ভারতের এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী ১৯৯৫ সালের ২৪ অক্টোবর পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের দিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দুশো ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে সূর্যের ব্যাস নির্ণয়ের এক বৃহৎ কর্মসূচি নিয়েছিলেন। রাজস্থানের দিল্লি-জয়পুর হাইওয়েতে আট কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে প্রায় ৬৬,০০০ বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশের সাহায্যে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সূর্যের ব্যাস নির্ণয় করে সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে দেন।।
তিনি তাঁর স্কুল জীবনের শিক্ষকদের বলেছিলেন - “আমি যদি আরো কয়েক বছর বেঁচে থাকতে পারি তাহলে নোবেল লরিয়েটদের টনক নড়িয়ে দিয়ে যাবো।” কিন্তু সে সুযোগ তিনি পান নি, ভারতের নাম সারা বিশ্বে উজ্জ্বল করে মাত্র ৪১ বছরে চলে যান না ফেরার দেশে। তাঁর নাম ডঃ নারায়ণ চন্দ্র রানা।
নারায়ণচন্দ্র রানা | नारायण चंद्र राणा | Narayan Chandra Rana
১৯৫৪ সালের ১২ই অক্টোবর পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন ২ ব্লকের সাউরি গ্রামে অত্যন্ত গরিব পরিবারে জন্ম। তবে এই তারিখটি স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় দেওয়া হয়েছিল, তাই সারা জীবন সমস্ত ডকুমেন্টে এই তারিখ রয়ে গেছে। আসলে নারায়ণের জন্ম হয় ১৯৫২ সালের চব্বিশে সেপ্টেম্বর (শুক্লাপক্ষের দুর্গাষষ্ঠী তিথিতে)। বাবার নাম রাজেন্দ্র রানা, পেশায় কামার এবং মা নাকফুঁড়ি রানা। তাঁদের দুই ছেলে আর এক মেয়ের মধ্যে নারায়ণচন্দ্র ছিলেন সবার বড়ো। বোন বিষ্ণুপ্রিয়া এবং ভাই সুজন। পেতল-কাঁসার থালা-বাটি-যন্ত্রপাতি সারাইয়ের কাজ করে কোন রকমে সংসার চালাতেন রাজেন্দ্র।।
পেতল-কাঁসার কাজ ছাড়াও রাজেন্দ্র ছোট বাচ্চাদের পড়াতেন। সেই বাবার টোলেই নারায়ণের হাতেখড়ি হয়। বাবার পাঠশালায় ক্লাস ৩ পর্যন্ত পড়ার পরে ভর্তি হন সাউরি কোটবাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার পরে নারায়ণচন্দ্র ভর্তি হন সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরে। ১৯৬৫ সালে মাত্র দশ বছর বয়সে বাবার মৃত্যু হলে তাঁর পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তিনি ক্লাস সেভেনের ছাত্র। সেই সময় স্কুলের শিক্ষকরা সহ আরও কয়েকজন নারায়ণের অসীম মেধার পরিচয় পেয়ে তাঁর পড়াশোনায় সাহায্য করেছিলেন। হোস্টেলে থেকে তাঁর পড়াশুনার ব্যবস্থা হয়। সংসার চালানোর জন্য মা লোকের বাড়িতে কাজ করতেন। এতো কষ্টের মধ্যেও মা তাঁকে কোনদিন পড়া ছেড়ে অন্য কাজ করতে বলেন নি।
ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরে তিনি পান বিজ্ঞানের জনপ্রিয় শিক্ষক মণীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী -র মতো জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে। তাঁর সংগ্রহের জ্যোতির্বিজ্ঞানের দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা জার্নাল, দেশ-বিদেশের নানান বইপত্র নারায়ণচন্দ্রকে প্রভূত অনুপ্রাণিত করেছিল। একবার কাঠের ফ্রেম আর নারকেল তেলের কৌটো দিয়ে তৈরি করলেন ছয় ইঞ্চি ব্যাসের একটি টেলিস্কোপ যন্ত্র। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের 'Sky and Telescope' পত্রিকাতে সেই টেলিস্কোপের রিভিয়্যু আলোচিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে নারায়ণচন্দ্র বিলেত থেকে একটি দামি দূরবীন তার শিক্ষক মণীন্দ্র স্যারকে উপহার দিয়েছিলেন। প্রিয় স্যারের উৎসাহে স্যারের তৈরি টেলিস্কোপে রাতের আকাশে গ্রহ-তারা দেখে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জন্মায় তাঁর।
১৯৬৯ সালে নারায়ণ সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দির থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে পাঁচটি বিষয়ে লেটার নম্বর পেয়ে সসম্মানে উত্তীর্ণ হন নারায়ণচন্দ্র। প্রথম স্থানাধিকারীর থেকে মাত্র দু'নম্বর কম পেয়েছিলেন।
বাবার পাঠশালায় ক্লাস ৩ পর্যন্ত পড়ার পরে ভর্তি হন সাউরি কোটবাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
পরীক্ষায় ভালো ফল করলেও উচ্চশিক্ষার জন্য আর্থিক সামর্থ তাদের ছিল না। সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল তাঁর প্রিয় স্কুল সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরের তিন শিক্ষক। মণীন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ী, হেডমাস্টার শ্রীনিবাস নন্দ এবং স্কুলের পরিচালন সমিতির তৎকালীন সেক্রেটারি নিমাইবাবু। নারায়ণের পড়াশুনার সমস্ত দায়িত্ব নিলেন তাঁরা।
১৯৭০-এর প্রথম দিকে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রি-ইউনিভার্সিটি কোর্সে ভর্তি হলেন নারায়ণ। পরীক্ষায় ভালো ফল করল সে। প্রি-ইউনিভার্সিটি-তে সফল হওয়ার পর ১৯৭১ সালে নারায়ণ ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে আবার ভর্তি হল প্রেসিডেন্সি কলেজে।
প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার পরে নারায়ণচন্দ্র ভর্তি হন সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরে।
এখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ এবং মহাকাশবিজ্ঞানের খ্যাতনামা অধ্যাপক অমল কুমার রায়চৌধুরীকে। সাধারণ অপেক্ষবাদ আর বিশ্বতত্ত্ব বিষয়ে পণ্ডিতব্যক্তি। সাধারণ অপেক্ষবাদে সিঙ্গুলারিটি প্রসঙ্গ উত্থাপনের প্রথম ধাপ তাঁর নামাঙ্কিত 'রায়চৌধুরী সমীকরণ' আবিষ্কার করে বিশ্বের সমীহ আদায় করে নিয়েছেন তিনি।
অধ্যাপক অমল কুমার রায়চৌধুরী ক্লাস নিতেন তিনতলায়। তিনতলায় ক্লাস করতে গিয়ে নারায়ণের বুকে প্রচন্ড অস্বস্তি হয়। হার্টের ডাক্তার দেখিয়ে জানা গেল তাঁর হার্ট ব্লকেজ রয়েছে। ডাক্তারী পরিভাষায়, Idiopathic Hypertrophic Sub-aeortic Stenosis with Complete Left Bundle Branch Block। অপারেশন করতে হবে, অনেক টাকার ব্যাপার। কিন্তু টাকা কোথায় ? আর্থিক কারণেই নারায়ণ ব্যাপারটা গুরুত্ব দিলেন না।
নারায়ণচন্দ্র রানা | नारायण चंद्र राणा | Narayan Chandra Rana
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফিজিক্স অনার্স পাশ করেন ১৯৭৪ সালে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করে তিনি ভর্তি হন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এই কলেজ থেকেই ১৯৭৬ সালে পদার্থবিদ্যায় দ্বিতীয় স্থানে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন।
এরপর ১৯৭৭ সালে ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চ (TIFR)-এ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে পি.এইচ.ডি শুরু করেন। রিসার্চের বিষয় 'কসমিক মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন' (Cosmic Microwave Radiation)। বিখ্যাত বিজ্ঞানী জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার ছিলেন তাঁর গবেষণার গাইড।
নারায়ণচন্দ্র রানা | नारायण चंद्र राणा | Narayan Chandra Rana
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু ১৯৭৮ সালের অক্টোবর মাসে তাঁর দুর্বল হার্টে বড়সড় অ্যাটাক হল। এমার্জেন্সি বিভাগে ভর্তি করা হল তাকে। জরুরী ভিত্তিতে কৃত্রিম পেস-মেকার বসাতে হবে। বেশি দেরী হলে আরও বড় অঘটন ঘটে যেতে পারে যে কোন সময়। অপারেশন করতে লাগবে প্রায় এক লক্ষ টাকা। কিন্তু কে দেবে এত টাকা ? সেদিন অপেরেশনের সমস্ত দায়িত্ত নিয়েছিল TIFR। TIFR-এর আর্থিক সাহায্যে পেস-মেকার বসল নারায়ণের শরীরে। সফল অস্ত্রোপচারের পরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি। TIFR-এর এই সাহায্য জীবনে কোনও দিন ভোলেনি সে।
১৯৮১ সালে ড. নারলিকার স্যারের তত্ত্বাবধানে সম্পূর্ণ হল তার পি. এইচ. ডি. (Ph.D.)। তাঁর গবেষণা পত্রের শিরোনাম 'অ্যান ইনভেস্টটিগেশন অফ দ্য প্রোপার্টিজ অফ ইন্টারগ্যালাকটিক ডাস্ট' (An Investigation of the Properties of Intergalactic Dust)। তাঁর এই গবেষণা পত্রটির জন্য তিনি 'Geeta Udgonkar Medal ― 1 st awarded medal' পুরস্কার পেয়েছিলেন। পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভারতে। ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণায় এক নতুন তারকার উদয় হল। গবেষণা পত্রটি ড. রানা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের চরণে উৎসর্গ করেছেন। তাঁর এই গবেষণা ‘বিগ ব্যাংগ তত্ব’ অর্থাৎ প্রায় ১৫০০ কটি বছর আগে মহাবিস্ফোরণে বিশ্ব সৃষ্টি হবার ঠিক পরের কয়েক সেকেন্ড অবয়বহীন মহাশক্তিপুঞ্জ থেকে কিভাবে আদি দুই মৌল হাইড্রোজেন এবং হিলিমাম তৈরী সম্ভব হলো তার উপরে নতুন ভাবে আলোকপাত করে।
নারায়ণচন্দ্র রানা (Dr. N. C. Rana) ১৯৮৫ সালে জার্মানি থেকে ১০০০০ পাউন্ড দিয়ে এই বিশাল আকৃতির টেলিস্কোপটি কিনে এনে তাঁর গুরু মনিন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ী'কে উপহার দিয়েছিলেন।
পি এইচ ডি সম্পূর্ণ করে তিনি TIFR-এ 'পার্মানেন্ট রিসার্চ ফেলো' হিসাবে নিযুক্ত হন। TIFR-এ গবেষণা তাঁকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিল। ১৯৮৩ সালে ভারতবর্ষের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির হাত থেকে 'বেস্ট ইয়ং সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড' গ্রহণ করেন। এই পুরস্কারটি 'ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমি' (INSA) প্রদান করে।
সম্ভবত ১৯৯০ সালের শেষের দিকে তাঁর প্রিয় মনিন্দ্র লাহিড়ী স্যারের অসুস্থতার খবর পেয়ে গবেষণার সমস্ত কাজ ফেলে ছুটে এলেন হুগলির গুড়াপে মাস্টার মশায়ের সেবা শুশ্রূষা করতে। ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসের পাঁচ তারিখে অমৃতলোকে পাড়ি দিলেন বিজ্ঞানের জনপ্রিয় শিক্ষক শ্রী মণীন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ী।
টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের পরে ড. নারায়ণচন্দ্র রানা ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (Inter-University Centre for Astronomy and Astrophysics - IUCAA)। IUCAA-তে যোগ দিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসাবে। অথচ একই সময়ে আমেরিকা থেকেও তাঁর কাছে অধ্যাপনার ডাক আসে। মাইনে প্রায় তিনগুন। কিন্তু অর্থের প্রতি লোভ না করে দেশের জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পাঁচ বছর পর এখানে তাঁর পদোন্নতি হয়। ১৯৯৬ সালে 'অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অফ রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি এবং অ্যাস্ট্রোফিজিক্স' হয়ে যান তিনি।
ছাত্রছাত্রীদের খুব ভালো বাসতেন। বন্ধুর মতো তাদের সঙ্গে মিশতেন। অনেক দুস্থ ছাত্রছাত্রীকে আর্থিক সাহায্য করতেন। অসংখ্য দরিদ্র ছাত্রকে তিনি নিজের IUCAA-এর বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছেন।
পুনের IUCAA তে ছাত্রদের জন্য আয়োজিত সামার ক্যাম্পে নারায়ণচন্দ্র রানা।
IUCAA ছাড়াও ইন্ডিয়ান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি-তে সায়েন্স পপুলারাইজেশনের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন-এর এডুকেশন সাব-কমিটি'র সম্মানীয় সদস্য ছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কমিশন (International Astronomical Union Commission)-এর ভারতীয় প্রতিনিধি ছিলেন তিনি।
১৯৮৩ সালে ভারতের ‘ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি’র (Indian National Science Academy, INSA) পক্ষ থেকে তাঁকে ‘ইয়ং সায়েন্টিফিক অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, TIFR মুম্বাই থেকে শ্রেষ্ঠ গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ দেওয়া হয় 'গীতা উদগাঁওকার পদক'। পুনে-তে ১৯৯৫ সালে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের সম্মান মেলে।
ডঃ রাণার স্বল্পায়ু জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শেষ কাজ হল সূর্যের সঠিক ব্যাস নির্ণয়। সূর্যগ্রহণ ঘিরে রয়েছে অনেক কুসংস্কার। এমনকি বিজ্ঞানীরাও অনেক ক্ষেত্রে ভুল তত্ত্ব দিয়েছেন। এইসব নিয়ে অনেক লিখেছিলেন নারায়ণচন্দ্র। কিন্তু মানুষকে বোঝানোর কাজে সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি অভাবনীয় উদ্যোগ নেন যা আমাদের দেশে কেউ কল্পনা করতে পারেন নি। বিংশ শতকের শেষের দিকে বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয় যে বিগত কয়েক শতকে সূর্যের ব্যাসের একটা পরিবর্তন হয়েছে। এ নিয়ে নানা মতভেদ থাকলেও সূর্যের ব্যাস সরাসরি মাপার উপর জোর দেন সবাই। সূর্যগ্রহণ এই পরিমাপের জন্য একটা দারুণ সুযোগ তৈরি করে। পদ্ধতিটা এইরকম – প্রচ্ছায়া (umbra) অঞ্চলের সীমানায় দাঁড়াতে হবে গবেষকদের। এবার Baily’s Beads এর প্রত্যেকটা ‘পুঁতি’ তৈরি হওয়ার এবং অদৃশ্য হওয়ার নির্দিষ্ট সময়গুলো মাপতে হবে। এই দৃশ্য এবং অদৃশ্য হওয়ার ঘটনা যেন একটা বিন্দুর এগিয়ে যাওয়াকে নির্দেশ করে। এভাবে পাওয়া পরিমাপকে ব্যবহার করে সূর্যের আপাত ব্যাস পাওয়া সম্ভব। বিজ্ঞানীরা দাবি করেন যে এই পদ্ধতি ত্রুটিমুক্ত কিন্তু সমস্যা এখানেই যে এক-একটা পরিমাপের জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয় যেহেতু দুটো পূর্ণ সূর্যগ্রহণের মধ্যে সময়ের ব্যবধান থাকে অনেকটাই।
ড. রানা এই ‘মুক্তোমালা’ সম্পর্কে খুব সুন্দরভাবে লিখেছেন -
‘চাঁদের দেহের আড়ালে সূর্য পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যাওয়ার সময় চাঁদের পূর্বপ্রান্ত ঘিরে একটি সরু আলোর রেখা আর মাঝে মাঝে আলোকবিন্দু দেখা যায়। একে বলে Baily’s Beads, বাংলায় বলা যেতে পারে মুক্তামালা। ১৮৩৬ সালের গ্রহণকালে জনৈক ইংরেজ বিজ্ঞানী বেইলি (Baily) প্রথম এর বর্ণনা দেন। দ্বিতীয় স্পর্শকালে পাহাড় পর্বত ঘেরা চাঁদের দেহ সূর্যের সর্বশেষ অংশ আবৃত করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পাহাড়ের উপত্যকা অংশের ফাঁকা স্থান দিয়ে সূর্যের আলোর ঝলক বাইরে আসে। তৃতীয় স্পর্শকালে অপর পাশ দিয়ে সূর্যদেহ উন্মুক্ত হতে শুরু হওয়ার ঠিক প্রাক্কালে অনুরূপ কারণে আবার মুক্তামালা দেখা যায়।’
১৯৯৫ এর ২৪ শে অক্টোবর এক পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহনের দিন তিনি এই মুক্তোমালা ব্যবহার করার জন্য ঢালাও ব্যবস্থা করলেন। সারা ভারত থেকে বাছাই করা ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে রাজস্থানের দিল্লি জয়পুর হাইওয়েতে সূর্যের ব্যাস পরিমাপ করতে নেমেছিলেন। সেখানে প্রায় আট কিলোমিটার জুড়ে ৬৬০০০ বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ ও ৪০০ শত ফটো ডিটেক্টর ব্যবহার করে সূর্যের ব্যাস নির্ণয় করে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি প্রথম একজন ভারতীয় জ্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞানী যিনি সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে নতুন ভাবে সূর্যের নির্ভুল ব্যাস পরিমাপ করেন এবং Astrophysicist Mr. Es Panck ও Mr. Fiala -এর তত্বকে ভুল প্রমান করতে পেরেছিলেন। ওনার মতে, “Our tentative value for the measurement of the Physical radius of the Sun at 3.02 hour UTC on October 24, 1995 may be placed as 6,96,500 k.m.”
ডঃ রাণা বলেন, এই সূর্যগ্রহণের সময় চাঁদের ছায়া ভারতের ওপর দিয়ে প্রায় ৫৫০০ কিলোমিটার বেগে চলে গেছে, তাই ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এর সাথে কথা বলে তিনি রাজি করান ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুটি বিমানকে, যারা পরবর্তী সূর্যগ্রহণে পৃথিবীপৃষ্ঠের উপর দিয়ে চলে যাওয়া চাঁদের ছায়াকে অনুসরণ করবে, আর এই সময় তারা যে তথ্য পাবে তা ডঃ রানা সংগ্রহ করবেন। কিন্তু সেই সুযোগ তিনি আর পাননি।
১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসের কুড়ি তারিখে 'দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া'র রিপোর্টার শ্রী সুব্রত রায় লিখেছিলেন―
'Now at 43, the scientist decided to ascertain the radius of the sun more accurately with the help of observations during the totally solar eclipse on 24th Oct., 1995.'
'Classical Mechanics' এর ওপর তাঁর এম.এসসি.-র পাঠ্য বই আজও ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিদেশের অক্সফোর্ড, হাভার্ড-এও পড়ানাে হয়। ১৯৯৭ সালে প্রকাশ করেছেন - 'Observer's Planner'। ১৯৯৫ এ প্রকাশিত হয় "Challenge to Aestronomy' বইটি। এ বছরই তিনি লেখেন 'Myth and Legends Related to Eclipse' নামে আর একটি বই। এছাড়া তাঁর লেখা 'Night Fall on a Sunny Morning' এবং 'Our Solar System'-ও বেশ আলােড়ন ফেলেছিল।
তাঁর গবেষণাপত্র বিলেতের ‘রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’-র মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নারায়ণচন্দ্রের লেখা ‘রিলেটিভ অ্যাবানডান্স অফ লাইটার এলিমেন্টস অফ মলিকিউল বিলিং আরলি পার্টস অব বিগ ব্যাং’ প্রবন্ধটি বিখ্যাত ‘ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার্স’-এ বিশেষ নিবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৩ সালে টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চের (TIFR)-এর ‘স্কুল অব ফিজিক্স’ তাঁর গবেষণাপত্রকে বছরের সেরা গবেষণাপত্র হিসেবে পুরস্কৃত করে।
১৯৯১ সালে পুনের IUCAA তে Emil Wolf এর সঙ্গে নারায়ণচন্দ্র রানা।
ওই বছরেই তিনি আরও উঁচু মানের গবেষণার জন্য বিলেতে যান ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে Prof.Arnold Wolfdale এর তত্বাবধানে “Post Doctoral Fellow” হিসেবে। , এখানে “Chemical Evolution of Our Galaxy” এর উপর ১০টি অতি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ লেখেন। Prof. Arnold অবাক হয়ে যান ডঃ রাণার পান্ডিত্যের গভীরতায়। তাঁর শারীরিক প্রতিকূলতার কথা ভেবে ডঃ রাণা কে ground floor এ আলাদা ঘর সহ লাইব্রেরী ব্যবস্থা করা হয়। এই সময় তিনি দুটি পুরস্কার পান “Common Wealth’ Bursary Award” ও “SERC Fellowship”। গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন দিক উন্মোচনের ফলে তিনি বিলেতের বিখ্যাত ‘রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’র সদস্য (Fellow of the Royal Society, FRS) নির্বাচিত হন। ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন’ (International Astronomical Union, IAU)-এর সদস্যপদও লাভ করেছিলেন নারায়ণচন্দ্র রানা। ডারহামে থাকাকালীন সেখানকার একজন মেধাবী ছাত্র D A Wilkinson নারায়ণচন্দ্র রানার অধীনে গবেষণা করেছিলেন। ডঃ রাণার মত অনুসারে, “Through most Astrophysicists Thought much of The Universe was made of exotic Particles in the form of invisible of so called ‘dark matter’ – all of that in the immediate neighbourhood of the sun could be in the form of non-luminous stars.” -এই মতবাদের জন্য ডঃ রানা সারা পৃথিবীতে সপ্তম স্থান অধিকার করেন।
আমরা বেশিদিন পাইনি এই বিজ্ঞানীকে। অথচ মৃত্যুর কিছুদিন আগেই ১৯৯৬ এর ১৭জুন থেকে ২৩ জুলাই তিনি ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, পােল্যাণ্ড সহ ইউরােপের ৭টি দেশে ঘুরে ঘুরে সেমিনারে বক্তব্য রাখেন মহাকাশ বিষয়ে। অতলান্ত মহাকাশের অসীম রহস্য ভেদ করতে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। সারা জীবনে ৭০টির বেশি গবেষণাপত্র লিখেছেন। দুবার জাতীয় সম্মান পান। 'Evolution of Galaxy and Earth' বিষয়ে গবেষণার জন্য ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল Wealth Bursnay Award এবং SERC ফেলোশিপ। The National Council for Science Academy and Technology Communication এর পক্ষ থেকে মরণােত্তর সম্মান পান।
১৯৯৬ সালের ২২ আগস্ট মাত্র ৪১ বছর বয়সে পুনায় নারায়ণচন্দ্র রানার মৃত্যু হয়। কিন্তু এমন বিজ্ঞানীর কি সত্যিই মৃত্যু হয়? তাঁর কাজেই তো বেঁচে আছেন তিনি!
The National Council for Science Academy & Technology Communication (NCSTC) কর্তৃক মরণোত্তর পুরস্কার
তাঁর স্মৃতিতে সাউরি গ্রামে স্থাপিত হয়েছে নারায়ণ স্মৃতি মন্দির। সেখানে তাঁরই দেওয়া দুটি দূরবীণ যন্ত্র (একটি ৬ ইঞ্চি ব্যাস, অন্যটি ১০ ইঞ্চি ব্যাস) রয়েছে। সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরের প্রয়াত স্যারের জন্য বিদেশ থেকে এনেছিলেন এই ১০ ইঞ্চি ব্যাসের টেলিস্কোপটি। ১৯৯১ তে তিনি গড়ে তুলেছিলেন 'এম এন লাহিড়ী অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল মেমোরিয়াল ট্রাস্ট'। মেদিনীপুর কলেজে রয়েছে 'এন সি রানা স্কাই অবজর্ভেশন সেন্টার'। যা এখনও মেদিনীপুরের এই প্রয়াত বিজ্ঞানীর স্মৃতি বহন করে চলেছে।
শিক্ষা―
• প্রাথমিক - সাউরী প্রাথমিক বিদ্যালয়
• মাধ্যমিক - সাউরী ভোলানাথ বিদ্যামন্দির
• পদার্থ বিদ্যায় স্নাতক - প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা
• পদার্থ বিদ্যায় স্নাতকোত্তর - সায়েন্স কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
• ডক্টরেট - টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ
• পোস্ট ডক্টরেট - ডারহাম ইউনিভার্সিটি, ইংল্যান্ড
শিক্ষার কৃতিত্ব―
• স্কুল জীবনে সর্বদা প্রথম
• মাধ্যমিক পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয়
• স্নাতকোত্তরে দ্বিতীয়
• শ্রেষ্ঠ গবেষণার জন্য Geeta Udgonkar Medel, TIFR, Mumbai
• Received International award “Wealth Bursnay Award” & “SERC for Fellowship”research on “Evolution of Galaxy and Earth” from Durhum University.
• Best Teacher Award from Pune - 1995
জাতীয় পুরস্কার―
• Indian National Science Academy (INSA) কর্তৃক প্রদত্ত Best Young SCientist Award
• The National Council for Science Academy & Technology Communication (NCSTC) কর্তৃক মরণোত্তর পুরস্কার
সৃষ্টি―
• Classical Mechanics – Included in M.Sc. syllabus and Oxford University.
• ডঃ নারায়ণচন্দ্র রানা: এক আলোকবর্তিকা - অনিন্দিতা মাইতি নন্দী (The Kharagpur Post)
• দীপককুমার দাঁ সংকলিত ও সম্পাদিত এবং মণীন্দ্র-নারায়ণ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ট্রাস্ট প্রকাশিত ‘জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানা’, ডিসেম্বর ২০১৭
• Utpal Mukhopadhyay, Saibal Ray, N C Rana: Life and His Contributions in Astrophysical Science, Indian Journal of History of Science, 51.3 (2016) 531-547
• Cirkovic, M. M., & Perovic, S. Alternative explanations of the cosmic microwave background: A historical and an epistemological perspective, Studies in History and Philosophy of Modern Physics (2017)৪। Alan D Fiala, David W Dunham, Sabatino Sofia, Variation of the solar diameter from solar eclipse observations, 1715-1991, Solar Physics, June 1994