বিখ্যাত বাঙালি কবি, নাট্যকার ও সংগীতকার। তিনি ডি. এল. রায় নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তাঁর রচিত প্রায় ৫০০ গান বাংলা সংগীত জগতে দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত গান "ধনধান্যে পুষ্পে ভরা", "বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ" ইত্যাদি দুই বাংলার আপামর মানুষের কাছে আজও একই রকম সমাদৃত, একই রকম বরণীয়। তাঁর রচিত নাটকের সংখ্যাও অনেক। তাঁর নাটকগুলি চার শ্রেণিতে বিন্যস্ত: প্রহসন, কাব্যনাট্য, ঐতিহাসিক নাটক ও সামাজিক নাটক। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে জীবদ্দশায় প্রকাশিত আর্যগাথা (১ম ও ২য় ভাগ) ও মন্দ্র বিখ্যাত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একঘরে, কল্কি-অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার-পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল-বিজয় ইত্যাদি।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্মৃতি রক্ষার জন্য ১৯৩৫ সালে কাজলদীঘির উত্তরপাড়ে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (২০১০)।
১৮৬৩ সালের ১৯ জুলাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় জন্মগ্রহণ করেন নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান। স্বাভাবিক ভাবেই বাড়িতে বহু গুণীজনের সমাবেশ হত। কার্তিকেয়চন্দ্র নিজেও ছিলেন একজন বিশিষ্ট খেয়াল গায়ক ও সাহিত্যিক। মা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। দ্বিজেন্দ্রলালের দুই দাদা রাজেন্দ্রলাল ও হরেন্দ্রলাল এবং এক বৌদি মোহিনী দেবীও ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যস্রষ্টা। দ্বিজেন্দ্রলাল ১৮৭৮-এ প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। এফ. এ. পাস করেন কৃষ্ণনগর গভঃ কলেজ থেকে। পরে হুগলি কলেজ থেকে বি.এ. এবং ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এম.এ. পাস করেন। এরপর কিছুদিন ছাপরার রেভেলগঞ্জ মুখার্জ্জি সেমিনারিতে শিক্ষকতা করার পর সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে যান কৃষিবিদ্যা শিক্ষা করার জন্য। রয়্যাল এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি হতে কৃষিবিদ্যায় FRAS এবং MRAC ও MRAS ডিগ্রি অর্জন করেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ Lyrics of Ind। এই বছরই দেশে প্রত্যাবর্তন করে সরকারি কাজে যোগ দেন দ্বিজেন্দ্রলাল। ভারতবর্ষে ফিরে তিনি জরিপ ও কর মূল্যায়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং মধ্যপ্রদেশে সরকারি দপ্তরে যোগ দেন। পরে তিনি দিনাজপুরে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ পান।
১৮৮৭ সালে তিনি প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আন্দুলিয়া নিবাসী প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা সুরবালা দেবীকে বিবাহ করেন। ১৮৯০ সালে সুজামুঠা পরগনায় সেটেলমেন্ট অফিসার হিসাবে আসেন মেদিনীপুর জেলায় (কাজলাগড়, পূর্ব মেদিনীপুর)। ১৮৬৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত সুজামুঠা জমিদারির মালিক হয়েছিলেন বর্ধমানের রাজপরিবার। বর্ধমানেশ্বরী মহারানী নারায়ণ কুমারী দেবীর শাসনকালে দেউলিয়া সুজামুঠা তাঁদের অধিকারে যায়। তাঁর পরবর্তী বর্ধমান-রাজ হন স্যার বিজয়চাঁদ মাহতাব (১৮৮৭-১৯৪১) এবং শেষ রাজা স্যার উদয়চাঁদ মহতাব (১৯০৫-১৯৮৪)। স্বাধীন ভারতে জমিদারি অধিগ্রহণ আইন বলবৎ হলে ১৯৫৫ সালে স্যার উদয়চাঁদের জমিদারির অবসান ঘটে। জমিদারেরা কাজলাগড়ে থেকে প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন না। রাজ এস্টেটের ম্যানেজার কাজলাগড় রাজবাড়ীর দোতালার দরবারে বসে আগের থেকে নিযুক্ত বা স্থানীয়ভাবে নবনিযুক্ত রাজকর্মচারীদের নিয়ে সে দায়িত্ব পালন করতেন।
পুত্র দিলীপ ও কন্যা মায়াকে নিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।
বাংলাদেশের সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা সমবেত কণ্ঠে গাইছেন "ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা"। ।
দ্বিজেন্দ্রলাল এই সুজামুঠা পরগনার জরীপ-জমাবন্দি বিভাগের সেটেলমেন্ট অফিসার নিযুক্ত হয়ে ১৮৯০ থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন বছর মেদিনীপুর জেলায় ছিলেন। খুব অল্প দিনেই কাজলাগড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। নতুন বন্ধুমহল নিয়ে রোজ সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক আড্ডার আসর বসাতেন দ্বিজেন্দ্রলাল। মেদিনীপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, কাজলাদিঘীর টলটলে জল দ্বিজেন্দ্রলাল ও তাঁর স্ত্রীকে মুগ্ধ করেছিল। দাম্পত্যজীবন তাঁর সাহিত্যসৃষ্টিকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল | স্ত্রী বাড়িতে অপেক্ষায় মালা গেঁথে রাখতেন তাঁর জন্যে। আসামাত্র পরিয়ে দিতেন। একদিন কাজলাদিঘীর পাড়ে বসে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে লিখলেন — 'আমি সারা সকালটি বসে বসে এই সাধের মালাটি গেঁথেছি'। এছাড়াও তাঁর অনেকগুলি গান ও কবিতা এখানেই রচিত।
আমি, সারা সকালটি বসে বসে এই সাধের মালাটি গেঁথেছি।
মেদিনীপুরে থাকাকালীন সাহিত্য সৃষ্টি ছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ হল, জমির অতিরিক্ত খাজনা বন্ধ করার সাহসী পদক্ষেপ। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন -
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্মৃতি রক্ষার জন্য ১৯৩৫ সালে কাজলদীঘির উত্তরপাড়ে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (২০১০)।
"আমার পূর্ববর্তী সেটেলমেন্ট অফিসারেরা জরিপে জমি বেশি পাইলেও খাজনা বেশি ধার্য করিয়া দিতেন। আমি সুজামুঠা সেটেলমেন্টে এই অভিপ্রায় প্রকাশ করি যে, এরূপ খাজনা বৃদ্ধি করা অন্যায় ও আইন বিরুদ্ধ। প্রজার সহিত যখন পূর্বে জমি বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া হয়, তখন মাপিয়া দেওয়া হয়না। আন্দাজ করিয়া সেই জমির পরিমান হস্তবুদ করা হয়। এই সময়ে স্যার চার্লস এলিয়ট বঙ্গদেশের লেফটেনেন্ট গভর্নর ছিলেন। তিনি উক্তরূপ বিভ্রাট দেখিয়া তদন্ত করিতে স্বয়ং মেদিনীপুর আসেন ও কাগজপত্র দেখিয়া আমাকে যথোচিত ভর্ৎসনা করেন। আমি আমার মত সমর্থন করিয়া বঙ্গদেশীয় সেটেলমেন্ট আইন বিষয়ে তাঁহার অনভিজ্ঞতা বুঝাইয়া দিই।"
কর্মরত অবস্থায় কৃষকদের অধিকার বিষয়ে তাঁর সাথে বাংলার ইংরেজ গভর্নরের এই বিবাদের ফলে তাঁকে সরকারের বিষ নজরে পড়তে হয়। সরকার তাঁর প্রমোশন বন্ধ করে দেয়। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। নিরীহ প্রজাদের উপকার করতে পেরে তিনি খুশি হয়েছেন। তাঁর এই কাজের জন্য স্থানীয় কৃষকরা তাঁকে দয়াল রায় নাম দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন -
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।
"আমি সত্যই ইহা শ্লাঘার বিষয় বিবেচনা করি যে, আমি এই ক্ষুদ্র ক্ষমতাতেই উক্ত কার্যে নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করিলেও সমস্ত বঙ্গদেশব্যাপী একটি উপকার সাধিত করিয়াছি, - নিরীহ প্রজাদিগকে অন্যায় কর বৃদ্ধি হইতে বাচাইয়াছি।"
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাজলাগড়ের এই স্থানেই ছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাড়ি। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (২০১০)।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাজলাগড়। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (২০১০)।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্মৃতি রক্ষার জন্য ১৯৩৫ সালে কাজলদীঘির উত্তরপাড়ে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়। মেদিনীপুরের ইতিহাস রচয়িতা যোগেশচন্দ্র বসু, কাঁথির সব-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সুরেন্দ্রনাথ সেন, বিখ্যাত অভিনেতা ইক্ষুপত্রিকার দীননাথ নন্দ এবং আরো অনেকের উদ্যোগে স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরী হয়েছিল।
নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ।
স্মৃতিস্তম্ভের একদিকে রয়েছে, কাজলাগড়ে বসে রচিত তাঁর গান -
"আমি, সারা সকালটি বসে বসে
এই সাধের মালাটি গেঁথেছি।
আমি, পরাব বলিয়ে তোমারি গলায়
মালাটি আমার গেঁথেছি।
আমি, সারা সকালটি করি নাই কিছু
করি নাই কিছু বঁধু আর;
শুধু বকুলের তলে বসিয়ে বিরলে
মালাটি আমার গেঁথেছি।
তখন গাহিতেছিল সে তরুশাখা ওপরে,
সুললিত সুরে পাপিয়া;
তখন দুলিতেছিল সে তরুশাখা ধীরে,
প্রভাত-সমীরে কাঁপিয়া।
তখন প্রভাতের হাসি, পড়েছিল আসি
কুসুমকুঞ্জভবনে;
আমি তারি মাঝখানে, বসিয়া বিজনে
মালাটি আমার গেঁথেছি।
বঁধু মালাটি আমার গাঁথা নহে শুধু
বকুল কুসুম কুড়ায়ে;
আছে প্রভাতের প্রীতি সমীরণ গীতি
কুসুমে কুসুমে জড়ায়ে;
আছে সবার উপরে মাখা তায় বঁধু
তব মধুময় হাসি গো;
ধর, গলে ফুলহার, মালাটি তোমার,
তোমারই কারণে গেঁথেছি।"
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাজলাগড়। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (২০১০)।
কলকাতার বিবেকানন্দ রোডে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাড়ি। ছবিঃ টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া।
এবং অন্যদিকে রয়েছে তাঁর অনুরাগীদের কবিতা -
"সেদিন
গাহিতেছিলে এ তরুশাখা পরে
সুললিত স্বরে পাপিয়া,
দুলিতেছিল এ তরুশাখা ধীরে
প্রভাত সমীরে কাঁপিয়া;
প্রভাতের হাসি পড়েছিল আসি
কুসুম কুঞ্জ ভবনে,
শিথিল ফুলের হাসি ছড়াইয়া
মঞ্জু মৃদুল পবনে,
তা'র মাঝখানে বসিয়া বিরলে
সযতনে গাঁথি ফুলহার
দিয়েছিল বধূ বঁধুর গলায়
প্রভাতের প্রীতি উপহার।
সেই মালিকার সুরভি আজিও
ফিরি' এই বনবীথিকায়,
উদাসীর মনে কার স্মৃতি আনে ?
কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।"
২০১৪ সালে পূর্ব মেদিনীপুরের তৎকালীন জেলাশাসক শ্রীমতি অন্তরা আচার্যের উদ্যোগে গঠিত হেরিটেজ কমিটির সদস্যরা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করছেন। উপরের সারিতে বামদিক থেকে - বি.ডি.ও অফিসের কর্মী, ড. বিভাসকান্তি মন্ডল, শ্রী মন্মথনাথ দাস, শ্রী দিপেন্দ্রনারায়ণ রায়, ড. সুস্নাত জানা। নিচে বামদিক থেকে - শ্রী রাজর্ষি মহাপাত্র, শ্রী মৃণালকান্তি দাস, শ্রী সুমন হাওলাদার (তৎকালীন এ.ডি.এম - পূর্ব মেদিনীপুর), শ্রী প্রণবানন্দ বাহুবলিন্দ্র, ড. হরিপদ মাইতি। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক (২০১৪)।
অরিন্দম ভৌমিক।
midnapore.in
(Published on 17.05.2021)
তথ্য সূত্রঃ-
● ভগবানপুর থানার ইতিবৃত্ত - প্রবোধচন্দ্র বসু।
● সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৯৮ সং, ২০০২ মুদ্রণ।
● ভগবানপুর ও ভুপতিনগর থানার ইতিহাস - মন্মথনাথ দাস।