আত্মজীবনীর আলোকে চন্দ্রকোণা ও সত্য ঘোষালঃ ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দের প্রেক্ষাপটে
Satya Ghoshal: In the context of 1938 AD | सत्य घोषाल
গণেশ দাস।
সালটা ১৯৩৮৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগের বছরের চন্দ্রকোণা শহর৷ নামেই "শহর"৷ নামেই পৌরএলাকা৷ আদপে তা গ্রামই৷ পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে লিকলিকে একটা লাল মোরামের সরু পথ৷ "না আছে কোনো ভালো বাজার, না কোনো ভালো দোকান, না দুটো গ্রামোফোন কি রেডিওর আড়ত৷ না একটা সিনেমা, না একটা ক্লাব, না একটা লাইব্রেরী৷ না চোখে পড়ছে একটা আধুনিক তরুণ কিংবা কোনো আধুনিকা তরুণী৷ তার উপর ম্যালেরিয়া জ্বর৷ একটা ভালো রেস্টুরেন্ট নেই, না দুটো ভালো চায়ের দোকান৷" ১
বিগত কয়েক দশক আগে তো সর্বনাশা প্লেগ এই অঞ্চলকে জনশূন্য করে দিয়েছিল৷ কয়েক বছর আগে থেকে আবার শুরু হল ম্যালেরিয়ার প্রকোপ৷ ১৮৭২ এ প্রথম জনগননাতে যেখানে এই শহরের জনসংখ্যা ছিল ২১,৩১১ জন , কমতে কমতে সেখানে জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬,০০০ এর কাছাকাছি ৷(১৯৩১খ্রীঃ— ৬০১৬ জন ও ১৯৪১ খ্রীঃ—৬৪১১ জন)৷ ২ প্লেগ আর ম্যালেরিয়ার গ্রাসে লোকগুলোও কেমন যেন হয়ে গেছে৷ "রোগা রোগা সব মানুষ৷ পেটটা বড়ো৷ হাত পা গুলো সরু সরু৷ কালো গায়ে কারও জামা নেই৷ পরনে কাপড় ছোটো করে গুটিয়ে পরা৷" ৩
চন্দ্রকোণার গোবিন্দপুর গ্রামে নির্মিত জিরাট স্কুলের সর্বপ্রথম কক্ষ (১৯৫০ দশকে তোলা )। ছবিঃ লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
"লাল মোরামের ভাঙা চোরা একফালি সরু রাস্তার দুধারে ছোটো ছোটো খড়ের ঘর৷" ৪ আর মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়ের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে কয়েকটি ভগ্ন দালান বাড়ী৷ না কোনো বাড়ীতেই জনমানব নেই৷ অট্টালিকাগুলোর ভগ্ন কঙ্কালসার খাঁচা কেবলই পড়ে আছে৷ পাখিরা যে কবেই উড়ে গেছে৷ হ্যাঁ গেছে তো৷ চন্দ্রকোণার সুবর্ণযুগের সেই সব ব্যাবসায়ী-বনিকেরা তো কবেই চন্দ্রকোণা ছেড়ে চলে অন্যত্র চলে গেছে৷ তাই তো আজ কেবলই জনশূন্য এই মহেঞ্জোদাড়ো৷
মুন্ডুমালাতে অবস্থিত, আদি 'চন্দ্রকোণা জিরাট বিদ্যালয়টি' গত কয়েক বছর আগে থেকেই ভাঙ্গুর হতে শুরু করেছিল৷ তাই বিদ্যালয় পরিচালকমন্ডলী ঠিক করেছিলেন অন্যত্র নির্জণ পরিবেশে (গোবিন্দপুরে) বিদ্যালয়টিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে৷ সেই অনুযায়ী পাঁচ বছর ধরে গোবিন্দপুরের আম, জাম, লিচু বাগানের নির্জন পরিবেশে টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির লম্বা বিদ্যালয় গৃহ তৈরি করা হল৷ আর এই বছরের প্রথমের দিকেই ( মতান্তরে ১৯৩৯ খ্রীঃ) বিদ্যালয়টিতে পঠনপাঠন শুরু হল৷ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেনীর পঠন পাঠনও হচ্ছিল এখানে৷ ওদিকে মুন্ডুমালাতে পড়ে রইল পুরানো বিদ্যালয় ভবনটি৷ অবশ্য একদম ফাঁকা নয়৷ এখানে রয়ে গেল ছাত্রাবাসটি৷ ৫
ঠাকুরবাড়ী বাজার৷ ৫২ বাজারের মধ্যে যে বাজারটি এখনও অতীত শ্রী কে আঁকড়ে বেঁচে আছে, সেটি এই ঠাকুরবাড়ী বাজার৷ এই বাজারের আর একটা নামও আছে , তা হল 'চাঁদনি চক'৷ এখন আষাঢ় মাস৷ বর্ষাকাল৷ এই সময় এখানে প্রতিবছরই রাথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়৷ বিশাল মেলা বসে৷ কেবল একটা নয়, দু দুটো রথ আসে এই চকে৷ একটা আসে অযোধ্যার রঘুনাথ ঠাকুরবাড়ী থেকে৷ সেটা লালজীউ রথ৷ আর একটা আসে নয়াগঞ্জের বড়অস্থল থেকে৷ সেটা গোপীনাথজীউ এর রথ৷ এবছরও দুটো রথই এসেছে৷ মেলাও বসেছে বিশাল৷ প্রচুর জনসমাগম৷ হরেক পসরার সমাবেশ৷ "বসেছে হরেক রকমের জিনিস, রঙীন কাঠের খেলনা৷ পিতলের আর কাঁসার বাসন, রঙীন কাপড়, ফুল -ফল৷ পাখা চামর, কাঁচের চুড়ি আর সুগন্ধি তেলের বাজার৷ লাল লাল পানীয় আর সরবৎ৷ বিক্রি হচ্ছে শুধু পাঁপড়, ভাজা বাদাম৷ কোনো কোনো দোকানে মাংস আর কালো খয়ের গলে পড়া মিঠে পান৷" ৬
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল ৷ মেলার মাঝে মিটমিট করে আলোও জ্বলে উঠল৷ না এ আলো ইলেট্রিকের আলো না৷ এ আলো "স্তিমিত গ্যাস আর মিটমিটে পোট্রোমাক্স" ৭ এর আলো৷ একেই বর্ষাকাল তার উপর আবার মোরাম বিছানো পথ৷ তাই এ পথ হয়েছে কর্দমাক্ত৷ এই পথেই "দল বেঁধে চলেছে সাঁওতাল ছেলেরা, হাতে বাঁশের বাশিঁ৷ ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল মাথায়৷ খাটো লাল পাড় কাপড় পরণে,কানে শালপাতার চটা৷ আঁড়বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে অপূর্ব সুরের যন্ত্রজাল রচনা করে চলেছে সাদা সাদা ধবধবে দাঁত তাদের৷ কুচকুচে কালো গায়ের রং৷ প্রত্যেকেই প্রাণ ভরে তাড়ি খেয়ে হেলে পড়েছে পরস্পরের কাঁধে৷ সমস্ত মেলা আর উৎসবের প্রাণ এরাই৷ দেখেই মনে হয় জাতটার শিল্পবোধ আছে৷ সৌন্দর্যকে পূজা করতে এরা জানে৷" ৮
জিরাট স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবীপ্রসাদ দুবে ও সম্পাদক সত্য ঘোষাল (১৯৬০ দশকে তোলা )। ছবিঃ লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
আরে বলাই হল না কয়েক দিন আগেই সুভাষচন্দ্র বসু চন্দ্রকোণা এসেছিলেন৷ তিনি যে এখন জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি৷ তাও আবার প্রথম নির্বাচিত সভাপতি৷ এই বছরেরই কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন৷ এই ঢেউ খেলানো সর্পিল পথ দিয়েই ট্যাক্সিতে করে চন্দ্রকোণারোড থেকে এই চন্দ্রকোণা শহর হয়ে কালিকাপুরে এক জনসভায় বক্তৃতা করতে এসেছিলেন৷ সেদিন চন্দ্রকোণাবাসী তাঁকে ফুলের মালা ও চন্দন দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন৷ যদিও "ইংরেজ সরকার সুভাষচন্দ্রের সভায় যোগ না দিবার জন্য জনসাধারনকে নানা কৌশলে সতর্ক করে দিয়েছিল৷ জিরাট স্কুলের শিক্ষক মহাশয়রাও নিয়ম মাফিক সমস্ত ছাত্রদের ঐ সভায় যোগ দিতে নিষেধ করেছিলেন"৷ ৯ কিন্তু কে শোনে কার কথা! জিরাট স্কুলের কয়েকজন ছাত্রও শোনেনি শিক্ষকদের কথা৷ তাদের রক্ত টগবগ করে ফুটছে ৷ পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও তারা রাজি৷ সুধীরকুমার মল্লিক( নবম), দিবাকর দাসের( অষ্টম) মতো কয়েক জন ছাত্র "হেঁটেই কালিকাপুর পৌঁছে গেছল সুভাষের কথা শোনার জন্য৷" ১০কেউ আবার সাইকেলে করে পৌঁছেছিল কালিকাপুরে৷ তাঁদের মধ্যে একজন কিশোর ছেলেও ছিল৷ তার নাম সত্য ঘোষাল৷ পরে তার স্মৃতিচারনা— "সেদিন সকাল থেকে ঝরে পড়ছিলো জল মুষলধারে৷ আমরা কালীমন্দিরের আটচালায় ( মুন্ডুমালা) জড়ো হয়েছি৷ সকাল থেকে বহু যত্নে তোরণ বেঁধেছি৷ একটা ফুলের মালা গেঁথেছি৷ সুভাষবাবু এলেন মোটরে৷ তাঁর পাশে নাড়াজোলের রাজা৷ গাড়ী থামালুম, মালা দিলুম৷ তারপর সেই অশ্রান্ত জলে ভিজতে ভিজতে গেলুম কালকাপুরে৷ বৃষ্টির জন্য মিটিং ভালো হোল না৷ সুভাষবাবু একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা কোরে বেরিয়ে গেলেন ঘাটাল ৷ আমার তখোনো আশা মেটেনি চললুম পিছু পিছু সাইকেলে করে ঘাটাল৷" ১১
কে এই সত্য ঘোষাল৷ ষোলো বছরের কিশোর ছেলেটি মাস তিনেক হল চন্দ্রকোণাতে এসেছে৷ চন্দ্রকোণা তার জন্মভূমি না৷ এটা তার পিতৃভূমি৷ তার বাবা কালীকিংকর ঘোষাল কর্মসূত্রে বিহারে থাকেন৷ সেখানেই (দেওঘর) তার জম্ম হয় ষোলো বছর আগে৷ সে আগে কখনও চন্দ্রকোণা আসেনি৷ এই প্রথম আসা৷ সদ্য সে ম্যাট্রিকুলেশান পরিক্ষা দিয়েছে৷ এবার ভর্তি হবে কলেজে৷ তাই এখন লম্বা ছুটি৷ বাবারও বদলি হয়েছে রাঁচিতে৷ সেখানে জয়েনের আগে তাঁরও লম্বা ছুটি৷ তাই দেশে আসা৷ তাও আবার ষোলো বছরে এই প্রথম৷ সত্যি বলতে কী এর আগে সে বাংলাদেশই দেখেনি৷ এখন দেখছে চন্দ্রকোণার চোখ দিয়ে৷
এই বছরের বৈশাখেই তারা এসেছে এখানে৷ চলুন সুদূর বিহার থেকে পিতৃভূমি চন্দ্রকোণা আসার দৃশ্যও একটু দেখে নেওয়া যাক৷ আগেই উল্লেখ করেছি, এর আগে কখনোই সে এখানে আসেনি ৷ এই প্রথম আসা হচ্ছে ৷ যদিও মনটা তার একদম ভালো না৷ কালাহান্ডিতে ট্রেনে ওঠার পর পর থেকেই তার চোখ বানভাসী৷ কেন হবে না? অনেক কিছুই যে সে ফেলে এসেছে সেখানে! তার সদ্য কিশোর বয়সের আবেগ আর.. আরও কত কিছু! সন্ধ্যাতে চন্দ্রকোণা রোডে নামার পর টাউনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে তাদের গাড়ি৷ কিন্তু স্মৃতি কিছুতেই তার পিছু ছাড়ছে না৷ বার বার মনোচক্ষে ভেসে উঠছে, আর ছলছল করে উঠছে তার দুচোখ৷ পাশে বাবা , মা, আর দিদি৷ পাছে দেখে ফেলে, তাই সে স্ব-ইচ্ছাতেই খরা সৃষ্টি করছে দুচোখে৷ তবুও ...তবুও তার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে পেছনের দিকে৷ "সীতারামপুর নদীঘাট আর নদীর জলে একটি ছেলের চোখের জলের যোগ৷ আরো পেছনে কার্মাটার , জামতোড়া, মিহিজাম, মধুপুর, জিসিডি আর ছায়াঘেরা দেওঘর৷ মোটরের পাশে দাঁড়ানো দুটি ছবি৷ ছবিদুটি স্পষ্ট সেই হাসনুহানার মদির সুরভি ছায়া বাগিচা, বেল,যুঁই, চামেলির গন্ধে নন্দিত মৃদু হাওয়া! সেই হাতে হাত দেওয়া , সেই কবিতা পড়া, গান গাওয়া, সেই স্তব্ধ অন্ধকার আর একজোড়া উন্মুখ ওষ্ঠ বোখরার খোবানীর মতো, কালো কালো হরিণের মতো একজোড়া অনিমেশ তৃষাতুর আঁখি৷ হু হু করে মোচড় দিয়ে উঠলো বুক- যা ফেলে এলুম তার কিছুই কী যাবে না পাওয়া! কেউ কী বলবে না, রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে৷" ১২ হঠাৎ তার সম্বিত ফিরে এল যখন বাবা বললেন এই দেখ আমরা চন্দ্রকোণার উপকন্ঠে চলে এসেছি৷ ছেলেটি বাইরেটা দেখল৷ চারদিকে অন্ধকারে ঢাকা৷ ছেলেটি উপরে আকাশের দিকে দেখল৷ দেখল একফালি চাঁদ আর অসংখ্য তারার মেলা, তাদের যেন স্বাগত জানাচ্ছে৷ বাবা বলল "এই দোনাই নদী, ঐ ওপারে লালগড়, চন্দ্রকোণার রাজাদের গড়৷ এর পরই চন্দ্রকোণা, মড়াখালি পেরোলেই৷" একটু পরে মড়াখালি এসে পড়ল৷ মৃতপ্রায় সরযূ নদী বয়ে চলেছে উত্তর থেকে দক্ষিনে৷ ছেলেটি পরে স্মৃতিচারণাতে লিখেছে, "জঙ্গল কমে এসেছে, দুধারে শুধু বাঁশগাছের কাঁটা বন আর লাটাবন, মরে হেজে যাওয়া কচুরি পানা ঠাসা অপরিচ্ছন্ন পুকুর, কলমিদামে ভরা ডোবা৷ বিধবার সিঁথির মতো শুষ্ক জীর্ন এই বাঁকা রেখার নাম সরযু নদী, দু পাশে বাঁশবন আর পানা ভরা নোংরা পুকুর৷ এ কোন মড়া শ্মশানের উপর দিয়ে চলেছি৷ কবে সে কতোদিন আগে প্লেগের আক্রমনের সময়ে মড়া নিয়ে এসে ফেলা হত এই খানে৷ বাতাসে কী সেই সব গলিত শবের পচা গন্ধ! অস্বাস্থ্যকর! এ কী ভীষণ গুমোট! তবে কী এ, পথ নয়? সত্যি এক মহাশ্মশান?" ১৩
গোপসাই, গাছশীতলা, গোঁসাইবাজার হয়ে যখন মুন্ডুমালাতে তাদের গাড়ী এসে পৌঁছালো তখন অনেক রাত হয়ে গেছে৷ তার বাবা চালককে বললেন, 'থামো৷ এসে গেছি৷' তারা গাড়ী থেকে নামতেই ছেলে মেয়ে নিয়ে রীতিমতো ভিড় জমে গেল, গাড়ীর চারধারে৷ নিকট ও দূর আত্মীয় , পাড়া প্রতিবেশীরা সব এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে৷ তারা আসবে বলে এত রাতেও যে এরা অপেক্ষা করে থাকবে তা সত্যি কল্পনা করেনি শহুরে কিশোর ছেলেটি৷ ১৪ছেলেটির "জ্যঠাইমা, তাঁর ছেলে মেয়েরা, পাড়ার সম্পর্কীত দাদা, কাকা, কাকীমা, বৌদিরা সব ভিড় করেছে৷ কেউ তার বাবা মাকে প্রণাম করছে তো কেউ স্বাগত জানাচ্ছে৷ সকলেই যেন নিকট আত্মীয়৷ এমন অভিজ্ঞতা ছেলেটির আগে কখনই হয়নি৷ বেদনার মাঝেও তাই তার খুব ভালো লাগলো ব্যপারটি৷ অথচ লোকগুলো না জানি একটু কেমন৷ অদ্ভুত সব রোগা রোগা লাগছে মানুষগুলিকে, সকলেই রীতিমত রুগ্ন, শীর্ণ, দুর্বল৷ ফ্যাকাসে রক্তহীন মুখ চোখ, সকলেই কেমন বিবর্ণ ,ম্লান৷" তারই মধ্যে একজন মহিলাকে সে দেখল, সে একটু ব্যতিক্রম৷ "দীর্ঘ বলিষ্ঠ তনু, স্বাস্থ্যোজ্বল মুখ৷" ছেলেটি মায়ের ইংগীতে ভদ্রমহিলাকে প্রণাম করার সঙ্গে সঙ্গে 'থাক ভাই থাক' বলে সে একটু সরে গেলেন৷ মাথার ঘোমটাটা একটু টেনে দিলেন৷ ভদ্রমহিলার স্বামী হেসে উঠলেন, আরে , ওকে দেখে ঘোমটা দিচ্ছ কেন? ওতো সেদিনকার ছেলে ,একটু লম্বা হয়েছে বৈ তো নয়৷" ১৫
সত্য ঘোঘাল (১৯৯০ দশকে তোলা )। ছবিঃ লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
দীর্ঘ যাত্রার ধকল তো ছিলোই তার উপর পেছনে ছেড়ে আসা স্মৃতিরা তাকে এতক্ষন কষ্টই দিচ্ছিল৷ তার উপর আবার এক 'মৃতের স্তুপে' প্রবেশ করা! বুকের ভিতরটা এতক্ষন চিন্ চিন্ ই করছিল৷ কেন জানিনা ভদ্রমহিলাটিকে দেখে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল সে৷ অবাক হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল সে ৷ তার পরনে "ময়লা একটা অতি সাধারণ লাল পাড় শাড়ী৷ না তার সাথে মিলিয়ে কোনো লাল ব্লাউজ সে পরেনি৷ আসলে চন্দ্রকোণাতে তখনও ব্লাউজ চালু হয়নি৷ শাড়ীর লাল পাড়ের সঙ্গে মিল রেখে পায়ে লাল আলতা আর সিঁথিতে চওড়া লাল সিঁন্দুর রেখা, শুভ্র কপালে লাল সিঁন্দুরের টিপ,নগ্ন হাত দুটি ঝুলে আছে ৷ সেই হাতের একটিতে কয়েকটি কাঁচের চুড়ি, একটিতে লোহা৷ টক টক করছে গৌরবর্ণ দেহের রং গঠনের সৌকর্ম আর বিন্যাস নিটোল ভাষ্কর্যের মতো৷ এতো রূপ এতো রং তবু কোনো জৌলুষ নেই, পারিপাট্য নেই , প্রসাধন নেই৷ সায়া নেই, ব্লাউজ নেই৷ শহরে কোনো ভদ্রঘরের মেয়েকে এই ভাবে দেখেনি সে৷ সমারোহ নেই, দৈন্য নেই, দীপ্তি যদি থাকেও দাহ নেই এতটুকু, যেন রেড়ির তেলে জ্বালা মাটির প্রদীপ৷" ১৬ সম্পর্কে বৌদি৷ বয়সেও তাই বড়৷ কত আর বয়স হবে৷ পঁচিশ কী ছাব্বিশ৷ অথচ মিল যেন তার দিদিদের সঙ্গেও নয়, মিল তার মায়ের সঙ্গে৷ সৌন্দর্যে ইনি লক্ষী প্রতিমার মতো৷ এই তাহলে গ্রাম বাংলার সৌন্দর্য- তুলসী তলায় মাটির প্রদীপের মতো স্নিগ্ধ৷ তার মনে হল , এই তাহলে চন্দ্রকোণার রূপ৷ "এই রূপ দেখেই কি সেদিন থেমে গিয়েছিল রাজপুত সর্দারের তীর্থ যাত্রা৷ কিন্তু এই রূপ কী বাঁধতে পারে?" ১৭
একটু পরে আরও দু জন আসলেন দেখা করতে৷ একজন ভদ্রলোক আর একজন ভদ্রমহিলা৷ ভদ্রলোকটি হল পাশের বাড়ীর গোকুলদা৷ "পায়ে খড়ম, গলায় পৈতা, খালি গা, বয়স সম্ভবতঃ ছত্রিশ সাঁইত্রিশ"৷ আর তার পাশের ভদ্রমহিলাটি তার স্ত্রী৷ কিশোর ছেলেটির বর্নণায়, " পুঁথির পাতা থেকে উঠে এসে দাঁড়িয়েছেন বিদ্যাপতির রাধা৷ নীলাম্বরী শাড়ীতে ঢাকা দুধে আলতার জীবন্ত ভাষ্কর্য৷ প্রস্ফুটিত রক্ত গোলাপের চেয়েও জীবন্ত স্বর্ণোজ্জ্বল দেহকান্তি, কালো কালো যাদুকরী দুটি মায়াময় চোখ, কালো কেশে সর্বনাশের নেশা, মুক্তোশুভ্র সুগঠিত দাঁতে মুখস্পর্শ হাসি, আনমিত ভুরুতে বিস্ফোরিত বিস্ময়, বিশ্রস্ত আঁচলে আকাশের অজস্রতা৷ অলক্তলিপ্ত লাজুক দুটি পদতল যেন অলিখিত দুটি কবিতা৷" ১৮ দুজনেই প্রণাম করলেন ছেলেটির বাবা ও মা কে৷ মায়ের চোখের ইশারায় ছেলেটিও প্রণাম করলেন তাঁদের৷ ভদ্রমহিলাকে প্রণাম করার পর সে তার হাত দিয়ে ছেলেটির চিবুক স্পর্শ করলো৷ ছেলেটির মনে হল " স্পর্শের ক্ষীরোদ সমুদ্র৷ তার মনে হল ,এঁকে দেখেই সর্দার বুঝেছিল, পৃথিবীতে যদি কোথাও তীর্থ থাকে, তবে তা এইখানে৷ প্রত্যাশা আর প্রদাহ দুই ই জ্বলছে এঁর দুই চোখে৷ গোকুলবাবু একে পূর্ণ করতে পারেন না৷ আয়ান কি পূর্ণ করেছিলেন শ্রীরাধাকে?" ১৯
তার মনে হলো এমন অপরূপ পূর্ণ বিকশিত সৌন্দর্য এর আগে কখনো সে দেখেনি৷ এতোদিন যাদের দেখেছে, জেনেছে তারা তারই সমবয়সী, তারা কিশোরী, তারা স্ফুটনোন্মুখ৷ আর ইনি পূর্ণ প্রস্ফুটিতা যৌবনে গর্বিতা৷ এই রূপই বেঁধেছিল রাজপুত সর্দার চন্দ্রকেতুকে৷ তার স্মৃতিচারণ, "এই তাহলে আমার চন্দ্রকোণার রূপ! এর রূপ সাগরেই ডুব দেওয়া, অরূপ রতনের আশায়! কী পেয়েছিলেন চন্দ্রকেতু! কী পাবো আমি? কী পাওয়ার আছে আমার?" ২০
কে এই চন্দ্রকেতু? তিনি ছিলেন এক রাজপুত বীর৷ পশ্চিমদেশ থেকে তীর্থযাত্রার জন্য পুরী গিয়েছিলেন৷ তার সঙ্গে ছিল অনেক সৈন্য সিপাহীও৷ সে অনেক কাল আগের কথা৷ সেই পঞ্চদশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিক৷ চন্দ্রকোণার গা দিয়েই তাঁরা ফিরছিলেন৷ তখন পশ্চিম বা উত্তর ভারত থেকে সবাই পুরী যেতেন এই পথ দিয়েই৷ বর্ধমান থেকে ভায়া মান্দারন, ক্ষীরপাই, কালিকাপুর, ঝাকরা, মেদিনীপুর হয়ে উড়িষ্যা৷ এ পথের নাম ছিল শহী সড়ক৷ রাজপুত বীর চন্দ্রকেতুও এই পথ ধরেই ফিরছিলেন৷ ঝাঁকরার কাছে 'চাঁদা' গ্রামে রাত্রীবাসের জন্য তাঁরা ছাউনি ফেলেছিল৷ সঙ্গীদের অসুস্থতার জন্য ঐখানে বেশ কয়েকদিন থাকতেও হয়েছিল তাঁদের৷ তারপর একদিন ঐ বীর, গুপ্তচর মারফত খবর পেলেন ওখান থেকে সামান্য উঃপঃ এ "মানা" নামে এক রাজ্য আছে৷ মল্ল রাজারা সেখানে রাজত্ব করেন৷ কী নেই সেখানে? এক কথায় "সোনার রাজ্য"! একে রাজপুত! যুদ্ধ রক্তে মিশে আছে৷ চোখেও তার রাজ্য জয়ের স্বপ্ন! ...রাজপুত তরুণটি আক্রমনও করলেন 'মানা' ভূমি৷ পরাজিত করলেন শেষ মল্লরাজ খয়ের মল্লকে৷ মানা রাজ্যের সিংহাসনও পেলেন তিনি৷ তাঁর নামানুসারে পরে মানার নাম হল 'চন্দ্রকোণা' ২১ তারপর অনেক, অনেক দিন কেটে গেছে৷ প্রায় ৫৩০ বছর৷ ষোলো বছরের এক কিশোরের মনে নানান কৌতুহল জেগেছে৷ প্রশ্ন জেগেছে, ঐ রাজা কেবলই কি রাজ্য জয়ের লোভেই এখানে আটকে পড়েছিল? নাকি, তারও চোখে ধরা দিয়েছিল, পুঁথির পাতা থেকে উঠে আসা কোন এক "বিদ্যাপতির রাধা" ? এমন ভাবনা কেন হল তার? তবে কি তারও এমন অভিজ্ঞতা হল?
হ্যাঁ, সেও বাঁধা পড়ে গেছে চন্দ্রকোণাতে৷ মাত্র কয়েক ঘন্টাতেই৷ এই তো একটু আগে তারা বিদেশ থেকে ফিরছে৷ এরই মধ্যে কী দেখল সে? তবে কি চন্দ্রকোণাও তাকে ভালোবেসে ফেলল? সেদিন অনেক রাতে সে বিছানায় শুতে গেল৷ দীর্ঘ যাত্রার ধকলে দেহ ও মন উভয় ই ক্লান্ত তার৷ সহজেই ঘুমিয়ে পড়ার কথা তার৷ কিন্তু তার কি সহজে ঘুম এল? সে লিখছে, " দেহে মনে ক্লান্তি৷ কিন্তু ঘুমোতে পারিনি ,একটুও ঘুমোতে পারিনি৷ চোখের সামনে ভেসে উঠছে দুটি কিশোরীর কান্না ভেজা মূর্তি৷ আর সেই সঙ্গে অজস্র স্মৃতি৷ আর আশ্চর্য আমার সদ্য পরিচিতা বৌদির মুখ, তাও ভেসে উঠছে৷ তাঁর হাসি, তাঁর কথা, কমনীয় দেহলতা, তাঁর মুখ, তাঁর চোখ সব৷ সবচেয়ে বেশী করে চোখে ভাসছে তাঁর মদির চাউনী আর মাদলতা গতি৷ একটার পর একটা সব ছবি ভাসছে চোখের সামনে৷ ঘুমে নয় , জাগরনে নয়, বাকী রাতটুকু কাটলো ঘোরের মাঝখানে৷" ২২
জিরাট মুন্ডুমালাতে অবস্থিত জিরাট স্কুলের আদি পরিতক্ত রূপ (ছবি —১৯৮০ দশকে তোলা )। ছবিঃ লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
বিনিদ্র রাত কাটার পর ভোরেই জ্যেঠতুতো দাদার ডাকে সে উঠে পড়ল৷ দাদা বলল চল তোকে পাড়াটা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসি৷ বেরিয়ে পড়ল ছেলেটি৷ লাল মোরামের চওড়া রাস্তাটা পেরিয়ে একটু ভেতরে ঢুকল তারা৷ রাস্তার দুধারে ছোটো ছোটো খড়ের ঘর৷ না এসব ঘর সে আগে কখনই দেখেনি৷ তাই অবাক দৃষ্টিতে সে বাড়ীগুলো দেখতে লাগল৷ তার সব থেকে বেশি অবাক লাগল বাড়ীর ভেতর থেকে যারা বেরিয়ে তাঁদের দেখে৷ তার কথায়," রোগা রোগা সব মানুষ, পেটটা বড়ো, হাত পা গুলো সরু সরু, গায়ের রং কালো, কারও গায়ে জামা নেই৷ পরনের কাপড় ছোটো করে গুটিয়ে পরা৷ নিষ্প্রভ চোখ নিয়ে নানা কথা জিগ্যেস করে৷ কিন্তু নিবিড় এক আত্মীয়তার সুর লেগে থাকে তাদের বাচন ভঙ্গীতে৷ গুছিয়ে কথা বলতে পারিনা৷তাদের প্রশ্নের উত্তরে, কেমন যেন যান্ত্রিক স্বরে কথা বলি৷" ২৩ পাড়াটা ঘুরতে ঘুরতে অনেকটা সময়ই কেটে গেল৷ তবুও তার মন চাইছিল না বাড়ী যেতে৷ কেন জানি না হঠাৎ করে সে আপন করে নিয়েছিল এই রোগগগ্রস্থ মানুষগুলোকে৷
দাদা বলল "চল এবার যাওয়া যাক৷ তবে তার আগে গোকুলদার বাড়ী একবার যেতে হবে৷ কাল কী বলেছিল তোর মনে নেই? তাদের বাড়ীতে আজ শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের উৎসব৷" ছেলেটি বলল, "হ্যাঁ তাইতো৷ তাহলে চল একবার ঘুরে আসি"৷ মিনিট খানেকের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল গোকুলদার বাড়ী৷ ছেলেটি স্মৃতিচারণাতে উঠে এসেছে, " দেখি ভাঙা ইটের একটা মন্দির৷ তার পেছনে একটা বাড়ী, তার অর্ধেকটা খড়ের ছাউনি আর মাটির দেওয়াল, আর বাকী অর্ধেকটা ইঁটের তবে চুনশুরকী দিয়ে গাঁথা৷ যে পাকাবাড়ী আমি এতদিন দেখে এসেছি, তার সঙ্গে কোনো মিল নেই৷" ২৪ গোকুলদার বাড়ীতে অনেকক্ষন সময় কেটেছিল তাদের৷ দুপুরে মাছ, ভাত, পায়েস খাইয়ে তবেই ছেড়েছিল "বিদ্যাপতির রাধা"৷
পরের দিন রাতেই ওখানে প্রথম কীর্তন গান শুনতে যায় ছেলেটি৷ রসিক নাগর শ্রীকৃষ্ণের উৎসব উপলক্ষ্যে নাটমন্দিরে বসেছে কীর্তনের আসর৷ গায়েন (তাদের তখন "আসামী" ও বলা হত) তাদের পাড়ারই একটি লোক ৷ নাম তার কানু৷ মাথায় একমাথা কালো ঝাঁকড়া চুল৷ টানাটানা দুটি চোখ, মাঝারি চেহারা, রঙ কালোর উপরে৷ ছেলেটি পরে লিখছে " কানু গান গাইছিলেন৷ এরকম গান আমি এর আগে শুনিনি৷ মদনমোহন ঠাকুর গোকুলদাদাদের গৃহদেবতা৷ সামনে একটি টিনের আটচালা৷ তাতে চল্লিশ পঞ্চাশ জনের মতো মানুষ বসেছিলেন৷ উপরে মূল ঠাকুর ঘরের সামনে একফালি চওড়া বারান্দা, যেখানে মেয়েরা বসেছিলেন৷ প্রৌঢ়ার সংখ্যা বেশী৷ দু চারজন বৃদ্ধা ছিলেন৷ যুবতীর সংখ্যা খুবই কম৷...কানু গায়ক নন, কীর্তনীয়া নন, তবু গাইছিলেন৷ সুর মোটামুটি ঠিকই৷ যাঁকে দেখে কীর্তনীয়া মনে হচ্ছিল তিনি সঙ্গে গাইছিলেন কানুর মাঝে মাঝে৷ কানুর গলা ঈষৎ ভাঙা, তবু সেই রাতে কানুর গান হয়েছিল অপরূপ৷ রাধার মিলনের আকুলতা ঝরে ঝরে পড়ছিল কানুর কন্ঠে৷ " ২৫
কয়েক দিনের মধ্যেই, এই কানুর সঙ্গে তার বেশ ভাব জমে উঠেছিল৷ চন্দ্রকোণাতে প্রথম যাত্রা দেখতে যাবার অভিজ্ঞতাও হয়েছিল এই কানুর সঙ্গেই৷ সে ঘটনা আরও দিন কয়েক পরের৷ তার কথায়, " বেরিয়ে পড়লুম, সন্ধ্যার পর৷ কানু তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল আরও কয়েকজন৷ যাত্রা হচ্ছে জয়ন্তীপুরে৷ শুনলুম দল এসে গেছে, লোকও জুটেছে৷ গিজগিজ করছে ভিড়৷ কানু বললেন চলো 'সাজবাসায়'(গ্রীণরুম)চলো৷ পাশে একটা গোয়াল ঘর৷ সেখানে সাজবাসা৷ দলের ম্যানেজার ঘোরাফেরা করছেন৷ কানু ম্যানেজারের কানে কানে আমার পরিচয় দিলেন৷ ম্যানেজার তাড়াতাড়ি এসে বললেন বাবু বসুন৷ বলে একটু জায়গা করে দিলেন৷ কানু উবু হয়ে বসে পড়লেন৷ কালো কালো ছেলেরা সফেদা আর সিঁন্দুর গুলে মেক আপ করছে৷ একজন অভিনেতা মেয়ের ভূমিকায় পাট করার জন্য সাজছেন৷ ধূতিটা গুটিয়ে পরা৷ তেলহীন একমাথা রুক্ষ চুল৷ রোগা চেহারার৷ সফেদা আর পিউডী নিয়ে রং করছেন মুখে৷ চোখে কাজল পরছেন৷ হাতে রং লাগাচ্ছেন৷ পায়ে আলতা৷ ঠোঁটও রাঙিয়ে নিলেন আলতা টিপে৷ ইতিমধ্যে আয়না নিয়ে তার মুখটা দেখে নিচ্ছেন একজন৷ আমার আয়না কে নিল বলে চীৎকার জুড়ে দিয়েছেন ততোক্ষনে হিরোইন সাজা ছেলেটি৷ ধূতিটিকে ছোটো করে তার উপর গলিয়ে দিলেন ঘাঘরা৷ বুকে এঁটে নিলেন কাঁচুলি, কাপড়ের বল দিয়ে৷ তারপর শাহাজাদীর জামা গায়ে দিয়ে একেবারে তৈরি৷ এবার একজনের সাহায্য নিয়ে চুল এঁটে নিলেন৷ মেক আপ সেরে একটা বিড়ি ধরালেন৷ আমার চোখের সামনেই একটি ছেলে মেয়েতে রূপান্তরিত হয়ে গেল৷" ২৬
সাজঘর থেকে বেরিয়ে ওরা এবার যাত্রার আসরে আসলো৷ চারিদিকে তখন লোক গিজগিজ করছে৷ তারা চারপাশে গোল হয়ে বসেছে৷ আর মাঝখানে একটু ফাঁকা জায়গা আছে৷ সেখানেই যাত্রা হবে৷ মাথার উপরে একটি সামিয়ানা৷ সেখানে দুটো পেট্রোম্যাক্স জ্বলছে হাজার বাতির৷ আরও কয়েকটা আছে বিরাট প্যান্ডেলের এখানে সেখানে৷ একজন লোক উঠে সেগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে, পাম্প দিয়ে দিচ্ছে যাত্রা শুরুর আগে৷ এই বার একটা ঘন্টা বাজলো ,তারপর একএক করে হারমোনিয়াম, তবলা ,ঢোল বাঁশী, ফ্লুট কর্ণেট প্রভৃতি আসতে লাগলো৷ একটা মজার ব্যাপার ঘটল এইসময়৷ একটা করে এই সব যন্ত্র আসছে, আর লোকেরা হাততালি দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠছে 'বল হরি হরিবোল'৷ এরপর একটি লোক প্রোগ্রাম নিয়ে এল, যাতে লেখা আছে যাত্রার কোন অভিনেতা কখনআসবে, কোন দৃশ্যে অভিনয় করবে৷ প্রোগ্রাম বিলি করার পর আবার ঘন্টা বাজলো৷ তারপর বাদ্যযন্ত্রগুলির বাদকেরা এসে বসে পড়লেন এবং একবার বাজিয়েও দেখে নিলেন সব৷ এবারে ঘন্টা বাজল আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল ঐক্যতান বাদন৷ ২৭
সত্য ঘোঘাল। ছবিঃ শান্তি পাহাড়ি মহাশয়ের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
ঐক্যতান বাদন শেষ হবার পর কতগুলি ছেলে, মেয়ে সেজে রুক্ষু পরচুল এঁটে নাচতে শুরু করলো৷ কখনো হিজড়ের মতো হাততালি দিতে দিতে , কখনও পায়ের কাপড় একটু তুলে ধরে কখনো বুকে হাত দিয়ে একটু মোটা দাগের অশ্লীল ভংগী করে চোখ নাচিয়ে 'পিয়ে যা মধু ভোমরা বঁধূ' বলে গান গেয়ে চলে গেল৷ এরপর ঢুকলেন মূল চরিত্রগুলি৷ তারা তারস্বরে চিৎকার হাত পা নাড়ে নেড়ে অভিনয় করতে লাগলেন৷ এধারে লোকের ভিড়৷ ঘামের গন্ধ৷ মাঝ রাতে অনেক লোকই ঘুমিয়ে পড়ল৷ অবশেষে যাত্রা শেষ হল, তখন রাত প্রায় তিনটা৷ ছেলেটি তারপর কানুর সাথে বাড়ি ফিরে এল৷ ২৮ এর পরেও সে অনেকবার যাত্রা দেখতে গেছে তবে এই অভিজ্ঞতা একদম অনন্য৷ তারপর ...তারপর ছমাস ছুটি কাটিয়ে তাকে চন্দ্রকোণা ছাড়তে হয়েছিল৷ কেননা এরপর তাকে যেতে হয়েছিল বাঁকুড়াতে৷ সেখানে সে ভর্তি হয়েছিল বাঁকুড়া ওয়েসলীয়ন কলেজে৷ কলেজ জীবন কাটিয়ে সে আবার ফিরে এসেছিল তার মায়াময় চন্দ্রকোণাতে৷ তখন থেকে সে এখানেই রয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা আমরা জানতে পারিনি৷ কারন তার আত্মজীবনী মূলক লেখা 'আমার চন্দ্রকোণা আর চন্দ্রকোণার আমি' সে শেষ করে যেতে পারেনি৷ মাত্র দুটি অধ্যায় লিখে গিয়েছিল৷
midnapore.in
(Published on 24.01.2021)
তথ্য সূত্রঃ-
● ১) " আমার চন্দ্রকোণা আর চন্দ্রকোণার আমি" - সত্য ঘোষাল ( সত্যপথে যাতিক, পুনঃমুদ্রন, ১৪০৯,পৃঃ-৩০)
● ২) "ভগ্নদেউলের ইতিবৃত্ত"- কানাইলাল দীর্ঘাঙ্গী ( পুনঃসংস্করণ, ২০২০, পৃঃ-১৬)
● ৩) সত্য ঘোষাল- ঐ (পৃঃ-১৬
● ৪) সত্য ঘোষাল- ঐ (পৃঃ- ১৬)
● ৫) "অনির্বান দীপশিখা"- বিকাশ কুমার ঘোষাল ( ২০০৬, পৃ-৩৯-৪১)
● ৬) সত্য ঘোষাল- ঐ (পৃঃ-৩০-৩১)
● ৭) সত্য ঘোষাল - ঐ ( পৃঃ-৩১)
● ৮) সত্য ঘোষাল- ঐ(পৃঃ-৩১)
● ৯)" চন্দ্রকোণা জিরাট হাইস্কুলে পাঠ্যজীবনকালের স্মৃতিচারণ"- সুধীর কুমার মল্লিক( চয়নী, ২০০৪-০৫ ,পৃঃ-৪)
● ১০) সুধীর কুমার মল্লিক- ঐ (পৃঃ- ১১)
● ১১) সত্য ঘোষাল - ঐ (পৃঃ-২৭)
● ১২) সত্য ঘোষাল—ঐ ( পৃঃ-১৪)
● ১৩)ঐ (পৃঃ-১৫)
● ১৪) ঐ (পৃ-১৫)
● ১৫) ঐ-(পৃঃ-১৫)
● ১৬)ঐ-(পৃঃ-১৫)
● ১৭) ঐ (পৃঃ-১৫)
● ১৮) ঐ (পৃঃ-১৫)
● ১৯)ঐ -(পৃঃ-১৫)
● ২০) ঐ- (পৃঃ-১৫)
● ২১) "মেদিনীপুরের ইতিহাস"—যোগেশ চন্দ্র বসু (১৯২১,পৃ-৯৪)
● ২২) সত্য ঘোষাল ( পৃঃ-১৬)
● ২৩) ঐ— (পৃঃ-১৬
● ২৪)ঐ—(পৃঃ-১৬)
● ২৫)ঐ—(পৃঃ-১৭)
● ২৬)ঐ—(পৃঃ-১৭)
● ২৭)ঐ— (পৃঃ-১৮)
● ২৮)ঐ—(পৃঃ-১৮)