মেদিনীপুরে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
शरत्चन्द्र चट्टोपाध्याय | Sarat Chandra Chattopadhyay
(১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ - ১৬ জানুয়ারি ১৯৩৮)
অরিন্দম ভৌমিক।
ডাকনাম - ন্যাঁড়া।
ছদ্মনাম - অনিলা দেবী।
বড়দিদি (১৯১৩), পল্লীসমাজ (১৯১৬), চরিত্রহীন (১৯১৭), দেবদাস (১৯১৭), শ্রীকান্ত (১৯১৭-১৯৩৩), দত্তা (১৯১৮), গৃহদাহ (১৯২০), পথের দাবী (১৯২৬), পরিণীতা (১৯১৪), শেষ প্রশ্ন (১৯৩১) - এই নামগুলি শুনলে যার কথা মনে আসে তিঁনি বাংলা সাহিত্যের 'অপরাজেয় কথাশিল্পী' শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা ভুবনমোহিনী দেবী'র পাঁচ ছেলেমেয়েদের মধ্যে শরৎচন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে বাবার মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর পৈতৃকভিটা ছিল উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাঁচড়াপাড়ার কাছে মামুদপুর গ্রামে। দিদির নাম অনিলা দেবী, বোন সুশীলা দেবী। দুই ভাই প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশচন্দ্র। শরৎচন্দ্রের মামাবাড়ি হালিশহরে হলেও পরে তাঁরা ভাগলপুরে চলে গেছিলেন। সংসারে অভাবের কারণে শরৎচন্দ্রের ছোটবেলা কেটেছে ভাগলপুরে মামাবাড়িতে।
দেবানন্দপুর গ্রামের এই বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Photo: Manik Mukhopadhyay Satyabrata Toy 1977 The Golden Book of Saratchandra. All Bengal Sarat Centenary Committee)। ।
দেবানন্দপুরের প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায় দুবছর পড়াশোনার পরে ভাগলপুরে এলে, মামা তাঁকে দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৮৯ সালে বাবার চাকরি চলে গেলে সবাই দেবানন্দপুরে ফিরে আসেন। শরৎচন্দ্র হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হলেও ১৮৯২ সালে অভাবের কারণে স্কুল ছাড়তে হয়। 'কাশীনাথ' ও 'ব্রহ্মদৈত্য' নামে গল্প দুটি সেই সময়ে লিখেছিলেন। ১৮৯৩ সালে তাঁরা আবার ভাগলপুর ফিরে যান। পড়াশুনার প্রতি শরৎচন্দ্রের আগ্রহের জন্য, সাহিত্যিক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দেন। ১৮৯৪ সালে এনট্রান্স পরীক্ষা পাস করে তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হন। কলেজের খরচ চালানোর জন্য দাদুর ভাই অঘোরনাথের দুই ছেলে সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে রাত্রে পড়াতেন। কিন্তু পয়সার অভাবে এফ.এ. পরীক্ষা দিতে পারেন নি। পড়াশুনা ছাড়ার পরে সময় কাটছিল আদমপুর ক্লাবে খেলাধুলো ও অভিনয় করে।
সেই সময় ভাগলপুরে বিভূতিভূষণ ভট্ট তাঁর বাড়িতে একটি সাহিত্যসভার আয়োজন করেছিলেন। সেই সাহিত্যসভার জন্য শরৎচন্দ্র লিখে ফেললেন বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা ইত্যাদি উপন্যাস ছাড়াও অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, বোঝা, হরিচরণ ইত্যাদি গল্প। বনেইলী রাজ এস্টেটে (Banaili Raj) শুরু করেন তাঁর চাকরি জীবন। কিন্তু কোন কারণে পিতার উপরে অভিমান করে চাকরি ও ঘর ছেড়ে চলে যান। পিতার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আবার ফিরে আসেন। এরপরে তিঁনি আসেন কলকাতায়। সেখানে উকিল লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে হিন্দি থেকে ইংরেজি অনুবাদ করার চাকরি পান। কলকাতার 'কুন্তলীন' প্রতিযোগিতায় 'মন্দির' নামে একটি গল্প লিখে পাঠিয়ে প্রথম হন। লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বোনের স্বামী উকিল অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় থাকতেন ব্রহ্মদেশে (রেঙ্গুনে)। ১৯০৩ সালের জানুয়ারি মাসে শরৎচন্দ্র ব্রহ্মদেশে (রেঙ্গুনে) সেই অঘোরনাথের বাড়িতে চলে যান, চাকরি পান বর্মা রেলওয়েতে হিসাব পরীক্ষক হিসেবে। সেখান থেকে দুবছর পরে বন্ধু গিরীন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে চলে যান পেগু (বর্তমানে Bago), থাকতেন অবিনাশ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। এক বছর পরে মণীন্দ্রনাথ মিত্রের সাহায্যে শরৎচন্দ্র বর্মার পাবলিক ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টস অফিসে চাকরি পেয়ে আবার রেঙ্গুন ফিরে আসেন।
'যমুনা' নামে পত্রিকার জন্য সম্পাদক ফনীন্দ্রনাথ পালের অনুরোধে 'রামের সুমতি' গল্পটি লেখেন। এরপর তিনি 'ভারতবর্ষ' পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। ১৯০৬ থেকে ১৯১৬ পর্যন্ত অ্যাকাউন্টস অফিসে চাকরি করার পরে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে শরৎচন্দ্র চাকরি ছেড়ে বাংলায় ফিরে আসেন।
ব্রহ্মদেশে থাকাকালীন শরৎচন্দ্র বোটাটং পোজনডং (botataung ) অঞ্চলে কলকারখানার মিস্ত্রিদের পাড়ায় একটি বাড়ির দোতলায় থাকতেন। তার বাড়ির নিচে এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রি মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। সেই ব্রাহ্মণ মিস্ত্রি তার মেয়ে শান্তি দেবীর বিয়ে এক মদ্যপের সঙ্গে ঠিক করলে শান্তি দেবী শরৎচন্দ্রের শরণাপন্ন হন। একরকম বাধ্য হয়েই শরৎচন্দ্র তাঁকে বিয়ে করেন। রেঙ্গুনে তাঁদের এক ছেলে হয়। কিন্তু প্লেগ রোগ, শান্তি দেবী এবং এক বছরের ছেলেকে চিরদিনের মত কেড়ে নেয়। অনেক বছর পরে রেঙ্গুনেই মেদিনীপুরের সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রে জড়িয়ে পড়েন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিভাবে ?
মেদিনীপুরের জামাই।
ব্রহ্মদেশে (রেঙ্গুনে) শ্রী কৃষ্ণদাস চক্রবর্তী নামে মেদিনীপুরের এক ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তির সঙ্গে শরৎচন্দ্রের আলাপ হয়। কৃষ্ণদাস বাবুর বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের আনন্দপুরের (কেশপুর) শ্যামচাঁদপুর গ্রামে। তাঁরা পদবি বদল করে অধিকারী থেকে চক্রবর্তী হয়েছিলেন। সেই কৃষ্ণদাস বাবুর অনুরোধে তাঁর ১৪ বছরের মেয়ে মোক্ষদাকে বিয়ে করেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর এই দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ও বিবাহের স্থান নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। অধিকাংশের মত হিরণ্ময়ী, কেউ কেউ বলেন মোক্ষদা। কেউ বলেন বিয়ে হয়েছিল রেঙ্গুনে, কেউ বলেন কেশপুরে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের আনন্দপুরের (কেশপুর) শ্যামচাঁদপুর গ্রামে শরৎচন্দ্রের শ্বশুরালয় (কৃষ্ণদাস বাবুর বাড়ি )। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।
এই দুই বিষয়ই স্বয়ং হিরণ্ময়ী দেবী পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন জীবনীকার গোপাল চন্দ্র রায়ের কাছে। তিঁনি জানিয়েছিলেন দুটো নামই তাঁর এবং তাঁর আদি নিবাস কেশপুরে, বিয়ে হয় রেঙ্গুনে ৩৬ নং গলিতে। বিয়ের পর শরৎচন্দ্র মোক্ষদার নাম রাখেন হিরন্ময়ী দেবী। তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন।
মেদিনীপুরের দিকে তাকিয়ে।
এতো গেল সম্পর্কের কথা। এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে। যদি বলি, শরৎচন্দ্র তাঁর অনেক লেখা মেদিনীপুরের দিকে তাকিয়ে লিখেছেন। আপনি বলবেন, সেটা আবার কেমন করে ? তাহলে একটু খুলেই বলি। মাঝবয়সে শরৎচন্দ্র হাওড়া জেলার সামতাবেড়ে (পানিত্রাস গ্রাম) মাটির বাড়িতে থাকতেন। দেউলটি রেল-স্টেশন থেকে অল্পদূরে সামতাবেড়ের বাড়িটা রূপনারায়ণ নদের তীরে একটি দারুন সুন্দর জায়গায় অবস্থিত। ১৯৭৮ সালের বন্যায় আশেপাশের সব গ্রামের মাটির বাড়ি নষ্ট হয়ে গেছিল।
শরৎচন্দ্র সামতাবেড়ের (পানিত্রাস গ্রাম) এই বাড়িতে নদীর দিকে মুখ করেই লিখতে বসতেন (এখনো তাঁর চেয়ার-টেবিল সেইভাবেই রাখা আছে)।
অথচ রূপনারায়ণের পাড়ে থেকেও শরৎচন্দ্রের মাটির বাড়িটা অদ্ভুতভাবে বেঁচে যায়। জানালা পর্যন্ত ভিতটি ইঁট-সিমেন্টে গাঁথা ছিল বলে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পড়ে যায়নি। পরে সরকারি উদ্যোগে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। এই বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে অর্থাৎ নদীর ওপারে মেদিনীপুর। শরৎচন্দ্র এই বাড়িতে নদীর দিকে মুখ করেই লিখতে বসতেন (এখনো তাঁর চেয়ার-টেবিল সেইভাবেই রাখা আছে)। তাহলে বুঝতেই পারছেন তিঁনি এই বাড়িতে যতগুলি লেখা লিখেছেন, সবগুলিই মেদিনীপুরের দিকে তাকিয়ে।
মেদিনীপুর শহরে শরৎচন্দ্র।
বাংলা ১৩৩৫ সনের ১২ই ফাল্গুন শরৎচন্দ্র মেদিনীপুর শহরে এসেছিলেন। সেই সময় 'বেলিহল পাবলিক লাইব্রেরির' (বর্তমানে রাজনারায়ণ স্মৃতি পাঠাগার) উদ্যোগে প্রত্যেক বছর মেদিনীপুর পাঠাগার সম্মেলনের আয়োজন করা হত। সেই সম্মেলনের দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মেদিনীপুর শহরে আসেন। রবিবার দুপুরের ট্রেনে মেদিনীপুর শহরে পৌঁছে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি নাড়াজোল রাজবাড়ীর ছোটকুমার বিজয়কৃষ্ণ খানের বাড়ীতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।
বিশ্রাম নেওয়ার পরে তাঁকে বটতলার চকে অবস্থিত ওয়াই এম, সি, এ প্রাঙ্গনে আনা হয়। সেখানেই পাঠাগার সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে জেলার অধিকাংশ পাঠাগারের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। অভার্থনা সমিতির সভাপতির ভাষণের পর মন্মথনাথ দাস শরৎচন্দ্রকে বরণ করেন। তাঁর উদ্যেশ্যে একটি কবিতা পাঠ করেন বিভূতিভূষণ দাস (বিদ্যা-বিনোদ) এবং 'শরৎ প্রশস্তি' পাঠ করেন নারায়ণ ভঞ্জ। সম্পাদক সুধাময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণের পর শরৎচন্দ্র তাঁর বক্তব্য রাখেন। সেই সময় সবাই নিজেদের ভাষণ লিখে এনে পাঠ করতেন। কিন্তু শরৎচন্দ্র কোন লিখিত ভাষণ পাঠ না করে সমাজে সাহিত্যের ভূমিকা ও তাতে পাঠাগারের করণীয় বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেন।
পরের দিন সকালে বিজয়কৃষ্ণ খানের কেরানিতলার বাড়ির হলঘরে একটি সাহিত্য আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। এই সাহিত্য আলোচনায় মনিষীনাথ বসু, মন্মথনাথ দাস, অধ্যাপক অশ্বিনীকুমার দত্ত, অধ্যাপক হরিচরণ মুখোপাধ্যায়, নটেন্দ্রনাথ দাস, কালীপদ দত্ত, অতুলচন্দ্র বসু, মহেন্দ্রনাথ দাস, সুধাময় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এই আলোচনা সভা প্রায় বেলা ১২টা পর্যন্ত চলে। শহরের সাহিত্যিকদের তরফ থেকে শরৎচন্দ্রের উদ্যেশ্যে মহেন্দ্রনাথ দাস একটি অভিনন্দন পত্র পাঠ করেন। সভার পরে শরৎচন্দ্র কর্ণগড়ের মহামায়া মন্দির দেখতে চাইলে দেবেন্দ্রলাল খান তাঁকে মোটরগাড়িতে করে মহামায়া মন্দির দেখিয়ে আনেন। কর্ণগড় থেকে ফিরে আসার পর সে সময়ের কার্যকরী সমিতির সদস্যদের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের একটি গ্রুপফটো তোলা হয়।
বিকেলবেলায় রাজা দেবেন্দ্রলাল খান শরৎচন্দ্রের সম্মানার্থে নাড়াজোল রাজকাছারীতে একটি চা-পানের আসরের আয়োজন করেছিলেন। চা-পানের আসরে সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা হয়। সেই আসরে মেদিনীপুরের লেখকরা তাকে নিজেদের লেখা বই উপহার দেন। চা-পানের আসরের পর শরৎচন্দ্র 'বেলিহল পাবলিক লাইব্রেরির' দীর্ঘকালের সম্পাদক এবং পৃষ্ঠপোষক ত্রৈলোক্যনাথ পাল মহাশয়ের বিশালাকার তৈলচিত্রের আবরণ উম্মোচন করেন। তারপর যুব সমিতির পক্ষ থেকে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়।
মেদিনীপুর শহরে দু-রাত্রি কাটানোর পরে, তৃতীয় দিন মঙ্গলবার (১৪ই ফাল্গুন) সকাল ৯.৪৫ মিনিটের ট্রেনে মেদিনীপুর থেকে বিদায় নেন। যাবার সময় বিজয়কৃষ্ণ খান তাঁকে সবং-এ তৈরী মেদিনীপুরের বিখ্যাত একটি বহু মুল্য সুদৃশ্য মসলন্দি উপহার দেন। স্টেশনে তাঁকে বিদায় জানাতে উপস্থিত ছিলেন বহু মানুষ।
প্রথম সারি (বসে), বামদিক থেকে - হিমাংশু রায়, গৌরহরি মিত্র।
দ্বিতীয় সারি, বামদিক থেকে - শরৎচন্দ্রের বন্ধু, বিজয়কৃষ্ণ খান, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ক্ষিতীশচন্দ্র দত্ত, মন্মথনাথ দাস।
তৃতীয় সারি, বামদিক থেকে - তিনকড়ি সেন, বিনয় দাসগুপ্ত, চন্দ্রশেখর দত্ত, সুধাময় বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র কানুনগো, বিভূতিভূষণ দাস, শিবময় বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিময় বন্দোপাধ্যায়।
১৩ই ফাল্গুন সকালের ঘরোয়া বৈঠকে যে আলোচনা হয়েছিল তার একটি বিবরণ মেদিনীপুরের বিশিষ্ট সাহিত্যিক আজহারউদ্দিন খান-এর শরতবিখ্যা বই থেকে দেওয়া হল। তিঁনি সুধাময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরোনো খাতাপত্র ও তৎকালীন পত্রপত্রিকা ঘাটাঘাটি করে শরৎচন্দ্রের কথোপকথন তৈরী করেছিলেন। বক্তাদের ভাষা যতদুর সম্ভব অক্ষুন্ন ও অপরিবর্তিত রেখেছেন।
কথোপকথন -
মন্মথনাথ দাস - সতীত্বের যে সেকেলে ধারণা তার বিরুদ্ধে আপনি একটা revolt এনেছেন। কেন তা বুঝিয়ে দিন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় - revolt আমি আনিনি, তবে তা এসেছে যুগের প্রবাহে এবং আমি শুধু তা প্রকাশ করেছি। অনেকদিন ধরে একটা কোন ধারণা বা বস্তু চলে আসছে বলেই যে তা ঠিক তা'ত নয়। কোন কিছুই চিরকালের জন্য সমানভাবে ঠিক নয়। পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের সতীত্ব একটা অন্ধ বই তো নয়। কাজেই মনুষ্যত্বকে যে সে ছাপিয়ে যাবে তা তো হতে পারে না। কর্তব্য, আর অধিকার-এ দুটির যধ্যে এখন অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ যে, একটা না থাকলে অপরটা নিরর্থক। শাস্ত্র আমি সব ভাল জানি নে। ধর্মও আমায় কিছু নেই; কিন্তু যা দেখে আসছি তাতে পুরুষের দিক থেকে কোনও কর্তব্য আছে বলে মনে হয় না। পুরুষের আছে শুধু অধিকার, শুধু দাবী। পুরুষের পক্ষে কী-ই বা সম্ভব নয়? অথচ একটি যুবতী মেয়ে যদি যৌবনে একবার একটা ভুল করে ফেলে তাহলে আর তার রেহাই নেই। তার চরম দুর্গতি করিয়ে তবে লোকে ছাড়বে। কেন? - তার ভালো হবার পথ, সমাজের মধ্যে 'একজন' হয়ে ফিরে আসবার পথ কেন খোলা থাকবে না? এই তো সমস্যা! তার কি প্রাণ নেই? আমি তো জানি তাদের মধ্যেও এত বড় প্রাণ আছে, যা অনেক গৃহস্থ ঘরের সতী মেয়ের মধ্যে নেই।
মন্মথবাবু - পুরুষ মানুষ যা খুশী তা করে ও তাতে নিজেকে অধঃপতিত করে - তাই বলে মেয়ে মানুষকেও কি তা করতে দিতে হবে?
শরৎচন্দ্র - এ তো ভুল। দিতে হবে কথার মানে কি ? আমি বলছিলাম যে, আপনি নিজে যা নন, কিসের জোরে আপনি তা অপর পক্ষের কাছে দাবী করেন? এইটা ভাবুন দেখি।
মন্মথবাবু - অন্যায় বা পাপের ওপর ঘৃণার ভাব জাগানো কি উচিত নয়?
শরৎচন্দ্র - হতে পারে উচিত। কিন্ত মানুষের ওপরে মানুষের ঘৃণা - এ ভাবতেও কষ্ট হয়। কিন্তু দেখুন তারক গাঙ্গুলীর 'সরলা' বইতে প্রমদা চরিত্র। অত বড় scoundrel দেখা যায় না; কিন্তু তবু সে আপনাদের সনাতন মাপ কাঠিতে পরম সতী। দৈহিক শুচিতাই কি এত বড় গুণ, যে মেয়ে মানুষ স্বামী জেলে যায় দেখেও তাকে বাঁচাবার জন্যে গহনা টাকা বের ক'রে দেয় না, সেও সতী! সেরূপ সতীত্বের যে কি মূল্য আমি তো জানি নে।
মন্মথবাবু - আপনি কি বলেন যাতে মনে ভয় জাগে এমন করে পাপের ছবি আঁকা উচিত নয় ? পাপের প্রতি ভয়ের কি দরকার নেই?
শরৎচন্দ্র - ভয় কি করবে বলুন তো। ভয়ের কথা তো চিরদিনই চলে আসছে। ফাঁসীর ব্যবস্থা আছে, তবু লোকে খুন করে কেন?
অশ্বিনীকুমার দত্ত - আচ্ছা বেশ্যার একটা ভাল গুণ দেখালে বেশ্যাবৃত্তির দোষ লোকের চোখে কমিয়ে দেওয়া হয় নাকি?
শরৎচন্দ্র - হয়তো হয়। আর হ'লেই বা ক্ষতি কি? আমি সেকালের রাজপুত্র আর রাক্ষসের গল্প লিখতে বসি নি। রাজপুত্রের সবই ভাল - তার এতটুকু কিছু খারাপ নয়। আর রাক্ষসের আগাগোড়া সব খারাপ, কোথাও এতটুকু ভাল নেই তার।
যা সত্যি তা আমি বলব না কেন? কে কি ভাববে তা মনে করে লেখা যায় না তো? আপনারা assume ক'রে নিয়েছেন যে, যা কিছু আগেকার সে সবই কিছু ভালো এবং তার সঙ্গে যেখানে আমি খাপ খাওয়াতে পারিনি সেখানেই সব দোষ দেন। আগে কার সঙ্গে ঠিক ঠিক না মিললেই কি তা খারাপ?
নটেন্দ্রনাথ দাস - বঙ্কিমচন্দ্র যেমন শৈবলিনীর শাস্তি দেখিয়েছেন, তেমনি ক'রে পাপের শাস্তি দেখান উচিত নয় কি?
শরৎচন্দ্র - আমি কাউকে শাস্তি দিতে পারি নে।
সুধাময় বন্দ্যোপাধ্যায় - বিরাজ বৌয়ের তো শাস্তি দেখিয়েছেন?
শরৎচন্দ্র - বিরাজের কথা আলাদা। তার শাস্তি সব স্বেচ্ছাকৃত, সে শাস্তি তার নিজের অন্তরের শাস্তি। কেননা, তার স্বামীকে সে প্রাণ মন দিয়ে ভালবাসতো; কিন্তু শৈবলিনী কখনো চন্দ্রশেখরকে ভাল-বাসেননি। তার peculiar and forced শাস্তি মনের ওপর তো জোর নেই। কত রকম physic force ইত্যাদির সাহায্য নিয়ে বঙ্কিমবাবুকে তখনকার সমাজের মান রাখতে হয়েছিল। আমার কথা হচ্ছে এই যে, আমি যেন কোন দিন মানুষের আত্মাকে আমার লেখার মধ্যে অপমান না করি। মেয়ে মানুষই হোক আর পুরুষ মানুষই হোক তার ওঠবার জন্যে একটা পথও যেন খোলা থাকে।
হিন্দু সমাজ অত্যন্ত নিষ্ঠুর। এর তুলনায় মুসলমান সমাজ ভালো; খ্রিস্টান সমাজ আরও ভালো। এই দেখুন আমার 'পল্লী সমাজে'র রমা আর রমেশ - দু'জনেই কত বড় মহাপ্রাণ, কতখানি মঙ্গল সাধনের ক্ষমতা দু'জনের মধ্যে ছিল। কিন্ত এই দু'জনের জীবন কীভাবে বার্থ হয়ে গেল! এদের দু'জনের একটা মিলন, একটা religious unity হতে পেল না। কিন্তু কেন, তা কি ভাববার বিষয় নয় ? এতবড় প্রাণ নষ্ট হয়ে গেল-অন্য কোন সমাজে এ রকমটা হ'তে পেত ? আমি শুধু ভাববার পথটা দেখিয়ে দিই, আপনারা সমস্যার সমাধান করুন। বাইরের জিনিষ দেখে আমরা অনেক ভুল করি। কিন্ত বাহিরটাই তো সব নয়। অন্তরই যে বড়, তাকে তো সত্যিই অস্বীকার করা যায় না। ভালবাসা যে কত বড় জিনিস, কতখানি তার ক্ষমতা তা ব'লে বোঝানো যায় না। সব দোষ ক্রটি এতে ঢেকে যায়।
মন্মথবাবু - আত্মত্যাগের যে আমাদের প্রাচ্য আদর্শ তা আপনার লেখার কতটুকু স্থান পেয়েছে?
শরৎচন্দ্র - আত্মত্যাগ তো বটেই। আপনারা অনেকেই হয়ত জানেন না, সে সুযোগ আপনাদের হয়নি, কিন্তু আমি বাইরে বাইরে অনেক দূরে দেখেছি। অন্য সমাজে অন্য জাতির তেতর স্ত্রী ও পুরুষের বিবাহের পূর্বে পরস্পর হৃদয় জয়ের জন্য কী বিপুল আত্মত্যাগ! ভালবাসার মত এমন আত্মত্যাগ শিক্ষা দিতে আর তো কিছু পারে না! আমি দেখেছি - একটা বর্মী মেয়ে তার ভালোবাসার পাত্রের সঙ্গে দুটা কথা বলবার আনন্দের জন্য রাতের পর রাত অন্ধকারে সাপ পরিপূর্ণ বাগানের জঙ্গলে প্রতীক্ষায় আছে। যৌন মিলনের পূর্বের অবস্থার কথাই বলছি আমি। প্রণয়-পাত্রীকে জয় করবার জন্যে যুবকের যে একটা বিপুল চেষ্টা, আন্তরিক সাধনা তাতে এত মাধূর্য যে তা আমি অন্যত্র দেখে দেখে আর ভুলতে পারি নি। এই যে পাবার মধ্যে sacrifice করা, কত চেষ্টা, কত সাধনা করা এতে মানুষকে অনেকখানি noble, অনেকখানি great ক'রে দেয়। আমাদের এখানে married couple-এর মধ্যে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। জয়ের যে একটা আনন্দ, জীবনের ওপর তার যে একটা মহৎ প্রভাব, তা থেকে এরা এখানে বঞ্চিত থাকে। জয়ের জন্যে কত ব্যস্ততা, কত আকুলতাই না দেখেছি! তারা শক্তি সঞ্চয় করে, নিজেদের তারা যোগ্য করে তোলে, দরকার হলে duel লড়ে। তারা ভালবাসার মর্যাদা বোঝে; ভালবাসার সম্মান রাখতে জানে। এখানকার সমাজ ধরে-বেঁধে কতকগুলো মন্ত্র পড়ে দু'জনকে এক ক'রে দিল। তাদের এক জায়গায় থাকতে হবে, শুতে হবে। তাদের নিজেদের জন্যে আর করবার কিছুই বাকী থাকে না। তারা বেশ ঘর সংসার করছে; ছেলে পুলে হচ্ছে। অশান্তিও হয় না, তা নয়। কিন্ত তারা ভালবাসার একটা জীবন্ত আনন্দ কখনো পায় না।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় | शरत्चन्द्र चट्टोपाध्याय | Sarat Chandra Chattopadhyay
মনীষীনাথ বসু - ঐ ব্যগ্রতা আকুলতা পশুদের মধ্যেও দেখা যায়, তাই বলে পশুরা কি সেজন্য বড়?
শরৎচন্দ্র - হ্যাঁ, ওটা পাশব ধর্ম তো বটেই। কিন্ত তাই বলে ত' আর দোষের নয়। যে আনন্দ তাতে আছে তা দুর্লভ। বলতে পারেন, জয়ের জন্য সে আকুলতা ক্ষণিক ? হতে পারে ক্ষণিক; কিন্ত সেই দু'দশ দিনের যে আনন্দ তার আর তুলনা নেই। সে আনন্দ জীবনের অনেক দুঃখ কষ্টকে ছাপিয়ে বড় হয়ে থাকে। তার influence খুবই কার্যকরী। Conquest-এর আনন্দ, সে কি কম ?
Self-made মানুষ যেমন বড়, যারা ভালবাসার পাত্রীকে জয় করে, একটা হৃদয় Conquest করে, তারাও তেমনি বড়।
তবে নীতি আমি মানি নে, এমন কথা আমি বলিনে। শুধু সৌন্দর্য চর্চা করব, কোনও নীতি-রুচি মানব না-এতো আর সত্যি সত্যিই চলতে পারে না। কেউ কেউ অবশ্য বলেন সাহিত্যের ভেতর নীতি-টিতি নেই, রুচি আছে, আমি কিন্ত তা বলিনে। আমি বলি নীতিও আছে।
মনীষীবাবু - এসব ধারণা হিন্দুধর্মের প্রতিকূল নয় কি?
শরৎচন্দ্র - বিশেষ কোন ধর্ম সম্বন্ধে আমি কিছু বলিনি, বলতে চাইও না। হয়তো কোন ধর্মই আমি বিশ্বাস করিনে। তবে একথা ঠিক যে এই যাকে হিন্দুধর্ম বলছেন, এই-ই আমাদের পঙ্গু করে রেখেছে, জড় করে রাখবার জন্যে সকলের চেয়ে বেশী দায়ী। এর চেয়ে মুসলমান ধর্মে মনুষ্যত্বের আদর আছে, খৃষ্ঠান ধর্মে তার চেয়েও বেশী। আমার বইয়ের মধ্যে পাত্র পাত্রীর মুখে অবশ্য তাদের উপযোগী কথা আছে। তার কোনটাই আমার নিজের মত নয়। আমি ওসব মানতে পারি না, মানি না। আমি এই জীবনটাকে নিয়েই থাকি। এই-ই অমার কাছে সব। পরজীবন আছে কিনা জানিনে। যাক, এসব আপনাদের ভাল লাগবে না। যা বলছিলাম আগে, এ যে নর-নারীর পরস্পর চেষ্টা করে হৃদয় জয় করার আনন্দ তা আগেও বোধ হয় ছিলো। তখনকার দিনেও নিজের যোগ্যতা জানিয়ে তরুণীকে জয় করতে হত। তা সে সকল জাতের সকল সমাজের মধ্যেই। কোনও রকম ভয়ে ভয়ে সাবধানে বাঁধা-ধরা গন্ডির ভেতর জীবন কাটিয়ে দেওয়া তারা ভালবাসতো না। তাদের অনেকেই তাই সত্যিকারের আনন্দ জীবনে পেত।
মনিষীবাবু - আচ্ছা, যে মদ খায় সে তো আনন্দ পায় ! কিন্তু তা কি ভাল?
শরৎচন্দ্র - এ কথার উত্তর নেই।
অশ্বিনীবাবু - কেউ কেউ অন্যের মাথায় লাঠি মেরেও তো আনন্দ পায়, তাও কি ভাল বলতে চান?
শরৎচন্দ্র - যারা তা পায়, তারা তা পাক। আনন্দের তো শুধু একটাই মুর্তি নয় যে, তারই থেকে সকলকে আনন্দ পেতে হবে আর না পেলে তার মাথায় লাঠি বসিয়ে দেবেন! তবে আমি যে যৌন বিষয়ক আনন্দের কথা বলছিলাম, তার সম্বন্ধে এও আমার দৃঢ় অভিমত, সে-সব জিনিষ ব্যক্ত করলেই তাতে রস বা আনন্দ সৃষ্টি হয় না। নয় অভিব্যক্তি চিরদিনই কদর্যতার প্রকাশক- তা লেখার ভেতরেই হোক বা আর যাতে হোক, একটা সংযম থাকা দরকার। একটা line of demarcation চাই। এই সংযমের নীতি যারা মানে না, অর্থলোভ কিংবা cheap popularity-র জন্যে যারা রসসৃষ্টির নামে নানা কদর্য জিনিষের অবতারণা করে তাদের রচনাকে সাহিত্য বলে মানতে পারিনে। এই রকমভাবে যারা সাহিত্যকে abuse করছেন, তাঁরা নাকি আবার বলেন যে, আমি তাদের পথ দেখিয়াছি। কিন্তু তারা যে রকম নগ্ন, নির্লজ্জ, বীভৎস চিত্র আঁকেন, দৈহিক মিলনে জৈব ধর্মের দিকটা এত বেশী সীমা ছাড়িয়ে রঙ ফেনিয়ে শেষ পর্যন্ত বর্ণনা না করে থামে না, সে রকম কিছু আমার কোনও বইয়ের কোনও চরিত্র অঙ্কনে কেউ দেখিয়ে দিতে পারেন?
Suggestiveness যা আমার বইয়ের কোথাও কোথাও পাবেন, সে হচ্ছে একটা স্বতন্ত্র জিনিষ, তবে ঐ যে আগে বলেছি, একটা line demarcation আছে, ও থাকা উচিত; কিন্ত গোল হচ্ছে এই নিয়ে যে, সে স্থির করে বলে দেওয়া একেবারে অসম্ভব। ঠিক কতটুকু বর্ণনা করলে উপভোগ রস সৃষ্টি হয় এবং তারপরেই কর্দমতার গ্লানি ঘুলিয়ে ওঠে একথা মনে মনে উপলব্ধি করার জিনিষ, ভাববার জিনিষ; বইয়ের কোন ধরা-বাঁধা মাপ-কাঠি দিয়ে এর সীমা নির্দেশ করা-যায় না। আবার সাহিত্য জিনিষটাও এতবড় wide যে,তার সম্বন্ধে নিয়ম বা বিধি-ব্যবস্থা codify করা যায় না।
কালিপদ দত্ত - আচ্ছা জাহাজের কেবিনে কিরণময়ীর ব্যবহারটা বর্ণনা করেছেন ....
শরৎচন্দ্র - তা আপনার ভাল লাগেনি এই তো ? তা কি করবো বলুন? সকলের তো এক জিনিষ ভাল লাগে না; তাই ভেবে তো লেখা নিয়ন্ত্রিত করা যায় না। তা ছাড়া যখন 'চরিত্রহীন' লিখি তখন আমার বয়স পঁচিশ বছর। অল্প বয়সের লেখায় হয়ত ততটা সংযম ছিল না। আর এই যদি আপনারা দোষের বলেন, তাহলে আমি বলি যে, বাংলা সাহিত্যে যেসব লেখা ভুরি ভুরি দেখছি তাদের তুলনায় আমি তো ভাল ছেলে-নিতান্ত শিশু। যাক কিরণময়ীর কথা হচ্ছিল, সে সব দিক থেকে বঞ্চিত। তারপর সে খুবই রূপবতী, বুদ্ধিমতী তো বটেই। রূপ বড় একটা মূলধন। মূলধন বেশী থাকলেই মানুষ উন্মানা হয়। তার অবস্থা সব দিক থেকে ভেবে দেখুন দেখি - ওর কর্মটা অস্বাভাবিক ? তা'ছাড়া যদি কেউ বলে এটা ভালো নয়, ওটা খারাপ, সেকথা আমি কতকটা বুঝতে পারি। যার যেমন লাগে, সে তেমন বলে। কিন্তু এই যে বলে, - 'এটা হ'তেই পারে না, ওটা অস্বাভাবিক, তাকে আমি বলি-এত বড় জগতের কতটুকু তোমার ধারণার মধ্যে আসে ? কতটুকু দেখেছ? বুদ্ধি দিয়েই বা কতটা আয়ত্ত করতে পারে ? আমি যে সব দেখেছি তা নয়, তবে অনেকের চেয়ে যে কত বেশী এসব দেখেছি তাতো আমি জানি। 'এটা সম্ভব আর ওটা অসম্ভব' - একথা সত্যিই কেউ বলতে পারে না। কিরণময়ীর চরিত্র যে ideal চরিত্র তা আমি বলছিনে, বরং তা হয়ত ছিল সাবিত্রী এবং তার চেয়ে বড় চরিত্র ছিল সুরবালা। পদ্মফুল কেন বেলফুল নয়-একথা বললে তার উত্তর নেই। যে যা ভাই। ১৭ / ১৮ / ১৯ এই রকম বয়সে আমার 'চন্দ্রনাথ', 'বড়দিদি', 'দেবদাস' লেখা, ২৫/২৬ বছরের লেখা 'চরিত্রহীন', ৩০ বছরে লেখা, 'শ্রীকান্ত' ৩৪ বছরে 'বিন্দুর ছেলে', 'রামের সুমতি?' 'পথ নির্দেশ'। 'গৃহদাহ' লিখেছি ৭/৮ বছর আগে; কিন্তু এমন নির্ভুল বই আর আমি লিখিনি। এর সম্বন্ধে কেউ কখনও আমাকে কিছু বলেনি।
প্রশ্ন (কে করেছেন, উল্লেখ নাই) - সতীত্বই তো হল নারীত্ব। আপনি আবার ও দুটোকে আলাদা কেন করেছেন?
শরৎচন্দ্র - এ প্রশ্নের উত্তরে আপনাদের আমার জীবনের একটা গল্প বলি। আমার গ্রাম সম্পর্কে আমার এক দিদি থাকতেন। তিনি ছিলেন বিধবা। গ্রামের লোক জনের সঙ্গে তার ছিল মধুর সম্পর্ক। তিনি লোকের রোগে সেবা করতেন; বিবাহ প্রভৃতি কাজকর্মে তার ডাক পড়ত। আমার গ্রামে এমন কেউ ছিলেন না যিনি তার কাছ থেকে কোন না কোন বিষয়ে উপকৃত হন নি। কদিন আমার খেয়াল চাপলো, দিদিকে ভয় খাওয়াতে হবে। তার কাচা বাড়ীর পাশেই একটা প্রকান্ড গাছ ছিল। ঠিক করলুম সন্ধ্যের সময় গাছে চেপে দিদিকে ভয় খাওয়াতে হবে। সন্ধেতে গাছে উঠলুম - গাছে উঠলেই তার বাড়ীর সবকিছু দেখা যায়। যেমনি গাছে উঠে একটা বিকৃত কন্ঠে 'দিদি' বলে চেচিয়ে উঠেছি তেমনি দেখলুম কে একজন লোক খাট থেকে নেমে খাটের নীচে লুকিয়ে গেল। আমার দিদির হয়তো সতীত্ব নেই, কিন্তু তাই বলে কি তাঁর নারীত্বও নেই ? সেবা দিয়ে, গরীবদুঃখীকে দান করে যে মহত্বের পরিচয় দিয়েছেন তার কি কোন মূল্য নেই ? দেহ ধদি সব, অন্তরটা কিছু নয়? যৌনের তাগিদে নারী যদি দেহটাকে পবিত্র না রাখতে পারে তা'বলে তার অন্য গুণাবলীর জন্যে আমাদের কাছ থেকে সে কি শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পারে না? তাই সতীত্ব ও নারীত্বকে আমি পৃথক করে দেখি।
প্রশ্ন (কে করেছেন, উল্লেখ নাই) - আপনি ভাল কাগজ কলমে লেখেন কেন ?
শরৎচন্দ্র - সাহিত্যই আমার সব। লেখা ছাড়া আর কিছু আমি করিনে। লিখে আমি আনন্দ পাই, আর এই লেখা থেকেই আমি জীবিকা নির্বাহ করি। মা সরস্বতীর যেন সেবা করছি, তাঁকে পুজো করছি তখন ভাল উপচার দিয়েই করব। তাই ভাল কাগজ, কলম, কালি দিয়ে লিখি এটা আমার বিলাস নয়, এ আমার অন্তরের শ্রদ্ধাঞ্জলি!
অস্ত্রগুরু হেমচন্দ্র কানুনগো ও শরৎচন্দ্র।
শরৎচন্দ্র মেদিনীপুরে দু-রাত্রি ছিলেন। মেদিনীপুর থেকে উপহার স্বরূপ পাওয়া বইগুলির মধ্যে একটি বই তিনি এই দু-রাত্রির মধ্যেই পড়ে শেষ করে ফেলেছিলেন। সেই বইটি হল অস্ত্রগুরু হেমচন্দ্র কানুনগোর লেখা 'বাঙলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা'। বইটি শেষ করার পরে, হেমচন্দ্র কানুনগোর সঙ্গে তিঁনি সবার অনুপস্থিতিতে, আলাদাভাবে কথা বলতে চেয়েছিলেন। শরৎচন্দ্রের ইচ্ছে অনুসারে হেমচন্দ্র কানুনগো তাঁর সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনায় বসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কি আলোচনা হয়েছিল তা দুজনের মধ্যে কেউই লিপিবদ্ধ করে যাননি।
অগ্নিশিশু শহীদ ক্ষুদিরাম ও শরৎচন্দ্র।
মুজাফ্ফরপুর জেলে ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট হাঁসি মুখে, মাথা উঁচু করে শহীদ হয়েছিলেন ক্ষুদিরাম। তাঁকে দাহ করা হয়েছিল মুজাফ্ফরপুরে বুধি-গন্ডক নদীর তীরে। ক্ষুদিরামের টানে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বার বার ছুটে গিয়েছেন মুজাফ্ফরপুরে বুধি-গন্ডক নদীর তীরের সেই জায়গায়, যেখানে জ্বলেছিল ক্ষুদিরামের চিতা। বসে থাকতেন অনেকটা সময়।
মুজাফ্ফরপুরে বুধি-গন্ডক নদীর তীরের সেই জায়গায়, যেখানে জ্বলেছিল ক্ষুদিরামের চিতা। ছবিঃ অরিন্দম ভৌমিক।
মেদিনীপুরের সঙ্গে ডাক-যোগ।
হয়ত ডাক-যোগের মাধ্যমে মেদিনীপুর জেলার অনেকের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ ছিল। সেই সমস্ত তথ্য জোগাড় করার জন্য আরো অনেক গবেষণার প্রয়োজন। এই লেখায় আমি তাঁর দুটি ডাক-যোগের কথা উল্লেখ করব।
প্রথমটি খেজুরীর সুবিখ্যাত ইতিহাসকার ও সুসাহিত্যিক মহেন্দ্রনাথ করণ-এর সঙ্গে। পৌন্ড্রক্ষত্রিয় (পোদ) সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের একটি লেখার প্রতিবাদ জানিয়ে মহেন্দ্রনাথ করণ তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন। এই বিষয়ে শরৎচন্দ্র ১২/১৪ টি চিঠি পেয়েছিলেন। কিন্তু মহেন্দ্রনাথ বাবুকেই তিনি প্রথম উত্তর দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, অন্যানদের ক্ষেত্রে তিঁনি একটি চিঠি লিখে, তা ছাপিয়ে সবাইকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মহেন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তিঁনি আলাদা ভাবে চিঠি লিখেছিলেন। শুধু একবার নয়, দুবার তিঁনি মহেন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন।
শরৎচন্দ্রের প্রথম চিঠি।
বাজে শিবপুর
১০/১০/১৮
সবিনয় নিবেদন,
আপনার পত্র পড়িয়া সুখ-দুঃখ দুই পাইয়াছি। আমার লেখায় আপনারা যে ব্যাথা পাইয়া নীরাবে সহ্য করেন নাই, ইহা আমাকে কম আনন্দ দেয় নাই। এ সমন্ধে আমি আজ পর্যন্ত ১২/১৪ খানি পত্র পাইয়াছি। প্রত্যেককে আলাদা করিয়া উত্তর দিব ভাবিযাছিলাম, কিন্তু তাহার পূর্বেই আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে বসিলাম। কারণ, সকলের বেদণাই এক ওজনের নয়, এবং সকলেই দীর্ঘ দিন ধরিয়া তাহার আবসানের প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিতে পারে না।
আমি 'দেশে' পোদ জাতির অস্পৃশ্যতার কথা যখন লিখি, তখন 'দেশ' বলিতে আমার নিজের গ্রামটাই মনে ছিল। আমার বেশ মনে পড়ে ছেলেবেলায় আমাদের বাড়ীতে একটি পোদ বালক পানের ব্যবসা করিতে আসিয়া আশ্রর গ্রহণ করে। ছেলেটি আমার দিদিকে মা বলিত। তাহার এক সময়ে হঠাৎ এক সাংঘাতিক পীড়া হয়। দিদি তাহার বমি প্রভৃতি পরিষ্কার করায়, তাহাকে ছোঁয়াছুঁয়ি করায় পাড়ার লোকে অনেক কথা বলে। দিদি তাহাতে এই জবাব দেন যে, আমাদের গৃহদেবতা 'দামোদর' যদি তাহার হাতে ভোগ না খান তিনি স্বপ্ন দিবেন। কারণ এই বিশ্বাস বাড়ীতে সকলের ছিল যে, কিছু একটা অনাচার হইলেই 'দামোদর' স্বপ্ন দেন। অবশ্য এবার তিনি কোন প্রকার আপত্তি করিয়া স্বপ্ন দেন নাই। সেই পীড়ার সময় আমার স্পষ্ট স্মরণ হয় দিদিকে দিনে ৫/৬ বার করিয়া স্নান করিতে হইত।
তবে, এখন সম্বাদ লইয়া জানিতেছি যে সকল জেলায় এক প্রকার প্রথা প্রচলিত নাই। যেমন আজও কোন কোন জায়গায়......ছুঁইলে কাপড় ছাড়িতে হয়, কিন্তু কলিকাতা প্রভৃতি অঞ্চলে হয় না।
এইবার আমার নিজের কথা বলিব। আমার লেখার যথার্থ তাৎপর্য আপনারা গ্রহণ করিতে পারেন নাই। কোন জাতিকে আমি অস্পৃশ্য মনে করি না এবং কাহারও হাতে জল খাইতে আমার বাধে না। বরঞ্চ, লোকের যখন বাধে তখন সেইটাই আমাকে সবচেয়ে বাধে।
বই ছাপাইবার সময় এই ছত্রটা ত' আমি তুলিয়া দিব বটেই, আর ইহা জাতিবিশেষের একটা মনঃ পীড়ার কারণ হইবে বুঝিলে আমি লিখিতাম না। কিন্তু আমার সকল লেখার সহিত আপনার পরিচয় থাকিলে এ সন্দেহ আপনার হইত না যে, উঁচু জাতকে সত্য সত্যই 'উঁচু' জাত মনে করিয়া তাহাদিগকে 'বড়' করিয়া তুলিবার অভিপ্রায়ে বা 'নীচু' জাতিকে মনোবেদনা দিয়া হিউমার সৃষ্টি করিবার জন্য এ কথা লিখি নাই। বরঞ্চ, উল্টা। ....
শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
(সূত্রঃ শরৎচন্দ্রের পত্রাবলী, সংকলক ও সম্পাদক - গোপালচন্দ্র রায়, পৃষ্ঠা ১৪১)
শরৎচন্দ্রের দ্বিতীয় চিঠি।
বাজে শিবপুর
৪ ঠা অশ্বিন' ২৬
আপনার পত্রখানি আমি দুইবার করিয়া পড়িয়াছি। আমার সেই পত্রখানির অংশবিশেষ যদি আপনার কোন কাজে আসে ত' আমি খুশিই হইব। যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করিতে পারেন আমার লেশমাত্র আপত্তি নাই। তবে আমার চিঠি লেখার প্রণালী এত কাঁচা, এত এলোমেলো যে ভাষার দিক দিয়া একটু লজ্জা করে। মহেন্দ্রবাবু আমি কেবল দুইটি জাতি মানি।
আমার আন্তরিক বিশ্বাস কোন মানুষেরই কোন সুনিদৃষ্ট জাতি নাই, জাতি আছে কেবল মানুষের হৃদয়ের-মস্তিষ্কের। সে কেমন জানেন? এই ধরুন আপনি নিজে। আপনার শিক্ষা, আপনার হৃদয়ের প্রশস্ততা, ইহার স্বদেশপ্রীতি, স্বজাতির দুঃখে বেদনাবোধ, ইহার আন্তরিকতা, - এইগুলিই বড় জাতীয়। যে আধারে ইহারা বাস করে সেই আধারটাই উঁচু জাতের। নইলে ব্রাহ্মণই কি আর দুলে-বাগদিই বা কি - ওইগুলো না থাকিলে কেবলমাত্র জন্মপত্রিকার লেখাগুলাই কোন মানুষকে কোনদিন উচ্চপদ দিতে পারিবে না। সে লেখা সোনার জল দিয়া মহামহোপাধ্যায়ের কলম হইতে বাহির হইলেও না।
পৌন্ড্রক্ষত্রিয় বেশ নাম। ব্রাত্যক্ষত্রিয়ের সঙ্গে সঙ্গে ও কথাটাও ব্যবহার করিতে করিতে ক্রমশঃ একটা বাদ দিলেই চলিয়া যাইবে।
আপনি ঘৃণা দিয়া ঘৃণার প্রতিশোধ দিবার কথা লিখিয়াছেন। বোধ হয় আপনার কথাই সত্য। এ বিষয়ে আমার বিশেষ কোন অভিজ্ঞতা নাই, সেই জন্য মতামত দিতে পারিলাম না। তবে, এটুকু বুঝিতে পারি, কেবলমাত্র ভাল মানুষের দ্বারাই সংসারের সকল কাজ চলে না।
শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
(সূত্রঃ শরৎচন্দ্রের পত্রাবলী, সংকলক ও সম্পাদক - গোপালচন্দ্র রায়, পৃষ্ঠা ১৪২)
মেদিনীপুরের সঙ্গে দ্বিতীয় যে ডাক-যোগের কথা উল্লেখ করব তা পশ্চিম মেদিনীপুরের আনন্দপুরের (কেশপুর) শ্যামচাঁদপুর গ্রামে অবস্থিত তাঁর শশুরালয়ের সঙ্গে। শরৎচন্দ্র বাবু তাঁর শশুরমশাই কৃষ্ণদাসকে প্রতিমাসে ১০ টাকা মানিঅর্ডার করে ঐ ঠিকানায় পাঠাতেন। ওই মানিঅর্ডারের রশিদ এলে হিরণ্ময়ী দেবী বুঝতেন তাঁর বাবা ভালো আছেন। শরৎচন্দ্রের দিদি অনিলাদেবীর ছোটো দেওর তিনকড়ি বাবু বলেছেন, তিনিও মাঝে মাঝে শ্যামচাঁদপুরের ঠিকানায় কৃষ্ণদাস বাবুকে মানিঅর্ডার পাঠিয়েছেন।
তারপর একদিন টাকা সমেত মানিঅর্ডার ফিরে এলো। হিরণ্ময়ী দেবী কান্নাকাটি করলেন, সেদিন থেকেই হিরণ্ময়ী দেবী ও শরৎ বাবুর জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল শ্যামচাঁদপুর গ্রাম।
চিরকালের মতো। .......
অরিন্দম ভৌমিক।
midnapore.in
(Published on 15.09.2008, Updated on 15.09.2021)
তথ্য সূত্রঃ-
● শরৎচন্দ্র, শ্রী গোপাল চন্দ্র রায়।
● শরৎচন্দ্রের পত্রাবলী, সংকলক ও সম্পাদক - গোপালচন্দ্র রায়।
● শরৎবীক্ষা, আজহারউদ্দিন খান।
● কে ক্ষুদিরাম ? (ISBN 978-81-931892-4-5), অরিন্দম ভৌমিক।
● শরৎ রচনাবলি, জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ, সম্পাদক : শৈলেন্দ্রনাথ গুহ রায়।
সাক্ষাৎকারঃ-
● পতিক দত্ত (শ্যামচাঁদপুর)
● বরুন দত্ত (শ্যামচাঁদপুর)