জ্যোতির্ময় নন্দ | ज्योतिर्मय नंद | Jotirmoy Nanda

জ্যোতির্ময় নন্দ

ज्योतिर्मय नंद | Jotirmoy Nanda

অরিন্দম ভৌমিক।


(২১ ভাদ্র ১৩১৫ - ১৯ কার্তিক ১৪০৩)

(৬ই সেপ্টেম্বর ১৯০৮ - ০৫ নভেম্বর ১৯৯৬)


জ্যোতির্ময়ং সদা সৌম্যাং নমামি নন্দ-নন্দনম।

মহা সারস্বতং বন্দে শাস্ত্রভূষণ - ভূষণম।।


ভারতের এক বরেণ্য মহাত্মা দিবংগত জ্যোতির্ময় নন্দ। তিনি ছিলেন জ্ঞান - কর্ম - ভক্তির মিলিত বিগ্রহ। তাঁর রচনা "স্বাদু স্বাদু পদে পদে।" পরম বৈষ্ণব এবং পরম শাক্ত এই মহাত্মার শাস্ত্রে ছিল কুশাগ্রবুদ্ধি। তাঁর পান্ডিত্য ছিল স্নিগ্ধ অথচ সজীব। সহস্রাধিক নিবন্ধ তিনি রচনা করেছেন। ছিলেন সর্ববিধ শাস্ত্রে অন্তঃপ্রবিষ্ট। লোকশিক্ষার অনন্য নায়ক তিনি ছিলেন। বিবিধ শাস্ত্রে তাঁর পান্ডিত্য তাঁকে মহিম-মন্ডিত করেছে। বঙ্গ-ভারতের এমন কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না যাতে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে ভাষণ না দিয়েছেন। জমিদার-নন্দন তিনি শাস্ত্রজ্ঞানে পরম ধনী, শাক্ত-বৈষ্ণবের মিলন তাঁতে দেখেছি। যুগনদ্ধ তাঁর পান্ডিত্য। তিনিই বলতে পারেন -


"কাব্যেপি কোমল ধিয়ো বয়মেব নান্যে।

তর্কেহপি কর্কশ ধিয়ো বয়মেব নান্যে।।"


বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার তিনি অবিসংবাদি পণ্ডিত-প্রকাণ্ড। সাধনা এবং পান্ডিত্য তাঁকে মহীয়ান করেছে। তিনি বহু গ্রন্থের প্রণেতা। বহু নিবন্ধের রচয়িতা। অজস্ৰ সংস্কৃত ও বাংলা কবিতা তিনি রচনা করেছেন। এই সর্বতোভদ্র মনীষীকে বন্দনা করি। তাঁর সারস্বত জ্যোতিঃকণায় বিশ্ব আলোকিত। কবির ভাষায় বলি - "ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময় তোমারি হউক জয়।"

জ্যোতির্ময় নন্দ | ज्योतिर्मय नंद | Jotirmoy Nanda

মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর হাইস্কুল (ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।)

বহু গুণান্বিত এই জ্যোতির্ময় মানুষটির জ্যোতিপুঞ্জ চতুর্দিকে বিচ্ছুরিত। তিনি নিরলস, নিষ্ঠাবান, নিরহংকার, নির্ভীক, ন্যায়পরায়ন, উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত, উন্নতমনা, উন্নত চরিত্র, উন্নত চিন্তারত, উদ্যমী, উৎসাহী, সহজ, সরল, সহমর্মী, সহনশীল, সমদৃষ্টিসম্পন্ন, জাতিবর্ণ অস্পৃশ্যতা বা ছুৎমার্গ সর্বপ্রকার গোঁড়ামীমুক্ত, বিদ্যান, বিদ্যোৎসাহী, অতিথিবৎসল, বহুগুণালংকৃত গুনগ্রাহী ও মানবদরদী।

তাঁকে দেখলেই ভারত বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আনন্দে বলে উঠতেন - "ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময় তোমারি হউক জয়।"

১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ই সেপ্টেম্বর (২১ ভাদ্র ১৩১৫), মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহাকুমার ভগবানপুর থানা'র (বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ভূপতিনগর থানা) সূয়াদিঘি গ্রামে জ্যোতির্ময় নন্দের জন্ম হয় । গ্রামদেবী মুগেশ্বরীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনপদ মুগবেড়িয়ার বিখ্যাত জমিদার নন্দ পরিবারে জন্মেছিলেন তিঁনি (জ্যেষ্ঠপুত্র)। পিতা ছিলেন প্রবল পরাক্রান্ত হৃদয়বান স্বাধীনতাপ্রেমী বিরজা চরণ নন্দ ও মাতা ছিলেন মমতাময়ী ভক্তিমতী লক্ষীপ্রিয়া দেবী। পিতামহ দানবীর গঙ্গাধর নন্দ (রায় সাহেব) সমাজকল্যাণ কর্মের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। মধ্যম পিতামহ দিগম্বর বিদ্যানিধি একদিকে যেমন সংস্কৃত চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তেমনি অন্যদিকে গোপনে বিপুল অর্থব্যয় করেছিলেন স্বাধীনতার যুদ্ধে। প্রপিতামহ ভোলানাথ নন্দেরও অবদান রয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে। মেদিনীপুর, ২৪ পরগনা ও বালেশ্বরে কয়েক হাজার বিঘার জমিদারি।

জ্যোতির্ময় নন্দ | ज्योतिर्मय नंद | Jotirmoy Nanda

জ্যোতির্ময় নন্দ | ज्योतिर्मय नंद | Jotirmoy Nanda (ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।)

প্রপিতামহ ভোলানাথ প্রতিষ্ঠিত গ্রাম্য চতুস্পাটিতেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। স্কুল শিক্ষা সম্পন্ন করেন পিতামহ নামাঙ্কিত গঙ্গাধর হাইস্কুল থেকে। প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। পরে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ১৯২৭ সালে আই.এস.সি. পাস (প্রথম বিভাগ) করেন। ১৯২৯ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে সংস্কৃত অনার্স নিয়ে বি.এ. পাস (প্রথম বিভাগ) করেন। বিশেষ কৃতিত্বের জন্য পেলেন সরকার থেকে মাসিক চল্লিশ টাকা বৃত্তি এবং গঙ্গামণি পদক। বি.এ. পড়াকালীন তাঁর বন্ধু ছিলেন ডঃ নরেশচন্দ্র শাস্ত্রী (প্রাক্তন অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়), দুজনে পরামর্শ করে বিশেষ বিভাগ হিসেবে 'বেদান্ত' নিয়েছিলেন। তৎকালীন মহামহোপাধ্যায় অধ্যাপকরা জ্যোতির্ময় নন্দের বুদ্ধি ও তীক্ষ্ণতার ভূয়সী প্রশংসা করতেন। মহামহোপাধ্যায় দুর্গাচরণ সাংখ্য বেদান্ততীর্থ মহাশয়ের তত্ত্বাবধায় পরীক্ষা দিয়া বেদান্ত তীর্থ উপাধি লাভ করেন। পাণিনি ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র, স্মৃতিশাস্ত্র, সাংখ্য, জ্যোতিষ ও তন্ত্র প্রভৃতি শাস্ত্রে তাঁহার গভীর পাণ্ডিত্য ছিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদান্ত নিয়ে এম.এ. পড়াকালীন দুই প্রিয় বন্ধু ছিলেন ডঃ গৌরীনাথ শাস্ত্রী (কাব্য বিভাগ) ও ডঃ মহানামব্রত ব্রহ্মচারী (ন্যায় বিভাগ)। কিন্তু ১৯৩০ সালে তাঁর পিতামহ গঙ্গাধর নন্দের মৃত্যুর কারণে ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়েই মুগবেড়িয়া ফিরতে হয়। পরবর্তীকালে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিষয়ে সিমলা ও রোটক ন্যাশনাল হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ থেকে এম.ডি.এইচ. এবং এম.এস.সি. ডিগ্রী লাভ করেন।

ছোটবেলায় তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন শ্রীশ্রী মা সারদামণির স্নেহধন্য শিষ্য সিন্ধুনাথ পণ্ডা। সম্ভবত এই গৃহশিক্ষকের সংস্পর্শেই অধ্যাত্ম চেতনার বিকাশ ঘটেছিল জ্যোতির্ময়ের মধ্যে। বড় হয়ে বরানগর পাঠবাড়ীর সর্বজনমান্য বৈষ্ণবাচার্য রামদাস বাবাজীর পদপ্রান্তে দীক্ষা নিয়ে হয়ে উঠেছিলেন পরম বৈষ্ণব। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সভার দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন 'ভক্তি চক্রবর্তী'। মনেহয় ভক্তির পথেই মিলেছিলেন ভক্তবৎসল ভগবানের সঙ্গে। তাই তাঁর প্রয়াণকালে তাঁর নশ্বর দেহ বিস্মিত চিকিৎসকদের চোখে হয়ে উঠেছিল অলৌকিক জ্যোতির্ময় সত্তা।

জ্যোতির্ময় নন্দ | ज्योतिर्मय नंद | Jotirmoy Nanda

জ্যোতির্ময় নন্দ | ज्योतिर्मय नंद | Jotirmoy Nanda (ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।)

তাঁর পূর্বপুরুষদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেমন - বেলদা গঙ্গাধর একাডেমি, মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর হাইস্কুল, ললাট গঙ্গাধর হাইস্কুল ইত্যাদি। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য আজীবন কাজ করেছেন তিঁনি। তাঁরই নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে 'মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর মহাবিদ্যালয়'। কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় তাঁর সততা সহকর্মীদের বিস্মিত ও বিমুগ্ধ করেছিল। ১৯৫৭ সালে কলেজ গড়ার প্রথম প্রয়াস যখন ব্যর্থ হল, জনসাধারণের কাছ থেকে সংগৃহীত প্রায় ৬০,০০০ হাজার টাকা জনে জনে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। অবাক ও বিমুগ্ধ দেশবাসীর পরম আস্থাভাজন হলেন তিনি। তাইতো কলেজ স্থাপনের দ্বিতীয়বারের প্রচেষ্টায় সাহায্যের আবেদনে অকুণ্ঠভাবে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এলেন তাঁরা। জ্যোতির্ময়বাবুর সংকল্প রূপ পেল, প্রতিষ্ঠিত হল মুগবেড়িয়া কলেজ। বিনা বেতনে সেই কলেজে অধ্যাপনাও করেছেন কিছুকাল। প্রপিতামহ প্রতিষ্ঠিত ভোলানাথ সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ পদে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন আমৃত্যু। ১৯৭৮ সালে এই প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদনে শাস্ত্রী ও আচার্য পাঠক্রমযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের মর্যাদা পেলে, সেখানেও অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। কাজ করেছেন কাঁথি সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ের অন্যতম পরিচালক হিসেবে। তিঁনি বহুবার রাজ্য সরকারের 'বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদে'র সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। দীর্ঘদিন দেশিকোত্তম ডঃ শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ (সভাপতি) মহাশয়ের সঙ্গে সহ-সভাপতি রূপে কাজ করেছেন 'নিখিল বঙ্গ সেবি সমিতিতে'। তারকেশ্বর মন্দিরের দেবোত্তর ট্রাস্টির দায়িত্ব পালন করেছেন বহু বছর।

শতাধিক কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায়। নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে উজ্জীবন, জাহ্নবী, উদ্বোধন, প্রতিধ্বনি,আর্য্যশাস্ত্র , আর্য্যদর্পণ, প্রণব, উদ্বোধন, মহানাম অঙ্গন, শ্রীসুদর্শন পথের আলো, গৌড়ীয়, মধুরম, নিতাই সুন্দর, বিশ্ববানী প্রভৃতি পত্রিকায়। ব্রহ্ম বিদ্যা পদাবলী (৩ খন্ড) ছয় 'স' ভাবনা, ভজন মঙ্গলম, উপাসনা বিজ্ঞান, বিরাজচরণ ধ্যান, গঙ্গাধর প্রণাম, মঙ্গলালোক, মাতৃদর্শন, মঙ্গলভারতী প্রভৃতি কাব্য ও গদ্যগ্রন্থ সবাইকে মুগ্ধ করেছে। তাঁর 'বন্দে বিবেকানন্দম', ভবতারিণী স্তোত্রম, গীতাজননী স্তোত্রম ইত্যাদি সংস্কৃত কবিতা নানা মঠ-মন্দির-আশ্রমে স্তোত্ররূপে পঠিত হয়। ঠাকুর সীতারাম দাস ওঁকারনাথদেব প্রবর্তিত 'আর্যশাস্ত্র' মাসিক পত্রে দীর্ঘদিন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মহাভারতের বঙ্গানুবাদ। ডঃ মহানামব্রত ব্রহ্মচারী সম্পাদিত শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের 'বেদস্তুতি'র ভাষ্যকার তিনিই।

জ্যোতির্ময় নন্দ | ज्योतिर्मय नंद | Jotirmoy Nanda

মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর হাইস্কুল (ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।)

হরিদ্বারের মহামণ্ডলেশ্বর আনন্দ আশ্রমের স্বামী শিবানন্দ গিরি মহারাজ তাঁকে 'শাস্ত্রমূর্তি' ও 'সিদ্ধ সাধক' নামে ভূষিত করেন। ঠাকুর সীতারাম দাস ওঁকারনাথদেব ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন - 'পণ্ডিতবাবা'। 'গৃহী সন্ন্যাসী' আখ্যা দিয়েছিলেন অখণ্ড মণ্ডলেশ্বর স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব। নবদ্বীপধাম প্রচারিণী সভা তাঁকে 'বিদ্যাভূষণ' উপাধিতে ভূষিত করেন। " জিত সর্বং জিতে রসে " মেনে চলতেন। তিনি জাতি ধর্মের চেয়ে মনুষ্যত্বকে বড় করে দেখেছেন। ধর্মীয় অনুশাসন ও আচার এর চেয়ে তিনি বড় করে দেখেছেন জীবনযাপনের সুনীতিকে। উচ্চতার সঙ্গে তিনি যাপন করে গিয়েছেন সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবন। তিনি ছিলেন নিরহংকার, নিরভিমান, পরনিন্দা, পরচর্চা থেকে দূরে থাকতেন। সর্বত্র সম্মানিত এবং জমিদার পরিবারের সন্তান হলেও তিনি পরতেন সাধারণ পোশাক, খেতেন সাধারণ নিরামিষ খাওয়ার। পান্ডিত্যের সঙ্গে জনকল্যাণের ব্রত ছিল তাঁর জীবনবেদ। সমাজসেবা, বিশেষত নারী-সমাজের উন্নতি, জাতিভেদ প্রথা রোধ, পরিবেশ দূষণ নিবারণ এবং সুস্থ সংস্কৃতি ও নৈতিকতার প্রসার নিয়ে আজীবন তিনি সংগঠন ও প্রচার কাজ চালিয়ে গেছেন।

মেদিনীপুরের এই সুসন্তান ১৯৯৬ সালের ০৫ নভেম্বর (১৯ কার্তিক ১৪০৩) আমাদের ছেড়ে অমৃতলোকে যাত্রা করেন।


শুভাশংসন


বিদ্যাবত্তা, শাস্ত্রজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মীক জ্ঞানচর্চা এবং সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য অনুশীলনে মেদিনীপুরের যাঁরা অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন পন্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময় নন্দ তাঁদের অন্যতম। তিনি জন্মেছিলেন কাঁথি মহকুমার মুগবেড়িয়া গ্রামের লব্ধকীর্তি ভূস্বামী 'নন্দ' পরিবারে। ভোলানাথ সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষরূপে, কাঁথি সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ের অন্যতম পরিচালক হিসেবে এবং বাংলাভাষা ও সংস্কৃতের সুলেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল বহুবিস্তৃত। পান্ডিত্যের সঙ্গে জনকল্যাণের ব্রত ছিল তাঁর জীবনবেদ। সমাজসেবা, বিশেষত নারী-সমাজের উন্নতি, জাতিভেদ প্রথা রোধ, পরিবেশ দূষণ নিবারণ এবং সুস্থ সংস্কৃতি ও নৈতিকতার প্রসার নিয়ে আজীবন তিনি সংগঠন ও প্রচার কাজ চালিয়ে গেছেন। বিত্তবান ব্যাক্তির বংশধর হয়েও তিনি সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের সঙ্গে মহত্বের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গেছেন। সতত সকলের জীবনের কল্যাণময় কর্মে নিয়োজিত থাকাই ছিল তাঁহার জীবনব্রত। সমাজে সৎ শিক্ষায় সুষ্ঠ বিতরণ ছিল তাঁহার জীবনের তপস্যাতুল্যা। এই বিষয়ে তাঁহার একমাত্র সহায়ক ছিল ঋষি শাস্ত্র ও চারিত্রিক দৃঢ়তা। এই সাধনায় তিনি ছিলেন শাস্ত্রনিষ্ঠ মধুভাষী বাগ্মী ও স্বধর্মনিষ্ঠ লেখনীধারী।

- মহামহোপাধ্যায় ভগবত গঙ্গোত্রী ডঃ মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, বিশ্ববরেণ্য মনস্বী সন্ন্যাসী, ধর্মপ্রবক্তা ও দার্শনিক।

জ্যোতির্ময় নন্দ | ज्योतिर्मय नंद | Jotirmoy Nanda

জ্যোতির্ময় নন্দ | ज्योतिर्मय नंद | Jotirmoy Nanda

তাঁর রচনার মধ্যে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য প্রকট হয়ে পড়েছে। যে গুনটি আমাকে বিশেষ মুগ্ধ করেছে তা হল তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গী। শাস্ত্রের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি সত্বেও তিনি যুক্তির দাবীকে প্রত্যাখ্যান করেননি। হৃদয় ও মনীষা দিয়ে বিচার করে তিনি অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা বলেছেন, যা দেখায় তাঁর পান্ডিত্য হতে প্রজ্ঞায় উত্তরণ ঘটেছে।

ডঃ হিরণ্ময় বন্দোপাধ্যায়,প্রাক্তন উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়


পরম শ্রদ্ধেয় পন্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময় নন্দ বিরচিত ব্রহ্মবিদ্যা পদাবলী আমাদের ভারতীয় ধর্ম দর্শন শাস্ত্রে একটি অভিনব মূল্যবান অবদান নিঃসন্দেহে।

জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ ও ভক্তপ্রবর গ্রন্থকার ওঙ্কারের মর্মার্থ বেদ, উপনিষদ, গীতা, ভগবত, মনু সংহিতা প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ থেকে উদাহরণ সহযোগে সুললিত কবিতার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে সকলের অশেষ কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। তাঁর এই শুভ প্রচেষ্টা জয়যুক্ত হোক।

ডঃ রমা চৌধুরী,প্রাক্তন উপাচার্য্যা, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

স্মরণাতীত কালের এই সুবর্ণ সূত্রসমূহ অনুসরণ করিয়া শাস্ত্রবেত্তা সুপণ্ডিত বাগ্মী কবিপ্রান ভক্ত নন্দ মহাশয় তাঁহার সার্থক ব্রহ্মবিদ্যা পদাবলী রচনা করিয়াছেন। গীতার ভক্তি ব্যাখ্যানে নন্দ মহাশয়ের সুকৃতি বিদ্বজনের সমাদরণীয় হইয়া রহিল। শাস্ত্র ও সংস্কৃত শিক্ষা প্রচারের পথে অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত নন্দ মহাশয় অশ্রান্তভাবে যে কাজ করিয়া চলিয়াছেন তাহা প্রশংসার অতীত।

জনার্দন চক্রবর্তী, প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও সমালোচক, প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, প্রেসিডেন্সি কলেজ।


পন্ডিতপ্রবর শ্রী জ্যোতির্ময় নন্দ অধ্যাত্ম তত্ত্বের ব্যাখ্যায় ও প্রচারে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপরিচিত। ব্রহ্মবিদ্যা - পদাবলী রচনা তাঁহার এক অভিনব প্রয়াস। তত্ত্বজ্ঞ পদকর্তার পদ রচনা সার্থক হইয়াছে - তাঁহাকে অভিনন্দন জানাই।

চপলাকান্ত ভট্টাচার্য, প্রাক্তন সম্পাদক আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর, প্রাক্তন সাংসদ।


শ্রদ্ধেয় জ্যোতির্ময় নন্দ মহাশয় কে আমি বহুদিন থেকে পরম বৈষ্ণব ও সংস্কৃত সাহিত্যে তাঁর অগাধ জ্ঞান আছে বলে জানতাম। কিন্তু তিনি যে ছন্দে ব্রহ্মবিদ্যা ও শক্তিতত্ত্বকে এমন মধুর ভাবে প্রকাশ করতে পারেন তাঁর ধারণা করতে পারিনি। তিনি প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মশক্তির পরিচয় যেভাবে দিয়েছেন তা শাক্ত বৈষ্ণব সকল ভক্তকে পরিতৃপ্ত করবে। তিনি শক্তি তত্ত্বের মূল কথাগুলি ছন্দের মাধ্যমে প্রকাশ করে ভক্তদের আনন্দদানের ব্যবস্থা করেছেন বলে আমি তাঁকে অভিনন্দন জানাই।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র,আকাশবাণী-খ্যাত প্রখ্যাত নাট্য নির্দেশক

প্রভূত অধ্যায়নবল আর যথার্থ গভীর উপলব্ধি এই দুই বলেই বলিয়ান শ্রীযুক্ত নন্দ তাহার ভাষারীতি স্বচ্ছ ও সাবলীল এবং তার পাণ্ডিত্যের মধ্যে নিরন্তর স্নিগ্ধতার স্বাদ পেয়ে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।

ডক্টর হরপ্রসাদ মিত্র,কবি ও সমালোচক, প্রাক্তন রবীন্দ্র অধ্যাপক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়


দিব্যতটিনী ধর্মামৃতমন্দাকিনী আজ মর্তলোকে অবতীর্ণা- নাম তাঁর ব্রহ্মবিদ্যা পদাবলী। বঙ্গে এই পূর্ণ ধারাটির যিনি বাহক তিনি অশেষ পুন্যকৃত, সার্থকজন্মা শ্রী জ্যোতির্ময় নন্দ। পরপর তিনটি প্রবাহের পীযূষধারায় অবগাহন করে আমার মতো বহু গৌড়জন আজ নতুন করে নিজেদের ভাগ্যবান ও কৃতার্থ মনে করছেন।

মনি বাগচি, জাতীয় জীবনীকার।

নন্দ মহাশয়ের বিদ্যা পুঁথিগত নয়। তেজস্বীনা বধীতবস্তু - এই প্রার্থনা তাঁর ক্ষেত্রে সার্থক হয়েছে। তিনি অধীত বিদ্যার চর্চা, অধ্যাপনা, প্রবন্ধ রচনা, শ্লোক রচনা, গ্রন্থ রচনা করেছেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সংস্কৃত শাস্ত্র সাহিত্যে তাঁর শুধু ব্যুৎপত্তিই নয়, প্রচার প্রসারেও তাঁর উৎসাহ অদম্য। অনুষ্ঠান নিত্যত্বং স্বতন্ত্রমপকর্ষতি - এই কথা বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। কিন্তু এই মহানুভব ভক্ত প্রমাণ করেছেন যে অনুষ্ঠানে রত থেকে ও কর্তব্যের আহ্বানে বিবিধ কর্ম সম্ভব হয়।

ডঃ সুরেশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়,রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্ত প্রখ্যাত সমালোচক ও গবেষক

পাণ্ডিত্যের সঙ্গে সাহিত্যরসের অনবদ্য মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন তিনি। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় তাঁর পাণ্ডিত্য এবং সাহিত্যরসের অপূর্ব সমন্বয় দেখে অবাক হতে হয়। উচ্চতার সঙ্গে তিনি যাপন করে গিয়েছেন সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবন। ব্রাহ্মণের উন্নত জীবনের আদর্শ প্রোথিত ছিল তাঁর হৃদয়ের গভীরে। ব্রাহ্মণের জীবনযাত্রার আদর্শ ছিল তাঁর নিত্যদিনের চর্যার ভক্তিকেন্দ্র আর সেই জীবনের জন্যই তিনি ছিলেন সকলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর জীবন অন্যের মনে সাত্ত্বিক জীবনযাপনের প্রেরণা সঞ্চার করত। ধর্ম যে মানুষকে সত্যিই ধারণ করে রাখে তার ধারনা পাওয়া যেত তাঁকে দেখে।

স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ,মনস্বী সন্ন্যাসী, সম্পাদক, উদ্বোধন, রামকৃষ্ণ মিশন


বিশাল সংস্কৃত সাহিত্যের অধ্যায়ন ও অধ্যাপনায় ছিলেন চিরকাল ব্রতী। রচনা করেছেন অনবদ্য সব গ্রন্থ। বিংশ শতাব্দীতে আবার পদাবলী সাহিত্যের তিনি ছিলেন ভগিরথ ব্রহ্মবিদ্যা পদাবলীর তিনটি খন্ডে ওঁকার তত্ত্ব, গীতা এবং চন্ডী নিয়ে তাঁর ত্রিবিধ কৃতি বঙ্গসাহিত্যে অভিনব সংযোজন, লুপ্ত পদাবলী সাহিত্যকে তিনি এ যুগে সঞ্জীবিত করেছেন। আদ্যোপান্ত পড়ে তার মনীষায় বিস্মিত হয়েছি। গভীর তত্ত্বকে মধুর ভাষায় তিনি মনোজ্ঞ ভাবে তুলে ধরেছেন। অধ্যাত্মজীবনে শ্রী রামদাস বাবাজী মহারাজের কাছে দীক্ষিত হয়ে ও মধুলুব্ধ ভ্রমরের মত তন্ত্রোক্ত পন্থায় সমসাময়িক সকল বরেণ্য মহাত্মার সঙ্গ করেছেন, তাঁদের লোককল্যাণ যজ্ঞে সংযুক্ত হয়েছেন। অসাম্প্রদায়িকতার মূর্ত প্রতীক তিনি। জনগণের মধ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির প্রচলনে, শাস্ত্র মর্যাদার সংরক্ষণে তাঁর ঐকান্তিক নিষ্ঠা দেখেছি। সমাজের কল্যাণে প্রভূত তিনি লিখেছেন - 'আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ' তাঁর জীবনটি ছিল উৎসর্গীকৃত।

ডঃ ধ্যানেশ নারায়ণ চক্রবর্তী,মহামহোপাধ্যায়, ভারতের জাতীয় গবেষণাচার্য


প্রাচীন ভারতের ঋষিপ্রতিম জ্ঞানতপস্বীর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন পণ্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময় নন্দ। তিনি শুধুই যে সংস্কৃতি চর্চায় আত্মমগ্ন ছিলেন, তা নয় তাঁর অমূল্য চিন্তারাশি বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সমাজের পক্ষে এক অমূল্য সম্পদ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মননশীল ও সংবেদনশীল বহু প্রবন্ধ তিনি রচনা করেছেন। প্রবন্ধ গুলি যে কোনো চিন্তাশীল মানুষকে নতুন করে ভাবনা চিন্তা করতে অনুপ্রাণিত করবে। প্রবন্ধ ছাড়াও অজস্র সংস্কৃত ও বাংলা কবিতায় পাওয়া যায় তাঁর কাব্য প্রতিভার সার্থক নিদর্শন।

প্রনবেশ চক্রবর্তী,সাহিত্যিক ও সাংবাদিক, পরিচালক, বিবেকানন্দ স্টাডি সার্কেল, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার

প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে, গভীর থেকে গভীরতর প্রদেশে প্রবেশ করেও বক্তব্যকে বিশদ-প্রাঞ্জল বুঝিয়ে দেওয়ার বিরল ক্ষমতার অধিকার ছিল তাঁর। তাঁর মধ্যে বিবিধ শাস্ত্র বৈবুধ্যে পুলকিত হয়েছি, বিস্মিত বোধ করেছি।

ডঃ রামজীবন আচার্য, প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও গবেষক, প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়


ভারতের প্রাণ ধর্মে, ভারতের গৌরব সংস্কৃতিতে। অসাম্প্রদায়িক ও উদার মনোভাব নিয়ে ধর্ম প্রসঙ্গে আলোচনা করে গিয়েছেন জ্যোতির্ময় নন্দ। গভীরতত্ত্বপলব্ধি ছাড়া উদার অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের অধিকারী হওয়া যায় না। শাস্ত্রজ্ঞান গভীরতার দরুন পণ্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময় নন্দের প্রবন্ধগুলি কালজয়ী হতে পেরেছে।

পবিত্রকুমার ঘোষ,প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক, প্রাক্তন সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, 'বর্তমান'।


জ্যোতির্ময়বাবু কলকাতা সংস্কৃত কলেজ হইতে বি.এ. পরীক্ষায় সংস্কৃতে প্রথম শ্রেণীর অনার্স লাভ করেন। আমার যতদূর মনে পড়ে কৃতিত্বের জন্য তিনি সরকার হইতে মাসিক চল্লিশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। আমরা উভয়ে পরামর্শ করিয়া বিশেষ বিভাগ হিসেবে 'বেদান্ত' লইয়াছিলাম। এখনো আমার মনে আছে, তৎকালীন মহামহোপাধ্যায় অধ্যাপকবর্গ জ্যোতির্ময়বাবুর বুদ্ধি ও তীক্ষ্ণতার ভূয়সী প্রশংসা করতেন। এমন নিরভিমান বিদ্বান ব্যক্তি জীবনে খুব কমই দেখিয়াছি। মহামহোপাধ্যায় দুর্গাচরণ সাংখ্য বেদান্ততীর্থ মহাশয় এর নিকট নিবিড় ভাবে অধ্যায়ন করিয়া পরীক্ষা দিয়া বেদান্ত তীর্থ উপাধি লাভ করেন। পাণিনি ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র, স্মৃতিশাস্ত্র, সাংখ্য, জ্যোতিষ ও তন্ত্র প্রভৃতি শাস্ত্রে তাঁহার গভীর পাণ্ডিত্য রহিয়াছে। জ্যোতির্ময়বাবুর সংস্কৃত শ্লোক রচনা শক্তির পরিচয় পাঠকবর্গ জাহ্নবীতেই পাইবেন। তিনি একজন সংস্কৃত মহাকবি। বহুবার তিনি বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদের সভ্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

ডঃ নরেশচন্দ্র শাস্ত্রী,প্রাক্তন অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

বিভিন্ন হাইস্কুলে, কলেজে ও বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সমিতির সভায় শিক্ষামূলক ভাষণ দেয়ার জন্য তিনি আহুত হয়েছেন। শিক্ষাবিষয়ক ভাষণে তাঁর বৈশিষ্ট্য থাকতো, থাকতো নতুন দিকদর্শন। মনে পড়ে বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী শ্রুতিনাথ চক্রবর্তী সেই ভাষণ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মন্তব্য করেছিলেন জ্যোতির্ময় যে শিক্ষকের শিক্ষক, গুরুর গুরু, এখন পরিচয় পেলাম। গান্ধীবাদী নেতা বিনোবাজীর শিষ্য চারুচন্দ্র ভান্ডারী মহাশয় পুরাতন গুরুকুলের পুনঃপ্রবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন নন্দ মহাশয় এর সভাপতিত্বে।

বানেশ্বর ভট্টাচার্য্য,শিক্ষাবিদ ও সুলেখক


আমি তাঁহার বহু ধর্মসভায় উপস্থিত থাকিবার সৌভাগ্য পাইয়া তদীয় পাণ্ডিত্যপূর্ণ নিগূঢ়তত্ত্ববোধক ধর্মোপদেশ ও সারগর্ভ তেজস্বী ভাষণ শ্রবণ করিয়া ভাববিমুগ্ধ হইয়াছিলাম। তিনি একাধারে সংস্কৃত ভাষায় শ্লেষগর্ভপদ্য নির্মাণে স্বভাবসিদ্ধ কবি, দার্শনিক, গ্রন্থনির্মাতা, সুপ্রবন্ধ লেখক, ধর্মপ্রচারক, আধ্যাত্মিক সাধক ও উদার হৃদয় ধৈর্যশীল ব্যক্তি। আমি সুদীর্ঘকালের মধ্যে কোনদিন তাঁহার ভ্রূকুটি কুটিল ক্রোধভঙ্গি দেখি নাই এবং তাঁহার মুখে কখনও কঠোর রূঢ় কর্কশ শব্দ শুনি নাই। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের মত তিনি শত্রু-মিত্রে সমদর্শী ও সর্বজীবকল্যাণকামী। তাঁহার অনন্যসাধারণ ত্যাগশীলতা ও সংস্কৃত শাস্ত্র চর্চা অক্ষুন্ন রাখার জন্য আত্মোৎসর্গের যে অতুলনীয় মহান অবদান উপস্থাপিত করিয়াছেন, সেই দিগন্ত প্রসারিত কীর্তির আলোকে তিনি চিরভাস্বর চিরস্মরণীয়।

শ্যামাপদ ন্যায়াচার্য,তর্কতীর্থ, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, বালানন্দ সংস্কৃত মহাবিদ্যালয় দেওঘর।


তাঁর সম্পাদক জীবনের বিস্ময়কর সুদীর্ঘকালীন ব্যাপ্তি এক স্মরণযোগ্য ঘটনা। রটনা নয়। অর্ধশতাব্দী কাল ওই পদে সগৌরবে তাঁর অধিষ্ঠান। সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্বের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু তিনি ব্যতিক্রম। বিদ্যালয়-সম্পাদক পদে তাঁর জীবিতাবস্থায় অন্য কেউ যতই যোগ্য হোন না কেন, তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন এটি অকল্পনীয়। এমনকি এমন ভাবনা-চিন্তা, পাপ; তাঁর বিকল্প নেই। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তাঁর দ্বিতীয় কেউ নেই। তিনি অবিকল্প, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি অদ্বিতীয়, অপরিবর্তনীয়। শ্রী জ্যোতির্ময় নন্দই প্রকৃত মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর হাইস্কুল। তিনি স্বয়ং একটি প্রতিষ্ঠান।

তারাপদ মাইতি,প্রখ্যাত বাগ্মী ও সমালোচক, প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর হাইস্কুল

তাঁর ভাবমূর্তি আমার হৃদয়পটে অঙ্কিত হয়ে আছে। পরকে আপন করার অস্বাভাবিক প্রবণতা ছিল তাঁর। তিনি আমাকে তাঁর সন্তানের মত স্নেহ করতেন, যা আমার জীবনের পরম এক প্রাপ্তি। তিনি ছিলেন সত্যের পূজারী, সততা, নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ণতার জীবন্ত প্রতিমূর্তি। এসব গুণপনায় তিনি লাভ করেছেন অন্যদের শ্রদ্ধা সমীহ সমাদর। কলেজ প্রতিষ্ঠায় জ্যোতির্ময়বাবুর সহযোগীরূপে কাজ করতে গিয়ে তাঁর সততা বহুভাবে আমাকে বিস্মিত ও বিমুগ্ধ করেছে। ১৯৫৭ সালে কলেজ গড়ার প্রথম প্রয়াস যখন ব্যর্থ হল, জনসাধারণের কাছ থেকে সংগৃহীত প্রায় ৬০,০০০ হাজার টাকা জনে জনে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। অবাক ও বিমুগ্ধ দেশবাসীর পরম আস্থাভাজন হলেন তিনি। তাইতো কলেজ স্থাপনের দ্বিতীয়বারের প্রচেষ্টায় সাহায্যের আবেদনে অকুণ্ঠভাবে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এলেন তাঁরা। জ্যোতির্ময়বাবুর সংকল্প রূপ পেল, প্রতিষ্ঠিত হল মুগবেড়িয়া কলেজ।

বানেশ্বর মাইতি, বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী, সমাজসেবী ও প্রাক্তন বিধায়ক, প্রাক্তন অধ্যাপক, মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর মহাবিদ্যালয়।


তাঁর মন ছিল সর্ব সংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, মানুষকে সৎপরামর্শ, সৎউপদেশ, চারিত্রিক গুণাবলির উৎকর্ষের জন্য তিনি সারাজীবন বহু গ্রন্থ লিখেছেন, বহু প্রবন্ধ লিখেছেন, বহু বিষয়ে শাস্ত্র ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে প্রকৃত মানুষত্বে উদ্বোধিত করার ব্রতে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন নিরহংকার, নিরভিমান, পরনিন্দা, পরচর্চা থেকে দূরে থাকতেন, এর বহু দৃষ্টান্ত আমি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি। বিনম্রতা ভদ্রতা সম্মানীয় ব্যক্তিকে সম্মান দেওয়া একটি আধ্যাত্মিক শক্তি, এটি দুর্বল স্বভাবের বা স্বার্থপরের অধিগম্য নয়।

শিবকালী মিশ্র,জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত, প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, বেলদা গঙ্গাধার একাডেমী।


পণ্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময় নন্দ মেদিনীপুর তথা বঙ্গপ্রদেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠাত জমিদার। স্বাধীন ভারতে ১৯৫৫ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ঘটে। প্রভুত্ব এবং কাঞ্চন কৌলিন্যের গুরুত্ব হারিয়ে বহু জমিদার যখন দিশেহারা তখন পণ্ডিতপ্রবর স্থিতধী। বিত্তবাসনার আবর্ত অতিক্রম করে চিত্ত উপাসনা এবং শিক্ষা-সংস্কৃতি, ধর্ম ও ঐতিহ্যের আরাধনায় আত্মনিয়োগ করলেন। এই উত্তরন শাশ্বত ভারতের ধারা অনুসরণ, যা স্বল্প শিষ্ট সুশিক্ষিত মানুষের জীবনে ঘটে। সুতরাং জমিদার জ্যোতির্ময় সমাজে এক বিরল ব্যাতিক্রম। আর্থিক জমিদারি হারিয়ে সনাতন ধর্ম, ঐতিহ্য ও শিক্ষা-সংস্কৃতির জমিদারিতে অধিষ্ঠিত হলেন তিনি। এক্ষেত্রে অধিকতর কৃতিত্ব সামাজিক মর্যাদা ও কৌলিন্যের অধিকারী হলেন জনসমাজে। মুগবেড়িয়ার নন্দ পরিবারের জীবনে ঘটল এক অনন্য উত্তরণ। তথা জন্মান্তর। নন্দ পরিবারের এই বৈপ্লবিক বিবর্তনে এক অবিসম্বাদী কৃতিত্ব জ্যোতির্ময় নন্দ মহোদয়ের।

ডঃ হরিপদ মাইতি,প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও ইতিহাসবিদ প্রাক্তন অধ্যক্ষ, মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর মহাবিদ্যালয়।


সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ওঁকে দেখলেই বলতেন ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারি হউক জয়। পণ্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময় নন্দ-র জন্ম ৬ সেপ্টেম্বর ১৯০৮, পূর্ব মেদিনীপুরের মুগবেড়িয়াতে। ম্যাট্রিক থেকে স্কটিশ চার্চের আইএস সি, সংস্কৃত কলেজে অনার্স-সহ বি এ-র সব কটিতেই প্রথম বিভাগ ছিল তাঁর দখলে। পেয়েছিলেন সরকারি বৃত্তি ও গঙ্গামণি পদক। এরপর বেদান্ত নিয়ে এম এ। পরে সিমলা ও রোটক ন্যাশনাল হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ থেকে এম ডি এইচ এবং এমএসসি ডিগ্রী লাভ। অতঃপর ফিরে আসেন প্রপিতামহ প্রতিষ্ঠিত চতুষ্পাঠীতে ততদিনে সেটি মহাবিদ্যালয় স্তরে উন্নীত। শিক্ষাদানের সঙ্গেই জ্যোতির্ময়ের অবশ্যকর্তব্য ছিল সমাজসেবা। পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি মিলেছে বিদ্যাভূষণ, ভক্তি চক্রবর্তী, বেদান্ততীর্থ, স্মৃতিবিশারদ উপাধিতে। বেশ কিছু বই ও বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। ৫ নভেম্বর ১৯৯৬-এ প্রয়াত হন। জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে সম্প্রতি বাংলা আকাদেমিতে এক অনুষ্ঠানে শুরু হল প্রথম বার্ষিক স্মারক বক্তৃতা। প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রচিত কয়েকটি বই। পরিকল্পনা আছে শতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ এবং ছড়িয়ে থাকা লেখা সংকলনের।

আনন্দবাজার পত্রিকা।


আমার পরম পূজ্য পিতৃদেব (শিবকালী মিশ্র, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত, প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, বেলদা গঙ্গাধার একাডেমী), বেলদা গঙ্গাধর একাডেমির প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শিবকালী মিশ্র , পণ্ডিতপ্রবরের অত্যন্ত স্নেহধন্য ছিলেন। পণ্ডিতপ্রবর বহুবার বেলদায় আমাদের বাড়িতে এসেছেন। আমার পিতৃদেবও বহুবার মুগবেড়িয়ায় পণ্ডিতপ্রবরের বাড়িতে গিয়েছিলেন। দু-জনের মধ্যে আত্মার নিবিড় বন্ধন ছিল। যখন তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন, তখন দেখতাম, দু-জনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন ধরনের আলোচনায় নিবিড় মগ্ন থাকতেন। বেদ-উপনিষদ, বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্ত পদাবলী, চাণক্য শ্লোক আরও কতো কী। কেমন করে যে সময় বয়ে যেতো কেউ টের পেতেন না। অনেক অনেক সুখদিন অনেক গৌরবকাল দু-জনে দু-জনের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন। সেসব বলা সময় সাপেক্ষ। তা নয়, আজ শুধু একটা ঘটনার কথা বলি - যা আজও আমার কাছে বিস্ময় ! সত্যি বলতে কী, এই ঘটনাটি বলার জন্যই আমার এই লেখার স্বতোপ্রণোদিত প্রকাশন। পণ্ডিতপ্রবর লোকান্তরিত হয়েছেন - খবরটি এলো দূরভাষ বাহিত হয়ে। এদিকে তখন আগের দিন রাত্রি থেকে আমার পিতৃদেব বেশ অসুস্থ। খবর জেনে আরও অস্থির হয়ে উঠলেন। আমায় বললেন মুগবেড়িয়া যেতে, পণ্ডিতপ্রবরকে প্রণাম জানিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। আমি ইতস্তত করছিলাম। এই অবস্থায় ওঁকে ছেড়ে কোথাও যেতে মন সায় দিচ্ছিলো না। কিন্তু পিতৃদেবের অস্থিরতায় ও বিষণ্ণতায় শেষ পর্যন্ত মুগবেড়িয়া এলাম। ততক্ষণে তাঁর পবিত্র নশ্বর দেহ কোলকাতার হাসপাতাল থেকে মুগবেড়িয়ার বাড়িতে আনা হয়েছে। শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁর পদযুগল স্পর্শ করা মাত্র আমি বিস্ময়ে চমকিত হলাম। এ কী ! কী করে এমন হতে পারে ! প্রায় আঠারো ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে , তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন , অথচ এখনও তাঁর শরীরে উষ্ণতা বিরাজমান! এও সম্ভব! এখন তো দেহ বরফ-শীতল থাকার কথা। কী আশ্চর্য! এ কীসের উষ্ণতা! এ কী সৎ অধ্যয়ন, সৎ চিন্তন, সৎ মনন ও সর্বোপরি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরে সমর্পণ - এইসবের বিকীরণ !!! কে জানে! হয়তো তাই।

বিনায়ক মিশ্র, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক (৭.৯.২০২০)।


তাঁর রচিত গ্রন্থঃ-


(১) জ্যোতির্ময় রচনাঞ্জলি

(২) মঙ্গল ভারতী

(৩) মঙ্গলালোক

(৪) মাতৃ দর্শন

(৫) ভজন মঙ্গলম

(৬) শক্তি পূজার মহত্ব

(৭) উপাসনা বিজ্ঞান

(৮) ছয় স ভাবনা

(৯) ব্রহ্মবিদ্যা পদাবলী (তিন খন্ড ) ইত্যাদি।


অরিন্দম ভৌমিক।

midnapore.in

(Published on 07.09.2020)

তথ্যসূত্র:-

(১) মহামহোপাধ্যায় ডঃ ধ্যানেশ নারায়ণ চক্রবর্তী রচিত জ্যোতির্ময় বন্দনা , ৪ঠা ভাদ্র, ১৪১৮

(২) ঈশ্বর চন্দ্র প্রামাণিক, গান্ধীবাদী সমাজকর্মী ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক

(৩) জন্মশতবর্ষে জ্যোতির্ময় প্রণাম -মন্মথনাথ দাস (বাংলা একাডেমি সভাগৃহে আয়োজিত "জন্মশতবর্ষ স্মারক বক্তৃতা" সভা উপলক্ষে 'সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের')

(৪) বানেশ্বর মাইতি, বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী, সমাজসেবী ও প্রাক্তন বিধায়ক, প্রাক্তন অধ্যাপক, মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর মহাবিদ্যালয়।

(৫) ডঃ হিরণ্ময় বন্দোপাধ্যায়, প্রাক্তন উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

(৬) জ্যোতির্ময় রচনাঞ্জলি - চৈতন্যময় নন্দ সম্পাদিত, সংস্কৃত পুস্তক ভান্ডার

(৭) আনন্দবাজার পত্রিকা