দুর্গা শঙ্কর দীর্ঘাঙ্গী।
চন্দ্রকোনার আঞ্চলিক কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, পুরাবৃত্ত অনুরাগী ,চন্দ্রকোণা সংগ্রহ শালার প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষক,শ্রী কানাই লাল দীর্ঘাঙ্গী।
শ্রী কানাই লাল দীর্ঘাঙ্গী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ খৃষ্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর চন্দ্রকোণা শহরের জয়ন্তীপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে। পিতার নাম শ্রী শশীভূষণ দীর্ঘাঙ্গী, মাতার নাম চারুবালা। পিতা ছিলেন তেজস্বী পুরুষ , সদানন্দময়, তৎকালীন টোল পণ্ডিত, মহাত্মা গান্ধীর একনিষ্ঠ ভক্ত। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বহু বিপ্লবীদের নিজ গৃহে আশ্রয় ও আহারারি দিতেন। তিনি ছিলেন ভাল অভিনেতা ও ধামার গানের ওস্তাদ ছিলেন। সংসারের খরচ চলত চাষবাস, যজমানদের বাড়ির নিত্য পূজার মাধ্যমে।
শৈশব কালে কানাইলাল রুগ্ন ছিলেন। তাঁর চিকিৎসক ছিলেন তখনকার সনামধন্য কবিরাজ বগলা চরণ ও স্থানীয় বিভিন্ন চিকিৎসক প্রমুখ। পরে বাঁকুড়া রামকৃষ্ণ মিশনের সনামধন্য চিকিৎসক স্বামী মহেশ্বরানন্দজীর চিকিৎসায় আরোগ্য লাভ করেন। পরে যোগাভ্যাস, প্রাণায়াম করে শরীরের উন্নতি করেন। ইনি প্রথমে গ্রামের রসময় চন্দ মহাশয়ের পাঠশালা, তৎপরে চন্দ্রকোণা জীরাট উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয় ও তৎপরে মেদিনীপুর মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেন। আই এ পরীক্ষার সময়ে তিনি মেনিনজাইটিস (Meningitis) রোগে আক্রান্ত হন। তৎকালীন কুমারগঞ্জ গ্রামের রাজবৈদ্য সৌরিন্দ্র কবিরাজ ও রঞ্জিত কুমার কবিরাজের চিকিৎসাধীনে আরোগ্য লাভ করেন।
কানাইলাল তাঁর "ভগ্ন দেউলের ইতিবৃত্ত" বইতে লিখেছেন "আমি যখন মেদিনীপুর মহাবিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করি, তখন আমার এক বন্ধু বলেন, 'তুমি খাস চন্দ্রকোণার লোক, তুমি কিছু ঐ পুরানো শহর সম্বন্ধে লিখ না।' সেই আমার 'ঐতিহাসিক চন্দ্রকোণা' নামক প্রথম কবিতা লেখা।" "আমি যখন ছেলে বেলায় ঠাকুরমার সঙ্গে এখানকার বিভিন্ন মঠ ও মন্দিরে বারো মাসের তের পরব দেখতে যেতাম ও তাঁর মুখে নানান ইতিকথা-উপকথা শুনতাম; তখন থেকেই এই সুপ্রসিদ্ধ দেবায়তনগুলির অমর দেব-কীর্ত্তি ও মধূময় জনশ্রুতি আমার চিত্তকে বিশেষ ভাবে উদ্বেলিত করতো। সেই থেকে আমার জীবনে আরো প্রায় বিশটি বছর অতিবাহিত হয়েছে। এরই মধ্যে কতো রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন ঘটলো। ঘটলো কত ঝড়, ঝঞ্ঝা, দুর্ভিক্ষ....... কত সমস্যা এলো আর গেলো। বয়ো:বৃদ্ধির সাথে সাথে ঐতিহাসিক শহরের সাথে আরো নিবিড় ভাবে পরিচিত হ'লাম। কতো দেখলাম...... শুনলাম...... জানলাম। যা দেখেছি, তা হ'ল এত অতি প্রাচীন সমৃদ্ধশালী জনপদের অস্থিচূর্ণবাহী বর্তমান চন্দ্রকোণা। উপবাসী দেবতা, মানুষ আর প্রেতাত্মাদের কান্না যা শুনেছি; আর যা জেনেছি, তা হ'ল এখানকার নানান ইতিকথা, উপকথা আর ইতিহাস। সত্যই এ হলো এক দ্বিতীয় মহেঞ্জোদাড়ো..... মৃতের সমাধি। " - ভগ্ন দেউলের ইতিবৃত্ত (১৩৭৬ সাল)।
কানাইলাল দীর্ঘাঙ্গী স্থানীয় ভৈরব পুর গ্রামবাসীদের অনুরোধে ভৈরবপুর উ: প্রা: বিদ্যালয়ে কিয়ৎকাল প্রধান শিক্ষকের পদে কার্য্য করেন। ঠিক এই সময়ে চিঙ্গুড়কশা জরীপ বিজ্ঞান স্কুল হইতে কৃতিত্বের সহিত সার্ভে ও লেভেলিং ট্রেনিং প্রাপ্ত হন। এসময়ে চন্দ্রকোণা পৌরসভার ভূতপূর্ব প্রতি স্বর্গীয় সুরেন্দ্রনাথ সাঁতরা মহাশয়ের আহ্বানে ইনি চন্দ্রকোণা পৌর দপ্তরে ওভারসিয়ার পদে কার্য্য গ্রহণ করেন। ঐ স্থলেই ইনি প্রায় ১৪ বৎসর কাল অত্যন্ত সুনামের সহিত ঐ কর্মে রত থাকেন। ঐ সময় পুর দপ্তর পরিদর্শককে সঙ্গে নিয়ে প্রাচীন শহর চন্দ্রকোণা নগরী ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন।
পরিদর্শক মহাশয় কানাই বাবুকে জিজ্ঞাসা করেন - " আচ্ছা কানাইবাবু ! চন্দ্রকোণার লালগড়, রামগড়, রঘুনাথগড়, দেউলডাঙ্গার মন্দির, হরিসিংপুরের কুচারগড়, কিরাতগড় ও বারদুয়ারী রাজ প্রাসাদের এতো পাথর কোথায় গেল? "
উত্তরে কানাইবাবু বলেন - "East India Company -র আমলে সেই সময় ভগ্ন ইমারতের পাথর নিয়ে রাংচায় সাহেব কোম্পানী জানাই নদীর উপর সুবৃহৎ বাঁধ তৈরি করেছে এবং পরবর্ত্তী কালে হয়েছে শোলাগ্যেড়ার মড়াখালির উপর বাঁধ, গোপসাই-এ খাল বাঁধ, গুড়্যাপুকুরের ঘাট ইত্যাদি তৈরি। কিন্তু কেউই এই ঐতিহাসিক স্মৃতিকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন নি। তৎকারণে এই সব স্থানের বহু প্রত্ন সামগ্রী, সম্পদ লুটপাট হয়ে গিয়েছে।"
আচ্ছা ঐতিহাসিক যুগে এই নগরীর তেমন কোন অত্যাচারের হদিস পান নি?
উত্তরে কানাইবাবু বলেন - " চন্দ্রকোণার স্বাধীন রাজারাই ছিল প্রকৃত ভূঞা, এঁরা কোনদিন গৌড়ের সুলতান ও দিল্লীর মুঘল বাদশাহ গণের কাছে সহজে মাথা নত করেন নি। এই সমস্ত রাজারা বার বার বিদ্রোহ করেছেন, এই সুযোগে দিল্লীর বাদশাহী ফৌজ, গৌড়ের সুলতান, বর্ধমান ও বিষ্ণুপুরের রাজারা এখানে লুটপাট করেছে। তাই চন্দ্রকোণা ধ্বংস হয়েছে ।"
কানাইবাবু জন্মভূমিকে আকৈশোর ভালোবাসতেন। বাবা আঞ্চলিক ইতিহাস লেখার উৎসাহ , প্রেরণা পেয়েছিলেন এনাদের অনূপ্রেরণা থেকে। ১৯৭৬ খ্রীস্টাব্দের শুভ দোলপূর্ণিমার তিথিতে ভগ্ন দেউলের ইতিবৃত্ত (প্রথম খণ্ড) নামক ঐতিহাসিক ধর্মগ্রন্থ প্রণয়ন করে বহু বিদগ্ধ জনের শ্রদ্ধাভাজন হন। সেই সময়, প্রবাসী, যুগান্তর প্রভৃতি পত্রিকা ও খবর কাগজে পুস্তিকার উপর মন্তব্য করা হয়। ড: রমা চৌধুরী, অধ্যাপক বিনয় ঘোষ ও ডেভিড ম্যাক্কচন সাহেব এই বইটির উপর উচ্চ মন্তব্য করেন। দীর্ঘদিন ধরে পরিশ্রম করে নানা স্থান থেকে বিভিন্ন পুরাবস্তু, সামগ্রী সংগ্রহ করে একক প্রচেষ্টায় অর্থব্যয়ে চন্দ্রকোণা সংগ্রহশালা গড়েছিলেন। নিজে নির্ভিক, সৎ ছিলেন। সেইজন্য সহ-পৌরপতির সঙ্গে মতের মিল না থাকার জন্য স্থায়ী চাকূরী থেকে ইস্তফা দিয়ে গোপেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। সরকারী জরীপ বিভাগের উচ্চ পদের চাকুরী গ্রহণ না করার কারণ ছিল প্রিয় জন্মভূমি , মেদিনীপুরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগ্রহশালার নাম "চন্দ্রকোণা সংগ্রহশালা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র' "। গত ১৯৮০ সালের ৪ অক্টোবর পশ্চিম বঙ্গ সরকারের ভূতপূর্ব Director of Archeology মাননীয় পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত মহাশয় চন্দ্রকোণার রঘুনাথ বাটীর কাচারী বাড়ীতে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই প্রতিষ্ঠানের দ্বারোদ্ঘাটন করেন। সেই শুভ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ড: শ্যামচাঁদ মুখার্জী, Superintendent of Archeology, Govt.of West Bengal, উক্ত জীর্ণ বাটীতে ৩-৪ বছর সংগ্রহ শাখাটি ছিল। এছাড়া দুর্বৃত্ত গণের অত্যাচারে বহু পুরাবস্তু নষ্ট হয়ে যায়। পরে বাধ্য হয়ে সংগ্রহ শালাটি নয়াগজ্ঞের বড় অঞ্চল এ স্থানান্তরিত করা হয়।
মঠাধ্যক্ষ রামদাস রামানুজ দাস মোহান্ত কিছু দিনের জন্য রাখার অনুমতি দেন। নিরাপত্তার কারণে ঐ স্থানে স্থানান্তরিত করেন। ঐ সময় প্রতি শনিবার বিকেলে ২টা থেকে ৪টা এবং চন্দ্রকোণার রথ, ঝুলন পুষ্যা মেলার সময় সকাল থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত দর্শকদের বিনামূল্যে মিউজিয়ামের অমূল্য পুরাবস্তু দেখিয়েছেন। এখানে বেশি দিন সংগ্রহ শালাটি রাখতে পারেননি নি, পরে নিজ বাটিতে স্থানান্তরিত করেন।
midnapore.in