বিদ্যাসাগর স্মৃতি সৌধ প্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষণ
যে সযত্ন স্মরণীয় বার্তা সর্বজনবিদিত তারও পুনরুচ্চারণের উপলক্ষ্য বারম্বার উপস্থিত হয়। যে মহাত্মা বিশ্বপরিচিত, বিশেষ অনুষ্ঠানের সৃষ্টি হয়, তাঁরও পরিচয়ের পুনরাবৃত্তির জন্য। মানুষ আপন দুর্বল স্মৃতিকে বিশ্বাস করে না মনোবৃত্তির তামসিকতায় স্বজাতির গৌরবের ঐশ্বর্য অনবধানে মলিন হয়ে যাবার আশঙ্কা ঘটে, ইতিহাসের এই অপচয় নিবারণের জন্যে সতর্কতা পুণ্যকর্ম্মের অঙ্গ। কেননা কৃতজ্ঞতার দেয় ঋণ যে জাতি উপেক্ষা করে, বিধাতার বরলাভের সে অযোগ্য।
মনীষীবাবুর অনুরোধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিমন্দিরে তাঁর অভিভাষণ পাঠ করছেন।
যে সকল অপ্রত্যাশিত দান শুভ দৈবক্রমে দেশ লাভ করে, সেগুলি স্থাবর নয়; তারা প্রাণবান, তারা গতিশীল, তাদের মহার্ঘতা তাই নিয়ে। কিন্তু সেই কারণেই তারা নিরন্তর পরিণতির মুখে নিজের আদি পরিচয়কে ক্রমে অনতিগোচর করে তোলে । উন্নতির ব্যবসায়ে মূলধনের প্রথম সম্বল ক্রমশই আপনার পরিমাণ ও প্রকৃতির পরিবর্তন এমন করে ঘটাতে থাকে। যাতে করে তার প্রথম রূপটি আবৃত হয়ে যায়, নইলে সেই বন্ধ্যা টাকাকে লাভের অঙ্কে গণ্য করাই যায় না। সেইজন্যেই ইতিহাসের প্রথম দূরবর্তী দাক্ষিণ্যকে সুপ্রত্যক্ষ করে রাখার প্রয়োজন হয়। পরবর্তী রূপান্তরের সঙ্গে তুলনা করে জানা চাই যে, নিরন্তর অভিব্যক্তির পথেই তার অমরতা, নিবির্বকার জড়ত্বের বন্দিশালায় নয়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্য ভাষার সিংহদ্বার উদঘাটন করে ছিলেন। তার পূর্ব থেকেই এই তীর্থাভিমুখে পথ খননের জন্য বাঙ্গালীর মনে আহ্বান এসেছিল এবং তৎকালীন অনেকেই নানাদিক থেকে সে আহ্বান স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাদের অসম্পূর্ণ চেষ্টা বিদ্যাসাগরের সাধনায় পূর্ণতার রূপ ধরেছে। ভাষার একটা প্রকাশ মননের দিকে এবং জ্ঞানের তথ্য সংগ্রহের দিকে অর্থাৎ বিজ্ঞান তত্বজ্ঞানে ইতিহাসে। আর একটা প্রকাশ ভাবের বহুরূপ রসসৃষ্টিতে; এই শেষোক্ত ভাবাকেই বিশেষ করে বলা যায় সাহিত্যের ভাষা। বাংলার এই ভাষা দ্বিধাহীন মূর্তিতে প্রথম পরিস্ফুট হয়েছে বিদ্যাসাগরের লেখনীতে । তার সত্ত্বায় শৈশব যৌবনের দ্বন্দ ঘুচে গিয়েছিল।
ভাষার অন্তরে একটা প্রকৃতিগত অভিরুচি আছে, সে সম্বন্ধে যাদের কাছে সহজ বোধশক্তি, ভাষার সৃষ্টিকার্যে তাঁরা স্বতই এই রুচিকে বাঁচিয়ে চলেন, একে ক্ষুণ্ণ করেন না। সংস্কৃতশাস্ত্রে বিদ্যাসাগরের ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। এইজন্য বাঙ্গলাভাষার নির্মাণকার্যে সংস্কৃত ভাষার ভাণ্ডার থেকে তিনি যথোচিত উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু উপকরণের ব্যবহারে তার শিল্পীজনোচিত বেদনাবোধ ছিল। তাই তার আহরিত সংস্কৃত শব্দের সবগুলিই বাঙ্গলা ভাষা সহজে গ্রহণ করেছে , আজ পর্যন্তও তার কোনটাই অপ্রচলিত হয়ে যায় নি। বস্তুত পাণ্ডিত্য উদ্ধত হয়ে উঠে তাঁর সৃষ্টিকার্যের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে নি। এতেই তাঁর ক্ষমতার বিশেষ গৌরব। তিনি বাঙ্গলাভাষার মুর্তি নির্মাণের সময় মর্যাদা রক্ষার প্রতি দৃষ্টি রেখেছিলেন । মাইকেল মধুসূদন ধ্বনি হিল্লোলের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিস্তর নূতন সংস্কৃত শব্দ অভিধান থেকে সংকলন করেছিলেন । অসামান্য কবিত্বশক্তি সত্বেও সেগুলি তার নিজের কাব্যের অলংকৃতরূপেই রয়ে গেল। বাংলাভাষার জৈব উপাদানরূপে স্বীকৃত হলো না। কিন্তু বিদ্যাসাগরের দান বাংলা ভাষার প্রাণ পদার্থের সঙ্গে চিরকালের মতো মিশে গেছে,কিছুই ব্যর্থ হয়নি ।
শুধু তাই নয়। যে গদ্য ভাষা রীতির তিনি প্রবর্তন করেছেন, তার ছাদটি বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা কার্যের ভূমিকা নির্মাণ করে দিয়েছে । অথচ যদিও তার সমসাময়িক ঈশ্বর গুপ্তের মতো রচয়িতার গদ্য ভঙ্গীর অনুকরণে তখনকার অনেক বিশিষ্ট সাহিত্যিক আপন রচনার ভিত গাঁথছিলেন, তবু সে আজ ইতিহাসের অনাদূত নেপথ্যে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে । তাই আজ বিশেষ করে মনে করিয়ে দেবার দিন এলো যে সৃষ্টিকর্তা রূপে বিদ্যাসাগরের যে স্মরণীয়তা আজও বাংলা ভাষার মধ্যে সজীব শক্তিতে সঞ্চারিত তাকে নব নব পরিণতির অন্তরাল অতিক্রম করে সম্মানের অর্ঘ্য নিবেদন করা বাঙ্গালীর নিত্যকৃত্যের মধ্যে যেন গণ্য হয়। সেই কর্তব্য পালনের সুযোগ ঘটবার জন্য বিদ্যাসাগরের জন্মপ্রদেশে এই যজ্ঞমন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে আমি তার দ্বার উদঘাটন করি । পুণ্য স্মৃতি বিদ্যাসাগরের সম্মাননার অনুষ্ঠানে আমাকে যে সম্মানের পদে আহান করা হয়েছে, তার একটি বিশেষ সার্থকতা আছে। কারণ এই সঙ্গে আমার স্মরণ করবার এই উপলক্ষে ঘটল যে বঙ্গসাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোক যদি স্বীকার করে থাকেন, তবে আমি যেন স্বীকার করি সমাজের দ্বার উদঘাটন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ।
এখনো আমার সম্মান নিবেদন হয়নি । সবশেষের কথা উপসংহারে বলতে চাই। প্রাচীন আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বংশে বিদ্যাসাগরের জন্ম, তবু আপণ বুদ্ধির দীপ্তিতে তাঁর মধ্যে ব্যক্ত হয়ে ছিল আনুষ্ঠানিকতার বন্ধন বিমুক্ত মন। সেই স্বাধীনচেতা তেজস্বী ব্রাহ্মণ যে অসামাণ্য পৌরুষের সঙ্গে সমাজের বিরুদ্ধতাকে একদা তাঁর সকরূণ হৃদয়ের আঘাত ঠেলে দিয়ে উপেক্ষা করেছিলেন, অদম্য অধ্যাবসায়ের সঙ্গে জয়ী করেছিলেন আপন শুভ সংকল্পকে, সেই তার উত্তুঙ্গ মহত্বের ইতিহাসকে সাধারণত তার দেশের বহুলোক সসঙ্কোচ নি:শব্দে অতিক্রম করে থাকেন। একথা ভূলে যান যে, আচারগত অভ্যস্ত মতের পার্থক্য বড়ো কথা নয় কিন্তু যে দেশে অপরাজেয় নির্ভীক চারিত্রশক্তি সচরাচর দুর্লভ, সে দেশে নিষ্ঠুর প্রফুল্লতার বিরুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্রের হিতব্রত পালন সমাজের কাছে মহৎ প্রেরণা । তাঁর জীবনীতে দেখা গেছে ক্ষতির আশঙ্কা উপেক্ষা করে দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বারম্বার আত্মসম্মান রক্ষা করেছেন, তেমনি যে শ্রেয়োবুদ্ধির প্রবর্তনায় দণ্ডপাণি সমাজ শাসনের কাছে তিনি মাথা নত করেননি, সেই কঠিন সঙ্কটের বিপক্ষে তিনি তার আত্মসন্মান রক্ষার মূল্যবান দৃষ্টান্ত। দীনদুঃখীকে তিনি অর্থদানের দ্বারা দয়া করেছেন, সেকথা তার দেশের সকল লোক স্বীকার করে, কিন্তু অনাথ নারীদের প্রতি যে করুণায় তিনি সমাজের রুদ্ধ হৃদয়দ্বারে প্রবল শক্তিতে আঘাত করেছিলেন, তাঁর শ্রেষ্ঠতা আরো অনেক বেশি। কেননা তার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে কেবলমাত্র তার ত্যাগশক্তি নয় তাঁর বীরত্ব। তাই কামনা করি, আজ তার যে কীর্তিকে লক্ষ্য করে এই স্মৃতিসদনের দ্বার উন্মোচন করা হলো. তার মধ্যে সর্বসমক্ষে সমুজ্জ্বল হয়ে থাক এই মহাপুরুষোচিত কারুণ্যের স্মৃতি ।
M E D I N I K A T H A J O U R N A L
Edited by Arindam Bhowmik
(Published on 11.05.2024)
তথ্যসূত্র:
• চিঠিপত্র।
• Rabindranath Tagore- A Biography, KRISHNA KRIPALANI
• কিছু বনফুল, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়।
• মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ, হরিপদ মন্ডল।
• মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ, কবি দর্শন, আজহারুদ্দীন খান।
• রবি প্রণাম, রবীন্দ্র স্মৃতি সমিতি, মেদিনীপুর।
• সাহিত্যিক আজহারউদ্দীন খান! রবীন্দ্রনাথকে দেখা শেষ মেদিনীপুরবাসী :কামরুজ্জামান।