দ্বিজ রামেশ্বর : এক কবি ও সাধকের কথা | Poet Dwija Rameswar | कवि द्विज रामेश्वर

দ্বিজ রামেশ্বর : এক কবি ও সাধকের কথা

Poet Dwija Rameswar | कवि द्विज रामेश्वर

সুতনু ঘোষ।


'মেদিনীপুর গর্ব করিতে পারেন যে , তিনি রামেশ্বরের ন্যায় কবিকে একসময়ে তাঁহার বক্ষে পোষণ করিয়াছিলেন ।' - রামগতি ন্যায়রত্ন



মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে দ্বিজ রামেশ্বরের নাম উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা রয়েছে । কবির লেখা শিবায়ণ ও সত্যনারায়ণের পাঁচালী বাংলার ঘরে ঘরে , পূজাপার্বন , উৎসবগুলিতে অপরিহার্য অংশ হিসেবে জড়িয়ে রয়েছে । তার লেখায় যেমন পৌরাণিক ও লৌকিক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তেমনই উঠে এসেছে সমসাময়িক মেদিনীপুরের নানা কথা । তবে রামেশ্বর শুধুমাত্র কবিই ছিলেন না । একনিষ্ঠ ভক্ত ও সাধক হিসেবেও তার পরিচয় পাওয়া যায় ।


দ্বিজ রামেশ্বর : এক কবি ও সাধকের কথা | Poet Dwija Rameswar | कवि द्विज रामेश्वर
রামেশ্বরের বাস্তুভিটা। ছবিঃ শ্যামাপ্রসাদ চক্রবর্তী ( যদুপুর নিবাসী গবেষক )।

উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে কবি ও সাধক রামেশ্বরের জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না । তবে কবির লেখনীর ওপর ভিত্তি করে এবং কর্ণগড় ও চেতুয়া বরদা অঞ্চলে প্রচলিত কাহিনীর মধ্য দিয়ে কবিজীবনীর একটি ধারণা পাওয়া যায় ।

কবি রামেশ্বরের গুরু চন্দ্রচূড় চক্রবর্তীর বংশধর পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তীর একটি জীর্ণ রোজনামচা থেকে জানা যায় কবি আনুমানিক ১৬৭৭ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন । কবির নিবাস , পরিচয় , জীবনের কয়েকটি ঘটনাবলী তিনি নিজকাব্যমধ্যেই লিখে গিয়েছেন ।

সত্যনারায়ণের কথায় তিনি লিখেছেন -


" সাকিম বরদাবাটী যদুপুর গ্রাম "


পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটালের কাছে তৎকালীন বরদা পরগণার অন্তর্ভুক্ত গ্রাম যদুপুর ।

এই অঞ্চলে এককালে কয়েকটি গোয়ালা পরিবার বসবাস শুরু করেছিল । যদুবংশীয় কথাটি থেকে যদুপুর নামটি এসেছে ।

কবি রামেশ্বর তার কাব্যগুলিতে নিজের পদবি সম্পর্কে কিছু উল্লেখ না করায় এই নিয়ে দুটি মত প্রচলিত আছে ।

কবির লেখায় পাওয়া যায় -


" ভট্টনারায়ণ মুনি সন্তান কেশরকণী

যতি চক্রবর্তী নারায়ণ ।

তস্য সুত কৃত কীর্তি গোবর্ধন চক্রবর্তী

তস্য সুত বিদিত লক্ষণ ।

তস্য সুত রামেশ্বর শম্ভুরাম সহোদর

সতী রূপবতীর নন্দন ।

সুমিত্রা পরমেশ্বরী পতিব্রতা দুই নারী

অযোধ্যানগর নিকেতন ।। "


বাংলার রাজা আদিশূর পুত্রেষ্ঠি রাজসূয় যজ্ঞ করার জন্য কান্যকুব্জ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণকে নিয়ে এসেছিলেন । তাদের একজন ছিলেন মহর্ষি ভট্টনারায়ণ । তার একজন পুত্র নৃপের বংশধর সর্বকেশরকোণী মানভূম থেকে মেদিনীপুরে এসে বসবাস শুরু করেন । এরা মধ্যদেশীয় রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত ছিল । অনেকের মতে , শান্তিল্য গোত্রীয় ব্রাহ্মণদের প্রাচীন রীতি অনুযায়ী তার পদবি ছিল বন্দ্যোপাধ্যায় । পরবর্তীকালে এই পদবি পরিবর্তন হয়ে চক্রবর্তী হয় । এই বংশেই জন্মগ্রহণ করেন কবি রামেশ্বর ।


দ্বিজ রামেশ্বর : এক কবি ও সাধকের কথা | Poet Dwija Rameswar | कवि द्विज रामेश्वर
শোভাসিংহের মারণযজ্ঞস্থল। ছবিঃ শ্যামাপ্রসাদ চক্রবর্তী ( যদুপুর নিবাসী গবেষক )।

কবির প্রপিতামহ নারায়ণ চক্রবর্তী তপোনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ ছিলেন । পিতামহ গোবর্ধন চক্রবর্তী ছিলেন বেদবিদ্যাবিশারদ । তাই অনেকে কবি রামেশ্বরকে শান্তিল্য গোত্রীয় চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ হিসেবে বলেছেন ।

তবে ভট্টাচার্য্য পদবির সমর্থকগণ বলে থাকেন - পরে হয়ত কবির পিতা তুতাটভট্টের মীমাংসা ও উদয়ণ আচার্য্যের ন্যায় সংগ্রহে বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করেন অথবা সর্বদর্শনের অধ্যাপক হিসেবে খ্যাতিলাভ করে ভট্টাচার্য্য উপাধি পেয়েছিলেন ।



১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে সংবাদ পূর্ণ চন্দ্রোদয় যন্ত্রে প্রকাশিত শিবায়ণ এবং ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গবাসী স্টীম মেশিন প্রেস থেকে প্রকাশিত শিবায়ণে কবির নাম রামেশ্বর ভট্টাচার্য্য বলে উল্লেখ আছে ।

কবির লেখা থেকেই জানা যায় তার বাবার নাম লক্ষণ , মায়ের নাম রূপবতী , ভাই শম্ভুরাম , তিন বোন পার্বতী , গৌরী ও সরস্বতী , দুজন স্ত্রী সুমিত্রা ও পরমেশ্বরী । এছাড়া দুর্গাচরণসহ ছয়জন ভাগ্নে , ভাগ্নীপুত্র কৃষ্ণরামের কথা উল্লেখ করেছেন রামেশ্বর । কিন্ত তার কোনও লেখায় তার সন্তানের কথা না থাকায় এবং এ বিষয়ে কোনও তথ্য আবিষ্কার না হওয়ায় মনে করা হয় তিনি নিঃসন্তান ছিলেন ।

রামেশ্বরের যখন অন্নপ্রাশন হয় , সেসময় একটি বড়ো থালায় তালপাতার পুঁথি , বাঁশের কলম , রূপার মুদ্রা , সিঁদুর কৌটো , সাদা ও লালফুল সামনে রাখা হল । শিশু রামেশ্বর ডানহাতে তুলে নিলেন কলম , বাম হাতে রক্তজবা ।


দ্বিজ রামেশ্বর : এক কবি ও সাধকের কথা | Poet Dwija Rameswar | कवि द्विज रामेश्वर
রামেশ্বরের সাধনাস্থল। ছবিঃ শ্যামাপ্রসাদ চক্রবর্তী ( যদুপুর নিবাসী গবেষক )।

রামেশ্বরের বাবার একটি চতুষ্পাঠী ছিল । কয়েক বছরের মধ্যে বেদ , উপনিষদ , স্মৃতি , দর্শন , পুরাণ ও বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যয়ণ করলেন কবি । পুরাণ পাঠক হিসেবে তার ডাক আসতে লাগল বিভিন্ন শিক্ষায়তন থেকে ।

তৎকালীন চেতুয়া বরদা অঞ্চলের জমিদার ছিলেন ' বাংলার শিবাজী ' নামে খ্যাত শোভাসিংহ । বরদাতে তিনি পরিখাঘেরা সুরক্ষিত গড় নির্মাণ করেছিলেন । এই গড়ে বিশালাক্ষী মন্দির প্রতিষ্ঠা ও নিত্যপুজার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল রামেশ্বরকে ।

কোনও বাগদীর মন্দিরে পুজার্চনা করবেন না বলে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন কবি ।

শোভাসিংহ এরপর একজন ব্রাহ্মণ গঙ্গারাম বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিশালাক্ষী মন্দিরের পূজারি নিযুক্ত করেন ।



একবার দুজন স্ত্রীকে নিয়ে কাপাসটিকরী গ্রামে মামার বাড়িতে গিয়েছিলেন রামেশ্বর । সেখান থেকে কর্ণগড়ে ঘুরতে যান মামার ছেলের সাথে ।

কর্ণগড় দুর্গ , ভিতরগড় , বাহিরগড় , পারাং নদী , মহামায়া ও দন্ডেশ্বর মন্দির চত্বর ঘুরে দেখেন কবি ।

মহামায়া মন্দিরে কবির সাথে দেখা হয় তান্ত্রিক চন্দ্রচূড় চক্রবর্তীর । রামেশ্বর তার কাছে তন্ত্রমতে দীক্ষালাভ করে কামরূপ কামাখ্যা তীর্থদর্শনে যান ।

পরে যদুপুর গ্রামে ফিরে এসে একটি বটগাছের নীচে চক্রাসন তৈরী করে সাধনা শুরু করেন ।

যদুপুরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম খড়ার । একবার সেখানে শুরু হল কলেরা ও বসন্তের উপদ্রব । এইসময় রামেশ্বর রচনা করলেন ' শীতলামঙ্গল ' , যা ' মগপূজা কাহিনী ' নামে পরিচিত ।


" শীতলামঙ্গল দ্বিজ রামেশ্বর গায়

হরি হরি বল সবে পালা হৈল সায় ।। "


ঔরঙ্গজেবের শোষণ ও অসহিষ্ণুতা নীতির বিরুদ্ধে তৎকালীন বহু রাজা ও জমিদারেরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে । হিন্দু - মুসলিম পারস্পরিক দ্বন্দ্বের নানা দৃষ্টান্ত ফুটে উঠতে থাকে সমাজের নানা স্তরে ।

চেতুয়া বরদা অঞ্চলের জমিদার শোভাসিংহ ও তার ভাই হেমৎ সিংহ সেসময় পার্শ্ববর্তী ছোটবড় নানা বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে একত্রিত করে বিদ্রোহের পরিকল্পনা সাজাতে থাকে ।

এসময় কবি রামেশ্বর লিখলেন অপর এক কাব্য ।

স্কন্দপুরাণের রেবাখন্ডে বর্ণিত সত্যনারায়ণের কাহিনীকে মুসলিম পীরের রূপে উপস্থাপন করলেন " সত্যনারায়ণ পাঁচালী " - তে ।


" কলিতে যবন দুষ্ট হৈন্দবি করিল নষ্ট

দেখি রহিম বেশ হৈলা রাম । "


এই কাব্যের মধ্য দিয়ে তার উর্দু , ফারসী ও হিন্দীতে দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় । মোগল যুগে নবাব দরবারে উর্দু , ফারসী ভাষার প্রচলন ছিল । তাই পন্ডিতেরা সংস্কৃতের সাথে সাথে এসব ভাষাও রপ্ত করত । রামেশ্বরও অধ্যয়ণ ও চর্চার মাধ্যমে ভাষাগুলিতে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন ।


দ্বিজ রামেশ্বর : এক কবি ও সাধকের কথা | Poet Dwija Rameswar | कवि द्विज रामेश्वर
"স্থাপিয়া কৌশিকী তটে "। চিত্রাঙ্কন: সায়ন ঘোষ।

একদিন বরদারাজ শোভাসিংহ ঘোড়ার পিঠে চলেছেন যদুপুর দীঘির পাশের রাস্তা দিয়ে । সেই দীঘিতে স্নান করে ফিরছিলেন রামেশ্বরের স্ত্রী সুমিত্রা । তার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ শোভাসিংহ তাকে জোর করে ঘোড়ায় তুলে নিলেন । সুমিত্রা প্রাণপণে আত্মরক্ষার চেষ্টা করায় তাকে পথের ধারে ফেলে শোভাসিংহ চলে গেলেন । এই ঘটনার পরে যদুপুরের ব্রাহ্মণসমাজ রামেশ্বরকে স্ত্রীকে ত্যাগ করার জন্য চাপ দিতে থাকে । এ সিদ্ধান্ত রামেশ্বর না মেনে পিতৃভিটে ছেড়ে কিছুদূরে কুটীর নির্মাণ করে থাকতে লাগলেন ।

রামেশ্বর শোভাসিংহের অপকর্মের কথা ভুলতে পারেননি। তিনি যে বট গাছের নীচে বসে সত্যনারায়ণের পাঁচালী লিখেছিলেন তার কাছেই বামন পুকুরের এক কোণে পঞ্চমুন্ডির আসন তৈরী করলেন । গুরু চন্দ্রচূড় চক্রবর্তী এসে তাকে সাহায্য করেছিলেন এই কাজে। এরপর বন্হিকুণ্ড প্রস্তুত করে রামেশ্বর শুরু করলেন শোভাসিংহের মারণযজ্ঞ । এ কথা জানতে পেরে শোভাসিংহের স্ত্রী অজিতা সুন্দরী রামেশ্বরের পায়ে লুটিয়ে পড়ে প্রাণভিক্ষা চাইলেন। রামেশ্বর তার কথা মেনে নিয়ে মারণযজ্ঞ বন্ধ রাখলেন ।



শোভা সিংহ ও তার স্ত্রী একাজ মেনে নিতে পারেননি । অপরাধের সাজা হিসেবে অজিতা সুন্দরীকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল তৎকালীন সুতানুটি গোবিন্দপুর এর কাছে চৌরঙ্গীর জঙ্গলে এক সাধুর আশ্রমে।

মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে শোভাসিংহের বিদ্রোহের সময়কাল ১৬৯৫ - ৯৬ খ্রীস্টাব্দ । তিনি বর্ধমান রাজ কৃষ্ণরাম রায়কে হত্যা করে বর্ধমান দখল করেন । কিছু দিনের মধ্যেই গঙ্গার পশ্চিমের একটি বড়ো এলাকা তার অধীনে আসে । কিন্তু তার কয়েক দিনের মধ্যেই শোভাসিংহের মৃত্যু হয়। শোনা যায় , জোর করে কৃষ্ণরাম রায়ের কন্যা সত্যবতীর সম্ভ্রম লুণ্ঠনের সময় সত্যবতীর ছুরির আঘাতে তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনার খবর শুনে আনন্দিত রামেশ্বর লিখলেন--


" হেরি শোভা ভোগবতী বর্ধমানে গেল ছুটি

সত্যবতীর লুটিতে যৌবন ।

ভগবতীর রোষানলে বক্ষবিদ্ধ হল শেলে

ধ্বংস হল কলির রাবণ । "


লোকের মুখে মুখে এই গান প্রচারিত হওয়ায় তা এসে পৌছালো শোভাসিংহের ভাই হেমৎ সিংহের কানে । হেমৎসিংহ রামেশ্বরের যদুপুরের বাড়ি ভেঙ্গে তাকে গ্রামছাড়া করতে বাধ্য করলেন । রামেশ্বর যদুপুর ত্যাগ করে তার দুই স্ত্রীকে নিয়ে কাপাসটিকরী গ্রামে মামাবাড়িতে এসে উঠলেন ।

কর্ণগড় এর রাজা রাম সিংহ অযোধ্যানগরে তার বসবাসের ব্যবস্থা করে তাকে পুরানপাঠক নিযুক্ত করলেন । কবি লিখেছেন--


" পূর্ববাস যদুপুরে হেমৎ সিং ভাঙ্গে যারে

রাজা রামসিংহ কৈল প্রীত

স্থাপিয়া কৌশিকী তটে বরিয়া পুরাণ পাঠে

রচাইল মধুর সঙ্গীত । "


এই অযোধ্যানগর কেশপুরে অবস্থিত , যার বর্তমান নাম অযোধ্যাবাড়। এটি কংসাবতী ও রূপনারায়ণের সংযোগকারী একটি খালের পাশে অবস্থান করছে । এখান থেকে কংসাবতীর দূরত্বও খুব বেশি নয়। তাই কবি কৌশিকী বলতে সম্ভবত কংসাবতীকেই উল্লেখ করেছেন । রামেশ্বর এরপর বিভিন্ন তীর্থ দর্শন করতে লাগলেন এবং পুনরায় কাব্য রচনায় মনোনিবেশ করলেন। কবি এরপর লিখেছিলেন সত্যনারায়ণের উপপাঁচালী ' আখোটি পালা '। লিখেছিলেন ' গোবিন্দমঙ্গল ' , যাতে তিনি শ্রীকৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্ত থেকে বৈকুণ্ঠগমন পর্যন্ত কাহিনী বর্ণনা করলেন।

অযোধ্যা নগরে রামেশ্বরের একটি যোগাসন ছিল। কর্ণগড় এর মহামায়া মন্দিরেও তার একটি পঞ্চমুন্ডীর যোগাসন ছিল । এখানে রামেশ্বর এবং রাজারাম সিংহের পুত্র যশোবন্ত সিংহ সিদ্ধিলাভ করেছিলেন । তবে এর আগে মহামায়া মন্দির চত্বরের পশ্চিমদ্বারের ওপর নির্মিত যোগীখোপা বা যোগমন্ডলে কবি যোগাভ্যাস করতেন ।



১৭১১ খ্রিস্টাব্দে রামসিংহের মৃত্যু হলে যশোবন্ত সিংহ কর্ণগড়ের রাজা হন । রামেশ্বর এইসময় শিবায়ন রচনা শেষ করে তার সভায় পাঠ করেন । সপ্তদশ শতক থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত শিবায়ন ধারার যে সমস্ত লেখনীর কথা জানা গেছে রামেশ্বরের শিবায়ন সেগুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় । কবি রামেশ্বর তার কাব্য কে বলেছেন 'ভবভাব্য ভদ্রকাব্য '।

ভবভাব্য অর্থাৎ কাব্যের চিন্তনীয় দেবতা শিব , ভদ্রকাব্য অর্থাৎ ভদ্রজনের শ্রুতিযোগ্য কাব্য ।

সমসাময়িক সামাজিক জীবনের রুচি ও রসবোধ ব্যবহার করে শিবের গৃহস্থ জীবন অনন্য উপায় ফুটিয়ে তুলেছেন কবি । কর্ণগড় এর দণ্ডেশ্বর শিব মন্দিরের দক্ষিণ অংশে বসেই তিনি রচনা করেছিলেন শিবায়ন কাব্য ।

রাজা যশোবন্ত ও কবি রামেশ্বরের নানা কাহিনী প্রচলিত আছে ।



একদিন রাজা রামেশ্বর কে জিজ্ঞাসা করলেন -- আজ কোন তিথি ? রামেশ্বর জানালেন - আজ পূর্ণিমা । কিন্তু সেদিন ছিল অমাবস্যা ।

রামেশ্বর নিজের ভুল বুঝতে পেরে মহামায়ার কাছে প্রার্থনা জানালেন । মহামায়া বললেন - আজ রাতে রাজাকে মন্দিরে নিয়ে আসো । রাতে রাজা মন্দিরে এসে দেখলেন কোথায় অমাবস্যা ! পূর্ণচন্দ্রের উদয় হয়েছে যেন। ভগবতী তার বাম হাতের বলয় উত্তোলন করে দেখিয়েছিলেন ।

একবার বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা গোপাল সিংহের সৈন্যরা কুলদেবতা মদনমোহনের সাথে কর্ণগড় আক্রমণ করেছিল । রাজা যশোবন্ত তখন মহামায়া মন্দিরে পঞ্চমুন্ডী আসনে সাধনায় মগ্ন । কর্ণগড়ের সৈন্যরা রাজার আদেশ না পেয়ে পালিয়ে গেল । এদিকে বিষ্ণুপুরের সৈন্যরা গড়ে প্রবেশ করলে তাদের গোলযোগে যশোবন্তের ধ্যানভঙ্গ হল । তিনি কাতর কণ্ঠে মহামায়াকে ডাকতে লাগলেন । দেবী মহামায়া একটি ঘোড়ার পিঠে চড়ে মাভৈঃ মাভৈঃ শব্দ করতে করতে শত্রুসৈন্য ধ্বংস করলেন । এরপর ভয়ানক যুদ্ধ হলো মদনমোহনের সাথে । মদনমোহন পরাজিত হয়ে বিষ্ণুপুরে ফিরে গেলেন । এই কাহিনী পাওয়া যায় রামেশ্বরের একটি ক্ষুদ্রকাব্যে ।


" মহামায়া মদনমোহনের ঠেলাঠেলি

দ্বিজ রামেশ্বর ভণে কলিকালে কেলি । "


রাজা যশোবন্ত রামেশ্বরকে সভাকবির পদে নিযুক্ত করেছিলেন । দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল । রামেশ্বরের অনুরোধে তার ভাই শম্ভুরামকে তিনি নাড়াজোল রাজবংশের অধীনে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন । দাদার মতো শম্ভুরামও কাব্য রচনায় পারদর্শী ছিলেন । জিমুতমঙ্গল , অনন্ত চতুর্দশী ব্রতকথা - এর মতো তার রচনাগুলি সমৃদ্ধ করেছে মধ্যযুগের সাহিত্যকে ।

রামেশ্বর তার লেখায় রাজা যশোবন্ত সিংহকে 'দেবীপুত্র ' বলেছেন । তার ভূয়সী প্রশংসা করে লিখেছেন -


" রাজা রণে ভৃগুরাম , দানে কর্ণ , রূপে রাম

প্রতাপে প্রচন্ড যেন রবি

শক্রের সমান সভা জ্বলন্ত আনল আভা

সুবেষ্টিত পন্ডিত সহ কবি ।। "


যশোবন্তের পুত্র অজিত সিংহের জন্য তার প্রার্থনা -

" পালা পূর্ণ হইল আশীর্বাদ অতঃপর

অজিত সিংহেরে রক্ষ রক্ষ রামেশ্বর । "


যশোবন্তের পিতামহ রাজা রঘুনাথকে কবি উল্লেখ করেছেন ' রঘুবীর মহারাজা ' হিসেবে ।


" রঘুবীর মহারাজা রঘুবীর সমতেজা

ধার্মিক রসিক রণবীর । "


রামেশ্বরের জীবনের অন্তিমলগ্নে ১৭৪৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি রচনা করেছিলেন ' মহাভারতের রাজধর্ম ' নামে একটি পুঁথি ।

১৭৪৪ খ্রীষ্টাব্দে শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন কবি ও সাধক রামেশ্বর পরলোকগমন করেন । মহামায়া মন্দির প্রাঙ্গণে তার সমাধি নির্মাণ করা হয় । তার কয়েকবছর পর ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দে রাজা যশোবন্তের মৃত্যু হলে তার সমাধি নির্মাণ করা হয় রামেশ্বরের পাশে ।

1962 খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ( মেদিনীপুর শাখা ) রামেশ্বরের সমাধিস্থানে একটি স্মৃতিমন্দির স্থাপন করে ।


দ্বিজ রামেশ্বর : এক কবি ও সাধকের কথা | Poet Dwija Rameswar | कवि द्विज रामेश्वर
কবির স্মৃতিবিজড়িত কর্ণগড় মহামায়া মন্দিরে তাঁর স্মৃতিসৌধ ( দন্ডেশ্বর মন্দিরের পূর্বে ) ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।

১৯৬২ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর মন্দির উদ্বোধনের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেদিনীপুরে এসেছিলেন । ১৬ ডিসেম্বর সকালে রবীন্দ্রনাথের যাত্রাপথে অর্থাৎ খন্ডরুই রাজবাড়ি থেকে বিদ্যাসাগর মন্দির যাওয়ার পথে যে বারোটি তোরণ নির্মিত হয়েছিল তার একটি ছিল রামেশ্বরের নামাঙ্কিত ।

১৯৫৬ সালের ১০ ই জানুয়ারি কবির জন্মস্থান যদুপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় ' যদুপুর কবি রামেশ্বর আত্যয়িক প্রাথমিক বিদ্যালয় ' । পরে যদিও তার নাম হয় ' যদুপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ' ।



পরবর্তীকালে গ্রামের মানুষের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ' কবি রামেশ্বরের গ্রন্থাগার ' । কিন্তু কয়েক বছরেই সেই গ্রন্থাগারের বিলুপ্তি ঘটে ।

বর্তমানে রামেশ্বরের বাস্তুর কিছু অংশ জবরদখল হয়েছে । কিছু অংশের উপর দিয়ে গিয়েছে পালপুকুর মনসুকা রাস্তা । তিনি যে বটবৃক্ষের নিচে সাধনা করতেন সেই জায়গায় গজিয়েছে নতুন বটগাছ। কবির ভাই শম্ভুরামের বংশধরেরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নানা জায়গায় । তার বংশের একটি ধারা আজও রয়েছে যদুপুর গ্রামে ।।


midnapore.in

(Published on 05.09.2021)
তথ্যঋণ:
১. অতীতের দর্পণ কবি রামেশ্বর - শ্রী শ্যামাপ্রসাদ চক্রবর্তী ( যদুপুর নিবাসী গবেষক )
২. রামেশ্বর রচনাবলী - পঞ্চানন চক্রবর্তী
৩. মেদিনীপুরের ইতিহাস ( দ্বিতীয় পর্ব ) - কমল চৌধুরী সম্পাদিত
৪. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ( তৃতীয় খন্ড ) - অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৫. শিবায়ন ( রামেশ্বর ভট্টাচার্য্য বিরচিত ) - শ্রী ঈশানচন্দ্র বসু
৬. শিব - সঙ্কীর্তন বা শিবায়ন - শ্রী যোগিলাল হালদার
৭. ঘাটালের কথা - পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ ও প্রণব রায়
৮. মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম - সুখময় মুখোপাধ্যায় ।

ছবিঋণ:
শ্যামাপ্রসাদ চক্রবর্তী ( যদুপুর )।
পটচিত্রের আদলে রামেশ্বরের ছবিটি এঁকেছে - সায়ন ঘোষ ( নিউটাউন নিবাসী )।