বিদ্যাসাগর মহাশয়ে'র আম ও বাক্সবাদাম গাছ।
অরিন্দম ভৌমিক।
প্রথম পর্ব
কি করেছেন? কেন বিখ্যাত? এইসব প্রশ্নের উত্তর ছাড়াই কিছু মানুষের নাম আমাদের মনে ছোটবেলা থেকেই গেঁথে যায়।
তাঁদের মধ্যে অন্যতম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
একটু বড় হয়ে, সম্ভবত স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে তাঁর সম্পর্কে জানলাম। কিন্তু সেটা ছিল শুধু জানার জন্য জানা, তার মধ্যে কোন উপলব্ধি ছিল না। অবশ্য তাঁকে সম্পূর্ণরূপে বোঝার ক্ষমতা কোনোদিন হবে কিনা এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
২০০৭ সালে, "মিডনাপুর-ডট-ইন" এর কাজ করতে গিয়ে তাঁর সম্পর্কে নতুন করে পড়তে শুরু করলাম। তখন যে বিষয়টি আমাকে সবথেকে নাড়া দিয়েছিল তা হল - "কার্মাটাঁড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যাওয়া"। যে ব্যাক্তি তাঁর জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের উন্নতির জন্য ব্যায় করেছিলেন, সেই তাঁকেই নির্বাসনে যেতে বাধ্য করেছিলাম আমরা। এই ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি।
এরপর কেটে গেছে অনেকগুলি বছর বিদ্যাসাগরে'র জন্মদিন ও প্রয়াণদিবস এলেই মনের ভেতর সেই ক্ষতটা নাড়া দিয়ে ওঠে। দিনগুলি পেরিয়ে গেলে আবার ভুলে যাই। দেখতে দেখতে এসে গেল ২০১৯ সাল, অর্থাৎ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপনের বছর। বছরের শুরু থেকেই মনটা ছটপট করছিল। মনে হচ্ছিল কোন ভাবে যদি তাঁকে ফিরিয়ে আনা যেত তাঁর জন্মভূমিতে।
একদিন মেদিনীপুরের খুব কাছেই কংসাবতী নদীর তীরে একটি নার্সারি থেকে গাছের চারা আনতে গিয়ে হঠাৎ মাথায় এল বিদ্যাসাগর তাঁর জীবদ্দশায় বহু বৃক্ষ রোপন করেছিলেন। তাঁর নিজের হাতে লাগানো আম গাছ এখনো কার্মাটাঁড়ে আছে। স্থানীয়রা সেই গাছের আম প্রসাদ মনে করে নিয়ে যান। শুধু কার্মাটাঁড়েই নয় তাঁর নিজের হাতে লাগানো একটি বিশাল বাক্সবাদাম গাছ (জংলী কাঠবাদাম, Sterculia foetida) বীরসিংহেও রয়েছে।
বিদ্যাসাগর মহাশয় এতটাই বৃক্ষপ্রেমী ছিলেন যে বীরাসিংহে তাঁর পিতামহীর লাগানো একটি অশ্বথ বৃক্ষ বাঁচানোর জন্য আদালতে মোকদ্দমা পর্যন্ত লড়েছিলেন। ঐ গাছের ঝামেলায় অতিষ্ঠ হয়ে একদিন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহোদর শ্রী সম্ভুচন্দ্র বলেছিলেন "আমি ওসব হাঙ্গামে থাকিতে ইচ্ছা করিনা"। সম্ভুচন্দ্রের কথা শুনে বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রচন্ড রেগে গিয়ে ভাইকে বলেছিলেন - "তুই মর্ তাহা হইলে আমি স্বয়ং লাঠি হাতে করিয়া গাছের তলায় দাঁড়াইয়া ঐ গাছ রক্ষা করিব।" শেষ পর্যন্ত সেই অশ্বথ গাছ রক্ষাও করেছিলেন তিনি।
এই সমস্ত ঘটনা মাথায় আসতেই ঠিক করে ফেললাম, যেভাবেই হোক বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মদিনে কার্মাটাঁড়ে'র সেই আম গাছের চারা তৈরী করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলিতে। করতে পারলে কিছুটা হলেও শান্ত হবে মন। এই ভেবে আনন্দ পাবো যে তাঁর প্রতিষ্ঠিত গাছের মাধ্যমেই ফিরিয়ে আনলাম তাঁকে।
কিন্তু সমস্যা হল কার্মাটাঁড়ে'র সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না আমার। এদিকে সময় খুবই কম কারণ মে মাস চলছিল, জুনের মধ্যে না গেলে আর আম পাওয়া যাবে না। এটুকু জানতাম যে ঝাড়খন্ড তৈরী হওয়ার আগে পর্যন্ত কার্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগরে'র বাড়ির দেখভাল করছিলেন "বিহার বেঙ্গলী এসোসিয়েশন"। প্রত্যেক বছর মুজাফ্ফরপুরে শহীদ ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান দিবসে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে, বিহারের সঙ্গে যোগাযোগটা আমার ভালোই হয়েছিল। তাঁরাই আমাকে বিশ্বনাথদেব বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। বিশ্বনাথদেব বাবু আলাপ করিয়ে দেন সুনির্মল দাস বাবু ও এস এন সিনহা বাবু'র সঙ্গে। যাঁদের নাম উল্লেখ করলাম তাঁরা এতটাই ভাল মানুষ যে আপনাদের সঙ্গে আলাপ না করিয়ে দিলে বিশ্বাস করবেন না। আমার পরিকল্পনা শুনে সবাই সমস্ত রকমের সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। কার্মাটাঁড় যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেক দিনই বিশ্বনাথ বাবু ও সুনির্মল বাবুর সঙ্গে আমার কথা হত।
বামদিকে সুনির্মল দাস এবং ডানদিকে বিশ্বনাথ দেব।
সবকিছু ঠিকঠাক করে অবশেষে জুন মাসের ১৪ তারিখ রওনা দিলাম কার্মাটাঁড়। মেদিনীপুর স্টেশন থেকে খড়্গপুর-আসানসোল-প্যাসেঞ্জার ট্রেন ছাড়লো ৬.২০ তে। এই ট্রেনে রিজারভেশন করা যায় না, দরকারও হয় না। ট্রেনে উঠেই বসার জায়গা পেয়ে গেছিলাম। মেদিনীপুর থেকে কার্মাটাঁড় যাওয়ার সরাসরি কোন ট্রেন নাই, হাওড়া হয়ে যাওয়াটাও অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আপনি মেদিনীপুরে (MDN) সকাল ৬.২০ তে KGP ASN PASS (68043) ধরুন, ৯.৫৮ তে জয়চন্ডী পাহাড় স্টেশনে (JOC) নেবে পড়ুন। সেখান থেকে ১০.৫৩ তে TATA DNR EXP (18183) -এ চেপে, দুপুর ১.১৩ মিনিটে কার্মাটাঁড় স্টেশন, যার বর্তমান নাম বিদ্যাসাগর স্টেশন (VDS)।
যাইহোক চন্দ্রকোনা, বাঁকুড়া, আদ্রা পেরিয়ে ঠিক সময়ে আমার ট্রেন জয়চন্ডী পাহাড় পৌঁছে দিল। হাতে সময় ছিল তাই স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে পাহাড় দেখলাম, স্টেশনটিও বাইর থেকে দেখতে সুন্দর। একটু দেরিতে এল আমার ট্রেন টাটা-দানাপুর এক্সপ্রেস, ট্রেনে উঠে দেখলাম খুব ভিড়। আমার রিজারভেশন ছিল, কোন মতে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলাম (রিজারভেশন ছাড়া কোনভাবেই এই ট্রেনে যাবেন না)। প্রচন্ড গরম হওয়া সত্ত্বেও কেন জানিনা আমার বেশ ভাল লাগছিল। বার্নপুর, আসানসোল, চিত্তরঞ্জন পেরিয়ে ট্রেন যখন জামতাড়া পৌঁছল আমি আর বসে থাকতে পারলাম না, উত্তেজিত হয়ে উঠে এলাম দরজার কাছে - কারণ পরের স্টেশন "বিদ্যাসাগর"।
বিদ্যাসাগর রেলওয়ে স্টেশন (কার্মাটাঁড়, ঝাড়খন্ড)।
জামতাড়া ছাড়ার পরে দরজায় দাঁড়িয়ে ইঞ্জিনের দিকে তাকিয়েছিলাম, দূর থেকেই বুঝতে পারলাম স্টেশনের হলুদ রঙের বোর্ড। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল হলুদ রঙের উপরে বড়ো বড়ো কালো অক্ষরে লেখা "विद्यासागर"। আরো সামনে আসতে দেখলাম হিন্দি, ইংরেজি, উর্দুর সঙ্গে বাংলাতেও লেখা রয়েছে "বিদ্যাসাগর"।
বিদ্যাসাগর রেলওয়ে স্টেশন (কার্মাটাঁড়, ঝাড়খন্ড)।
ট্রেন থেকে নেমে দেখলাম ছিমছাম, সাজানো-গোছানো সুন্দর ছোট্ট স্টেশন, অন্যান্য ভাষার সঙ্গে সাঁওতালিতেও এনাউন্সমেন্ট হচ্ছে।
বিদ্যাসাগর রেলওয়ে স্টেশন (কার্মাটাঁড়, ঝাড়খন্ড)।
স্টেশন সুপারিন্টেন্ডেন্টের অফিসের পাশেই বিদ্যাসাগর -এর একটি বিশাল ছবি রয়েছে। ছবিতে তিঁনি বই হাতে একটি কাঠের চেয়ারে বসে রয়েছেন, দেখে মনে হচ্ছে তিঁনিই স্টেশনটির দায়িত্ব নিয়ে সবকিছু তদারকি করছেন। সবথেকে আকর্ষণীয় ব্যাপার হল, স্টেশনের দেওয়ালগুলিতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলি শিল্পীর তুলিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বিদ্যাসাগর রেলওয়ে স্টেশন (কার্মাটাঁড়, ঝাড়খন্ড)।
বিদ্যাসাগর রেলওয়ে স্টেশন (কার্মাটাঁড়, ঝাড়খন্ড)।
বিদ্যাসাগর রেলওয়ে স্টেশন (কার্মাটাঁড়, ঝাড়খন্ড)।
বিদ্যাসাগর রেলওয়ে স্টেশন (কার্মাটাঁড়, ঝাড়খন্ড)।
বিদ্যাসাগর রেলওয়ে স্টেশন (কার্মাটাঁড়, ঝাড়খন্ড)।
১৯৭৮ সালে এই স্টেশনের নাম রাখা হয় "বিদ্যাসাগর"। যেদিকেই তাকাই "বিদ্যাসাগর" -এর নাম। উত্তেজনা তো ছিলই, সবকিছু দেখে মনটা এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে গেল। মনে মনে ভারতীয় রেল'কে ধন্যবাদ জানালাম।
বিদ্যাসাগর রেলওয়ে স্টেশন (কার্মাটাঁড়, ঝাড়খন্ড)।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে বামদিকে কয়েক পা এগোলেই আপনার ডান দিকে দেখতে পাবেন একটি স্টেট ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্ক পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তায় একটু গেলেই দেখতে পাবেন "নন্দন কানন" -এর গেট। আপনাদের তো বলাই হয়নি, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁর এই বাড়ির নাম রেখেছিলেন "নন্দন কানন"। (১৮৭৩ সালে তিঁনি এই বাড়িটি কিনেছিলেন। "নন্দন কানন" -এর কাহিনী আরেকদিন শোনাব।)
ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম হাঁসি মুখে এগিয়ে আসছে 'জিতেন্দর মণ্ডল'। জিতেন্দরই এখানকার কেয়ারটেকার, দুই ছেলে ও স্ত্রী কে নিয়ে থাকে (এখন তারা এখানে নেই, গ্রামের বাড়িতে গেছে)। এই বিশাল ক্যাম্পাসের সমস্ত দায়িত্ব সে একলা হাতেই সামলায়। ক্যাম্পাসে ঢুকেই আমি এদিক-ওদিক দেখতে শুরু করায়, জিতেন্দর বলল - "এই গরমে এতদূর থেকে এসেছেন, আগে স্নান-খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নিন বিকেলে সব দেখবেন"। আমি দেখলাম কথাটা খারাপ বলেনি জিতেন্দর।
জামশেদপুর অতিথি ভবন (কার্মাটাঁড়, ঝাড়খন্ড)।
জিতেন্দর আমাকে সব ধরণের রুম দেখাল, যেহেতু অন্য কোন অতিথি নেই তাই যেখানে খুশি থাকার অনুমতি ছিল আমার। মূলত দুটি অতিথিশালা রয়েছে। মূল অতিথিশালাটি একটি দ্বিতল বড় বিল্ডিং যেখানে রান্না হয়, খাওয়া হয়, রুমের সংখ্যাও অনেক (জিতেন্দর এখানেই থাকে)। অপরটি একতলা দুই রুম বিশিষ্ট অতিথিশালা। আমি দ্বিতীয়টি বেছে নিলাম, কারণ এটি বিদ্যাসাগর মহাশয় যেখানে পড়াতেন তার খুব কাছে। অতিথিশালাটির নাম "জামশেদপুর অতিথি ভবন", কারণ জামশেদপুর বেঙ্গলী এসোসিয়েশনের সদস্যদের অনুদানে এই ভবনটি নির্মিত হয়েছে।
স্নান সেরে নিয়ে সুনির্মল বাবু ও বিশ্বনাথ বাবুকে ফোন করে সব জানালাম। উনারা সকাল থেকে অনেকবার ফোনে খবর নিচ্ছিলেন - কোথায় আছি? কত দূর পৌঁছলাম ? ইত্যাদি। আগামীকাল সকালে পাটনা থেকে এসে পৌঁছবেন এস. এন. সিনহা বাবু। উনিই আনুষ্ঠানিক ভাবে আমগুলি আমার হাতে তুলে দেবেন। বিকেল বেলায় জামতাড়া থেকে আসবেন দেবাশিস মিশ্র বাবু।
এই সেই জায়গা, যেখানে বসে বিদ্যাসাগর মহাশয় সবাইকে পড়াতেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়ি।
স্নান-খাওয়ার পরে ঘরের মধ্যে মন টিকলো না, তাই বিশ্রাম নেওয়া আর হল না। বখাটে ছেলের মত দুপুর বেলায় ঘুরে-বেড়ালাম "নন্দন কানন" -এর আনাচে কানাচে। দাতব্য চিকিৎসালয়, প্রাইমারি স্কুল, গাছের তলায় যেখানে তিনি পড়াতেন, তাঁর গৃহ - তবে সব থেকে বেশি সময় কাটালাম আম গাছের নিচে। আনুমানিক ১৪৫ বছর আগে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিজের হাতে লাগানো "কিষান ভোগ" আমে'র গাছ। আমগুলি খুবই মিষ্টি কিন্তু প্রত্যেক বছর হয় না, ১ বছর ছাড়া আম হয়। অনেক কষ্ট করে কিছু আম পাড়লাম।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিজের হাতে লাগানো "কিষানভোগ" আম গাছ।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিজের হাতে লাগানো "কিষানভোগ" আম গাছ।
বিকেল বেলায় জিতেন্দর ও আমি চা খাচ্ছিলাম, এমন সময় ফোন এল দেবাশিস বাবুর। উনি বিশেষ কারণে আসতে পারছেন না, কিন্তু একটি বই উনার কাছ থেকে নেওয়া খুবই দরকার। তাই আমিই তড়িঘড়ি ট্রেন ধরে রওনা দিলাম জামতাড়া, কারণ রাত্রে ফেরার ট্রেন খুব একটা নেই। জামতাড়া পৌঁছে দেখলাম দেবাশিস বাবু বই হাতে স্টেশনেই অপেক্ষা করছেন। একটি গাছের তলায় বসে, মাটির ভাঁড়ে চা'য়ে চুমুক দিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিলাম অনেকটা সময়। দেবাশিস বাবুই ফেরার ট্রেনে তুলে দিলেন। "নন্দন কাননে" ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছিল, তাই ফিরেই খেতে বসে গেলাম। জিতেন্দরে'র রান্নার হাত খুব ভাল, খাওয়ার শেষে আবার "কিষান ভোগ" আম। রাত্রে অনেক্ষন বিদ্যাসাগরের মূর্তির কাছে বসেছিলাম, চারদিকে গুটঘূটে অন্ধকার, নিস্তব্ধতা চিরে মাঝেমধ্যে ট্রেনের আওয়াজ। ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘুম ভাঙলো ভোর ৫ টায়। আমি সাধারণত দেরিতেই উঠি, কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ভোর বেলায় ঘুম ভেঙে যায়। জিতেন্দরকে বলাই ছিল আমি ব্রেকফাস্ট বাইরে করব। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম, সঙ্গে নিলাম জিতেন্দরের বাইক। প্রথমেই গেলাম স্টেশনের ঐপারে নবনির্মিত বিদ্যাসাগর পার্ক দেখতে। ভারতীয় রেল নির্মিত পার্কটির মধ্যে বিদ্যাসাগর -এর একটি মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পার্ক থেকে বেরিয়ে ২ গ্লাস ছাতুর শরবত খেলাম। তারপর রওনা দিলাম ৯ কিমি দূরে একটি গ্রামে (এই গ্রামের গল্প অন্য একদিন শোনাব)। সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করলাম, সাহায্য করলেন বাচ্চু রাওয়ানি, পরিমল বাল এবং বলবীর ঠাকুর। ফেরার সময় সবাই মিলে চা'য়ের সঙ্গে জমিয়ে গরম পকোড়া ও জিলিপি খেলাম।
"নন্দন কাননে" ফিরে এসে আবার লেগে পড়লাম আম পাড়তে ও আমের আঁটি সংগ্রহ করতে। কিছুক্ষন পরেই এসে পৌঁছলেন এস. এন. সিনহা বাবু। সিনহা বাবু স্টেট ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন, একসময় এথেলেটিক্সে জাতীয় স্তরে বিহারের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। উনার কাছেই শুনলাম নন্দন-কানন পুনরুদ্ধারের কাহিনী।
আমার হাতে আমগুলি তুলে দিচ্ছেন এস. এন. সিনহা বাবু।
জিতেন্দর মন্ডল -এর সঙ্গে।
এরপর সেই বটগাছের নিচে বিদ্যাসাগর (মূর্তি) কে সাক্ষী রেখে আমার হাতে আমগুলি তুলে দিলেন সিনহা বাবু। স্নান করে একসঙ্গে খেতে বসলাম - ডাল, তরকারি, রুই মাছের ঝোল, স্যালাড এবং খাওয়ার শেষে অবশ্যই কিষান-ভোগ আম। অবশেষে ফেরার পালা, কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে প্রণাম করে রওনা দিলাম মেদিনীপুরের উদ্দেশ্যে।
দ্বিতীয় পর্ব
'আম' এসে গেল মেদিনীপুর। কয়েকদিন ধরে চলল আমের আঁটি শুকনো করা, তারপর মাটি তৈরি করে চারা তৈরির কালো পলিথিনের প্যাকেটে বসিয়ে দিলাম আমের আঁটি (জুলাই মাসে)। কেন জানি না, চারা বেরোলো অল্প কয়েকটি। অগাস্ট মাসটা কেটে গেল "সবুজ ক্ষুদিরাম" অভিযানের বৃক্ষরোপন করতে করতে। যদিও মাঝে একবার বীরসিংহ গিয়ে দিলীপ ব্যানার্জী বাবুর (বিদ্যাসাগর -এর জন্মভিটের তত্ত্বাবধায়ক) সঙ্গে কাঠ বাদাম গাছের চারা তৈরির পরিকল্পনা করে এসেছি। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতেই পরিকল্পনা করতে লাগলাম যে জন্মদিনে আম গাছের চারাগুলি কোথায় লাগাবো। অনেক ভাবনা-চিন্তা করে ঠিক করলাম বিদ্যাসাগর মহাশয়ে'র নিজের হাতে তৈরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাগাবো গাছগুলি। 'বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয়' ছাড়া তেমন প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেল মাত্র দুটি (১) ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত ঘাটাল বিদ্যাসাগর উচ্চ বিদ্যালয় ও (২) ১৮৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বাসুদেবপুর বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ (অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায়)। ঠিক করলাম এই তিনটি জায়গাতেই লাগানো হবে আম গাছ, তবে বীরাসিংহে গাছটি 'বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয়' -এর পরিবর্তে তাঁর জন্মভিটেতেই লাগানো হবে।
১১ সেপ্টেম্বর বীরসিংহ থেকে খবর এল কাঠ-বাদাম গাছের চারা তুলে প্যাকেটে ভরতে হবে, নয়তো পরে আর তোলা যাবে না। ১৪ সেপ্টেম্বর বাইকে রওনা দিলাম বীরসিংহের উদ্দেশ্যে, সঙ্গে পেলাম কৌশিক'কে। 'বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয়' -এ পৌঁছে টিচার ইনচার্জ শক্তিপদ বেরা বাবুর সঙ্গে দেখা করে কাজে লেগে পড়লাম। সঙ্গে এল একদল উৎসাহী ছাত্র। এতজন একসঙ্গে হাত লাগানোয় অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা সমস্ত চারা প্যাকেটে ভরে ফেললাম। কাজের শেষে সবাই মিলে 'রসগোল্লা' খেলাম। শক্তিপদ বাবু আনুষ্ঠানিক ভাবে একটি চারাগাছ তুলে দিলেন আমার হাতে। জন্মদিনে এই কাঠ-বাদামের চারাগাছ লাগান হবে কার্মাটাঁড়ে। মহা আনন্দে ফিরে এলাম মেদিনীপুর।
"বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয়" -এর ছাত্রদের সঙ্গে। ছবিঃ কৌশিক।
শক্তিপদ বেরা বাবু আনুষ্ঠানিক ভাবে একটি কাঠবাদাম গাছের চারা তুলে দিচ্ছেন। ছবিঃ কৌশিক।
২০ সেপ্টেম্বর আবার বাইকে রওনা দিলাম আম গাছের চারা নিয়ে। প্রথমেই বীরাসিংহে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মভিটেতে পৌঁছে একটি চারা গাছ তুলে দিলাম দিলীপ বাবুর হাতে। সেখান থেকে সোজা 'ঘাটাল বিদ্যাসাগর উচ্চ বিদ্যালয়', চারাগাছ তুলে দিলাম প্রধানশিক্ষক সুব্রত মাইতি মহাশয়ের হাতে। পরবর্তী গন্তব্যস্থল বাসুদেবপুর বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ, এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিয়কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় খুব উৎসাহের সঙ্গে চারাগাছ হাতে তুলে নিলেন। চারাগাছগুলি আগেই পৌঁছে দিলাম কারণ জন্মদিনে আমরা ব্যাস্ত থাকবো তিনটি জায়গায় - প্রথমে মেদিনীপুর শহরে, তারপর বীরসিংহ এবং সব শেষে পৌঁছব কার্মাটাঁড়ে। জন্মদিনে চারাগাছগুলি প্রধানশিক্ষকরাই নিজ নিজ স্কুলে লাগাবেন।
বীরাসিংহে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মভিটেতে দিলীপ ব্যানার্জী মহাশয়ের হাতে আম গাছ তুলে দেওয়া হল।
'ঘাটাল বিদ্যাসাগর উচ্চ বিদ্যালয়' -এর প্রধানশিক্ষক সুব্রত মাইতি মহাশয়ের হাতে চারাগাছ তুলে দেওয়া হল।
'বাসুদেবপুর বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ' -এর প্রধান শিক্ষক অমিয়কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের হাতে চারাগাছ তুলে দেওয়া হল।
বিশেষ কারণবশত প্রথম আমগাছটি জন্মদিনের দুদিন আগে অর্থাৎ ২৪ তারিখ বীরাসিংহে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মভিটেতে লাগানো হয়। চারাগাছটি লাগান ঘাটালের বিধায়ক শঙ্কর দলুই মহাশয়। বাকি গাছগুলি স্কুল কর্তৃপক্ষ ২৬ তারিখ অর্থাৎ জন্মদিনের দিনই লাগান। আমরা ঐ দিন ভোর থেকে মেদিনীপুর শহরে কর্মসূচি শুরু করি। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই প্রথমে বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দিরে ও LIC চত্ত্বরে তাঁর মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়। মাল্যদানের পরে বাইক রেলি করে শহর পরিক্রমা করি আমরা। এরপর মেদিনীপুর থেকে সোজা বীরসিংহ। বীরাসিংহে শ্রদ্ধা জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কার্মাটাঁড়ে'র উদ্যেশ্যে। যখন পৌঁছলাম তখন রাত্রি ১২ টা বাজতে বেশি দেরি নাই। সুনির্মল বাবু যে রাস্তায় কতবার ফোন করেছিলেন তার কোন হিসেবে নাই। খুব দ্রুততার সঙ্গে গাছ আয়োজন করলাম কারণ দিন শেষ হওয়ার আগেই লাগাতে হবে। অবশেষে "নন্দন কাননে" লাগানো হল সেই কাঠ-বাদামে'র গাছ। শুধু "নন্দন কাননেই" নয়, পরের দিন ফেরার সময় বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবিজড়িত St Anthony School এর বিদ্যাসাগর পাঠাগারেও ঐ কাঠ-বাদামের চারা লাগালেন শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবী দুর্গাদাস ভান্ডারী (জন্মদিন উদযাপনের বিস্তারিত কাহিনী আরেকদিন শোনাব)।
পরবর্তী সময়ে কিছু স্কুলে লাগানো হয়েছিল ঐ জংলী কাঠবাদাম গাছের চারা। দেখতে দেখতে ১০ মাস পার হয়ে এল তাঁর ১৩০ তম প্রয়াণ দিবস। বিদ্যাসাগরের মৃত্যু হয় ১৮৯১ সালের ২৯ শে জুলাই, রাত্রি ২টো ১৮ মিনিটে। রাত ১২টা পেরিয়ে যাওয়ায় তারিখটা আসলে ৩০ শে জুলাই। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে "মিডনাপুর-ডট-ইন" এর উদ্যোগে ৩০ তারিখ ঠিক রাত্রি ২টো ১৮ মিনিটে ঐতিহাসিক মেদিনীপুর শহরের বুকে রোপন করা হল সেই কাঠ-বাদাম গাছের চারা।
২০২০ সালের ৩০ জুলাই ঠিক রাত্রি ২টো ১৮ মিনিটে ঐতিহাসিক মেদিনীপুর শহরের বুকে রোপন করা হল সেই জংলী কাঠবাদাম গাছের চারা।
আপনিও যদি কোন প্রতিষ্ঠানে এই চারাগাছ লাগাতে চান, তাহলে অবশ্যই জানাবেন।
জানি পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কোনদিন ফিরে আসবেন না।
কিন্তু নতুন প্রজন্মকে যদি তাঁর আদর্শ ও চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত করা যায়, সেটাই বা কম কি ?
অরিন্দম ভৌমিক
midnapore.in
(Published on 2 August 2020)