দানবীর গঙ্গাধর নন্দ।
गंगाधर नन्द | Gangadhar Nanda
অরিন্দম ভৌমিক।
(১৬ই শ্রাবণ ১২৬৮ - ২০ চৈত্র ১৩৩৬ )
তৎকালীন কাঁথি মহকুমার ভগবানপুর থানার অন্তর্গত সুয়াদিঘি (মুগবেডিয়া নামে পরিচিত) গ্রামে (বর্তমানে ভূপতিনগর থানা) বাংলা ১২৬৮ সালের ১৬ই শ্রাবণ গঙ্গাধর নন্দের জন্ম হয়। পিতার নাম ভোলানাথ নন্দ এবং মাতা সুধাময়ী। ভোলানাথ নন্দ ছিলেন মুগবেড়িয়ার জমিদার। ভোলানাথ নন্দের তিন ছেলে, বড় গোবিন্দপ্রসাদ, মেজ দিগম্বর ও ছোট গঙ্গাধর। তিন ছেলেই ছিলেন রত্ন। ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিমান গোবিন্দপ্রসাদ ছিলেন দয়ালু এবং সুবিচারক। দিগম্বরের মত ধর্মনিষ্ঠ ত্যাগী ব্রাহ্মণ পন্ডিত সেই সময়ে ছিল বিরল। দিগম্বরের পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি 'বিদ্যানিধি' উপাধি পেয়েছিলেন।
মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর হাইস্কুল। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।
এইবার আসা যাক গঙ্গাধর প্রসঙ্গে। তখনকার দিনে লেখাপড়া শিক্ষার সুবিধা সব জায়গায় ছিল না। সেই কারণে গঙ্গাধর ছোটবেলায় বেশি দূর পড়াশুনার সুযোগ পান নি। বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় অল্প শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তাঁর মেধা ও গুনের জন্য স্থানীয় পন্ডিতরা খুবই স্নেহ করতেন। গঙ্গাধরের কথা পন্ডিতরা গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন।
পিতার মৃত্যুর পর তিন ভাই প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী হন। কিছুদিন তিনজনে একসঙ্গেই সংসার করেছিলেন। সেই সময়ে তিনজনে মেদিনীপুর ও সুন্দরবন অঞ্চলে হাজার হাজার বিঘা জমি কিনেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা বিপুল ধন-সম্পদের অধিকারী হয়ে উঠলেন। এই বিপুল ধন-সম্পদ পরিচালনার জন্য তাঁরা পৃথক ভাবে সংসার পরিচালনা করতে লাগলেন। গঙ্গাধর নিজের সম্পত্তি পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই তাঁর গুনগরিমা প্রকাশ পেতে লাগল।
তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্মই মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ। ধর্মহীন মানুষ পশুর সমান। জীবে দয়া, পরোপকার, ভোগবিলাসের বিসর্জনই প্রকৃত ধর্ম। শুধু বিশ্বাস নয় এই সমস্ত জিনিস তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলতেন।
অল্প বয়স থেকেই গঙ্গাধর বিষয়-সম্পত্তির পরিচালনা আরম্ভ করেছিলেন। সেই সময় মোক্ষদা দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের শৈলজা ও বিরজা নামে দুই পুত্রসন্তান হয়। শিশুপুত্রকে স্বামীর কোলে রেখে অল্প বয়সেই দেহত্যাগ করেন মোক্ষদা দেবী। তখন গঙ্গাধর যুবক মাত্র। কিন্ত তিনি পুনরায় বিবাহ না করে নিজেকে দেশের সেবায় নিয়োজিত করেন।
বেলদা গঙ্গাধর একাডেমি।
তিনি মানতেন কর্মই ধর্ম। গঙ্গাধরের জীবন ছিল কতকগুলি কর্মের যোগফল। কর্মই ছিল তাঁর সবথেকে প্রিয়। যে কোন পরিস্থিতিতেই তিনি নিজের কর্মে অবিচল থেকেছেন। ভগবানের উপর তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল। সমস্ত কর্মের ফলাফল ভগবানের উপর ছেড়ে দিয়ে তিনি অবিশ্রান্ত কর্ম করে যেতেন। তাঁর কর্মময় জীবনের কিছু ঘটনা তুলে ধরা প্রয়োজন।
শুরুতেই বলেছি, তখন দেশে লেখাপড়া শিক্ষার তেমন সুবিধা ছিল না। ফলে দেশের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার অভাবে জীবনের আদর্শ হারিয়ে ফেলেছিল। তারা অনেকসময় অলস ও কর্মহীন হয়ে অসৎ পথে চলে যেত। সারাদিন পরনিন্দা, পরচর্চা করে দিন কাটাতো। সমাজের এই অধঃপতন গঙ্গাধর কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, সমাজের প্রকৃত উন্নতির একমাত্র উপায় জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা-বিস্তার। সে সময় সমস্ত কাঁথি মহকুমার মধ্যে মাত্র দুটি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় ছিল।
গঙ্গাধর প্রথমে নিজের গ্রামে একটি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এই বিদ্যালয়ের নাম "মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর এইচ. ই. স্কুল"। কিছুদিন পরে তিনি বেলদা ষ্টেশনের কাছে আরো একটি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন। স্কুলটির নাম "বেলদা গঙ্গাধর একাডেমী"। এছাড়াও "গঙ্গাধর পাঠশালা" নামে তাঁর প্রতিষ্ঠিত আরো একটি স্কুল আছে। সেই সময়ে এই সব বিদ্যালয়ে প্রায় অর্ধেকের বেশী ছাত্র বিনা বেতনে শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিল। এমন কি, যে সমস্ত ছাত্র পরীক্ষার ফি দিতে পারতো না, গঙ্গাধর তাদেরকে আর্থিক সাহায্য করতেন।
সংস্কৃত শিক্ষার প্রতিও তাঁর লক্ষ ছিল। তিনি পিতার প্রতিষ্ঠিত "ভোলানাথ চতুষ্পাঠী" -র অনেক উন্নতি সাধন করেন। এই টোলে বহুছাত্র সংস্কৃত শিক্ষালাভ করত। সেখানে তাদের থাকার ও খাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। কাঁথির প্রভাত কুমার কলেজের উন্নতির জন্য সেই সময়ে তিনি এককালীন দশ হাজার টাকা দান করেছিলেন। বহু পত্র-পত্রিকা ও পুস্তকে সমৃদ্ধ ছিল তাঁর ব্যাক্তিগত গ্রন্থশালা।
সেই সময়ে বহু দরিদ্র মানুষ অর্থাভাবে বিনা-চিকিৎসায় প্রাণ হারাতো। গঙ্গাধর সেই হতভাগ্য গরিব মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য "মুগবেড়িয়া দাতব্য ওষধালয়" ও "সুধাময়ী দাতব্য আয়ুর্বেদীয় ওষধালয়" নামে দুটি ওষধালয় স্থাপন করেন।
গঙ্গাধর নন্দের তৈলচিত্র। চিত্র সৌজন্য - চৈতন্যময় নন্দ।
কাঁথি মহকুমার অধিকাংশ লোককে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে বেলদা ষ্টেশনে যেতে হত। সেখানে ট্রেণের অভাবে বহু যাত্রীকে রাত্রি কাটাতে হত। সে সময় ষ্টেশনে থাকার কোন ব্যবস্থা ছিলোনা, তাই যাত্রীদের খুব অসুবিধায় পড়তে হত। গঙ্গাধর যাত্রী ও জনসাধারণের অসুবিধার কথা ভেবে তাদের থাকার জন্য একটি সুন্দর পান্থশালা তৈরী করে দেন। শুধু পান্থশালাই নয় জলের অসুবিধার কথা চিন্তা করে পান্থশালার সামনে চওড়া ঘাট সহ সরোবর বানিয়ে দিয়েছিলেন। তীর্থযাত্রী ও অন্যান্য লোকেদের থাকার সুবিধার জন্য তিনি পুরী, ভুবনেশ্বর, মেদিনীপুর ও কাঁথিতে ঘর তৈরী করে দিয়েছিলেন।
দেশের দরিদ্র জনসাধারণ যাতে অল্পসুদে ঋণ পেতে পারে সেই জন্য তিনি নিজের গ্রামে ঋণদান সমিতি ও সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক স্থাপনে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন (মুগবেড়িয়া সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক)। দেশে যাতে শিল্পের বিকাশ হয়, সেইজন্য তিনি সবাইকে তাঁতের কাজ, কাঠের কাজ, লোহার কাজ প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়ার জন্য বহু অর্থ ব্যয় করেন। নিজের বাগানে দেশ-বিদেশের নানা ফল ও অন্যান্য গাছ লাগিয়ে কৃষকদের সামনে আদর্শ স্থাপন করেছেন।
তিনি আবার আধুনিক সংস্কৃতি চর্চার পুরোধা। কলকাতার পরিচালক ও ওস্তাদ আনিয়ে গড়ে তুলেছিলেন শান্তি থিয়েটার। নিজের বাড়িতে শ্যামামায়ের মন্দির ও ভুপতিনগরে শীতলা মন্দির তাঁরই প্রতিষ্ঠিত।
বাংলা ১৩৩৩ সালের দারুণ বন্যায় যখন সমগ্র মেদিনীপুর জেলায় হা-হা-কার উঠে, তখন এই মহাপ্রাণ গঙ্গাধর শয়ে শয়ে গ্রামবাসীকে এক বছরের জন্য খাওয়ার ও পোশাক দিয়ে রক্ষা করেছিলেন।
গঙ্গাধর যে কত ছোট-বড় দেশহিতকর কাজ করে গেছেন তার কোন হিসেবে নেই। বহু জায়গায় জলাশয় ও কুঁয়ো খনন করিয়ে, বিদ্যালয় স্থাপন করে, দেবদেবীর সুন্দর সুন্দর মন্দির নির্মাণ করিয়ে, সেতু তৈরী করে, নদীবাঁধ বানিয়ে, পথঘাট বাঁধিয়ে দিয়ে এবং গরিবের অভাব মোচন করে তিনি তাঁর অর্থের প্রকৃত সদ্ব্যাবহার করে গিয়েছেন। অন্নহীন, বস্ত্রহীন লোক তাঁর কাছ থেকে নিরাশ হয়ে ফিরে যায়নি। দেশের বহু শিক্ষিত লোক গঙ্গাধরের কাছে অল্পবিস্তর ঋণী।
বেলদা গঙ্গাধর একাডেমি।
অসহায়ের সহায়, অনাথের বন্ধু, পিতৃহীনের পিতা, দেশের উপদেষ্টা, শিক্ষক, আদর্শ পুরুষ গঙ্গাধর গত বাংলা ১৩৩৬ সালের ২০ চৈত্র পরলোক গমন করেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর কর্মের জন্য দেশবাসীর কাছে অমর হয়ে রয়েছেন।
জয়তু জয়তু গঙ্গাধর নন্দনামধারী।
পুণ্যকীর্তি গঙ্গাজলধারার্পনকারী।
দেবালয় বিদ্যালয় পান্থনিলয় সলিলাশয় -
- ভেষজান্ন বস্ত্রদান লোকচিত্তহারী।
মানবহিত সাধন ধনদানযজ্ঞকারী।।
বহুলদুঃখি দুঃখহান-দেশজাড্যতিমিরহরণ-
-নিখিল শুদ্ধ কর্মকরণ পৃতমার্গচারী।
মরণ শূন্য বিজ্ঞ সুজন সেবাব্রতকারী।।
অদ্য বিনয়নম্রশিরসা নৌমি দৈন্য সহিতবচসা
দানবীর গঙ্গাধরমমরলোকচারী।
নরদৈবতপুজন শুভ ভারতকৃতিকারী।।
গঙ্গাধর বিদ্যালয়-পুণ্যোৎসবমিলিত হৃদয়-
-সংগত বহুদূরনিকট দেশমনুজানারী।
জ্যোতির্ময় এষ নমতি, পততু করুণাবারি।।৪
অরিন্দম ভৌমিক।
midnapore.in
(Published on 16.04.2021)
তথ্যসূত্রঃ
(১) মেদিনীপুর গৌরব -শ্রী প্রমথনাথ পাল ও শ্রী দ্বারকানাথ পড়িয়া।
(২) মেদিনীপুর চরিতাভিধান - মন্মথনাথ দাস।
(৩) মেদিনীকথা পূর্ব মেদিনীপুর - অরিন্দম ভৌমিক।
(৪) গঙ্গাধর নন্দের জন্মশতবার্ষিকী উৎসব উপলক্ষে ১৯৬১ সালে কবিতাটি লিখেছিলেন জ্যোতির্ময় নন্দ।
কৃতজ্ঞতাঃ
● শ্রী চৈতন্যময় নন্দ, মুগবেড়িয়া।
● শ্রী বিকাশ কুমার মাইতি, তিলন্তপাড়া।
● শ্রী শোভনলাল মাইতি, তিলন্তপাড়া।