সাথি হিসাবে থাকলেন বাঁকুড়ার শৈলেন চক্রবর্তী। ট্রেনে এবং নৌকাতে করে বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে ‘বারহা’ বাজার পৌঁছালে সেখানে তিনি একটি মাত্র ‘Winchester Rifle’ – এর ওপর ভর করে প্রধান ঘাঁটি আগলাবার দায়িত্ব আবার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। এই রাইফেলের সাহায্যেই সে যাত্রায় বেঁচে যান এবং অস্ত্র বোঝাই একটি ট্রাঙ্ক নিয়ে আবার হিন্দু হস্টেলে ফিরতে সক্ষম হন।
১৯০৭ সালে ঢাকার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এলেনকে স্টীমারে হত্যার পরিকল্পনা নেন বিপ্লবীরা। আক্রমনকারী সাঁতার দিয়ে মেঘনা নদী পার হয়ে এলেও ইংরেজদের কুনজর এড়াতে পারেনি। তাই যখন সে ফেরার অবস্থায় ঘুরছে তখন বসন্ত সরকার তাঁর বন্ধু পরিচয়ে এই যুবকটিকে নিজের গ্রামে লুকিয়ে রাখেন। আক্রমণকারীর বাড়ি ছিল ময়মনসিংহে। পরে তাকে ডাকা হত নলিনী সরকার বলে। মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে বসন্ত সরকার কতবার যে তিনি দু:সাহসিক কাজ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। দুরন্ত সাহস এবং প্রত্যয় দৃঢ় অঙ্গীকার তাকে সব সময় ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াত।
১৯১৪ সালে বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ, বাঘা যতীন, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, অতুল প্রমুখদের সহায়তায় ‘ম্যাভেরিক’ জাহাজ যোগে জার্মানি হতে যে বিদেশী অস্ত্রশস্ত্র আনার ব্যবস্থা হয় বালেশ্বরের চাঁদবালীতে সেই অস্ত্রশস্ত্র রাখার ভার পড়ে বসন্ত সরকারের ওপর। চাঁদবালী গিয়ে বাড়িও তিনি ঠিক করে এসেছিলেন। কিন্তু ভারতের দুর্ভাগ্য সে অস্ত্রশস্ত্র নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। তার আগেই বুড়িবালামের তীরে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হন যতীন, নীরেন, মনোরঞ্জন, চিত্রপ্রিয় আর জ্যোতিষের দল। ১৯১৫ সালে প্রতি জেলখানা সরকারি অস্ত্র এবং কোষাবার দখল করবার সিদ্ধান্ত নিলে বসন্ত কুমার সরকার, তারাপদ মুখার্জী, বিপিন হাজরা, মনু ভট্টাচার্য, পঞ্চানন, রাঘব সরকার প্রমুখদের নিয়ে মেদিনীপুর সেণ্ট্রাল জেল দখল করার দায়িত্ব নেন। কিন্তু এই ষড়যন্ত্রের সংবাদ ফাঁস হয়ে যাবার ফলে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
বোমা তৈরি, রাজনৈতিক ডাকাতি, বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়া ইত্যাদির অপরাধে বসন্ত সরকারকে ব্রিটিশ রাজশক্তি বহুবার জেলে পাঠিয়েছে। ১৯১০ সালে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অপরাধে প্রেসিডেন্সী জেলে পাঠানো হয়। খুলনা-যশোহর গাং কেসে জড়িত থাকার অজুহাতে ১৯০৯ সালে কলিকাতা ও বাংলার অন্যান্য স্থান থেকে যে ৮৮ জন আসামীকে গ্রেপ্তার করা হয় বসন্ত সরকার ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম। ইংরেজরা কাতরাবালির বাড়িতে ফৌজ পাঠিয়ে বাড়ির জিনিস তচনচ করে বসন্ত সরকারকে ধরে। ১৯২২ সালে মেদিনীপুর সেণ্ট্রাল জেলে ছ’মাস আটকে রাখা হয়। ১৯৩০ সালে ঘরে বোমা তৈরির অজুহাতে স্পেশাল কেস সৃষ্টি করে ইংরেজরা বসন্ত সরকার এবং তার ভাইপো বিনয়কে শাস্তি দেয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আরও বহুবার তাঁকে জেলে পাঠানো হয়েছে। কখনো বাগেরহাট, কখনো সাতক্ষীরা, কখনো বা কাকদ্বীপ প্রভৃতি জায়গায় সে সময়গুলি কেটেছে।
এত শাস্তি, এতবার জেল দেওয়া সত্বেও বিটিশ সরকার কোনদিনের জন্যও পারেনি বসন্ত সরকারকে তাঁর বৈপ্লবিক কার্যকলাপ থেকে নিবৃত্ত করতে। জেলে পাঠানো হয়েছে- ছাড়া পেয়েই আবার বিপ্লবের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তিনি। নিজের জীবনের চেয়েও তাঁর কাছে দামী ছিল তাঁর দেশ। ভয় কাকে বলে জানতেন না তিনি। এমনকি কারার অন্তরালে গিয়েও তিনি তাঁর মাথা ইংরেজ সরকারের কাছে নিচু করেন নি। অন্তরে যে তাঁর কতখানি সাহস ছিল তা নিচের ঘটনা থেকে জানা যায়। সন্ত্রাসবাদী অন্যান্য বিপ্লবীদের সঙ্গে তখন তিনি প্রেসিডেন্সী জেলে। বড়লাট প্রেসিডেন্সী জেল পরিদর্শনে এসে রাজবন্দীদের সঙ্গে সাক্ষাত করছেন। বসন্ত সরকারের কাছে এসে বড়লাট জিজ্ঞেস করলেন, “How are you?” উত্তরে বসন্ত সরকার স্বভাবসুলভ তেজোদৃপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, “Don’t you feel ashamed? What we have done? We wanted freedom only and we received in human beast like treatment and you put us in dark cells. For the last one year we were not even allowed to see anybody.”
বসন্ত সরকার যে কতখানি নির্ভীক ও সাহসী ছিলেন তার প্রমাণ এখনো ছড়িয়ে আছে সন্ধিপুর এলাকার লোকশ্রুতিতে। এখনো এখানকার বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মুখে শোনা যায় বসন্ত সরকারের নাকি লেজ ছিল। কথাটা হাস্যস্পদ মনে হলেও তিনি যে সত্যিকারের একজন বীরপুরুষ ছিলেন সেটারই পরিচয় পাওয়া যায়। আরো শোনা যায়-সন্ধিপুরের উত্তর পাশে কাদড়া নামক স্থানে যে মেদিনীপুর জমিদার কোম্পানীর সদর কাছারিবাড়ি আছে সেখানে নাকি শীতের দিনে বিকালবেলায় ইংরেজ সাহেবরা মেমদের নিয়ে বেড়াতে আসতো। যদি এই সময় তাদের কেউ বলতো যে বসন্ত সরকার আসছে তাহলে তারা কোথায় যে ভয়ে লুকাতো তার ঠিক-ঠিকানা থাকতো না।
১৯২১ সাল থেকে ভারতের রাজনৈতিক সংগ্রামে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন ও অহিংসাবাদ প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এর ফলে অসংখ্য সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সাথে বসন্ত সরকারও তাতে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। কিন্তু সশস্ত্র বৈপ্লবিক সংগ্রামকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি। একথা তিনি তাঁর লেখা ‘অগ্নিযুগের স্মৃতিকথা’ গ্রন্থেই স্বীকার করেছেন। ‘অগ্নিযুগের স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “১৯২৫ সাল হইতে ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীজীর অহিংসাবাদ প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। বিপ্লবীরাও অনেকে গান্ধী প্রভাবিত কংগ্রেসে যোগ দিতে থাকেন, কিন্তু অহিংসাকে কখনোই তাঁহারা মনে প্রাণে বরণ করিতে পারেন নাই। তাঁহারা বরাবরই সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিতেন”। এই মনোভাবের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায় পরবর্তী কার্যকলাপেই। ১৯২৯ সালে লাহোরে কংগ্রেসের অধিবেশন বসলে তিনি গোপনে আগ্নেয়াস্র্র নিয়ে যেতে ভোলেননি। উদ্দেশ্য একটাই ছিল, ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ভারতের বুকে আর দ্বিতীয়বার ঘটতে না দেওয়া। তাই তিনি প্রস্তুত হয়েই গিয়েছিলেন।
একাধারে সহিংস আন্দোলন, অপরদিকে অহিংস আন্দোলন দু’টোই তিনি করে গেছেন। যখন যেটা ভালো মনে করেছেন তখন তাতেই যোগ দিয়েছেন। যে কোনো প্রকারে দেশের স্বাধীনতা চাই-ই চাই, এটাই ছিল তাঁর জীবন-মরণ পণ। ১৯৪২ সালে থানা কংগ্রেসের সভাপতি নিযুক্ত হওয়ার অপরাধে মেদিনীপুর সেণ্ট্রাল জেলে আবার একবার তাঁকে কারাবাস ভোগ করতে হয়। সহিংস আন্দোলন করার সময় স্বাধীন জীবিকার কোনো উপায় ছিল না তাঁর। তত্কালীন ইংরেজ শাসকরা সবসময় কড়া নজরে রাখত। ঐ সময়ে মেদিনীপুর জেলার বিনপুরে কুইকাকো স্কুলে একবার প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। কিন্তু ইংরেজ জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট নোটিশ দিয়ে জানিয়ে দেয়, শিক্ষা লাইনে বসন্ত সরকারের থাকা চলবে না। ‘ল’ পড়ার জন্য চেষ্টা চালালেন। তাতেও বাধ সাধল ইংরেজ। এরপর মেদিনীপুরেই ‘জর্জ লাইব্রেরী’ নামে একটি বইয়ের দোকান খুলেন। কিন্তু রাজরোষ পড়ার তরে কোনো স্থায়ী কাজই করতে পারেননি তিনি।
এরপর ভারত স্বাধীনতা লাভ করলে শেষ জীবনে বসন্ত সরকার স্বগ্রামে কাতরাবালিতে ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। শিক্ষা বিস্তার এবং দেশকে রোগমুক্ত করার জন্য তাঁর চেষ্টার অন্ত ছিল না। তাঁর ভাই রাঘবচন্দ্র সরকার সন্ধিপুরের বুকে হাইস্কুল গড়তে চাইলে উত্সাহের সঙ্গে তিনি তাতে যোগদান করেন। স্কুলের পাশাপাশি কলেজ স্থাপনেও তিনি তাঁর উদার হস্ত প্রসারিত করে দিয়েছিলেন। অর্থ সাহায্য করে অনেক গরিব ছাত্রকে তিনি পড়তেও সাহায্য করেছেন। একবার একটি দু:স্থ ছাত্র তাঁকে এসে ধরল যে আর্থিক দুরবস্থার জন্য সে পড়াশোনা করতে পারছে না। সব শুনে দয়ালু বসন্ত সরকার তাঁকে কিছু অর্থ অর্থাত্ টাকা-পয়সা দিলেন। টাকা পয়সা পেয়ে খুশি মনে ছাত্রটি জিজ্ঞেস করল, “ কতদিলে শোধ করতে হবে”? উত্তরে বসন্ত সরকার বললেন, “এই অর্থ আমাকে দিতে হবে না। যদি কোনোদিন তোমার মত কোনো দু:স্থ অসহায় ছাত্র তোমার কাছে এসে সাহায্য ভিক্ষা করে তবে সেদিন তাকে দিও”। বসন্ত সরকারের প্রকৃতি ছিল এমনই উদার ও সরল।
এদিকে আবার হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষা এবং তাদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখার ব্যাপারেও তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ দাঙ্গার দিনেও মেদিনীপুর ও হুগলি সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কোনরকম সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা ঘটতে পারেনি এই বসন্তকুমার সরকার এবং তাঁর ভাই রাঘবচন্দ্র সরকারের জন্যই। এহেন দেশপ্রেমিক, অগ্নিযুগের বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরযোদ্ধা, সাহসী মানুষটিকে আজ কিন্তু দেশবাসী ভুলে যেতে বসেছে। তিনি লোকান্তরিত হ’ন ১৯৬৫ সালের ৫ এপ্রিল। তাঁর জন্মদিন কিংবা মৃত্যুদিন তেমন করে পালিত হয় না। তাঁর নামে কোনো রাস্তা বা সড়ক নেই। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আর পাঁচটা মানুষের মতোই তিনি চলে গেছেন মানব-ইতিহাসের অন্তরালে।
সন্ধিপুর অঞ্চল, মেদিনীপুর জেলা তথা পশ্চিমবঙ্গের গর্ব এই অগ্নিসন্তানের স্মৃতি রক্ষার্থে এবং তাঁর উজ্জ্বল আদর্শ এবং ত্যাগের মহিমা প্রচারে কিছু করা স্থানীয় প্রশাসনের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না কী? কিছু না হোক এলাকার মানুষ তথা দেশবাসী যাতে তাঁদের অন্তরের শ্রদ্ধা ভালোবাসা তাঁকে জানাতে পারেন তার ব্যবস্থা করা?
midnapore.in