130th Birthday Celebration of Shaheed Khudiram Bose
অরিন্দম ভৌমিক।
২০১৬ সালে বলিউডে ক্ষুদিরামের ওপরে তৈরি হচ্ছিল একটি হিন্দি বায়োপিক। সিনেমাটির লেখকের অনুরোধে ক্ষুদিরাম সম্পর্কিত কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে অনুভব করেছিলাম যে, কোনও বইতেই তাঁর সম্পর্কে সমস্ত তথ্য নেই এবং যা আছে তার মধ্যেও অনেক তথ্য বিভ্রান্তিকর। সেই চিন্তা থেকেই শুরু করেছিলাম শহীদ ক্ষুদিরামের জীবনীমূলক পুস্তক "কে ক্ষুদিরাম"।
ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল ক্ষুদিরামের স্মৃতিবিজড়িত মুজাফ্ফরপুর যাওয়ার। বই লিখতে গিয়ে জেনেছিলাম সরকারি ভাবে মুজাফ্ফরপুর জেল থেকে অমৃতবাবুকে চিঠিতে ক্ষুদিরামের শেষ চারটি ইচ্ছার কথা জানানো হয়েছিল। একটি ইচ্ছা পূর্ণ হলেও বাকি তিনটি ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়। জানিনা, মৃত্যুর পরেও মানুষের ইচ্ছা পূরণ করা যায় কিনা। তবুও ক্ষুদিরামের বাকি ইচ্ছাগুলি পূরণের জন্য ক্ষুদিরামের ১১১তম আত্মবলিদান দিবসে পৌঁছে গিয়েছিলাম মুজাফ্ফরপুর।
শহীদ ক্ষুদিরামের প্রতি বিহার তথা মুজাফ্ফরপুরবাসীর ভালোবাসা আমাকে বিস্মিত করেছিল। কোনদিন স্বপ্নেও কল্পনা করিনি একটি অন্য রাজ্যে তাঁকে এত সম্মান জানানো হয়। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বাংলার কোন শহীদকে ভারতের অন্য কোথাও প্রান্তে এইভাবে সম্মান জানানো হয় কিনা আমার জানা নাই। ক্ষুদিরামের প্রতি মুজাফ্ফরপুরবাসীর আবেগ দেখে যেমন গর্বিত হয়েছিলাম, তেমনই মনে মনে খুবই লজ্জা পেয়েছিলাম। কারন আমাদের রাজ্যে বা ক্ষুদিরামের নিজের জেলা মেদিনীপুরে এই ধরণের উদ্যোগ কখনোই চোখে পড়েনি।
মনে মনে ঠিক করেছিলাম, মেদিনীপুর ফিরে গিয়ে নিজের সাধ্য মত চেষ্টা করব। ঠিক করলাম মুজাফ্ফরপুর থেকে আনা শহীদ ক্ষুদিরামের চিতাভূমির মাটি ও বুধি-গণ্ডক নদীর জল দিয়ে বৃক্ষ রোপন অভিযান শুরু করব অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। শুরু হবে স্বাধীনতা দিবসে ক্ষুদিরামের স্মৃতি বিজড়িত জায়গাগুলিতে বৃক্ষ রোপনের মাধ্যমে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসে সেই মাটি ও জল দিয়ে কলিজিয়েট স্কুলে বৃক্ষরোপণ করলেন শ্রী অলোক রাজোরিয়া (এস.পি) ও শ্রী দীননারায়ণ ঘোষ (এস.ডি.ও) মহাশয়। হবিবপুরে জন্মভিটায় বৃক্ষরোপণ করলেন সেখানকার সদস্যরা।
এরপর ব্যাস্ত হয়ে যাই "কে ক্ষুদিরাম" বইটির কাজে। নভেম্বর মাসের শুরুতেই শেষ হয়ে যায় বইটির কাজ। ওদিকে এগিয়ে আসছে ক্ষুদিরামের জন্মদিন। জন্মদিনের প্রস্তুতির জন্য প্রথমেই কথা বলি হবিবপুরে তাঁর জন্মভিটায় 'ক্ষুদিরাম ব্যায়ামাগার' কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। জন্মদিনে ক্ষুদিরামের পুজোর জন্য জানাই সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দিরে। নিদৃষ্ট দিনে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় শহীদ ক্ষুদিরামের আত্মীয়দের। কাছেই একটি ডেকোরেটারে মাইক, চেয়ার ইত্যাদির আগাম বায়না করে আসি। সুন্দর ভাবে সাজানো একটি মাটির হাঁড়িতে ১৩০ টি নলেন গুড়ের রসগোল্লার (১৩০ তম জন্মদিন) অর্ডার দেওয়া হয় দুলারী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। পায়েসটা বাড়িতে গিন্নিকেই বানাতে বলেছিলাম। 'মিও-আমোরে' কোম্পানিতে একটি সুন্দর কেকের অর্ডার দেওয়া হয়। ফ্লেক্স প্রিন্ট করতে দিলাম জন্মদিনের জন্য। জন্মদিনে তাঁর স্মৃতি বিজড়িত জায়গা গুলিতে বৃক্ষরোপন করার জন্য কিনলাম অমলতাস গাছের চারা।
দেখতে দেখতে হয়ে গেল ২ ডিসেম্বর। সকাল বেলায় তমলুক থেকে এলেন শ্রী ভাস্করব্রত পতি। তমলুকে লাগানোর জন্য তাঁর হাতে তুলে দিলাম অমলতাস চারা, শহীদ ক্ষুদিরামের চিতাভূমির মাটি, বুধি-গণ্ডক নদীর জল এবং 'কে ক্ষুদিরাম' বই। দুপুর বেলায় হাটগাছিয়া (দাসপুর) থেকে এলেন শ্রী গঙ্গাধর রায়, একই ভাবে তাঁর হাতেও তুলে দিলাম গাছ, মাটি, জল ও বই। বিকেল বেলায় কিনলাম ১৩০ টি মোমবাতি, ১৩০ টি বেলুন, ১৩০ টি ফুলের মালা, রঙিন কাগজ ইত্যাদি। হবিবপুরে জন্মভিটেতে গিয়ে ঝাঁট দিয়ে, জল ঢেলে পরিষ্কার করলাম। বৃক্ষরোপনের জন্য খুঁড়লাম গর্ত।
এমনিতে আমি দেরিতেই ঘুম থেকে উঠি কিন্তু ৩ তারিখ ঘুম ভেঙে গেল অ্যালার্ম বাজার আগেই। উঠে দেখলাম রিংকি (গিন্নি) পায়েস বানাচ্ছে। আমি দোকান থেকে সুসজ্জিত মিষ্টির হাঁড়ি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে রওনা দিলাম হবিবপুর। পৌঁছনোর পরেই দেখলাম চেয়ার ও মাইক পৌঁছে গেছে। আমি প্রথমেই মাইক ও সাউন্ড বাক্স লাগিয়ে চালিয়ে দিলাম - "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি"। জন্মদিন উপলক্ষে এই গানটির বিভিন্ন রেকর্ডিং সংগ্রহ করেছিলাম। সংগ্রহে শিল্পীদের কণ্ঠে ছাড়াও ছিল বাঁশি, কিবোর্ড, মাউথঅর্গানে বাজানো ঐ গানের সুর। এছাড়াও জন্মদিন উপলক্ষে শুক্লা মুখার্জীর কণ্ঠে রেকর্ডিং করেছিলাম ঘোষণা যা প্রত্যেকটি গানের পরে বাজছিল।
একটু পরেই পৌঁছে গেল সুব্রত দে, দুজনে মিলে শুরু করে দিলাম সাজানোর কাজ। ধীরে ধীরে পৌঁছতে লাগলেন আমন্ত্রিতরা, বয়স নব্বই পেরিয়ে গেলেও সবার আগে পৌঁছে গিয়েছিলেন কলিজিয়েট স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শ্রী হরিপদ মন্ডল। সকাল ৯ টা থেকে শুরু হল মাল্যদান, প্রথমেই মাল্যদান করল ক্ষুদিরাম ব্যায়ামাগারের কচিকাচারা, তারপর বয়সানুক্রমে বাকিরা। মাল্যদানের সঙ্গে চলতে থাকলো তাঁর জয়োধ্বনি এবং বন্দেমাতরম।
আমাদের সবার মাল্যদানের পরে বেদিতে আসেন শ্রী হরিপদ মন্ডল। ক্ষুদিরামকে নিয়ে তিনিও একসময় কাজ করেছেন। এই বয়সেও তিনি কারুর সাহায্য ছাড়াই মাল্যদান করলেন। মাস্টারমশাইয়ের পরেই মাল্যদান করেন ক্ষুদিরামের মাতৃসমা দিদি অপরূপা দেবীর নাতি শ্রী সুব্রত রায় (রাহুল) ও তাঁর স্ত্রী শ্রীমতি মমতা রায় (ভিমাচরণ রায়ের ছেলে ও বৌমা)। এরপর মাল্যদান করেন মহম্মদ ইয়াসিন পাঠান (কবীর জাতীয় পুরস্কার খ্যাত), শ্রী চিন্ময় দাস (আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক) ও অন্যান্য বিশিষ্টজনেরা।
সবার মাল্যদানের পরে দ্বিতীয় পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে উন্মোচন করা হয় "কে ক্ষুদিরাম" বইটির প্রচ্ছদ। লাল ফিতে কেটে পর্দা সরিয়ে শ্রী হরিপদ মন্ডল উদ্বোধন করলেন প্রচ্ছদটি। এরপর শ্রী সুব্রত রায় ক্ষুদিরামের জন্মভিটের কুন্ড থেকে "কে ক্ষুদিরাম" বইগুলি এনে সবার হাতে তুলে দেন এবং সবাই মিলে পুষ্পবৃষ্টি ও শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে বইটি উদ্বোধন করা হয়। সঙ্গে চলতে থাকে ক্ষুদিরামের জয়োধ্বনি।
তৃতীয় পর্যায়ে পুজো। উদ্বোধন করা বই, মিষ্টির হাঁড়ি ও পায়েস নিয়ে সবাই পৌঁছে যাই মায়ের কাছে। মন্দিরে হিমাদ্রি চট্টোপাধ্যায় বাবু আমাদের অপেক্ষাতেই ছিলেন। পুরোহিত মশাই পুজো দেন শহীদ ক্ষুদিরামের নামে। পুজোর শেষে সবাই মিলে একসঙ্গে গাওয়া হয় 'একবার বিদায় দে মা' গানটি। মন্দির থেকে ফিরে এসে পুজো করা পায়েস ও মিষ্টি দেওয়া হয় ক্ষুদিরামের মুখে।
চতুর্থ পর্যায়ে ছিল বৃক্ষরোপন। সবাই মিলে মুজাফ্ফরপুর থেকে আনা শহীদ ক্ষুদিরামের চিতাভূমির মাটি ও বুধি-গণ্ডক নদীর জল দিয়ে বৃক্ষ রোপন করা হয়। উপস্থিত প্রত্যেকেই অল্প করে জল ও মাটি দেন চারাগাছে।
হবিবপুরের এই অনুষ্ঠানের শেষে বিশ্বনাথ দিকপতি বাবুকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম শহরে অবস্থিত ক্ষুদিরামের অন্যান্য মূর্তিগুলিতে মাল্যদান করতে (মোট ৬ টি মূর্তি)। হবিবপুরের এই অনুষ্ঠান চলাকালীন তমলুক ও হাটগাছিয়াতেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্বোধন করা হয় "কে ক্ষুদিরাম" বই এবং চিতাভূমির মাটি ও বুধি-গণ্ডক নদীর জল দিয়ে রোপন করা হয় বৃক্ষ।