পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চুয়াডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষাকর্মী মহম্মদ ইয়াসিন পাঠান উদার মানবধর্মের প্রতীক। তিনি আমাদের গর্ব। দারিদ্রের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি এগোয়নি। স্বশিক্ষিত ইয়াসিন জাতি-ধর্ম আর দারিদ্যের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভালোবেসেছেন “মন্দিরময় পাথরা”র ধবংসপ্রায় পুরাকীর্তিগুলিকে। এগিয়ে এসেছেন সংরক্ষণে । অতিক্রম করতে হয়েছে বহু চড়াই-উতরাই। সময়ের সঙ্গে ইয়াসিন-কে ঘিরে একটা প্রত্যাশা তৈরী হয়ে গিয়েছিল এলাকার মানুষের মনে। মুসলিম যুবক ইয়াসিনের নেতৃত্বে “পাথরা পুরাতত্ব সংরক্ষণ কমিটি” প্রতিষ্ঠা হলো। কমিটির তত্বাবধানে এগিয়ে চলল মন্দির রক্ষার কাজ। বিভিন্ন সময়ে পাশে থেকে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছেন বিশিষ্ট পুরাতত্ববিদ তারাপদ সাঁতরা সহ সমাজের বিভিন্ন ব্যাক্তিত্ত। আজ ইয়াসিন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। মাননীয় রাষ্ট্রপতি “কবীর” সম্মান দিয়ে কাজের স্বীকৃতি জানিয়েছেন। একটি প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন সাম্মানিক “ডক্টরেট”। ভারত সরকারের পুরাতত্ব বিভাগ মন্দির সংরক্ষণের কাজে ও রাজ্য সরকার “মন্দিরময় পাথরা”-কে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কাজে এগিয়ে এসেছেন। ভারতের যোজনা কমিশন “মন্দিরময় পাথরা”-কে দিয়েছেন টাকা। কিন্তু ইয়াসিন ভালো নেই। বড় অভিমানে উচ্চারণ করেন- “আমার কথা তেমন করে কেউ ভাবেন না। জানি না নিদারুণ দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে আর কতদিন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব।” ব্যতিক্রমী এই মানুষটি ঘিরে আমাদের অনেক গর্ব, অনেক প্রত্যাশা ।
নিম্ন মধ্যবিত্ত ক্ষেতমজুর পরিবারে জন্ম। সাত ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ইয়াসিন বড়। অভাব-অনটনের কারণে পড়াশোনার সঙ্গে ক্ষেতের কাজে যুক্ত হতে হয়েছেন ছোটবেলা থেকে। অষ্টম শ্রেণিতে পাশ করার পর নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে তিন মাস ক্লাস করার পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে জন-মজুর হিসেবে ক্ষেতের কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। অসুস্থ মা-বাবা এবং ছোট ছোট ভাই-বোনেদের অন্ন যোগানোর দায় তাঁকে ছোটবেলা থেকেই বহন করতে হয়েছে। কবিতা লেখার ঝোঁক ছিল। অমানুষিক পরিশ্রম হলেও লেখা বন্ধ করেননি। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মেদিনীপুরের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখতে থাকেন। বাংলা সন ১৩৮১-তে ইয়াসিন তাঁর দুই বন্ধুকে (আব্দুল সাত্তার খাঁন ও বাদলকিশোর ভূইএ্যা) নিয়ে নিজের গ্রাম থেকে “গ্রামবার্তা” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পাশাপাশি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মেদিনীপুর শহরের “মেদিনীপুর বার্তা” পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ, গ্রাম-বাংলা বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। স্থানীয় হাইস্কুলে পিয়নের চাকুরী পাওয়ার পর সাহিত্য-চর্চায় নিজেকে আরো বেশি নিয়োজিত করেন।
সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে প্রথম থেকেই তার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্কুল যাওয়ার পথে ছোট্টো ইয়াসিনের সঙ্গে হঠাৎই আলাপ হয় প্রখ্যাত পুরাতত্তবিদ গবেষক শ্রদ্ধেয় তারাপদ সাঁতরার সঙ্গে। উনি “মন্দিরময় পাথরা” কোনদিকে জানতে চেয়েছিলেন। ছোট্টো ইয়াসিন স্কুল না গিয়ে তাঁকে পথ দেখিয়ে মন্দিরময় পাথরায় নিয়ে যায়। তারাপদবাবুর সঙ্গে ছিলেন গবেষক হিতেশরঞ্জন সান্যাল ও গবেষক গোপাল ছাওলে মহাশয়।
মন্দিরময় পাথরা ও তাঁর জন্মস্থান হাতিহলকা পাশাপাশি দুটি গ্রাম। এই দুটি গ্রামের মাঝে কলাইচন্ডী খাল।
তারাপদ সাঁতরা মহাশয়ের সান্নিধ্যে এসে মন্দিরময় পাথরায় অবস্থিত অজস্র প্রাচীন মন্দিরের আকর্ষণে মন্দিরগুলো ও তার নির্মাতাদের সম্পর্কে অজানা তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন। পাথরার প্রাচীন মন্দিরগুলোকে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের কতিপয় ব্যাক্তি ভেঙে নষ্ট করে ইট-পাথর নিয়ে যেতেন। তাদের কাজে প্রথম বাধা দেন ইয়াসিন - প্রতিবাদ করেন। বিপদের তোয়াক্কা না করে মন্দিরগুলিকে রক্ষা বা সংরক্ষণের চেষ্টায় এলাকার হিন্দু-মুসলমান ও সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষদের একত্রিত করার একক উদ্যোগ নেন তিনি। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে সব ধর্মের মানুষদের নিয়ে “পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটি” গঠনে সক্ষম হন। কমিটির পক্ষে ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই ডিসেম্বর তৎকালীন জেলা শাসক মাননীয় প্রভ দাস, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ড. সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মেদিনীপুর কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মাননীয় ধীরাজমোহন ভট্টাচার্য সহ প্রচার মাধ্যমের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ করে পাথরার প্রাচীন মন্দিরগুলিকে রক্ষার আবেদন জানানো হয়।
প্রথম পর্যায়ে এই কাজে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বা সরকারী কোন সহযোগিতা একেবারেই পাননি। তবে স্থানীয় জনসাধারণের সহযোগিতা যথেষ্টভাবেই পেয়েছিলেন। তাঁর সম্প্রদায়ভুক্ত বৃহৎ অংশের মানুষজনের কাছ থেকে আগেই অবহেলিত হয়েছিলেন। এখনো হচ্ছেন। মন্দিরময় পাথরা গ্রামের কিছু কিছু মানুষের অসহযোগিতা অতীতের মতো এখনো রয়েছে। “মন্দিরময় পাথরা” প্রচারের আলোয় আসার পর মেদিনীপুরের বহু ব্যক্তিত্ব সবরকম সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু এখানে একটি বিষয় সংকোচের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে, মন্দিরময় পাথরা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে তাঁকে বহু ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়েছে। অভাবের তাড়নায় ইয়াসিন বেশিদূর পড়াশোনা করতে না পারলেও ভাই ও ছেলেমেয়েদের যথাসাধ্য শিক্ষিত করেছেন। দুর্ভাগ্য তাদের বেকারত্ব আজও ঘোচেনি।
সবাই ভাষণ দেন “সাম্প্রদায়িক ঐক্য” রক্ষার। খুবই অনুতাপের বিষয়, বাস্তবে যাঁরা (যেমন আমি) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের মেল বন্ধনের জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করছেন, তাদের পরিবার যাতে একটু ভদ্রভাবে বেঁচে থাকতে পারেন- সে বিষয়ে উদ্যোগ থাকবে না কেন?
পাথরা বিষয়ে তাঁর রচিত গ্রন্থ “মন্দিরময় পাথরার ইতিবৃত্ত”। পাথরার অজানা-অজ্ঞাত অতীত ইতিহাস নিয়ে রচিত তাঁর এই গবেষণা গ্রন্থ ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৩রা মার্চ উদ্বোধন করেন মাননীয় বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরী মহাশয়। তারপর এই গ্রন্থের দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাশয় ২০০৩ খিষ্টাব্দের ২৭শে নভেম্বর।
তাঁর গ্রামের পাশের গ্রাম “মন্দিরময় পাথরা”। ঝাবার সঙ্গে কাজে পাথরা যাওয়া-আসার পথে মন্দিরগুলো দেখতেন। এতগুলো মন্দির, অট্টালিকা কে বা কারা, কোন সময়ে, কেন করেছেন, এই ভাবনা মাঝে মধ্যে তাঁর মনে উদয় হত। বড় হলে আরো কৌতুহল বৃদ্ধি পায়। নিজের সম্পাদিত “গ্রামবার্তা” পত্রিকায় লিখতে শুরু করলেন মন্দিরময় পাথরার অজানা-অজ্ঞাত কিছু তথ্য। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পুরাতত্ত্ব গবেষক তারাপদ সাঁতরা, পরে পুরাতত্ত্ব গবেষক প্রণব রায় মহাশয়ের সান্নিধ্যে এসে দারুণভাবে উৎসাহিত হয়ে এই কাজে মন-প্রাণ ঢেলে দিলেন। তারপরের ইতিহাস তো সবারই জানা।
(১) ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য মাস। এই মাসে “মন্দিরময় পাথরা”র প্রাচীন মন্দিরগুলি রক্ষার জন্য “পাথরা পুরাতত্ত্ব কমিটি” প্রতিষ্ঠা হয়।
(২) ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই ডিসেম্বর স্মরণীয় দিন। “মন্দিরময় পাথরা”র প্রাচীন মন্দিরগুলিকে রক্ষার জন্য জেলা শাসক সহ প্রচার মাধ্যমগুলিকে পাথরায় আনতে সক্ষম হন।
(৩) ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা মার্চ তাঁর গবেষণা গ্রন্থ “মন্দিরময় পাথরার ইতিবৃত্ত” (১ম সংস্করণ) প্রকাশ হল। উদ্বোধন করলেন শ্রদ্ধেয় বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরী মহাশয়।
(৪) ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই আগস্ট তাঁর জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের জন্য মাননীয় রাষ্ট্রপতি ড. শঙ্করদয়াল শর্মা মহাশয়ের হাত থেকে সর্বভারতীয় “কবীর” পুরস্কার গ্রহণের করেছিলেন। তিঁনি গর্বিত এই কারণে যে, “কবীর” পুরস্কার পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র তিনিই পেয়েছেন।
(৫) ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরময় পাথরার মন্দিরগুলো রক্ষার অবদানের জন্য ইংরেজি তথ্যচিত্র "ROMANCING THE STONE" এবং তাঁর নিজের চরিত্রে অভিনয় অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা।
(৬) ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে পাথরার মন্দিরগুলো এবং তাঁর জীবনী অবলম্বনে ভারত সরকারের “ফিল্ম-ডিভিসন” নির্মিত বাংলা টেলিফিল্ম “কাণ্ডারী” তৈরী হয়।
(৭) ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে নভেম্বর তাঁর গবেষণা গ্রন্থ “মন্দিরময় পাথরার ইতিবৃত্ত” ২য় পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ হল। উদ্বোধন করলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাশয়।
(৮) ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই জুলাই তারিখে ভারত সরকারের “আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া” মন্দিরময় পাথরায় অবস্থিত ৩৪টি প্রাচীন মন্দিরের মধ্যে ২৮টি মন্দির এবং তৎসংলগ্ন ২০ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করলেন।
পারিবারিক ক্ষেত্রে আমার মা, স্ত্রী, ভাই এবং ছেলেমেয়েদের সহযোগিতা অবশ্যই ছিল বা এখনো আছে। কিন্তু এদের অন্ন যোগানোর একমাত্র যন্ত্র আমি নিজেই। “যন্ত্র”কে সবসময় “মন্দিরময় পাথরা”র জন্য নিয়োজিত রেখে মা, স্ত্রী, ভাই ও ছেলেমেয়েদের বেঁচে থাকাতে অজস্র বাধা সৃষ্টি করেছি। এখনও সেই অবস্থাই বিদ্যমান। দারিদ্র নিত্যসঙ্গী। তবে আমি দুঃখ করি না। বড় কাজে কাউকে না কাউকে ত্যাগ তো করতেই হয়।