স্বাধীনতা, সংগ্রামী, নবকুমার পাঁজা, Freedom, fighter, Naba Kumar Panja, Binaberia, Shirsha, Keshpur

ধৈর্যের মহাসাগর স্বাধীনতা সংগ্রামী নবকুমার পাঁজা।

Naba Kumar Panja | नबकुमार पांजा

মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি।


ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মেদিনীপুর জেলার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। অবিভক্ত এই জেলার শহর-শহরতলি ছাড়াও একেবারে প্রত্যন্ত এলাকা অর্থাত্ পাড়া-গাঁ থেকেও এত বিপুল সংখ্যক স্বাধীনতা সংগ্রামী বা বিপ্লবী দেশের স্বাধীনতা আনয়নের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তা এক কথায় অভাবনীয়। সেরকমই একটি ছোট্ট গ্রাম বিনাবেড়িয়া। বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর ব্লকের অন্তর্গত ২ নং শিরষা গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন এই গ্রামটি যে মানুষটির পুণ্যপাদস্পর্শে ধন্য হয়েছে, গর্বিত হয়েছে এখানকার জল-হাওয়া-মাটি নদী পুকুর-খেত আর মানুষজন তিনি হলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং অনন্য হৃদয়ের অধিকারী নবকুমার পাঁজা।



ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গাওয়া প্রথম বাঙালি শহিদ অগ্নিযুগের বিপ্লবী অগ্নিবালক ক্ষুদিরাম বসুর জন্মস্থান মোহবনী গ্রামেরই অনতিদূরে বিনাবেড়িয়ায় নবকুমার পাঁজার যৌবনের দিনগুলি কেটেছে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অর্থাত্ ভারতমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের মহতী সংকল্পে। পরে স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিয়েছেন দেশের কাজে, মানুষের কল্যাণের মহতী সাধনায়। যা তাঁর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত ছিল অটুট, স্থিরচিত্ত এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

স্বাধীনতা, সংগ্রামী, নবকুমার পাঁজা, Freedom, fighter, Naba Kumar Panja, Binaberia, Shirsha, Keshpur
স্বাধীনতা সংগ্রামী নবকুমার পাঁজা | Freedom fighter Naba Kumar Panja (Binaberia, Shirsha, Keshpur)

চল্লিশের দশক। সারাদেশ তখন উত্তাল। আসমুদ্র হিমাচল কেঁপে উঠেছে। চারদিক থেকে ধ্বনিত হচ্ছে ‘ইংরেজ, ভারত ছাড়ো’, ‘আমাদের স্বাধীনতা দাও।’ এমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণে কি স্থির থাকা যায়? না, স্থির থাকতে পারেননি নবকুমার পাঁজা। দেশের স্বাধীনতার জন্যে তাঁর প্রাণ যে তখন কাঁদছে, হৃদয় ব্যাকুল বিদীর্ণ হচ্ছে। যোগ দিলেন ভারতছাড়ো আন্দোলোনে। পরাধীনতার হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে, এরজন্য যা করবার তাই করতে হবে। অনেকের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে পিকেটিং, থানা দখল ইত্যাদি ইংরেজ বিরোধী কাজে অংশ নিলেন। কেশপুর থানা দখলের সময় ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর দলের লোকেদের খণ্ডযুদ্ধ হয়, প্রচুর গুলি বিনিময় হয়। ঐ সময় ইংরেজ পুলিশদের হাত থেকে আগ্নেয়াস্ত্র পর্যন্ত ছিনিয়ে নেয় তাঁর দলের লোকেরা। অত্যুত্সারহী জনগণ যাঁরা দাঁড়িয়ে এই লড়াই দেখছিলেন তাঁদের একজন পুলিশের গুলিতে মারাও যান।



নবকুমার পাঁজার ছেলেবেলা কেটেছে খুবই কষ্টে, কঠিন-কঠোর দারিদ্র্যের সঙ্গে তীব্র লড়াই করে। তাঁর থেকে এগারো বছরের ছোটোভাই বাদলচন্দ্র পাঁজার কথায়- সংসারের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। যাকে বলে অসচ্ছল পরিবার। দু’বেলা খাওয়া-পরা জুটত না ঠিকমতো। কতদিন না খেয়েই স্কুলে যেতে হয়েছে। নবকুমার পাঁজার শিক্ষার প্রথম পাঠ শুরু খেতুয়ার রানীয়ড় ক্ষুদিরাম বিদ্যাপীঠে। পড়াশোনার সাথে সাথেই দুচোখে টলমল করে দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন। ইংরেজদের দেশ থেকে তাড়াতে হবে নইলে স্বস্তি নেই, শান্তি নেই। গোপনে চলত মিটিং আর বিভিন্ন সভা। যার ফলে ইংরেজদের কুনজরে পড়ে যান তিনি। চন্দ্রকোণা রোডে পড়ার সময় একবার পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে আসছেন ইংরেজ পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং জেলে পাঠায়। তিনমাস কারান্তরালে থাকার পর তিনি ছাড়া পান। এইসব কারণে পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে তাঁর। পরে নিজের চেষ্টায় গড়বেতা ও চন্দ্রকোণা টাউনে পড়াশোনা করে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পড়াশোনার প্রতি বরাবরই ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ ছাড়াও তিনি যোগ দিয়েছিলেন চারের দশকেরই আর এক আন্দোলন তেভাগা আন্দোলনে। কৃষকদের স্বার্থরক্ষায় আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।



ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করলে তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন। সক্রিয় কর্মী হিসাবে যোগ দেন কম্যুনিস্ট আন্দোলনে। সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা, দেশের দারিদ্র্য দুরীকরণ, নিরক্ষর মানুষদের শিক্ষার আলোয় আনার ব্যাপারে প্রতিনিয়ত কঠোর সংগ্রাম করে গেছেন। সেই সঙ্গে চেয়েছেন গড়তে সারাজীবন শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা। পাশাপাশি চলত চিকিত্সারর কাজ। ডাক্তারিশাস্ত্রে তথাকথিত বড়ো ডিগ্রি ছিল না ঠিকই কিন্তু অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ডাক্তারিটা ভালোই করেছেন। শেষের দিকে তিনি এলাকায় ডাক্তারবাবু হিসাবেই বেশি পরিচিত হয়ে পড়েছিলেন। ঝড়-ঝঞ্ঝা, রোদ-বৃষ্টি, রাতবিরেত অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় উপেক্ষা করেও তিনি ছুটে গেছেন অসুস্থ মানুষের পাশে, মুমূর্ষু রোগীর সেবায়। অনেককে বিনা পয়সাতেও চিকিত্সাে করেছেন। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব মানুষের মঙ্গলের জন্যই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছেন কম্যুনিস্ট আন্দোলনে যোগ দেওয়ার সূত্রে রবি মিত্র, হরেন মিত্র, সরোজ রায়, কামাখ্যা ঘোষ, সত্য ঘোষাল, বিশ্বনাথ মুখার্জি, প্রমুখ বিদগ্ধ মনীষী ও নেতা-নেত্রীদের। নবকুমার পাঁজার তিন ছেলে এবং পাঁচ মেয়ে। ছোটো ছেলে ডা: অসিতবরণ পাঞ্জা বর্তমানে থাকেন আমেরিকাতে। সেখানে তিনি চিকিত্সাদশাস্ত্রে গবেষণার কাজে ব্রতী আছেন। সেই কৃতী সন্তান অসিতবাবু এক অন্তরঙ্গ সাক্ষাত্কামরে এই প্রবন্ধকারকে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে অশ্রু ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেন – তাঁদের বাবা ছিলেন একজন সজ্জন ব্যক্তি, যাকে বলে মহত্প্রা ণের মানুষ। আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন ভারতমতার ভালো হোক, দেশের প্রতিটি মানুষ সুখে-শান্তিতে থাকুক। কারো ক্ষতি হোক তা তিনি চাইতেন না। কেউ তেমন তাঁর শত্রুতা করতে চাইলেও তিনি তাদেরকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছেন। ফলে সেই শত্রুই কখন আপনা থেকেই তাঁর কাছে মিত্র হয়ে গেছে। রাগ-বিরক্ত বলে কিছু ছিল না। যাকে বলে তিনি ছিলেন ধৈর্যের মহাসাগর। প্রতিদিন কত মানুষ কতরকম সমস্যা ঝামেলা নিয়ে তাঁর কাছে এসেছেন কিন্তু তিনি কখনো বিরক্ত হননি। হাসিমুখে মন দিয়ে তাদের সমস্যার কথা শুনেছেন। তারপর যতটা পেরেছেন সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন। শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর অসম্ভব রকমের টান। আমেরিকায় তাঁকে যেসব চিঠি লিখেছেন–সেখানে প্রতিবারই ভারতমায়ের কথা বলা আছে। বলেছেন – ‘ভারতমাতা তোমার মুখ চেয়ে বসে আছে। মানুষের জন্য তুমি কিছু করো।’ একটা পরিচ্ছন্ন প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা সবসময় তাঁর মাথায় কাজ করত।



নবকুমার পাঁজা ছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূর্ত প্রতীক। মানুষে মানুষে বিভেদ তিনি চাইতেন না। তাঁর চলার পথে অনেক মুসলমানই তাঁর বন্ধু ছিলেন। মুগবসান গ্রামের সাতাত্তর বছরের বৃদ্ধ হজরতুল্লাহ-র কথায় নবকুমার এত গুণের অধিকারী ছিলেন তা বলে শেষ হওয়ার নয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনগুলিতে ইংরেজ তাড়ানোর সংগ্রামে যেমন ব্রতী হয়েছিলেন –তেমনই পরবর্তী জীবনে মানুষের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে গেছেন এবং নিজ জীবনে তা প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এখানেই মানুষটি অনন্য, আর দশজনের থেকে আলাদা।



সহধর্মিনী স্নেহলতা পাঁজার অনুভূতিতে সংসারের ভালো চাওয়ার পাশাপাশি মানুষের ভালোর কথা ভেবে গেছেন মানুষটি সারাজীবন ধরে। নিবিড়ভাবে ভালোবাসতেন দেশকে। স্বদেশপ্রেম এবং মানবপ্রীতি মানুষটিকে মহীয়ান করে তুলেছিল।

স্বাধীনতা, সংগ্রামী, নবকুমার পাঁজা, Freedom, fighter, Naba Kumar Panja, Binaberia, Shirsha, Keshpur
স্বাধীনতা সংগ্রামী নবকুমার পাঁজা | Freedom fighter Naba Kumar Panja (Binaberia, Shirsha, Keshpur)

অসংখ্য মহত্গুসণ এবং সহৃদয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম বীর সেনানী নবকুমার পাঁজা ২০০৪ সালের ১৭ এপ্রিল প্রয়াত হয়ে পাড়ি দেন অমর্ত্যলোকে। তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে ভুগছিলেন। তাছাড়া একবছর আগে বড়োছেলে অনিলকুমার পাঁজার অকালমৃত্যুতে তিনি অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের মহতী কাজে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের জন্য ভারত সরকার তাঁকে তাম্রপত্র ফলক দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯৮৮ সালের ১৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী রজীব গান্ধী এই তাম্রপত্র ফলক তুলে দেন। যা তাঁর নিজের পরিবার তথা গ্রামবাসী সর্বোপরি এলাকাবাসীকে প্রচণ্ড গর্বে গর্বিত করেছে। তাঁর একটি আবক্ষমূর্তি স্থাপিত হলে এলাকার জনগণ আরও খুশি হবেন।


midnapore.in

(Published on 24.07.2021)