মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  | मेदिनीपुर में रवीन्द्रनाथ टैगोर | Rabindranath Tagore in Medinipur (Midnapore)

মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


मेदिनीपुर में रवीन्द्रनाथ टैगोर | Rabindranath Tagore in Medinipur


অরিন্দম ভৌমিক।




Home » Famous people in Medinipur » Arindam Bhowmik » মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



এই প্রবন্ধে মূলত ১৯৩৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর মেদিনীপুর শহরে আগমনের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে ১৯৩৯ সালের অনেক আগে থেকেই ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে মেদিনীপুর জেলার যোগাযোগ ছিল। সম্ভবত ১৮৬১ সালে পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমবার মেদিনীপুর শহরে এসেছিলেন। নাড়াজোল রাজ পরিবারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। ঋষি রাজনারায়ণ বসু-র কন্যা এবং ঋষি অরবিন্দের মা স্বর্ণময়ী দেবীর বিবাহ উপলক্ষে তিনি দ্বিতীয়বার মেদিনীপুরে আসেন ১৮৬৪ সালে। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ৩ বছর। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের লবন ব্যবসা কেন্দ্র ছিল খেজুরীর নোনাপোতা গ্রামে। তিনি কার সাহেবের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ব্যবসা করেছিলেন বলে নাম ছিল কার-টেগোর এন্ড কোম্পানি। রবীন্দ্রনাথ নিজেও কিন্তু মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে গিয়েছেন। যেমন ১৮৯৭ সালের ২০ অক্টোবর তিনি তাঁর 'পদ্ম' নামের নৌকোয় করে বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হিজলী টাইডাল ক্যানেল দিয়ে উড়িষ্যা গিয়েছিলেন। এই পথেই তিনি লিখেছিলেন 'শ্রেষ্ঠভিক্ষা মহাত্মা গান্ধী'। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আসা-যাওয়ার পথের স্টেশন ছিল খড়্গপুর। বোম্বে, মাদ্রাস, পুরী বা ইংল্যান্ড গেলেও খড়্গপুর স্টেশন হয়েই যেতেন। ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঘটে হিজলী হত্যাকান্ড। প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'প্রশ্ন'।


"ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে দয়াহীন সংসারে"



মেদিনীপুর শহরে রবীন্দ্রনাথ



মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর স্মৃতি সমিতির উদ্যোগে বিদ্যাসাগর স্মৃতি সৌধ তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। সমিতির কর্তাদের ইচ্ছে যে স্মৃতি মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন যেন রবীন্দ্রনাথ করেন। এই সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সজনীকান্তের হৃদ্যতার কথা বহির্জগতে গোপন ছিল না। অতএব স্মৃতি সমিতির কর্তারা সেই সূত্রে সজনীকান্তকে দূত হিসেবে কবির কাছে প্রেরণ করেন।


যোগাযোগ শুরু হয় দ্বারোদ্ঘাটনের ১ বছর আগের থেকে। সজনীকান্তকে লেখা কবির এই চিঠি থেকেই তা বোঝা যায় -


৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩৮


"UTTARAYAN"

SANTINIKETAN, BENGAL


কল্যাণীয়েষু

ভুলেই গিয়েছিলুম। তোমার চিঠি পেয়ে আজ আমি কয়েক লাইন লিখে মেদিনীপুরে কালেক্টরকে পাঠিয়ে দিয়েছি। মুক্তির উপায় থেকে বোধ হচ্চে আমার মুক্তির উপায় নেই। আচ্ছা কপি করিয়ে পাঠিয়ে দেব। সুধাকান্ত রায় চৌধুরী বলচে পালিশ করে দেওয়া দরকার। আমার মন বলচে আর তো পারা যায় না। যারা জন্মায় কুঁড়ে হয়ে তারা মরে খাটতে খাটতে ।


ইতি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৬/৯/৩৮


মেদিনীপুরে আসার আগে পর্যন্ত এই বিষয়ে অনেকগুলি চিঠির আদান-প্রদান হয়েছিল। এমনকি দার্জিলিংয়ের মংপু থেকেও তিনি বেশ কিছু চিঠি লিখেছিলেন।


সেই সময় মেদিনীপুর টগবগ করে ফুটছে। সদ্য তিনজন জেলা মেজিস্ট্রেট বিপ্লবীদের হাতে খুন হয়েছে - পেডি, ডগলাস, বার্জ। মেদিনীপুরে প্রথম বাঙালি ম্যাজিস্ট্রেট বিনয়রঞ্জন সেন। তিনি এসেই চেষ্টা করলেন বৈপ্লবিক চেতনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে সাংস্কৃতিক চেতনার দিকে নিয়ে যেতে। শুরু করলেন মেদিনীপুর শহরে বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দির। সংঘটিত হল সর্বভারতীয় চিত্রপ্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীতে বিচারক ছিলেন বিখ্যাত শিল্পী অতুল বসু মহাশয়। এরপর বিদ্যাসাগর হলের দেওয়াল চিত্র আঁকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হল শিল্পীদের। এই কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন সেদিনের তাবড় তাবড় শিল্পী, যেমন গোপাল ঘোষ, বাসুদেব রায়, কালীকিঙ্কর ঘোষদস্তিদার, গৌর দাসগুপ্ত, দেবব্রত মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা।


মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  | मेदिनीपुर में रवीन्द्रनाथ टैगोर | Rabindranath Tagore in Medinipur (Midnapore)
বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দির। ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।

বিনয়রঞ্জন সেনই ছিলেন বিদ্যাসাগর স্মৃতি সমিতির প্রধান উদ্যোক্তা। বিনয়রঞ্জন সেন-এর স্ত্রী চিরপ্রভা সেন ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রী। সজনীকান্ত রবীন্দ্রনাথকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, কবির ইচ্ছানুসারে মেদিনীপুরে একটি স্বতন্ত্র বাড়িতে তাঁকে রাখার ব্যবস্থা করা হবে। এদিকে সুষ্ঠভাবে সবকিছু তদারকি করতে তাঁর একান্ত সচিব সুধাকান্ত রায়চৌধুরী অনুষ্ঠানের কয়েকদিন পূর্বেই মেদিনীপুরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। গিয়ে শুনলেন যে স্বতন্ত্র বাড়ির বদলে জেলা-অধিকর্তার বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তিনিই রবীন্দ্রনাথকে সংবাদ দিলেন যে তৎকালীন জেলা-অধিকর্তার বাড়িতে তার স্ত্রীর (চিরপ্রভা সেন) তত্বাবধানে কবির থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।


রবীন্দ্রনাথ এই সংবাদে অতিমাত্রায় বিব্রত হয়ে চিরপ্রভা সেনকে ৪ ডিসেম্বর ১৯৩৯, চিঠিতে লিখলেন-


“কল্যাণীয়াসু চির,


তোমার চিঠিখানি পেয়ে খুশি হলুম। কিছুদিন থেকেই মেদিনীপুরে যাবার আলোচনা চলছে । তোমাদের দূত সজনীকান্তের সঙ্গে এই কথা স্থির করেছি যে আমাকে একলা কোনো বাড়িতে যেন রেখে দেওয়া হয় -আমার অভ্যেস সম্পূর্ণ নিরালায় থাকা - এখানেও আমি একখানা বাড়িতে একলা থাকি। সজনী তাই বলেছিলেন- আমাকে স্বতন্ত্র বাড়িতে স্থান দেবেন, তাতে আমার অনেকটা ক্লান্তি দূর হবে।


ইতি

তোমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৪/১২/৩৯”


শুধু চিরপ্রভা সেনকে চিঠি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ চুপ থাকলেন না। সেইসঙ্গে সজনীকান্তকেও ৬/১২/৩৯ তারিখে চিঠি লিখেছিলেন। শেষমেষ কবির থাকার ব্যবস্থা হয় রামগড় রাজার বাড়িতে (বর্তমানে কৈবল্যদায়িনী কমার্স কলেজ)।


মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  | मेदिनीपुर में रवीन्द्रनाथ टैगोर | Rabindranath Tagore in Medinipur (Midnapore)
রামগড় রাজার বাড়ি (বর্তমানে কৈবল্যদায়িনী কমার্স কলেজ)। ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।

১৯৩৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা পৌরসভা আয়োজিত 'খাদ্য ও পুষ্টি' প্রদর্শনীর উন্মোচন অনুষ্ঠানের পৌরোহিত্য করার জন্য রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ঠিক হয়েছিল যে শান্তিনিকেতন থেকে ট্রেন হাওড়ায় পৌঁছনোর পরে এবং মেদিনীপুরগামী ট্রেন ছাড়ার মাঝে যে সময় পাওয়া যাবে, সেই সময়টুকু রবীন্দ্রনাথ পৌরসভার অনুষ্ঠানের পৌরোহিত্য করবেন। রবীন্দ্রনাথ কলকাতা হয়ে মেদিনীপুর যাবেন বলেই ঐ দিন পৌরসভার অনুষ্ঠানটি রাখা হয়েছিল।


১৫ ডিসেম্বর (বাংলা ২৯শে অগ্রহায়ণ ১৩৪৬) শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ মেদিনীপুরের উদ্দেশে রওনা হলেন। সঙ্গে ছিলেন -


কৃষ্ণ কৃপালনি,

অনিলকুমার চন্দ,

সুধাকান্ত রায়চৌধুরী

ও শচী রায়।


পৌরসভার পক্ষ থেকে কবিকে স্টেশনে স্বাগত জানান তৎকালীন কলকাতার মেয়র নিশীথ সেন, কলকাতা হাইকোর্টের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত ব্যারিস্টার।



মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  | मेदिनीपुर में रवीन्द्रनाथ टैगोर | Rabindranath Tagore in Medinipur (Midnapore)
মেদিনীপুর স্টেশন। ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।

নিদৃষ্ট সময়েই মেদিনীপুরগামী ট্রেনে চড়লেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতন থেকে যারা কবির সঙ্গে এসেছিলেন তাঁরা ছাড়াও সঙ্গে যুক্ত হলেন -


সজনীকান্ত দাস,

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়,

স্যার যদুনাথ সরকার,

অধ্যক্ষ ক্ষিতিমোহন সেন,

রাজকুমার ড. রঘুবীর সিং,

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,

ড. অমিও চক্রবর্তী,

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়,

অনাদি ঘোষ দস্তিদার,

পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়,

নলিনীকান্ত সরকার,

রামকমল সিংহ


দিনটি ছিল শুক্রবার, মেদিনীপুর পৌঁছতে রাত্রি দশটা বেজে যায়। প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যেও অসংখ্য মানুষ কবিকে দেখতে উপস্থিত ছিলেন মেদিনীপুর স্টেশনে -


জেলাশাসক বিনয়রঞ্জন সেন,

জেলার জজ এস এন গুহরায়,

মহিষাদলের রাজকুমার দেবপ্রসাদ গর্গ,

পুরসভার চেয়ারম্যান রায়বাহাদুর দেবেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য,

মনিষীণাথ বসু,

ক্ষিতীশচন্দ্র চক্রবর্তী,

রায়সাহেব কবিরুদ্দিন আহম্মদ,

বি কে আচার্য,

সি কে হাজরা,

অধ্যক্ষ বঙ্কিমদাস বন্দোপাধ্যায়


এছাড়াও বহু বিশিষ্ট ব্যাক্তি উপস্থিত ছিলেন স্টেশনে। ট্রেন স্টেশনে পৌঁছতেই 'বন্দেমাতরম' এবং রবীন্দ্রনাথের জয়ধ্বনিতে অসংখ্য মানুষ কবিকে অভ্যর্থনা জানালেন। ট্রেনের পাদানি থেকে প্লাটফর্মের উপর দিয়ে একদম রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সেলুন গাড়ি (saloon car) পর্যন্ত লাল কার্পেট পাতা হয়েছিল। বিনয়রঞ্জন সেন রবীন্দ্রনাথকে সম্বর্ধনা জানালেন। রবীন্দ্রনাথ ট্রেন থেকে নামলে, তাঁকে একটি সুসজ্জিত চেয়ারে বসিয়ে পালকির মত করে বাইরে গাড়ি পর্যন্ত আনা হয়। সেই সেলুন গাড়িতে করেই তাকে স্টেশন থেকে বর্তমান ক্ষুদিরাম নগরের কে.ডি.কলেজ লেনে অবস্থিত রামগড় রাজার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় (বর্তমানে কে.ডি.কলেজ)। স্টেশনের বাইরে ফুল, পাতা এবং আলো দিয়ে সাজানো বিশাল "বিদ্যাসাগর তোরণ" বানানো হয়েছিল। তোরণের উপরে নহবৎখানা বানানো হয়েছিল। সেখানে শিল্পীরা সানাই, বাঁশি ইত্যাদি বাজাচ্ছিলেন। রাস্তার দুদিকে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য মানুষ শঙ্খধ্বনি ও পুষ্পবর্ষণ করছিলেন।


পরের দিন ১৬ ডিসেম্বর শনিবার সকাল ৯ টার সময় রবীন্দ্রনাথকে একটি সুসজ্জিত গাড়িতে করে শোভাযাত্রার সঙ্গে মেদিনীপুরের বিভিন্ন রাস্তা যেমন বার্জ রোড, কলেজ রোড, লাইব্রেরী রোড ও সাহিত্য পরিষদ রোড দিয়ে স্মৃতিমন্দিরে আনা হয়। স্টেশনের বাইরে "বিদ্যাসাগর তোরণ" ছাড়াও বিভিন্ন রাস্তায় 'বীরেন্দ্রনাথ শাসমল', 'মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার', 'মুকুন্দরাম চক্রবর্তী', 'রামেশ্বর চক্রবর্তী', 'রাজনারায়ণ বসু' প্রভৃতি জেলার কৃতি ব্যাক্তিদের নামে মোট ১১ টি তোরণ বানানো হয়েছিল।


মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  | मेदिनीपुर में रवीन्द्रनाथ टैगोर | Rabindranath Tagore in Medinipur (Midnapore)
স্কুলের সামনে এই রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন সাহিত্যিক আজহারুদ্দিন খান। ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।

নিজের রবীন্দ্র দর্শন সম্পর্কে সাহিত্যিক আজহারুদ্দিন খান বলেছেন,


‘স্কুলের কল্যাণেই আমি ছাত্রাবস্থায় রবীন্দ্রনাথকে দেখি- রবীন্দ্রনাথকে দেখা এক পুণ্য সঞ্চয়। …আমাদের প্রধানশিক্ষক বিদ্যালযয়ের সমস্ত ছাত্রকে স্কুলের সামনের রাস্তার দু’ধারে লাইন করে শীতকালের সকালে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। পরনে ছিল হাত কাটা গেঞ্জি কালো প্যান্ট। রবীন্দ্রনাথ বেলা ৯টায় আমাদের বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে হুড খোলা মোটরে আস্তে আস্তে চলে গেলেন স্মৃতি মন্দির উদ্বোধন করতে। তিনি চলে গেলে আমরা কলেজ মাঠে ডিঙিয়ে তাঁর পৌঁছাবার আগে স্মৃতি মন্দিরে গিয়ে পৌছালাম। বিকেলের দিকে কবিগুরুকে সমবেত ভাবে ড্রিল দেখানো হয়েছিল। তাঁকে দেখার সৌভাগ্য এই বিদ্যালয়ে পড়তাম বলেই সম্ভব হয়েছিল। বিদ্যালয়ের কাছে এটি আমার প্রধান ঋণ।”


রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিমন্দিরে পৌঁছলে প্রায় ১০,০০০ মানুষ শঙ্খধ্বনি এবং জয়ধ্বনি দিয়ে তাঁকে সম্বর্ধিত করলেন। প্রথমেই সমবেত কণ্ঠে কবির রচিত গান


'দশ দেশ নন্দিত করি, মন্দ্রিত তব ভারী'


গাওয়া হয়। এই গানের পরে শ্রীযুক্ত ভাগবত দাস স্বস্তিবচন দিয়ে মঙ্গলাচরণ করেন। মঙ্গলাচরণের পরে গাওয়া হয় -


"ভেঙ্গেছ দুয়ার এসেছে জ্যোতির্ময়"


এরপরে, এই অনুষ্ঠানের সাফল্য কামনা ও দেশবাসীকে বিদ্যাসাগরের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত করতে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে বিশিষ্ট ব্যাক্তিরা যে সমস্ত বার্তা পাঠিয়েছিলেন সেগুলি পাঠ করেন মেদিনীপুর সাহিত্য পরিষদের সভাপতি মনীষীনাথ বসু সরস্বতী মহাশয়। যাদের বার্তা পাঠ করা হল, তাঁরা হলেন -


রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ

মহাত্মা গান্ধী

জহরলাল নেহেরু

সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন

মৌলানা আবুল কালাম আজাদ

রেভারেন্ড এন্ড্রুজ

লেডি প্রতিমা মিত্র

বিজয়প্রসাদ সিংহরায় প্রমুখ


স্মৃতি সংরক্ষণ সমিতির সম্পাদক বাবু চিত্তরঞ্জণ রায় তাঁর রিপোর্টে বিদ্যাসাগরের আদর্শকে সাফল্যমণ্ডিত করার উদেশ্যে মেদিনীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে যে বিশাল কর্মকান্ড আরম্ভ হয়েছে তার উল্লেখ করেন।


মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  | मेदिनीपुर में रवीन्द्रनाथ टैगोर | Rabindranath Tagore in Medinipur (Midnapore)
মনীষীবাবুর অনুরোধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিমন্দিরে তাঁর অভিভাষণ পাঠ করছেন।

এরপরেই মনীষীবাবুর অনুরোধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিভাষণ পাঠ করেন এবং বিপুল জয়ধ্বনির মধ্যে স্মৃতিমন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করেন। দ্বারোদ্ঘাটনের পরেই


"জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে

ভারত ভাগ্য বিধাতা"


গানটি উপস্থিত সকলেই একসঙ্গে গাওয়া হয়। বিশ্বভারতীর অনাদি ঘোষ দস্তিদারের পরিচালনায় সতীদেবী, জয়া দাস, বিজয়া দাস, হাসি মুখোপাধ্যায়, সাগরময় ঘোষ ও সুজিতরঞ্জন রায় প্রমুখ শিল্পীরা রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন। এরপরেই সকালের অনুষ্ঠান শেষ করা হয়।


সন্ধাবেলায় স্মৃতিমন্দিরে মনীষীনাথ বসু সরস্বতীর সভাপতিত্বে বিদ্যাসাগর জয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। স্যার যদুনাথ সরকার বিদ্যাসাগর যুগ এবং দেশের প্রতি তাঁর দান সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন। শ্রদ্ধেয় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় বলেন - বিদ্যাসাগর কেবল বাঙ্গালা বা ভারতের নহেন, তিনি সমগ্র মানব সমাজের। ক্ষিতিমোহন সেন বলেন - বিদ্যাসাগর দেশবাসীর পুরুষানুক্রমিক শিক্ষাগুরু। কারণ তাঁরই রচিত গ্রন্থের সাহায্যে তাঁদের প্রথম বর্ণ পরিচয় হয়।


এছাড়াও রামগড় রাজার বাড়িতে যেখানে কবি ছিলেন সেখানে স্মৃতিরক্ষা কমিটি সান্ধ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতা আবৃতি করে সবাইকে শুনিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে যে সমস্ত রেডিও-শিল্পীরা এসেছিলেন তাঁরা রাত্রে স্মৃতি মন্দিরে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন।


১৭ ডিসেম্বর রবিবার সকাল ৮ টার সময় স্মৃতিমন্দিরে মনীষী বাবুর সভাপতিত্বে এক বিরাট সভায় মিউনিসিপালিটি, জেলাবোর্ড এবং সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক রবীন্দ্রনাথকে তিনখানি অভিনন্দনপত্র দেওয়া হয়। মিউনিসিপালিটি, জেলাবোর্ড এবং সাহিত্য পরিষদের সদস্যদের সহযোগিতায় মেদিনীপুরের নাগরিকরা রবীন্দ্রনাথকে একটি টাকার তোড়া উপহার দেন।


এরপরে রামগড় রাজার বাড়ির কাছে একটি বটগাছের নিচে প্রায় ২ হাজার মহিলা ও ছাত্রী সমবেত হয়ে রবীন্দ্রনাথকে সম্বর্ধনা দেন। তাঁদেরকে রবীন্দ্রনাথ বলেন -


মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  | मेदिनीपुर में रवीन्द्रनाथ टैगोर | Rabindranath Tagore in Medinipur (Midnapore)
বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছেন ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন।

"বাংলার নারী সমাজে যে চেতনার সঞ্চার হয়েছে, তার ফলে এদেশের পুরুষরাও নবজীবন লাভ করেছে এবং নতুন উৎসাহে সঞ্জীবিত হয়েছে। নারী সমাজের এই জাগরণ পুরুষগণকে নব নব প্রেরণা দেন করেছে। দেশের সেবায় যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের শিরে নারীজাতির আশীর্বাদ অজস্রধারায় বর্ষিত হয়েছে।"


উপসংহারে তিনি আরো বলেন যে, নারীসমাজের শক্তি ও দৃঢ়তা এই দেশে নব জীবন সঞ্চার করেছে। তিনি আশা করেন যে এদেশের নারীসমাজ তাঁদের শক্তি ও সাহস দ্বারা চিরকাল ধরে পুরুষের হৃদয়ে উৎসাহ ও উদ্দীপনা সঞ্চার করতে থাকবে।


এছাড়াও মেদিনীপুরের ছাত্রসমাজ কবিগুরুকে একটি অভিনন্দন পত্র দিয়ে সম্বর্ধিত করে। ছাত্রদের পক্ষ থেকে কবিগুরুকে একটি টাকার তোড়া উপহার দেওয়া হয়।


উৎসব কমিটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ


মেদিনীপুর সাহিত্য পরিষদের বিশেষ অনুরোধ ও আহ্বানে ১৭/১২/৩৯ তারিখ বিকেল ৫ টায় বিশ্বকবি তার বাসভবনের প্রাঙ্গণে পরিষদের সদস্যগণের সঙ্গে মিলিত হন এবং একটি সমবেত আলোকচিত্র গ্রহণে সম্মতি দানকরেন। উৎসব কমিটি পৃথকভাবে গঠিত হয়েছিল। এই কমিটির সদস্যগণের মধ্যে ছিলেন -


১। বিনয়রঞ্জন সেন (সভাপতি), জেলাশাসক ২। দেবেন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য ৩। মনীষীনাথ বসু ৪। চিত্তরঞ্জন রায়। ৫। ক্ষিতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী। ৬। অতুল চন্দ্র দে। ৭। মহেন্দ্রনাথ দাস। ৮। জ্ঞানেন্দ্রনাথ চৌধুরী। ৯। চারুচন্দ্র সেন। ১০। জহরলাল অধিকারী । ১১। সতীশ চন্দ্র আঢ্য। ১২। প্রভাতচন্দ্র মাইতি ১৩। ব্রজমাধব রায় ১৪। পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী ১৫। নলিনীরঞ্জন রায় ১৬। সুধাময় বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৭। যতীন্দ্রকৃষ্ণ মাইতি। ১৮। অতুলচন্দ্র বসু। ১৯। সত্যরঞ্জন দত্ত। ২০। অমূল্য কৃষ্ণ দত্ত। ২১। গোষ্ঠবিহারী দত্ত। ২২। মানববন্ধু কানুনগো। ২৩। বাসুদেব মণ্ডল। ২৪। গৌরচন্দ্র পিড়ি। ২৫। নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ সোম। ২৬। শ্রীরাধারমণ চক্রবর্তী।


মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  | मेदिनीपुर में रवीन्द्रनाथ टैगोर | Rabindranath Tagore in Medinipur (Midnapore)
উৎসব কমিটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ।

এই কমিটির সঙ্গে যারা বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিলেন তারা হলেন,


১। চিরপ্রভা সেন (জেলা শাসক বিনয়রঞ্জনের পত্নী)। ২। দেবপ্রসাদ গর্গ (মহিষাদলের রাজকুমার) ৩। নরসিংহ মল্লদেব (ঝাড়গ্রামের রাজা) ৪। দুর্গাদাস রায় (বাসুদেবের জমিদার) ৫। প্রবীর সিংহ গজেন্দ্র মহাপাত্র ৬। জনাব কবিরুদ্দিন আহমেদ ৭। কাজী সামসুল আলাম ৮। হেমচন্দ্র দাসকানুনগো। ৯। রামসুন্দরসিং ১০। জগদীশ চন্দ্র রুদ্র ১১। পুলিন বিহারী দিন্ডা ১২। শ্রীমতী নলিনী দিন্ডা ১৩। এস,এন, গুহরায়।


মেদিনীপুর শহরের প্রখ্যাত আইনজীবী জ্ঞানেন্দ্রনাথ চৌধুরীর উদ্যান প্রাঙ্গণে এই কমিটির একটি সান্ধ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বকবি সেই সম্মেলনেও অনুগ্রহ করে যোগদান করেন এবং আলোকচিত্র গ্রহণে সম্মতি দেন। এই সকল আলোকচিত্র কলকাতার ইউনিভারস্যাল আর্ট গ্যালারী তুলেছিল ।


আনন্দবাজার, যুগান্তর, ভারত প্রভৃতি দৈনিক পত্রিকাগুলির প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানগুলিতে উপস্থিত থেকে সহযোগিতা করেছিলেন এবং অরোরা টকিজের কর্তৃপক্ষ অনুষ্ঠানগুলির একটি চলচ্চিত্র ফিল্ম রেকর্ডও গ্রহণ করেছিলেন। কমিটির পক্ষে শ্রীযুক্ত রাধারমণ চক্রবর্তী (বল্লভপুর, মেদিনীপুর শহর) সংবাদ প্রেরণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।


পরের দিন ১৮ ডিসেম্বর সোমবার তিনি শান্তিনিকেতনের উদ্দেশে রওনা দেন। তাঁর ব্যবহৃত চেয়ারটি এখনও স্মৃতিমন্দিরে রয়েছে।


মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  | मेदिनीपुर में रवीन्द्रनाथ टैगोर | Rabindranath Tagore in Medinipur (Midnapore)
রবীন্দ্রনিলয়। ছবি: অরিন্দম ভৌমিক।

সেই স্মৃতি ধরে রাখতে কয়েক বছর পরেই গড়ে উঠল "রবীন্দ্রনিলয়" নামক সাহিত্য, শিল্প, সংগীত চর্চার প্রতিষ্ঠান। কবিগুরুর তিরোধানের পরে মেদিনীপুর সাহিত্য পরিষদের একটি বার্ষিক অনুষ্ঠানে আবার এসেছিলেন অধ্যক্ষ ক্ষিতিমোহন সেন শর্মা। রবীন্দ্রনিলয় তৈরির কাজ তখন শেষ হয়েছে। কিন্তু নামকরণ এবং উদ্বোধন কোনোটাই হয়নি। এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটি নামকরণ করে উদ্বোধন করলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয় ক্ষিতিমোহন সেন শর্মা।




M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

(Published on 08.05.2024 । ২৫ বৈশাখ ১৪৩১)


তথ্যসূত্র:

• চিঠিপত্র।
• Rabindranath Tagore- A Biography, KRISHNA KRIPALANI
• কিছু বনফুল, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়।
• মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ, হরিপদ মন্ডল।
• মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ, কবি দর্শন, আজহারুদ্দীন খান।
• রবি প্রণাম, রবীন্দ্র স্মৃতি সমিতি, মেদিনীপুর।
• সাহিত্যিক আজহারউদ্দীন খান! রবীন্দ্রনাথকে দেখা শেষ মেদিনীপুরবাসী :কামরুজ্জামান।



নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।