ড. রানা'র জন্মদিনে সাউরি গ্রামে।
नारायण चंद्र राणा | Narayan Chandra Rana
সালটা ছিল ১৯৯৬। আমি তখন বেঙ্গালুরুতে কলেজের ছাত্র। পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ আমার কোন দিনই ছিল না। কিন্তু মেদিনীপুরের যে কোন বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই। এছারাও ঘর পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখার সখটাও ছিল বরাবর।
স্বাভাবিক ভাবেই আমার হস্টেলের রুমটিও ছিল সুন্দর করে সাজানো এবং আমার পড়ার টেবিলে বিদ্যাসাগর, ক্ষুদিরাম, মাতঙ্গিনী এবং বীরেন্দ্রনাথ-এর ছবি রাখা থাকত। যদিও সেই পড়ার টেবিলে আমি পরীক্ষার আগের দিন ছাড়া বসতাম না বললেই চলে।
আমাদের হস্টেলে ভারতের বহু রাজ্যের ছাত্র থাকতো। আমরা জানতাম কে কোন রাজ্য থেকে এসেছে, কিন্তু তারা কোন জেলা থেকে এসেছে সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনে থাকতো না। বাতিক্রম ছিল আমার ক্ষেত্রে, আমার জেলার নাম সবাই জানত। কারণ ঐ চারটি ছবি। সবার রুমে যখন স্পোর্টস স্টার বা জনপ্রিয় নায়ক/নায়িকাদের পরিচিত ছবি লাগানো থাকতো, তখন আমার রুমের ঐ চারটি ছবি সবার কৌতূহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সবাই জানতে চাইতো এবং আমি সংক্ষেপে তাঁদের সম্পর্কে বলতাম। স্বাভাবিক ভাবেই মেদিনীপুর নামটা সবার মনে গেঁথে গিয়েছিল।
সেই সময় হস্টেলে মাঝে মাঝেই সন্ধ্যাবেলায় Surprise Visit-এ আসতেন প্রিন্সিপ্যাল বা অন্য কোন অধ্যাপক। কারণ আমরা raging-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলাম। senior-রা লুকিয়ে raging করছে কিনা দেখার জন্যই হত এই Surprise Visit।
একদিন, তেমনই এক Surprise Visit-এ এসে আমার রুমে ঢুকে পড়েছিলেন ফিজিক্স-এর অধ্যাপক ডঃ রেড্ডি। আমি তো ভয়ে অস্থির কারণ লেখাপড়া আমি একদমই করতাম না, আর ফিজিক্স তো একদমই নয়। তার উপর উনার ক্লাস আমি করতামই না।
কিন্তু সমস্ত ভয়ের অবসান ঘটিয়ে রেড্ডি স্যার হাসি মুখে বললেন- “বাহ, খুব সুন্দর সাজিয়ে রেখেছ”। তারপরেই ছবিগুলির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন- “বিদ্যাসাগর সম্পর্কে আমি কিছুটা জানি, বাকি তিনজনের সম্পর্কে বল”। আমি তো মহা আনন্দে গড়গড় করে সব বলে গেলাম। সেই দিন থেকে রেড্ডি স্যারও জেনে গেলেন “মেদিনীপুর” নামটি।
এই “মেদিনীপুর” নামের জন্যই তিনি আবার একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন তাঁর অফিসে। দিনটি ছিল ১৯৯৬ সালের ৩০ আগস্ট, শুক্রবার। মনে আছে কারণ সেদিন আমার জন্মদিন ছিল। স্যার-এর অফিসে যেতেই জিজ্ঞেস করলেন- “মেদিনীপুর-এর একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম বল?” আমি তখন একজনেরই নাম জানতাম Mani Lal Bhaumik, সেই নামটাই বললাম। স্যার কিছুটা অবাক হয়ে বললেন- “উনিও মেদিনীপুরের মানুষ, খুব ভাল! কিন্তু তুমি আমাকে তোমার জেলার অন্য আরেকজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী’র নাম বল?“
আমার স্টকে ঐ একটি নামই ছিল, তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। স্যার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বেশ খুশিই হয়েছেন মনে হল। তিনি যে আমার জেলা সম্পর্কে আমাকেই নতুন কোন তথ্য দিতে চলেছেন, এই ব্যাপারটা তাঁর মুখের এক্সপ্রেশন দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো।
স্যার একটি পেপার কাটিং-এর ফটোকপি আমাকে দিয়ে বললেন- "এটা তোমাদের ওখানের একটি ইংরেজি সংবাদপত্রের খবর, আমি Indian Institute of Astrophysics (বেঙ্গালুরুর Koramangala অঞ্চলে অবস্থিত) থেকে পেয়েছি। হস্টেলে গিয়ে এটা পড়ো।"
Indian Institute of Astrophysics, Bengaluru
সেই পেপার কাটিংটি আমার জন্মদিনের সবথেকে বড় উপহার ছিল। যদিও সেটি একটি শোকসংবাদ ছিল। কিন্তু ড. নারায়ণচন্দ্র রানা সম্পর্কে সেই প্রথম জানতে পেরেছিলাম। ড. রানা আমাদের ছেড়ে চলে গেছিলেন সেই মাসেরই ২২ তারিখ। সংবাদটি Telegraph-এ প্রকাশিত হয়েছিল ২৬ তারিখ। লিখেছিলেন ড. সোমক রায়চৌধুরী, যিনি Inter-University Centre for Astronomy & Astrophysics-এর বর্তমান Director।
Inter-University Centre for Astronomy & Astrophysics, Pune
তাঁর লেখার শুরুর এবং শেষের লাইন দুটি আমার খুব ভালো লেগেছিল। শুরুতেই তিনি লিখেছিলেন -
"Narayan Chandra Rana was a very unusual man in every sense of the term."
এবং শেষ লাইনটি ছিল এই রকম -
There should be a law of the Universe that should prevent people like Narayan Chandra Rana from escaping from their missions in life before they are done.
শেষের লাইনটি হয়তো আরো অনেকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কিন্তু ড. রানা থাকাটা একটু বেশি করেই দরকার ছিল। কারণ তিনি থাকলে এতদিনে আমাদের দেশ astrophysics-এ অনেকগুলো ধাপ এগিয়ে যেত। হয়ত মেদিনীপুর পেত তাঁর প্রথম নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী'কে।
ড. রানা'র ব্যাপারে যেহেতু আমার জন্মদিনেই প্রথম জানতে পেরেছিলাম, তাই মনের মধ্যে একটা ইচ্ছে জন্ম নিয়েছিল। ঠিক করেছিলাম কোন না কোন দিন তাঁর জন্মদিন তাঁরই গ্রামে গিয়ে পালন করব। আমার সেদিনের সেই ইচ্ছে পূরণ হল ২৫ বছর পরে ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর।
যে কোন মনীষীর জন্মদিন পালনের ক্ষেত্রেই আমি বৃক্ষরোপনের উপরে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। যার জন্মদিন, তাঁর পছন্দের গাছের নাম জানতে পারলে বা কোন ভাবে কোন গাছের সঙ্গে তাঁর কোন যোগসূত্র পেলে খুবই ভালো হয়। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না, সেক্ষেত্রে আমাদের পছন্দসই কোন একটি গাছ নির্বাচন করা হয়। সেই মত ড. রানা'র পছন্দের গাছ খুঁজতে শুরু করেছিলাম অনেকদিন আগে থেকেই। অনেক চেষ্টার পরেও তেমন কোন তথ্য পেলাম না। বাধ্য হয়েই অন্য কোন গাছের কথা ভাবছিলাম।
হঠাৎ একদিন তাঁর গবেষণা পত্র থেকেই পেয়ে গেলাম যোগসূত্র। তাঁর গবেষণা পত্রের শিরোনাম ছিল 'অ্যান ইনভেস্টটিগেশন অফ দ্য প্রোপার্টিজ অফ ইন্টারগ্যালাকটিক ডাস্ট' (An Investigation of the Properties of Intergalactic Dust)। তাঁর এই গবেষণা ‘বিগ ব্যাংগ তত্ব’ অর্থাৎ প্রায় ১৫০০ কোটি বছর আগে মহাবিস্ফোরণে বিশ্ব সৃষ্টি হবার ঠিক পরের কয়েক সেকেন্ড অবয়বহীন মহাশক্তিপুঞ্জ থেকে কিভাবে আদি দুই মৌল হাইড্রোজেন এবং হিলিমাম তৈরী সম্ভব হলো তার উপরে নতুন ভাবে আলোকপাত করেছিল। এই গবেষণা পত্রটি তিনি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের চরণে উৎসর্গ করেছেন।
পড়াশুনার জন্য কলকাতায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার সামর্থ তাঁর ছিল না। বেলঘরিয়া'র 'রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যার্থী আশ্রম'-এ থেকেই তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়াশুনা সম্পূর্ণ করেছিলেন। রামকৃষ্ণ পরমহংশদেব এবং স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারার সংমিশ্রণে তৈরি আশ্রম। স্বামী ধ্যানাত্মানন্দজী, স্বামী প্রীতি মহারাজ, স্বামী অমলানন্দজী সহ অন্যান্য সন্ন্যাসীদের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন বহুদিন। তিনি বেলুড় মঠের অধ্যক্ষ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজের নিকট রামকৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। এম.এস.সি চলাকালে তার হৃদযন্ত্রের বিকলতা ক্রমশ বাড়ে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল শারীরিক অসুস্থতা। সেই সময় বেলঘরিয়া রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজদের চেষ্টায় চিকিৎসা শুরু হয়েছিল তাঁর।
পুনে IUCAA-তে তাঁর কোয়ার্টার-এর দেওয়ালে শোভা পেত শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, জগৎ জননী সারদাময়ী দেবী আর স্বামী বিবেকানন্দের সুন্দর বাঁধানো ছবি। তাঁদেরকে প্রতিদিনই শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতেন তিনি।
নাগচম্পা বা নাগলিঙ্গম ফুল। বৈজ্ঞানিক নাম Couroupita guianensis, এর ফলের আকৃতি কামানের গোলার মত তাই অনেকে একে cannonball tree নামেও ডাকে।
শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং স্বামী বিবেকানন্দের খুব প্রিয় ছিল নাগচম্পা বা নাগলিঙ্গম বৃক্ষ। বৈজ্ঞানিক নাম Couroupita guianensis, এর ফলের আকৃতি কামানের গোলার মত তাই অনেকে একে cannonball tree নামেও ডাকে। সারা পৃথিবীতে এমন কোন রামকৃষ্ণ মিশন পাবেন না যেখানে এই নাগচম্পা বৃক্ষ নেই। বেলঘরিয়া রামকৃষ্ণ মিশনেও ছিল এই বৃক্ষ। যখন গাছে ফুল থাকতো, ড. রানা সেই ফুল এনে রাখতেন তাঁর হস্টেলের রুমে রাখা শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ছবির সামনে।
আমি পেয়ে গেলাম আমার বৃক্ষ। ঠিক করলাম জন্মদিনে তাঁর স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলিতে লাগানো হবে এই বৃক্ষ। কিন্তু ঠিক করলেই তো হবেনা, গাছের চারা তৈরী করতে হবে। এই চারা সহজলভ্য নয়। ফোন করলাম জ্যোতির্ময় খাটুয়াকে। বৃক্ষরোপনের ব্যাপারটা আমি দেখলেও, গাছের চারা জোগাড় করার ব্যাপারটা জ্যোতির্ময় দেখে। নাগচম্পার নাম শুনে জ্যোতির্ময় বলল- "একটি চারা আমি দেড় বছর ধরে বড় করেছি, বাকি কটা লাগবে বলুন আমি জোগাড় করে ফেলব।" গাছের ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম।
মণীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী -র লাগানো বকুল গাছের নিচে - (ডান দিক থেকে) ড. রানা'র ছোটবেলা বন্ধু শ্রী হিমাঙ্ক পাল, স্কুলের এক বছরের সিনিয়র শ্রী অশোক ভৌমিক এবং তাঁর অংকের মাস্টারমশাই শ্রী চিত্তরঞ্জন দাস।
এদিকে আমাদের আরেক সদস্য পূর্ণচন্দ্র ভূঁইয়া ধারাবাহিকভাবে ড. রানা'র জীবনী লিখছিলেন। যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেই ধারাবাহিক। সেই ধারাবাহিক বই আকারে প্রকাশ করব আমরা। তাই কিছু ছবি তোলারও দরকার ছিল। একদিন আমি আর পূর্ণ রওনা দিলাম ড. রানা'র গ্রাম সাউরি। প্রথমেই পৌঁছলাম ড. রানা'র স্কুল ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরে। আগের থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন ড. রানা'র ছোটবেলা বন্ধু শ্রী হিমাঙ্ক পাল, তাঁর অংকের মাস্টারমশাই শ্রী চিত্তরঞ্জন দাস, ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরের বর্তমান প্রধান শিক্ষক শ্রী অনুপ পাত্র এবং স্কুলের এক বছরের সিনিয়র শ্রী অশোক ভৌমিক। সকলেই খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের আপ্যায়ণ করলেন এবং সবকিছু ঘুরিয়ে দেখালেন। দেখলাম বিজ্ঞানের জনপ্রিয় শিক্ষক মণীন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ী'র লাগানো বকুল গাছ এবং তাঁকে যে বিশাল আকারের টেলিস্কোপটি উপহার দিয়েছিলেন ড. রানা। স্কুলের বিশাল খেলার মাঠ এবং তার থেকেও বড় দীঘি, দেখলেই সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে। জন্মদিনে গাছ লাগানোর ব্যাপারটাও সবাইকে জানালাম।
ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরে সবার কাছে বিদায় নিয়ে আমরা পৌঁছলাম সাউরি কোটবাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, ড. রানার প্রথম স্কুল। স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রী রামচন্দ্র দাস অনেক্ষন ধরেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমরা অনেকটা সময় কাটালাম। তিনি গাছ লাগাতে খুব ভালোবাসেন। স্কুলে ছাত্রদের জন্য তৈরী করেছেন সবজি ও ফলের বাগান। সবকিছু ঘুরিয়ে দেখালেন। জন্মদিনে বৃক্ষরোপনের কথা শুনে খুবই উৎসাহ দেখালেন। সেদিনের মত আমরা ফিরে এলাম। বাকি যে জায়গাগুলিতে গাছ লাগানো হবে, সেগুলি আমরা ফোনেই কথা বলে নেব ঠিক করেছিলাম।
ড. রানা'র বাড়িতে অবস্থিত তাঁর মূর্তিতে মাল্যদানের পরে আমরা - (বামদিক থেকে) রাজকুমার দাস, জ্যোতির্ময় খাটুয়া, অরিন্দম ভৌমিক এবং পূর্ণচন্দ্র ভুঁইয়া।
ড. রানা'র বাড়িতে বৃক্ষরোপনের পরে আমরা - (বামদিক থেকে) রাজকুমার দাস, পূর্ণচন্দ্র ভুঁইয়া, অরিন্দম ভৌমিক এবং জ্যোতির্ময় খাটুয়া।
১২ অক্টোবর ড. রানা'র জন্মদিনে আবার রওনা দিলাম সাউরি। সেদিন আবার সপ্তমী, চারিদিকে পুজো চলছে। মেদিনীপুর থেকে আমি, সবং থেকে পূর্ণচন্দ্র ভুঁইয়া, এগরা থেকে রাজকুমার দাস এবং রামনগর থেকে জ্যোতির্ময় খাটুয়া, এই ছিল আমাদের সেদিনের ছোট্ট টিম। সকাল ১০.৩০ নাগাদ আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম ড. রানা'র বাড়িতে। সেখানে এখন স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে থাকেন তাঁর ভাই শ্রী সুজন রানা। আগের থেকেই অপেক্ষা করছিলেন ড. রানা'র দুই সহপাঠি শ্রী হিমাঙ্ক পাল ও শ্রী দুর্গাপদ পণ্ডা এবং ৪/৫ বছরের সিনিয়র শ্রী দুর্গেশকুমার নন্দ মহাশয়। একটু পরে এলেন ড. রানা'র বোনের বড় ছেলে শ্রী ননীগোপাল রানা। সুজন বাবুরা আগের থেকেই ড. রানা'র মূর্তিটি পরিষ্কার করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছিলেন।
ড. রানা'র বাড়িতে বৃক্ষরোপনের আগে- (বামদিক থেকে) শ্রী দুর্গাপদ পণ্ডা, শ্রী দুর্গেশকুমার নন্দ, শ্রী সুজন রানা, শ্রী সত্যজিৎ রানা এবং শ্রী হিমাঙ্ক পাল।
ড. রানা'র বাড়িতে বৃক্ষরোপন করছেন- (বামদিক থেকে) শ্রী দুর্গেশকুমার নন্দ, শ্রী সুজন রানা, শ্রী দুর্গাপদ পণ্ডা, এবং শ্রী হিমাঙ্ক পাল।
প্রথমেই বৃক্ষরোপন করা হল। মাটি খুঁড়লেন ড. রানা'র ভাতুস্পুত্র শ্রী সত্যজিৎ রানা। সবাই মিলে রোপন করা হল প্রথম নাগচম্পা বৃক্ষটি। এরপরে সবাই মূর্তিতে মাল্যদান করলেন। জন্মদিনে মিষ্টিমুখ না করলে তো চলবেনা। সুজনবাবু অনেক ধরণের মিষ্টির আয়োজন করেছিলেন। না না বলেও সব মিষ্টি খেয়ে নিলাম আমরা। মিষ্টির পরে চায়ের আড্ডা। চা পান করতে করতে আমরা ড. রানা'র ছোটবেলার অনেক গল্প শুনলাম সবার কাছ থেকে। আরো হয়তো অনেক্ষন বসতাম আমরা, কিন্তু ওদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্রী রামচন্দ্র দাস ততক্ষনে ৬/৭ বার ফোন করে জানতে চেয়েছেন- কখন তাঁর স্কুলে পৌঁছবো আমরা। তিনি এতটাই উৎসাহী যে, মাঝে মাঝেই ফোনে খোঁজ নিতেন জন্মদিনে আমরা পৌঁছচ্ছি কিনা?
ড. রানা'র বাড়িতে তাঁর মূর্তিতে মাল্যদান করছেন শ্রী দুর্গেশকুমার নন্দ।
ড. রানা'র বাড়িতে তাঁর মূর্তিতে মাল্যদান করছেন শ্রী হিমাঙ্ক পাল।
মাল্যদানের পরে দুই সহপাঠী শ্রী দুর্গাপদ পণ্ডা এবং শ্রী হিমাঙ্ক পাল।
ড. রানা'র বাড়িতে মাল্যদানের পরে- (বামদিক থেকে) শ্রী হিমাঙ্ক পাল, শ্রী দুর্গাপদ পণ্ডা, শ্রী সত্যজিৎ রানা, শ্রী ননীগোপাল রানা, শ্রী সুজন রানা এবং তাঁর স্ত্রী।
নারায়ণচন্দ্র রানা | नारायण चंद्र राणा | Narayan Chandra Rana
তাই সময় নষ্ট না করে আমরা পৌঁছলাম তাঁর স্কুলে। স্কুলে পৌঁছে দেখলাম বিশাল আয়োজন। প্রধান শিক্ষকের অফিস ঘরটি বেশ লম্বা, সেই ঘরে পর পর টেবিল সাজিয়ে সবাই বসে রয়েছেন। শেষ প্রান্তে, একটু উঁচুতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ড. রানা'র ছবি। আমরা ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিলেন - প্রধান শিক্ষক শ্রী রামচন্দ্র দাস, সহ শিক্ষক শ্রী হিমাংশু শেখর পাড়ী, শ্রী সুশান্ত নন্দী, শ্রী বিশ্বেন্দু বিকাশ দাস, শ্রী দেবব্রত সেন, শ্রী দীপঙ্কর সেনাপতি, উপস্থিত ছিলেন শুভানুধ্যায়ী শ্রী নরোত্তম রায়, শ্রী পার্থসারথী দাসমহাপাত্র, শ্রী সন্তোষ গিরি এবং আরো অনেকে।
ড. রানা'র জন্মদিনে সাউরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
ড. রানা'র জন্মদিনে সাউরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করলেন শ্রী নরোত্তম রায়। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ও মাল্যদানের পরে আমরা স্কুলের মাঠে পৌঁছলাম বৃক্ষ রোপনের জন্য। আগের থেকেই মাটি খুঁড়ে বেড়া তৈরী করে রাখা ছিল। সবাই মিলে বৃক্ষ রোপন করা হল। একটি নয় দুটি বৃক্ষ রোপন করা হল জন্মদিন উপলক্ষ্যে। জন্মদিন উপলক্ষ্যে শিক্ষকরা নিজেদের উদ্যোগেই মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেছিলেন। রান্নার বাবস্থাপনায়ও ছিলেন এক শিক্ষক মশাই। মেনু ছিল জন্মদিনের মতোই- স্কুলের গাছের লেবু, ডাল, মাশরুমের তরকারি, ওল-চিংড়ি, মাছের ঝোল, মাছের কালিয়া, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি। খাওয়ার শেষে মুখ ধুয়ে এসে কোল্ডড্রিঙ্কস ও মুখসুদ্দী। কিন্তু খুব আফসোসের বিষয়, আমি সকাল থেকে এতো মিষ্টি খেয়েছিলাম যে এখানে কব্জি ডুবিয়ে খেতে পারিনি। অবশ্য রাজকুমারও কিছু খায়নি কারণ তার বাড়িতে অশৌচ চলছে, তাই সে আমিষ খাবে না। প্রধান শিক্ষক জানালেন, ড. রানা'কে নিয়ে স্কুলে অনেক কিছুই করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।
ড. রানা'র জন্মদিনে সাউরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্যদান করছেন প্রধান শিক্ষক শ্রী রামচন্দ্র দাস।
ড. রানা'র জন্মদিনে সাউরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্যদান করছেন তাঁর ভাতুস্পুত্র শ্রী সত্যজিৎ রানা।
ড. রানা'র জন্মদিনে সাউরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম বৃক্ষরোপণ।
ড. রানা'র জন্মদিনে সাউরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম বৃক্ষরোপণ।
ড. রানা'র জন্মদিনে সাউরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বৃক্ষরোপণ।
ড. রানা'র জন্মদিনে সাউরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মধ্যাহ্নভোজন।
ড. রানা'র জন্মদিনে সাউরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মধ্যাহ্নভোজন।
সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা পৌঁছলাম ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরে। স্কুলের মাঠে চলছিল দুর্গাপুজো। উপস্থিত ছিলেন ড. রানার অংকের শিক্ষক শ্রী চিত্তরঞ্জন দাস। আমরা সবাই ড. রানার মূর্তিতে মাল্যদান করলাম। মূর্তিটি রয়েছে একটি কংক্রিটের ঘেরার মধ্যে। সেই ঘেরার মধ্যেই একধারে আমরা মাটি খুঁড়লাম। যে চারাটি জ্যোতির্ময় দেড় বছর ধরে বড় করেছে, সেই চারাটাই এখানে লাগালাম আমরা।
ড. রানা'র জন্মদিনে সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরে লাগানো হল দেড় বছরের এই নাগচম্পা গাছটি।
ড. রানা'র জন্মদিনে সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরে মাল্যদানের পরে আমরা।
সকাল থেকে প্রচুর খাওয়া হয়েছিল, তার উপরে সেদিন প্রচণ্ড গরম ছিল। স্কুলের দীঘিতে স্নান করতে খুব ইচ্ছে করছিল। প্রথবার এসেই সেই দীঘির প্রেমে পড়েছিলাম আমি। কিন্তু আমাদের এক্সট্রা প্যান্ট বা গামছা কিছুই ছিল না। আমাদের গাছ লাগানো দেখতে সেখানে এক ঢাকি ভাই উপস্থিত হয়েছিলেন (তার কোমরে গামছা বাঁধা ছিল)। সেই আমাদের ছবি তুলে দিয়েছিল। তাকে গামছা চাইতে হ্যাঁ বা না কিছুই বলছেনা দেখে, তার গ্রামের নাম জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল পটাশপুরের অমরপুর গ্রাম থেকে এসেছেন। অমরপুর শুনেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম- "পরিবেশবিদ সোমনাথ অধিকারীকে চেনন ? উনি আমাদের প্রবীণ সদস্য এবং উপদেষ্টা।" সোমনাথ বাবুর নাম শুনেই ঢাকিভাই চিনতে পারলেন। সেই সুযোগে আমি হাঁসি মুখে বললাম- "তাহলে সোমনাথ বাবুকে বলছি আপনাকে ফোন করে গামছা দেওয়ার অনুরোধ করতে"। এই কথা শুনে ঢাকিভাইও হাঁসি মুখে গামছা দিলেন আমাদের।
ড. রানা'র জন্মদিনে সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরের দীঘিতে আমরা।
ড. রানা'র জন্মদিনে সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরের দীঘিতে আমরা।
সেদিনের মত আমাদের জন্মদিনের সমস্ত কর্মসূচি শেষ হয়ে গেছিল (পরে একদিন তাঁর বোনের বাড়িতে বৃক্ষরোপনের কর্মসূচি রয়েছে)। তাই নিশ্চিন্তে পরের দেড় ঘন্টা আমরা কাটালাম দীঘির জলে। হস্টেলে থাকা কালীন এই দীঘিতেই স্নান করতেন ড. রানা। সারাদিনের সমস্ত পরিশ্রম ধুয়েমুছে গেল দীঘির জলে।
তবে একটা গামছায় কিভাবে চারজন স্নান করলাম, সেটাই দিনের শেষে সবথেকে বড় প্রশ্ন ?
অরিন্দম ভৌমিক।
midnapore.in
Published on 17.10.2021