মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  | मेदिनीपुर में रवीन्द्रनाथ टैगोर | Rabindranath Tagore in Medinipur (Midnapore)

১৭/১২/৩৯ রবিবার বিকেল ৪ টায়


রবীন্দ্র নিবাসের সামনে মাঠে আয়োজিত


ছাত্রসভায় রবীন্দ্রনাথের ভাষণ


मेदिनीपुर में रवीन्द्रनाथ टैगोर | Rabindranath Tagore in Medinipur


অরিন্দম ভৌমিক।




Home » Famous people in Medinipur » Arindam Bhowmik » মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



আজকে যে পুণ্য অনুষ্ঠানকে সুসম্পন্ন করবার জন্য আমাকে আহান করা হয়েছে, - তা আশ্চর্য সফলতা লাভ করেছে। সে আনন্দ আজ সমস্ত দিন আমার হৃদয়কে পূর্ণ করে আছে। এখন দিন অবসান হয়ে এল, অপরাহ্ণ; সমস্ত দিনের ক্লান্তি সে ক্রমশ: আমার এই জরাজীর্ণ দেহে ঘনীভূত হয়ে আসছে। অতএব তোমাদের কাছে আমার এই নিবেদন- আমার কাছে, এখন তোমরা অধিক কিছু প্রত্যাশা করো না। কর্মকে যথার্থভাবে সুসম্পন্ন করবার জন্য ছাত্রদের ভিতর যে আশ্চর্য অধ্যাবসায় দেখা গেল সে আমার চিরকাল মনে থাকবে । তার একটা বিশেষ কারণ আছে । আমি তোমাদের সঙ্গে অর্থাৎ এই জেলার ছাত্রবৃন্দের সঙ্গে সুপরিচিত নই। তোমাদিগকে এই আমি প্রথম দেখলুম এবং এই একটি বৃহৎ কর্মানুষ্ঠান উপলক্ষ্যে দেখলুম- তোমাদের আগ্রহ, ত্যাগ ও অধ্যবসায় । দেখে আমি খুব আশান্বিত হয়েছি, এখানকার ভবিষৎ সম্বন্ধে । কিন্তু দক্ষিণ বঙ্গের ছাত্রদের সম্বন্ধে গুরুতর উদ্বেগের কারণ মনে জন্মেছে। দেখ, ঝরণা পর্ব্বতগিরি থেকে নীচে নেমে এসে ধরণীকে উর্বর করে, অভিষিক্ত করে। তার একটি নিয়ম আছে। সে হচ্ছে প্রণামের নিয়ম। সে নেমে আছে হেট হয়ে আছে। এই নিয়ম যদি সে পালন করে ধরণী ধন্য হয়। এর বিপরীত হলে সেটা অত্যন্ত অশোভন শুধু নয়, অস্বাভিক হয়। এখনকার দিনে ছাত্রদের ব্যবহার যে দিন দিন উৎকট হয়ে উঠেছে, সে আমাদের দেশের পক্ষে অত্যন্তউদ্বেগের কারণ হয়েছে। যেখানে আমাদিগকে নম্র হয়ে গ্রহণ করতে হবে সেখানে যারা উদ্ধত হয়ে তাকে প্রত্যাখান করে, তারা অকৃতার্থ হবে সমস্ত জীবন ধরে। বিনয়ের সহিত গ্রহণ করতে পারা- একটা ক্ষমতা। যারা মনে করে এটা অক্ষমতার লক্ষণ তারা ভূল করে এবং সেজন্য সমস্ত দেশকে দুর্গতি সহ্য করতে হবে। যারা যথাযোগ্য স্থান থেকে শাসনভার গ্রহণ করতে অক্ষম, যারা সে শাসনকে মনে করে অধীনতার লক্ষণ, তাদের অন্তরের ভিতর যথার্থ যে দৌবর্বল্য আছে সেটা আজকের দিনে প্রশ্রয় পেয়েছে। এই কাপুরুষতা আমরা দেখতে পাই আমাদের সাহিত্যে, সমাজে, সভাস্থল সর্বত্র অত্যন্ত কুশ্রী রূপ ধারণ করে আমাদের ভয়ের কারণ জমাচ্ছে। একথা বলবার একটা কারণ উপস্থিত হয়েছে বলে এটা আমার মনে সুস্পষ্ট হয়েছে।


আমি যখন এখানে আসছিলুম পথের কলিকাতার পৌর পরিষদ আমাকে আহবান করে নিয়ে যায়। যে বিষয় সম্বন্ধে বলতে তারা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন যদিও সে সম্বন্ধে আমার যা বক্তব্য, দেশের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রেখে তা লিপিবদ্ধ করে নিয়েছিলুম অত্যন্ত ক্লান্তির মধ্যে। সে যে কি রকম উশৃঙ্খলা, কি রকম কলরব, কোলাহল- দক্ষযজ্ঞ ভঙ্গের জন্য দানবের মত সমস্ত সভা ভেঙে দেবার জন্য চেষ্টা দেখলুম। তাদের বুঝা উচিৎ ছিল একটা সংকীর্ণ জায়গায় সকলের স্থান দেওয়া অসাধ্য তখন তাদেরকে প্রবেশ করতে দেওয়া সম্ভব নয়। তাদের মনে বোধ হয় একথা এসেছিল আমরা যখন শুনতে পাচ্ছিনা, তখন আর কেহ শুনতে পাবে না- এই ঈর্ষাতে সভাকে প্রায় নিষ্ফল করে দিল। তারপর খড়্গপুর এসে দেখলুম কি রকম ভাঙ্গন ধরেছে। যথোচিত শাসন গ্রহণের শক্তি ছেলেদের একটুও নেই। যেখানে শিক্ষকেরা ছাত্রদের ভয় করে চলে পাছে তাদের ব্যবসায়ের ক্ষতি হয়, সেখানে কি সর্বনাশ তৈয়ার হয়ে উঠেছে অঙ্গ বয়স্ক ছেলেদের ভিতর দিয়ে। এরা কি কখনও দেশের যথার্থ ভার গ্রহণ করতে পারবে ? কখনও পারবে না। এরা ভাঙবে। বাংলা দেশে ভেঙে দেওয়ার প্রবণতা চারিদিকে দেখতে পাই। দেশের লোকের মনে একটি অত্যন্ত ভুল ধারণা আছে-যেন অস্বীকার কথা, নিয়মকে, নীতিকে অস্বীকার করার মধ্যে বীরত্ব আছে । তার মধ্যে যে কাপুরুষতা আছে সেটা তারা বুঝে না। কি সর্বনাশ ঘটেছে, জীবনের সকল বিভাগে কি দুর্বলতা সৃষ্টি হচ্ছে। বরযাত্রীরা যখন বুঝে কন্যাপক্ষীয়েরা অসহায়, মাথা হেট করে থাকতে তারা বাধ্য, তখন তাদের উপর উৎপীড়ন হয়। উৎপীড়ণ করে কারা ? যারা অযোগ্য অভাজন, অন্য কোথাও যাদের স্থান নেই তারা দুর্বলকে পীড়ন করে, অপমান করে। আজকের দিনে শিক্ষার ভিতর যে দুর্নীতি প্রবেশ করেছে দেখে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়েছি।


আমাদের অল্প বয়সে গুরুজনদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়েছে। কখনও মনে করিনি- তাদের প্রতি ঔদ্ধত্ব প্রকাশ করার মধ্যে একটা বীরত্ব আছে, গৌরব আছে। তাদের সম্মান করতে পারার মধ্যে আমাদের নীতিজ্ঞান প্রকাশ পায়। তোমাদের যা দেখলুম, খুব আনন্দিত হয়েছি। ছাত্রধর্মের মধ্যে শিক্ষা করবার যে নীতি আছে, প্রণালী আছে তার-উচ্চ আদর্শকে তোমরা সর্বতোভাবে রক্ষা করবে। এক একটি অন্যায় দৃষ্টান্ত জনসমাজের ভিতর বিষ প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে । এখানে যেন সে বিষ প্রবেশ করতে না পারে। সকাল বেলায় বহুজনসভায় যে বিনয়ের ভাব, সংযমের ভাব দেখেছি তাতে আমি আশ্চর্য হয়েছি, আমার মনে হয়েছিল- এমন বৃহৎ জনতা, এরা যথার্থ শিষ্টাচার রাখতে পারবে না। তোমাদের দেখে আমি আশাহ্বিত হয়েছি- কলিকাতা থেকে দুরে তোমাদের মধ্যে এই দুনীতি প্রবেশ করেনি। আশা করি কখনও যেন না করে। ভারতবর্ষের শাসন ভার যাদের উপর পড়বে তারা যদি চালিত হতে শিক্ষা না করে, ছেলেবেলা থেকে শাসন গ্রহণ করতে না শিখে, সমস্ত নিয়মকে যদি তারা অস্বীকার করে, তাকে আধুনিকতার লক্ষ্য বলে মনে করে গর্ববোধ করে, তাহলে ধিক এ দেশ; তাহলে অত্যন্ত দুর্গতি হবে এ দেশের, এ কথা জোর করে বলতে পারি। এ রকম কুশিক্ষা ও ঔদ্ধত্ব পৃথিবীর আর কোথাও দেখিনি ।


জাপানে গিয়েছি- কি আশ্চর্য রীতিনীতি ছেলেরা শিক্ষা করছে। হাজার ছাত্র দেখেছি, তাদের মধ্যে কাজ করেছি, বক্তৃতা করেছি যে ভাষায় তারা অর্ধেক বুঝিনি- কি রকম হয়ে নিঃশব্দে, শ্রদ্ধার সঙ্গে যথার্থ আন্তরিক ভক্তির সঙ্গে তারা শিক্ষকের মত মেনে নিয়েছে, নত হয়ে তাকে গ্রহণ করেছে। সর্বত্র দেখলুম জনতার মধ্যে নতি আছে। রেলস্টেশনে বা অন্য কোথাও যেখানে বড় সমারোহ হয়েছে, জনতার মধ্যে সর্বদা একটি চেষ্টা, একটি আগ্রহ দেখেছি- কর্তব্যের যেন বাধা না পড়ে। সবর্বজনের সঙ্গে যেখানে আমাদের ব্যবহার, সেখানকার নীতি যদি আমরা রক্ষা করতে না পারি তাহলে বৃহৎ কাজ আমরা কখনও করতে পারব না। কেননা দেশের কাজ সে তো সর্ব্বসাধারণের কাজ। তাকে ভাঙবার জন্য যদি কেবল উদ্যম করি, কোন মতান্তর থাকার দরুন বা অন্য কোন কারণে যদি তার উপর অত্যাচার করে সৌজন্যে আঘাত করি তাতে অত্যন্ত ক্ষতি হবে সৌজন্য কাপুরুষোচিত নয়,পুরুষোচিত। তরুণদের তার অভাব লক্ষ্য করে আমি অত্যন্ত ভীত হয়েছি। গুরুজনেরা শঙ্কিত হয়ে তাদের মাথা হেট করেছেন।


ভালোর জন্যে তারা কথা বলতে ভীত হন। এই সকল অনিয়ম বাংলাদেশের ছাত্রবৃন্দ ছাড়া অন্য কোথাও দেখিনি। এখানে কিন্তু সে লক্ষণ দেখিনি। সে জন্য খুশী হয়েছি। তোমাদের ভিতর যে পুরুষোচিত উদ্যম ও অধ্যবসায় দেখলুম, সর্বজনমান্য মেদিনীপুরের গৌরবকে তোমরা যে রকম সংযতভাবে বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করেছ তা দেখে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। এই বিনয়ের ধারা, সৌজন্যের ধারা কখনও যেন ক্ষুন্ন না হয়।


উপসংহারে আমি একটা কথা বলবো । তোমাদের একটু নিন্দা করব। অপটুতা হাসবার জিনিস নয়। যারা কোন কাজ করেছে, তাদের যদি কোন ক্রটি হয়- সেটা দেখছো ব্যায়ামে অপটুতা, তাতে করুণা মনে করো, লজ্জা মনে কোর না । যদি দৈবাৎ পদস্থলন হয়, ব্যবহার যদি ঠিক করতে না পার, হেসো না। অত্যন্ত নিষ্ঠুর সেটা, তাতে লজ্জা দেওয়া হয়, তাতে তাদেরকে দাবিয়ে দেওয়া হয়। যারা দেখাতে এসেছে তাদের কৃতিত্ব, প্রাণপণে চেয়ে তাদের প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার হতে পারে না।




M E D I N I K A T H A J O U R N A L

Edited by Arindam Bhowmik

(Published on 30.05.2024)


তথ্যসূত্র:

• চিঠিপত্র।
• Rabindranath Tagore- A Biography, KRISHNA KRIPALANI
• কিছু বনফুল, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়।
• মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ, হরিপদ মন্ডল।
• মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ, কবি দর্শন, আজহারুদ্দীন খান।
• রবি প্রণাম, রবীন্দ্র স্মৃতি সমিতি, মেদিনীপুর।
• সাহিত্যিক আজহারউদ্দীন খান! রবীন্দ্রনাথকে দেখা শেষ মেদিনীপুরবাসী :কামরুজ্জামান।



নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার মূল্যবান মতামত জানান।