পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯
অরিন্দম ভৌমিক।
খুব ছোটবেলায় সবাই মিলে চাঁদা তুলে সরস্বতী পূজা করতাম, তার যে কি আনন্দ বলে বোঝানো যাবেনা। কিংবা ধরুন বর্ষাকালে কাদা মাঠে সবাই মিলে ফুটবল খেলা। একটু বড় হওয়ার পরে যখন প্রথমবার সবাই মিলে হৈ হৈ করে দূরদেশে ঘুরতে গেছিলাম, সেই আনন্দটাই বা কি কম ছিল। এই রকমই জীবনের অনেক ফেলে আসা আনন্দ ফিরে পেয়েছিলাম বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মদিনে।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
এই দিনটির প্রস্তুতি নিয়েছিলাম অনেকদিন ধরেই। বিহারে, ঝাড়খণ্ডে, বীরাসিংহে যোগাযোগ করা। কার্মাটাঁড় গিয়ে আম নিয়ে এসে চারা তৈরী করা, বীরসিংহ থেকে কাঠবাদাম গাছের চারা আনা, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলিতে যোগাযোগ করা (বিদ্যাসাগরের আমগাছ ও কাঠবাদাম গাছ প্রবন্ধটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন) । তাছাড়াও ব্যানার তৈরী, পোস্টার তৈরী, টি-শার্ট তৈরী, ছবি তৈরী, গান রেকর্ডিং, পতাকা তৈরী, সবাইকে বার বার বলে বাইকের সমস্ত পেপারস ঠিক করানো, এমার্জেন্সিতে ব্যাকআপ গাড়ির জন্য কথা বলে রাখা, কেক তৈরী, মিষ্টি ও পায়েসের অর্ডার দেওয়া, ছোট ট্রাক বুক করা, মাইক বুক করা, ফুল কেনা আরো কত কি।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
পরিকল্পনা ছিল এই রকম - (১) ২৬ তারিখ ভোর বেলা আমরা মিলিত হব বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরে [যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এবং উদ্বোধন করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর] (২) সেখানে বিদ্যাসাগরের মূর্তিতে মাল্যদান করার পরে আমরা বেরোবো শহর পরিক্রমা করতে [একটি ছোট ট্রাক ও বাইক সহযোগে] (৩) LIC সার্কেলে বিদ্যাসাগরের মূর্তিতে মাল্যদান (৪) বাইক রেলি করে সবাই মিলে বীরসিংহ যাত্রা (৫) বীরসিংহ থেকে আবার কার্মাটাঁড় যাত্রা (৬) মেদিনীপুর থেকে কার্মাটাঁড় পর্যন্ত মোট ২০০ টি বৃক্ষ রোপন (৭) ২৭ তারিখ ফিরে আসা।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
অবশেষে এল সেই দিন, ২৬ সেপ্টেম্বর। উত্তেজনায় রাত্রে খুব একটা ঘুমোতে পারিনি, ঘুম ভেঙে গেছিল অনেক ভোরে, ঠিক যেমনটা হত ছোটবেলায় সরস্বতী পুজোর দিন। তবে আমার ঘুম থেকে ওঠার আগেই পার্থ (তমলুক), জ্যোতির্ময় (দিঘা-রামনগর) ও দীপঙ্কর-দা (কলকাতা) বাইকে রওনা দিয়েছিল নিজেদের জায়গা থেকে। বেশ কয়েকদিন ধরেই টানা বৃষ্টি পড়ছিল, আজকেও তার অন্যথা হয়নি। সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ে চলেছে, কখনো বা জোরে। বাড়ির সামনে ছোট ট্রাকটি এসে দাঁড়ালো ৬ টার দিকে। ট্রাকের মাথায় লোহার ফ্রেমে বাঁধানো বিদ্যাসাগরের ছবি লাগিয়ে পাঠিয়ে দিলাম বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরে, সঙ্গে গেল কৌশিক। সবকিছু গুছিয়ে আমরা বাইকে রওনা দিলাম ৭.৩০ মিনিটে। আমরা মানে আমি, আমার ৫ বছরের ছেলে এবং আমার স্ত্রী রিংকি। রিংকি তখন ৭ মাসের গর্ভবতী। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা, Bike Rally -তে যাবেই।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
স্মৃতি মন্দিরে পৌঁছে দেখি আমাদের আগেই সেখানে সুস্মিতাদি, সুব্রত দা (দাস), কৌশিক, শিবদেব, ঝর্ণাদি পৌঁছে গেছেন। একটু পরেই পূর্ব মেদিনীপুর থেকে পৌঁছল পার্থ ও জ্যোতির্ময় এবং কলকাতা থেকে পৌঁছলেন দীপঙ্কর-দা। তারপর একে একে পৌঁছল সুব্রত (দে), পূর্ণ, আগন্তুক, শিশির, স্বেতা ও কৃষ্ণ।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
বৃষ্টি পড়েই চলেছে। তাই অপেক্ষা না করে ৮.৩০ মিনিটে আমরা কাজে নেবে পড়লাম, বিদ্যাসাগরের গান চালিয়ে দেওয়া হল। এই দিনটির জন্যই নতুন গান রেকর্ডিং করা হয়েছিল। বিদ্যাসাগরের গানগুলি মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) -এর এই অভিযানের জন্য বিশেষভাবে লিখেছিলেন সবং -এর সান্তনু অধিকারী, রেকর্ডিংও তিনিই করিয়েছিলেন।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
প্রথমেই আমরা সবাই মাল্যদান করলাম স্মৃতি মন্দিরের ভেতরে অবস্থিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মূর্তিতে। তারপর শুরু করলাম Bike Rally, প্রথমে সুসজ্জিত ট্রাক আর পেছনে আমরা বাইক নিয়ে চলেছি মোট ১৮ জন। বৃষ্টি হচ্ছিলোই কিন্তু হঠাৎ এলো খুব জোরে, তারমধ্যেই আমরা LIC সার্কেলে বিদ্যাসাগরের মূর্তিতে মাল্যদান করলাম।
প্রথমেই আমরা সবাই মাল্যদান করলাম স্মৃতি মন্দিরের ভেতরে অবস্থিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মূর্তিতে।
আমরা LIC সার্কেলে বিদ্যাসাগরের মূর্তিতে মাল্যদান করলাম।
কিছুক্ষনের জন্য বৃষ্টি থেমেছিল, আবার এল জোরে। সেই প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই শহর পরিক্রমা করল আমাদের Bike Rally। সে এক দারুন অভিজ্ঞতা, মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলার কথা।
শহর পরিক্রমার পরে কাকভেজা হয়ে সবাই পৌঁছলাম আমাদের বাড়ি। সবাই গা-হাত মুছে, জামাকাপড় পাল্টে আলোচনায় বসলাম। রিংকি সবার জন্য গরম চা ও সঙ্গে নারকেল, চানাচুর সহযোগে মুড়ি মেখে আনলো। প্রশ্ন উঠল, এরপরেও কি আমরা বাইকে যাবো ? কারণ মেদিনীপুর থেকে বীরসিংহ ৬৫ কিলোমিটার এবং বীরসিংহ থেকে কার্মাটাঁড় ২৩৫ কিলোমিটার, অর্থাৎ মোট ৩০০ কিলোমিটার ঝড়জল পেরিয়ে যেতে হবে। একদল বলল বাইকে আরেকদল বলল না। অবশেষে জয় হল বাইকের - আমরা ওই অবস্থাতেই যুদ্ধকালিক তৎপরতায় সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বীরসিংহের উদ্দেশে। সবার মাথায় বিদ্যাসাগরের জেদ চেপেছিল।
খুব কম সময়ের মধ্যেই আমাদের বাইক বাহিনী মেদিনীপুর শহর ছাড়িয়ে হাইওয়েতে উঠল। দুর্যোগের কারণে আমাদের টিম ১৮ জন থেকে ১৫ জনে ঠেকেছে। মেঘলা আকাশ সবার ফুরফুরে মেজাজ, বাইক চলছে ৭০ এর উপরে। দেখতে দেখতে পাঁচখুরি পেরিয়ে গেলাম। কিন্তু সেই সুখ বেশিক্ষন থাকলো না। আকাশ কালো হয়ে প্রচন্ড বৃষ্টি এল, সঙ্গে ঝোড়ো হওয়া। তখন আশেপাশে দাঁড়ানোর কোন জায়গা নেই। কিছুটা গিয়ে অযোধ্যা নগর নামে একটি গ্রাম দাঁড়ানোর জায়গা পেলাম। আমরা খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম যে এইভাবে যাওয়া খুবই বিপদজনক, কিন্তু আমরা যাবোই। ব্যাকআপ হিসেবে যে গাড়ির সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলাম সেই গাড়িকে ফোন করে আমার বাড়িতে পৌঁছতে বললাম। আমরা আবার প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই ফিরে এলাম মেদিনীপুর।
ফিরে দেখলাম গাড়ি পৌঁছে গেছে। বেশ বড়ো গাড়ি টেম্পো-ট্রাভেলার। সবার বাইক ঢোকানো হল আমার বাড়িতে, জিনিসপত্র বাইক থেকে আনলোড করে তোলা হল গাড়িতে। বাইক গুলো রাখা হল আমার বাড়িতে। আবার একপ্রস্থ গা-হাত-পা ভালো করে মুছে জামা পাল্টে গাড়িতে চাপলাম (১৫ জন)। এবারে সবাই অনেকটা নিশ্চিন্ত, সবাই বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গল্প করতে করতে চললাম। মিডনাপুর-ডট-ইন (midnapore.in) -এর টি-শার্ট গুলো জানলায় মেলে দেওয়া হল শুকোনোর জন্য।
দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই, গাড়িও বৃষ্টির জন্য চলছে খুব আস্তে। কার্মাটাঁড় তো বহত দূর কি বাত হ্যায়, বীরসিংহ কখন পৌঁছব সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। তবে সবার মনে একটা শান্তি ছিল যে আমরা গাড়ির ভেতরে রয়েছি। বেলা গড়াতেই সবার প্রচণ্ড খিদে পেতে শুরু করল, কিন্তু বৃষ্টির জন্য একটিও হোটেল খোলা পেলাম না। তখনও আমরা ক্ষীরপাই পৌছাইনি, তাই ক্ষীরপাই'র বন্ধুদের (বাপ্পা ও ষষ্ঠী) ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় খাবো ? ওরা জানালো বড় চাতালের পরেই একটা ট্রাক ড্রাইভারদের জন্য হোটেল আছে (চাতালঃ- বৃষ্টির জল যাতে রাস্তা নষ্ট না করে সেই জন্য বানানো লম্বা সিমেন্টের কম উচ্চতার ব্রিজ)।
বড় চাতালের পরেই হোটেল দেখে আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। সমস্যা হল এতজনের খাওয়ার নেই, সমাধানও হয়ে গেল। রাস্তার দুদিকে দুটি হোটেল ছিল, আমরা অর্ধেক এদিকে অর্ধেক ওদিকে ঢুকে গেলাম। খাটিয়ায় বসে গরম গরম রুটি, ভাত, তরকারি যেন অমৃতের মত লাগছিল (আমি কিন্তু অমৃত কেমন খেতে জানিনা)।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
খেয়েদেয়ে আবার রওনা দিলাম বীরসিংহ। অবশেষে আমরা ২.৩০ মিনিটে পৌঁছলাম বিদ্যাসাগরের জন্মভিটায়। দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সবকিছুই প্রায় নতুন করে করা হয়েছে, ফুলের মালায় প্রায় ঢেকে যাওয়া বিদ্যাসাগরের মূর্তিটি দেখে সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। জন্মভিটার দায়িত্বে থাকা দিলীপ ব্যানার্জী বাবুকে আগের থেকেই সবকিছু বলা ছিল। বিদ্যাসাগরের আম গাছ লাগানোর ব্যাপার নেই কারণ আমাদের হয়ে আম গাছ আগেই লাগিয়ে দিয়েছেন ঘাটালের বিধায়ক শঙ্কর দলুই মহাশয়(বিদ্যাসাগরের আমগাছ ও কাঠবাদাম গাছ প্রবন্ধটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন)। সময় নষ্ট না করে আমরা সাজাতে শুরু করলাম, চালিয়ে দেওয়া হল বিদ্যাসাগরের গান (আমাদের সদস্য ভগবত মাঝির একটি পোর্টেবল সাউন্ড-সিস্টেম সঙ্গে নিয়ে গেছিলাম)।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
আগের থেকেই ঠিক করেছিলাম বাঙালি ও পাশ্চাত্য দুইভাবেই উদযাপন করব এই মহা মানবের জন্মদিন। সেই মতোই বানানো হয়েছিল পায়েস, মিষ্টি, কেক। কেক বানানো হয়েছিল দুটি - একটি বাংলায় লেখা বীরসিংহের জন্য এবং অপরটি অলচিকিতে লেখা কার্মাটাঁড় -এর জন্য।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
প্রথমেই সবাই মিলে জ্বালানো হল ২০০ টি মোমবাতি। ফুলের মালার সঙ্গে লাগানো হল বেলুনও। মাঝে বসানো হল বাংলায় লেখা কেক। সাজানো হল মিষ্টি - দই ও পায়েস ছাড়াও ছিল ক্ষীরপাইয়ের বাবরসা, হাউরের মুগের জিলিপি, মেদিনীপুরের ক্ষীরগজা, নাড়াজোলের সরভাজা ইত্যাদি।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
ডেকে আনা হল বীরসিংহের ছেলে-মেয়েদের। ছোট ছোট মেয়েরাই কাটলো সেই কেক, বিদ্যাসাগরকে খাইয়ে দিল পায়েস ও মিষ্টি। ছোটদের মধ্যে সে কি আনন্দ। সবশেষে সবার মধ্যেই ভাগ করে দেওয়া হল কেক, মিষ্টি ও পায়েস। বৃষ্টি কিন্তু থামেনি, থামিনি আমরাও। দিলীপ বাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কার্মাটাঁড়ের উদ্দেশে। বড় রাস্তায় বাসস্ট্যান্ডে এসে শিশির ও স্বেতা নেবে গেল, আমরা রইলাম ১৩ জন।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
বীরসিংহ ছেড়ে এগিয়ে চলেছি কার্মাটাঁড়ের উদ্দেশে। যেতে হবে আরো ২৩৫ কিলোমিটার, ঘড়িতে ৩.৩০ বেজে গেছে। বেশ কিছুক্ষন যাওয়ার পর অসুস্থ বোধ করলেন সুব্রত দাস বাবু এবং আরো একটু পরে সুস্মিতাদি। আমরা ঠিক করলাম উনাদের বাড়ি ফিরে যাওয়াই ভাল। গড়বেতা বাস-স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বাসে তুলে দেওয়া হল দুজনকে। ১৮ থেকে ১৫, তারপর ১৩ এবং শেষ পর্যন্ত রইলাম ১১ জন।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
তারপর আবার যাত্রা, রাস্তা ভাল নয় তাই খুব একটা জোরে চালাতে পারছেনা গাড়ি। আমাদের গাড়ির চালকের নাম - মাহাত। ধীর,স্থির, ঠান্ডা মাথার ড্রাইভার। তাই আমরা নিশ্চিন্তে নিজেদের মধ্যেই গল্প করছিলাম। সন্ধের ঠিক আগে একটা সুন্দর ফাঁকা জায়গায় ধাবাতে চা পান করতে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষন হাত পা ছড়িয়ে গল্প করে আবার রওনা দিলাম।
কার্মাটাঁড় থেকে সুনির্মল দাস বাবু দুপুর বেলায় ফোন করে জেনেছিলেন আমাদের গতিবিধি। সন্ধের পর থেকে প্রতি ঘন্টায় খবর নিতে শুরু করলেন। অন্ধকার হয়ে গেছে, গাড়ি চলছে আগের থেকে একটু জোরে। অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। যারা জেগে আছে তারাও চুপচাপ। একে একে পেরিয়ে গেলাম ওন্দা, বাঁকুড়া। গঙ্গাজলঘাঁটি পৌঁছতেই দেখলাম সবাই আবার নড়েচড়ে বসেছে, গল্পও শুরু হয়েছে। সবাই গুগল-ম্যাপ দেখছে আর পৌঁছনোর সম্ভাব্য সময় নিয়ে বিস্তর অঙ্ক কষছে।
গল্প করতে করতেই পৌঁছে গেলাম মেজিয়া। মেজিয়ার পরে দামোদর নদী পেরোনোর পর কিছুক্ষন দামোদর নদী নিয়ে চলল আড্ডা। রানীগঞ্জ পেরোতেই গাড়ির গতি বেড়ে গেল কারন আমরা ১৯ নম্বর জাতীয় সড়কে উঠেছি (NH19)। যারা অঙ্ক কষছিল গাড়ির স্পিড দেখে আবার নতুন অঙ্ক নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। খুব কম সময়ের মধ্যেই আমরা আসানসোল পৌঁছে গেলাম। আসানসোলকে বা দিকে রেখে এগিয়ে চললাম আমরা।
একসময় ১৯ নম্বর জাতীয় সড়ক (NH19) ছেড়ে ডানদিকে চিত্তরঞ্জনের রাস্তায় বেঁকে গেলাম, গাড়ির গতি আবার কমে গেল। সবার আবার খিদে পেয়ে গেছে। বোরিরা ও সালানপুর পেরিয়ে একটা জায়গায় সবাই একসঙ্গে গাড়ি থামানোর জন্য হৈ হৈ করে উঠল। কারণ একটি মিষ্টির দোকানে গরম গরম রসগোল্লা তৈরী হচ্ছে। জায়গাটার নাম জেমারি। নামলো রসগোল্লা খেতে কিন্তু খেল পকোড়া, ঝুরিভাজা, গজা, কাঠিভাজা, ঝালমুড়ি, সিঙ্গাড়া, চা ইত্যাদি। শুধু খাওয়া নয় গাড়িতে খাওয়ার জন্য সঙ্গে নিয়েও নিল অনেক কিছু।
আবার চলল গাড়ি। সবাই খাওয়ার দোকানে হামলা করলেও আমাদের মধ্যে একজন অন্য একটি দোকান খুজছিল। অন্যজন টি হল শিবদেব এবং সে খুঁজছিল একটি নতুন প্যান্ট, যদিও পাওয়া যায়নি। বৃষ্টিতে ভিজে গেলেও সবার কাছেই অতিরিক্ত জামাকাপড় ছিল কিন্তু শিবদেব সবক্ষেত্রেই ব্যাতিক্রমী। সে একবস্ত্রেই এসেছিল কার্মাটাঁড় যাবে বলে। আমার একটি টি-শার্ট ও সর্টস দিয়েছিলাম কিন্তু আমার বা অন্য কারুর প্যান্ট তার মাপে হয়নি। ভাগ্যবশত একটি গামছা সে সঙ্গে এনেছিল। আমার দেওয়া সর্টসের উপরে সেই গামছা পরেই সে চলেছে আমাদের সঙ্গে। ব্যাপারটা আপনার কেমন কেমন লাগতেই পারে কিন্তু সুলেখক ও সাংবাদিক শিবদেবের তাতে কোন কিছু যায় আসেনা। যে কোন পরিস্থিতিতেই পৌঁছতে হবে কার্মাটাঁড়।
গাড়িতে উঠেও কিন্তু খাওয়া বন্ধ হয়নি। হাত ঘুরছিল বিভিন্ন ধরণের প্যাকেট। সুনির্মল বাবু যথারীতি মাঝে মাঝে খবর নিচ্ছেন। যারা যারা সব ধরণের খাওয়ার ট্রাই করছিল একটু পরেই তারা বলতে শুরু করল - এটা ঠিক ছিল কিন্তু ওটা না খেলেই হত বা 'ওটা ঠিক ছিল কিন্তু এটা না খেলেই হত।' এটা-ওটা করতে করতে পৌঁছে গেলাম চিত্তরঞ্জন। চিত্তরঞ্জন শহরকে ডান দিকে রেখে আমরা পৌঁছলাম মিহিজাম। অর্থাৎ প্রবেশ করলাম ঝাড়খণ্ডে।
ঘড়িতে রাত্রি ১০ টা, আরো ৪০ কিলোমিটার পথ বাকি। যেভাবেই হোক রাত্রি ১২ টার আগে কার্মাটাঁড় পৌঁছে নন্দনকাননে লাগাতে হবে বীরসিংহের কাঠবাদাম গাছের চারা এবং করতে হবে জন্মদিনের অনুষ্ঠান। ওদিকে সুনির্মল বাবু ঘন ঘন ফোন করে খবর নিচ্ছেন আমাদের। বৃষ্টির জন্য রাস্তার অবস্থা খারাপ, মিহিজাম থেকে জামতারা পৌঁছতেই লেগে গেল ৪০ মিনিট, অর্থাৎ ঘড়িতে ১০.৪০। মাঝে আমরা একটু ভুল রাস্তায় গেছিলাম। এরপর টান টান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে রাত্রি ১১.৩৫ মিনিটে আমরা পৌঁছলাম বিদ্যাসাগরের বাড়ি 'নন্দনকানন'।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
সুনির্মল বাবু এই বয়সেও সবাইকে নিয়ে গেটের কাছেই অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। ১২ টা বাজতে ২৫ মিনিট বাকি তাই আমরা এক মুহূর্ত নষ্ট না করে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করতে লাগলাম। অনেক আলোচনার পরে ঠিক হল জামশেদপুর অতিথি ভবন ও মূল অতিথিভবনের মাঝের বাগানে লাগানো হবে গাছটি। জিতেন্দরের কাছ থেকে মাটি খোঁড়ার খুরপি নিয়ে সবাই মিলে রোপন করা হল সেই বৃক্ষ।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
বৃক্ষ রোপনের পর সময় নষ্ট না করে আমরা এলাম বিদ্যাসাগরের মূর্তির সামনে। বীরসিংহের মতই মিষ্টি, পায়েস, কেক, বেলুন দিয়ে সাজানো হল। জ্বালানো হল ২০০ টি মোমবাতি। চালানো হল বিদ্যাসাগরের গান। আমাদের হয়ে সুনির্মল বাবু সহ বিহার ও ঝাড়খণ্ড বেঙ্গলি এসোসিয়েশনের সদস্যরা একসঙ্গে কাটলেন অলচিকিতে লেখা বিদ্যাসাগরের কেক, খাওয়ালেন পায়েস ও মিষ্টি। ১২ টা বাজার ৫ মিনিট আগেই সম্পূর্ণ হল সমস্ত অনুষ্ঠান।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
এরপর রাত্রের খাওয়ার পালা। নন্দনকাননে সারাদিন অনুষ্ঠানের ফলে সুনির্মল বাবুরা ক্লান্ত ছিলেন। সুনির্মল বাবুকে বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করা হলেও তিনি কোন কথাই শুনলেন না। উল্টে আমাদের খাওয়ার পরিবেশন করতে লাগলেন। জন্মদিন উপলক্ষে অনেক পদের আয়োজন করা হয়েছিল নন্দনকাননে, খাওয়ার শেষে ছিল পায়েস।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
আমাদের শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল একটি লম্বা ঘরে পরপর বিছনা পেতে। হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে সবাই একসঙ্গে গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেছি বুঝতেও পারিনি। সকাল বেলায় ঘুম ভাঙতে দেখলাম জ্যোতির্ময় নেই। পার্থ বলল অফিসের জরুরি কাজ পড়ায় ভোরবেলাই রওনা দিয়েছে কলকাতার উদ্দেশে। বিছানায় বসেই একপ্রস্থ চা পান করলাম সবাই। ব্রেকফাস্টও ছিল লোভনীয়, গরম গরম পরোটা ও সবজি।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
ব্রেকফাস্ট করেই দৌড় লাগলাম বি. বি. গুহ বাবুর গাড়িতে করে ম্যারাথন পয়েন্টে, বাকিরা রইল নন্দনকাননে। এমনিতেই ম্যারাথনের প্রতি আমার একটা আলাদা আকর্ষণ রয়েছে তার উপর আবার বিদ্যাসাগরের জন্মদিন উপলক্ষে প্রথমবার ম্যারাথন প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছে। বি. বি. গুহ বাবু ছাড়াও ছিলেন শ্রী দুর্গাদাস ভান্ডারী, শ্রী নিবাস মন্ডল, শ্রী বিদ্যাচন্দ্র মুখার্জী ও আরো অনেকে।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
প্রতিযোগীদের মধ্যে উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মত। প্রথমবার তাই ৫ কিলোমিটারের আয়োজন করা হয়েছিল। ছেলে মেয়েদের আলাদা আলাদা মোট চারটি বিভাগ করা হয়েছিল। ম্যারাথন শুরুর পরে আমরা কভার করছিলাম গাড়ি থেকে। সমস্ত প্রতিযোগী সফলতার সঙ্গে শেষ করেছিল ৫ কিলোমিটার।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
ম্যারাথনের পরে আবার নন্দনকানন। সেখানে অনুষ্ঠান চলছিলই। আমরা সবাই বিদ্যাসাগরের শয়নকক্ষে গিয়ে একসঙ্গে প্রার্থনা করলাম। নন্দনকাননে সারাদিন অনুষ্ঠান চলবে কিন্তু আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে কারণ রাস্তায় বিদ্যাসাগরের স্মৃতি বিজড়িত গ্রন্থাগারে বৃক্ষরোপনের ব্যাপার রয়েছে। সুনির্মল বাবু আমাদের কিছুতেই ছাড়বেন না। ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
বেলা হয়ে যাচ্ছে দেখে বিদ্যাসাগরের মূর্তিতে প্রণাম করে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা রওনা দিলাম, সঙ্গে চললেন দুর্গাদাস বাবু। বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবিজড়িত St Anthony School এর বিদ্যাসাগর পাঠাগারে বীরসিংহের কাঠ-বাদামের চারা লাগালেন শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবী দুর্গাদাস ভান্ডারী। বৃষ্টি কিন্তু আবার শুরু হয়েছে এবং আমরা মাঝে মাঝেই ভিজছি। পেট ভরা থাকলেও দুর্গাদাসবাবু আমাদের জোর করে রসমালাই, সিঙ্গারা, চা খাওয়ালেন।
পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন।
বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবিজড়িত St anthony school এর বিদ্যাসাগর পাঠাগারে আমাদের আনা কাঠ-বাদামের চারা লাগালেন শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবী দুর্গাদাস ভান্ডারী।
এবার গন্তব্য লাধনা ড্যাম (Ladhna Dam)। ফেরার পথে একটু সময় কাটানোর আমরা পৌঁছলাম লাধনা ড্যাম। জামতারা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার এবং কার্মাটাঁড় থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জায়গাটি অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। চারদিকে সবুজ, সামনে বিশাল জলরাশি, দূরে পাহাড়। আমরা গাড়ি থেকে নেমেই জলের দিকে দৌড়লাম, কেউবা গেল উপরে মন্দিরে। নৌক চেপে ঘুরে বেড়ালাম অনেক্ষন। দেখলাম মাছধরা, মৎস্যজীবীদের সাইকেল নিয়ে জলের মধ্যে চালালাম কিছুক্ষন। সব মিলিয়ে আমরা দারুন উপভোগ করলাম লাধনা ড্যাম।
লাধনা ড্যাম (Ladhna Dam)।
লাধনা ড্যাম (Ladhna Dam)।
লাধনা ড্যাম (Ladhna Dam)।
লাধনা ড্যাম (Ladhna Dam)।
লাধনা ড্যাম (Ladhna Dam)।
এবার ফেরার পালা। ফেরার পথের গল্প আর করলাম না। ঠিক এক বছর পরে লিখলাম সেই দিনের কথা। স্মৃতিগুলো কিন্তু এখনো তাজা। কোভিড-১৯ এর জন্য এই বছর আমরা কার্মাটাঁড় যেতে পারলাম না। প্রার্থনা করি প্রত্যেক বছর যেন এই দিনটিতে একই ভাবে বীরসিংহ হয়ে পৌঁছতে পারি কার্মাটাঁড়।
অরিন্দম ভৌমিক
midnapore.in
(Published on 26 September 2020)